তলানিতে খাদ্য মজুদ!
সরকারি গুদামে এই মুহূর্তে আপদকালীন খাদ্য মজুদ প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। গত বছরের ৩০ এপ্রিল সরকারি গুদামে চাল-গমের মজুদ ছিল ১০ লাখ ২২ হাজার ৪০ টন। চলতি বছর একই দিন এই মজুদ নেমে চার লাখ ৭৭ হাজার ৯০ টনে এসেছে। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুঁকির বিশ্ব তালিকায় প্রথম সারিতে থাকা বাংলাদেশে কমপক্ষে ১০ লাখ টন খাদ্য মজুদ রাখা খুবই জরুরি বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। আর সেই মোতাবেক বিগত বছরগুলোতে মজুদের পরিমাণ ছিল কম-বেশি ১০ লাখ টন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আগামীতে বড় ধরনের কোনো দুর্যোগ দেখা দিলে খাদ্য পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। যদিও এটি মানতে নারাজ খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্তাব্যক্তিরা। তাদের দাবি, কোনো সমস্যা হবে না। ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিক্রি কর্মসূচিতে আপদকালীন মজুদ থেকে সাড়ে সাত লাখ টন চাল সরবরাহ করার কারণেই মূলত মজুদের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ওই কর্মসূচি নেয়ার আগে ছিল না তেমন কোনো প্রস্তুতি অথবা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। আর এ কারণেই মজুদ কমার সঙ্গে সঙ্গে সেটি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যাও খাদ্য মজুদ কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এমন দুর্যোগের বিষয়টি তাদের ধারণার মধ্যেই ছিল না। উল্লেখ্য, হাওর অঞ্চলে বিভিন্ন খাদ্যসহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে এ পর্যন্ত সাড়ে ১৮ হাজার টনের বেশি চাল আপদকালীন মজুদ থেকে বিতরণ করা হয়েছে। খাদ্য মজুদ কম থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি (১০ টাকা কেজি দরের চাল) আরও এক মাস চালু রাখার ঘোষণা দেয়া হলেও সেটি বন্ধ রাখা হয়েছে।
পাশাপাশি জোড়াতালি দিয়ে চলছে ওএমএস, ভিজিএফ এবং জিআরের মাধ্যমে সরকারের খাদ্যসহায়তা কার্যক্রম। আর দুর্বল মজুদ পরিস্থিতি টের পেয়েই এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। কারণ তারা জানেন দাম স্বাভাবিক রাখতে দেশব্যাপী ওএমএস কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয় সরকারের। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিদেশ থেকে ছয় লাখ টন চাল আমদানি করতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী বুধবার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে খাদ্য অধিদফতর। জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, সরকারি মজুদে কোনো ঘাটতি নেই। হাওর এলাকায় যথাযথ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। পাঁচ লাখ টন খাবার মজুদ থাকলে ঘাটতি হয় কী করে? শিগগিরই আরও ১৬ লাখ টন ধান-চাল ও গম সংগ্রহ করা হবে। এসব অপপ্রচারে কান না দেয়ারও পরামর্শ দেন মন্ত্রী। জানা গেছে, গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি গুদামে খাদ্য মজুদ রয়েছে চার লাখ ৭৭ হাজার ৯০ টন। এর মধ্যে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৮১ টন চাল এবং এক লাখ ৮৯ হাজার ৯০ টন গম। এরই মধ্যে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওর অঞ্চলের ছয় জেলায় তিন লাখ ৩০ হাজার পরিবারকে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় মাসে ৩০ কেজি করে বিনামূল্যে চাল ও ৫০০ টাকা অর্থসহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। এ প্রসঙ্গে গত ১৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া সাংবাদিকদের বলেছেন, ১০০ দিন পর্যন্ত এ সহায়তা দেয়া হবে। পাশাপাশি ওএমএস কর্মসূচি চলবে। এ ছাড়া ১০ টাকা কেজি দরের চালও অব্যাহত থাকবে। এ সহায়তা পরবর্তী ফসল না ওঠা পর্যন্ত চলবে। এ সময় মন্ত্রীর পাশে খাদ্য সচিবও উপস্থিত ছিলেন। অথচ হাওর অঞ্চলে গত ৩০ এপ্রিল থেকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণ কর্মসূচি বন্ধ রাখা হয়েছে। সেখানে শুধু ওএমএস, ভিজিএফ কর্মসূচি চালু রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ওএমএসের মাধ্যমে হাওর অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত ৩৮৩টি ইউনিয়নে এক টন করে চাল বিতরণের কথা বলা হলেও বাস্তবে ২৭৯টি ইউনিয়নে এ কর্মসূচি চলছে। ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও হাওর এলাকায় ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিতরণ কর্মসূচি কেন বন্ধÑ জানতে চাইলে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বদরুল হাসান বলেন, কর্মসূচি মে মাস পর্যন্ত চালু রাখার কথা বলা হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। হাওর এলাকায় ওএমএস ও ভিজিএফ কর্মসূচি চালু রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, সরকারি মজুদ ব্যবস্থা কখনোই এত নাজুক হয়নি। খাদ্য নিরাপত্তা মজুদ তলানিতে ঠেকেছে। মজুদ কম থাকায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি (১০ টাকা কেজি দরের চাল) মে মাস পর্যন্ত চালু রাখার কথা থাকলেও এপ্রিলেই তা বন্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি বোরো সংগ্রহ টার্গেট অনুযায়ী না হওয়ার আশঙ্কা করছে সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরাই। টার্গেট সফল করতে চাল আমদানির শুল্ক তুলে দেয়া হচ্ছে। যাতে বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ে এবং দাম কমে যায়। চালের মজুদ কম হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই গত বছর ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি কর্মসূচি চালু করে সরকার। এই কর্মসূচির আওতায় গত সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে সাড়ে চার লাখ টন চাল বিতরণ করা হয়। চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিল দুই মাসে তিন লাখ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে এই কর্মসূচিতে। আর এই সাড়ে সাত লাখ টন চাল আপদকালীন মজুদ থেকে সরবরাহ করা হয়েছে, যা বর্তমানে বিব্রতকর অবস্থায় এনে ফেলেছে সরকারকে। খাদ্য মজুদ ঝুঁকির বিষয়ে সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল যুগান্তরকে বলেন, বিপদের কথা চিন্তা করেই আপদকালীন মজুদ রাখা হয়। চালের সরকারি মজুদ তিন লাখের নিচে নেমে আসা কোনো ভালো খবর নয়। সরকারের উচিত যে কোনো মূল্যে চালের মজুদ ও বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানো। কারণ একদিকে সরকারি গুদামেও চাল নেই; অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন তাদের কাছেও চাল নেই। মজুদ যত কম হবে ততই দাম হু হু করে বাড়বে। ব্যবসায়ীরা যখন জানতে পারেন সরকারি মজুদ কম, তখন তারা ইচ্ছামত দাম বাড়াবেই।
আগাম বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা থাকে, তাহলে তো দাম ও মজুদ দুটোই বাড়াবে। কারণ তারা জানেন সরকারি মজুদ পর্যাপ্ত না থাকায় ইচ্ছা করলেই সরকার ওএমএস বা অন্য কোনো কর্মসূচি চালু করতে পারবে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গরিব ও সাধারণ মানুষ। চাল আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার কোনো মহলের কারসাজি কিনা জানতে চাইলে সাবেক এই খাদ্য সচিব বলেন, চাল আমদানি না করলে চালের দাম বাড়তেই থাকবে। আমদানিতে ১০ শতাংশ শুল্ক রাখা প্রয়োজন। সীমিত হারে শুল্ক দিয়ে চাল আমদানি করতে হবে। একেবারে তুলে দিলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চালের মজুদ পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলে হাওর অঞ্চলসহ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় আরও বেশি খাদ্যসহায়তা দিতে পারত সরকার। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী যুগান্তরকে বলেন, মিলারদের কাছে চালের কোনো মজুদ নেই। অন্যদিকে সরকারি মজুদও তলানিতে ঠেকেছে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, চাল আমদানির শুল্ক তুলে নেয়া হচ্ছে। আমরা শুল্ক তুলে নেয়ার বিপক্ষে হলেও মজুদ পরিস্থিতির কারণে রাজি হতে হয়েছে। খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. বদরুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, হাওর এলাকায় অকাল বন্যায় ক্ষতি হলেও বোরো সংগ্রহের টার্গেট ব্যাহত হবে না। দেশে যে খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি চলছে তাতে প্রতি মাসে চাল-গম খরচ হচ্ছে মাত্র ২৫ হাজার টন। এখনও যে মজুদ রয়েছে তাতে আরও সাত-আট মাস চলবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) থাকায় জিটুজি পদ্ধতিতে স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় চাল-গম আনা সম্ভব। ফলে বড় ধরনের দুর্যোগ হলেও তা মোকাবেলার সামর্থ্য সরকারের রয়েছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন নয় সরকার।
No comments