সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণ
বহুল আলোচিত সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণ হয়েছে। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটায় সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় জিএসএলভি-এফ০৯ স্যাটেলাইটির উৎক্ষেপণ করা হয়। এ উপলক্ষে পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান একটি ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ স্যাটেলাইটকে আঞ্চলিক সহযোগিতার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেছেন, এর মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল। আর মোদি সরকারকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এই স্যাটেলাইট দক্ষিণ এশিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে দেবে। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সহায়তা করবে। এটি উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং ভারত তাদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে স্থল, জল এবং আকাশপথ ছাড়িয়ে মহাশূন্য পর্যন্ত বিস্তৃত করল। খবর এনডিটিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও বাসসের। এনডিভির খবরে বলা হয়েছে, শুক্রবার বিকালে নির্ধারিত সময়েই অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে রকেটটির সফল উৎক্ষেপণ হয়। এ উপলক্ষে ইসরো আয়োজিত অনুষ্ঠানে সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে উপগ্রহটির সফল মহাকাশযাত্রার ভিডিও ক্লিপও প্রদর্শন করা হয়। প্রায় ৩ বছর সময় নিয়ে আইএসআরও নির্মিত উপগ্রহটির নিক্ষেপণ যন্ত্রসহ এর ওজন ২ হাজার ২৩০ কেজি। স্যাটেলাইট খরচ ২৩৫ কোটি রুপি,
উৎক্ষেপণসহ মোট খরচ হয়েছে ৪৫০ কোটি রুপি। পুরো ব্যয় বহন করছে ভারত। উপগ্রহটি আগামী ১২ বছর কর্মক্ষম থাকবে। এই কৃত্রিম উপগ্রহের ১২টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে একটি পাচ্ছে বাংলাদেশ। বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ গণমাধ্যমকে জানান, টেলিমেডিসিন, টেলিশিক্ষা, আন্তঃসরকার নেটওয়ার্ক, দুর্যোগ পরিস্থিতিতে জরুরি যোগাযোগ, টেলিভিশন ব্রডকাস্ট ও ডিটিএইচ টেলিভিশন সেবার সুবিধা পাওয়া যাবে এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই স্যাটেলাইট দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সদস্য দেশগুলোতে মজুদ প্রাকৃতিক সম্পদের সন্ধান করা যাবে। সম্ভবপর হবে সঠিক ভৌগোলিক ‘ম্যাপিং’। এ ছাড়া এই উপগ্রহের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সংশ্লিষ্ট দেশগুলো- যোগাযোগ, দুর্যোগকালীন সহযোগিতা, দেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ম্যাপিং, টেলিমেডিসিন, টেলিকমিউনিকেশন, টেলিএডুকেশন, তথ্য-প্রযুক্তিসহ এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের জনগণের যোগাযোগ এবং দুর্যোগকালীন তথ্য সরবরাহে ব্যবহৃত হবে। এই উপগ্রহটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দারিদ্র্য ও অশিক্ষা দূরীকরণসহ পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে এবং আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দিয়ে সহযোগিতা করবে। এজন্য উপগ্রহের সঙ্গে সংযুক্ত দেশগুলোর গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি করতে হবে, যার মাধ্যমে উপগ্রহটি থেকে ১২ কেইউ-ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডারের মাধ্যমে সরবরাহকৃত ডাটা গৃহীত হবে। এই উপগ্রহটির মাধ্যমে ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর আরও কাছাকাছি অবস্থানে চলে আসবে বলেই ইসরোর অভিমত। জানা গেছে, ভারত এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের উদ্যোগ নেয়ার পর ২০১৪ সালের সার্ক সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশকে এ উপগ্রহের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
পাকিস্তান ছাড়া সার্কের সব দেশই তাতে সাড়া দেয়। বাংলাদেশ নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা নিলেও সেই প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে না নিশ্চিত হওয়ার পর সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইটে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। স্যাটেলাইটটির নাম প্রথমে সার্ক স্যাটেলাইট ঠিক করা হলেও পাকিস্তান না আসায় পরে নাম বদল করা হয়। এটিকে জিওসিনক্রোনাস সেটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল-এফ০৯ সংক্ষেপে জিএসএলভি-এল০৯ নাম দেয়া হয়েছে। এটিকে সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইট বা দক্ষিণ এশিয়া স্যাটেলাইট হিসেবেও ডাকা হবে। ভারতীয় গণমাধ্যমে এটিকে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে উপহার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণ এশীয় নেতাদের ভিডিও কনফারেন্স : স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ উপলক্ষে পাকিস্তান বাদে সার্কভুক্ত সব দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান একটি ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অনুষ্ঠানে সূচনা ও সমাপনী বক্তৃতা দেন। সফল উৎক্ষেপণের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ স্যাটেলাইটকে আঞ্চলিক সহযোগিতার দৃষ্টান্ত বলেন। এই উদ্যোগে যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা ও আফগানিস্তানকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি। নরেন্দ্র মোদি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে আমরা একই পরিবারের সদস্য। এই উপমহাদেশের শান্তি, সমৃদ্ধি, প্রগতি ও সমগ্র মানবতার স্বার্থে আমরা এক হয়েছি। এর আগে এক টুইটে মোদি বলেন, দক্ষিণ এশিয়া স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণ একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এর মধ্য দিয়ে নবদিগন্ত উন্মোচিত হল। উৎক্ষেপণের দেয়া বক্তৃতায় নরেন্দ্র মোদি ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের (ইসরো) বিজ্ঞানীদের ধন্যবাদ জানান। বলেন, এই উৎক্ষেপণ এই বার্তাই দেয় যে, আকাশ কারও একার নয়।
