উত্তরাঞ্চলের ৩ জেলায় বোরো ধানে চিটা
‘ওষুদ যা দিবার কওছে তাই তো দিচ্ছি। কিন্তুক কাজ হওছে না’—বললেন জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার নান্দাইলদীঘি পাথারে বোরো ধানচাষি আবদুল মান্নান। তিনি চার বিঘা জমিতে হাইব্রিড জাতের বোরো চাষ করেছেন। এর অর্ধেক জমিতে ধানের ছড়া পুষ্ট হচ্ছে না। পাতা শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। গত বুধবার জমিতে কথা হচ্ছিল আবদুল মান্নানের সঙ্গে। নান্দাইলদীঘি পাথারে বিঘার পর বিঘা জমিতে এই সমস্যা। ধানের চমৎকার ছড়া বের হলেও পুষ্ট হচ্ছে না, চিটা হয়ে যাচ্ছে। ধানগাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। কৃষি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজারদের পরামর্শে কৃষকেরা ওষুধ দিলেও বিশেষ কাজ হচ্ছে না। নান্দাইলের আকলিমা বেগমের সাড়ে তিন বিঘায়, আবদুস সালামের এক বিঘায়—এমন করে সবার জমিতে এই রোগ দেখা গেছে। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এর নাম ‘ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতামরা’ সংক্ষেপে ‘বিএলবি’। পাশাপাশি ব্লাস্ট রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে বগুড়া, জয়পুরহাট ও নওগাঁয়। সরেজমিনে এই তিন জেলায় দেখা গেছে, মাঠের পর মাঠের বোরো জমির ধান চিটা হয়ে গেছে। উত্তরাঞ্চলে ধান চাষের অন্যতম প্রধান উৎস এই তিন জেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এবার ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৭০৫ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ও স্থানীয় উচ্চ ফলনশীল জাতের বোরো চাষ হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বগুড়ার সোনাতলা, শিবগঞ্জ, দুপচাঁচিয়া; জয়পুরহাটের কালাই, ক্ষেতলাল এবং সদর উপজেলায় ব্লাস্ট ও বিএলবির প্রকোপ দেখা গেছে বেশি। নওগাঁয় প্রকোপ কম হলেও অতিবর্ষণে নিম্নাঞ্চলের জমি তলিয়ে গেছে। কৃষি বিভাগ তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেনি। জয়পুরহাটে বোরো চাষ হয়েছে ৭২ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে। জয়পুরহাটের চাষিরা বললেন, তিন ফসলি জমিতে আমন কাটার পর আলুর চাষ হয়। আলু উঠলে ফাল্গুনের শেষে বোরো রোপণ হয়। আলুর জমিতে বোরো চাষ করায় এই জেলায় ব্লাস্ট ও পাতামরা রোগের প্রকোপ বেশি। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে করণীয় সম্পর্কে সচেতন করতে মাইকিংসহ লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু রোগের প্রকোপ কমছে না।
কৃষকেরা বলছেন, বোরোতে এখানে বিঘাপ্রতি ন্যূনতম ২০ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ মণ পর্যন্ত ফলন হয়। এক বিঘায় খরচ পড়ে গড়ে আট হাজার টাকা। এর মধ্যে বীজ ৫০০ টাকা, চাষ ২০০ টাকা ও বপন ৫০০ টাকা, সার ও পানি ৪ হাজার ৫০০ টাকা, কাটা ২ হাজার টাকা ও মাড়াই ৩০০ টাকা। এর সঙ্গে জমি যদি পত্তন নিতে হয়, তার খরচ আছে। নিজের শ্রমের মজুরি আছে। এবার ধানের সরকার নির্ধারিত দাম প্রতি মণ ৯৬০ টাকা। সে অনুযায়ী ২০ মণের দাম আসে ১৯ হাজার ২০০ টাকা। খরচ বাদে হাতে থাকার কথা ১০-১১ হাজার টাকা। কিন্তু যেসব জমিতে রোগ দেখা দিয়েছে, তাতে বিঘায় পাঁচ মণ ধানও পাওয়া যাবে না। অনেকের পুরো জমির ফসলই নষ্ট হয়ে গেছে। আলুর ফলনে যে সুখ, স্বস্তি ছিল, তা বিনষ্ট করেছে বোরোর রোগবালাই। কালাইয়ের পুনট, নান্দাইল, সরাইল, বানিহারা, হাজিপাড়া; ক্ষেতলালের নিশ্চিন্তা, শিশি, শালবন, ক্ষেতলাল ও জয়পুরহাট সদরের বিলতুলসী, সোটাহার, কমরগ্রাম, বানিয়াপাড়ায় দেখা গেছে, বিঘার পর বিঘা খেতের ধানের পাতা শুকিয়ে গেছে কিংবা ধানের ছড়া অপুষ্ট ও ফ্যাকাশে সবুজ। নিশ্চিন্তার কৃষক আবু হেনা বলেছেন, ওষুধ দিয়ে কোনো ফল পাচ্ছেন না। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুধেন্দ্র নাথ রায় বলেন, জেলার পাঁচ উপজেলাতেই ব্লাস্ট ও পাতামরা রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। তবে তা খুব আশঙ্কাজনক নয়। তাঁরা রোগ নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট রয়েছেন। ব্লক সুপারভাইজাররা নিয়মিত কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, প্রচারপত্র বিতরণ করেছেন। বগুড়ায় ৮০ শতাংশ পাকলেই ধান কাটার জন্য মাইকিং বগুড়ায় বোরো চাষ হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৬৫০ হেক্টরে। ব্লাস্ট ও পাতামরা রোগের প্রকোপ দেখা দেওয়ায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাইকিং করে ৮০ শতাংশ ধান পাকলেই খেত থেকে কেটে নিতে বলেছে। শতভাগ পাকার অপেক্ষা না করতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সোনাতলার জোড়গাছা ইউনিয়নের দীঘলকান্দি গ্রামের কৃষক নুরুল ইসলাম বলেন, ১২ বিঘায় বোরো চাষ করেছেন। বিআর-২৮ জাতের তিন বিঘার ধান কেটেছেন। ‘ব্লাস্ট’ রোগে প্রায় সব ধান চিটা হয়ে গেছে। তিন বিঘায় ফলন পেয়েছেন মাত্র তিন মণ। দীঘলকান্দির শাজাহান আলীর ফসল নষ্ট হয়েছে সাত বিঘার। হাট করমজা গ্রামের কৃষক বাবু মিয়ার তিন বিঘা খেত ব্লাস্ট আক্রান্ত। সোনাতলার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সালাহ্ উদ্দিন সরদার বলেন, উপজেলায় ১০ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ২০ হেক্টর জমির ধান ব্লাস্টে আক্রান্ত হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মাইকিং, উঠান বৈঠক ও লিফলেট বিতরণ করে কৃষকদের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। শিবগঞ্জের কিচক ইউনিয়নের সাতআনী মাঠে বোরো খেতে ‘ব্লাস্ট’ ছড়িয়ে পড়েছে। দুপচাঁচিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে পাতামরা রোগ।
দুপচাঁচিয়ার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল হোসেন বলেন, উপজেলায় ১৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ১০০ হেক্টরে পাতামরা রোগ দেখা দিয়েছে। ধান কাটার জন্য মাইকিং করা ছাড়াও আক্রান্ত খেতে আটকে থাকা পানি দ্রুত অপসারণ এবং পটাশ সার স্প্রে করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক প্রতুল চন্দ্র সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ২৭ হেক্টর জমির ব্লাস্ট রোগ দমন করা হয়েছে। ১২ শতাংশ ধান ইতিমধ্যে কাটা হয়েছে। নওগাঁয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় নওগাঁয় বোরো চাষ হয়েছে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সত্যব্রত সাহা বলেন, ৪৫৩ হেক্টর জমির ধান পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে গেছে। বিশেষ করে নিয়ামতপুর, মান্দা, আত্রাই ও সদর উপজেলার বিল এলাকার জমি অতিবর্ষণে ডুবে গেছে। এ ছাড়া ব্লাস্ট আক্রান্ত হয়েছে ১৬ হেক্টর। ফলে জেলায় বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ২৮ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। আগামী সপ্তাহ খানেকের মধ্যে মাঠে আর ধান থাকবে না। ক্ষতি জানা যাচ্ছে না ব্লাস্ট ও পাতামরা রোগে ক্ষতির পরিমাণ কত, এখনো তা জানা যাচ্ছে না। বগুড়া ও জয়পুরহাটে ব্লাস্ট ও পাতামরা রোগে আক্রান্ত জমি কত, সে বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চূড়ান্ত হিসাব করা হয়নি। বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত বগুড়া অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, উৎপাদন যদি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৫ শতাংশ কম হয়, তবে ক্ষতিগ্রস্ত বলা যাবে। কিন্তু তেমন ক্ষতি হবে না। অতিবৃষ্টির জন্য পাতামরা রোগের প্রকোপ বেড়েছে। বিশেষ করে হাইব্রিড জাতগুলো অনুমোদিত নয়। এ ধরনের জাত থেকেই এসব রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। তবে আগামী মৌসুমে যদি জাত পরিবর্তন না করে চাষাবাদ করা হয়, তবে বড় রকম ক্ষতি হতে পারে।
No comments