এটি আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করে। দক্ষিণ এশিয়ার দৃশ্যপট বদলে দেবে- শেখ হাসিনা : গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অঞ্চলের জনগণের কল্যাণে দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ সম্পৃক্ততার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের জনগণের উন্নতি সহযোগিতার নানা ক্ষেত্রে দেশগুলোর সফলভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার ওপর নির্ভর করছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে এই অঞ্চলকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। যেখানে আমরা সুপ্রতিবেশীর মতোই বসবাস করে আমাদের জনগণের জন্য গঠনমূলক নীতির বাস্তবায়ন করতে পারি, যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ়করণে অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, এই উপগ্রহ উৎক্ষেপণ দক্ষিণ এশিয়ায় দেশগুলোর দৃশ্যপট বদলে দেবে। এটি উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং ভারত তাদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে স্থল, জল এবং আকাশপথ ছাড়িয়ে মহাশূন্য পর্যন্ত বিস্তৃত করল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি নিশ্চিত মহাশূন্যে এই সহযোগিতা আমাদের এই অঞ্চলের স্বার্থে আমাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উচ্চাকাক্সক্ষী পথে নিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইট এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এ সময় গণভবনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমসহ আমন্ত্রিত অতিথি এবং সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনা তার বক্তৃতার শুরুতেই সফল উপগ্রহ উৎক্ষেপণ এবং তার সাম্প্রতিক ভারত সফরে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও আতিথেয়তা প্রদর্শনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ভারত সরকার এবং সে দেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদিজি আমি আপনার সঙ্গে আবারও কথা বলার সুযোগ পেয়ে আনন্দিত। একই সঙ্গে আজকে এই প্ল্যাটফর্মটি আফগানিস্তান, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল এবং শ্রীলংকার আমার অন্যান্য সন্মানিত সহকর্মীদের সঙ্গে ভাগ করতে পেরেও আনন্দিত।’ তিনি বলেন, এই সুযোগে গত এপ্রিল মাসের ৭ থেকে ১০ তারিখ ভারত সফরকালে আমাকে এবং আমার সফরসঙ্গীদের উষ্ণ আতিথেয়তা প্রদর্শনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানে আমি আপনাকে ও ভারত সরকারকে দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইট সফলভাবে উৎক্ষেপণের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি খুবই আনন্দিত যে, মাত্র ক’দিন আগেই আমরা দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইটে সহযোগিতার বিষয়ে ‘অর্বিটাল ফ্রিকোয়েন্সি’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে আগামীতে পারস্পরিক সহযোগিতা আরও উত্তরোত্তর বৃদ্ধির আশা প্রকাশ করে সব দেশ ও জনগণের সুখ, সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন কামনা করেন। ভিডিও কনফারেন্সে আরও বক্তৃতা করেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আশরাফ গণি, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী থেসারিং তোবগে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল এবং শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা শ্রীসেনা। তিন বছর আগে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের (ইসরো) বিজ্ঞানীদের নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, এমন একটা উপগ্রহ তৈরি করতে যার দ্বারা দক্ষিণ এশিয়ায় সার্ক সদস্যভুক্ত দেশগুলো উপকৃত হতে পারবে। সেই থেকে এই উদ্যোগের শুরু। প্রাথমিকভাবে রাজি হয়েও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান এই প্রকল্প থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। কাজ শেষ হয়ে গেলে গত মাসের ৩০ এপ্রিল ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই উপগ্রহ সম্পর্কে বলেন, জিস্যাট-৯ আমাদের প্রতিবেশীদের জন্য এক অমূল্য উপহার হতে চলেছে। উন্নয়নের স্বার্থে এই উপগ্রহের অবদান হবে সুদূরপ্রসারী। ইসরোর সাফল্যের পাগড়িতে এই উপগ্রহ সেই অর্থে আরও এক উজ্জ্বল পালক। ইসরো চেয়ারম্যান এএস কিরণ কুমার জানান, গত ২৮ ঘণ্টার কাউন্টডাউনের পর অত্যন্ত সফলভাবে এই উপগ্রহ উৎক্ষেপণ হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্বার্থে এ এক দৃঢ় পদক্ষেপ। উৎক্ষেপণের আগেই ইসরোকে অভিনন্দন জানিয়ে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী রাজ্যবর্ধন সিং রাঠোর টুইট করে বলেন, এই উপগ্রহ সম্প্রীতি ও সহযোগিতার প্রতীক, ভারত যা সব সময় কামনা করে এসেছে।
No comments