ডিবির সেই এসি আরও ভয়ঙ্কর
১৫ জুলাই ২০১৫। ওই দিন ভোরে ময়মনসিংহ থেকে এনা পরিবহনে ঢাকায় আসছিলেন নেত্রকোনার পূর্বধলার যুবলীগ নেতা আতিকুর রহমান খান উজ্জ্বল। সকাল ৮টার দিকে গাড়িটি উত্তরায় র্যাব-১ কার্যালয়ের সামনে আসতেই গতিরোধ করে ১০-১২ জন। উজ্জ্বলকে টেনেহিঁচড়ে গাড়ি থেকে নামানো হয়। চোখ বেঁধে তোলা হয় একটি মাইক্রোবাসে। অজ্ঞাত স্থানে রেখে টানা ২১ দিন তার ওপর চলে অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এ ঘটনায় উজ্জ্বলের পরিবার ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করে। প্রযুক্তিগত তদন্তে নেমে খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাই তখন হতবাক হয়েছিলেন। কারণ অপহরণের নাটের গুরু ৩১ বিসিএসের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) রুহুল আমীন সরকার। তিনি তখন র্যাব সদর দফতরে কর্মরত ছিলেন। ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) মঈনুল হক এ বিষয়ে রুহুল আমীনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি ঘটনার কথা অস্বীকার করেন। উজ্জ্বলের মা আসমিনা খাতুন ঢাকায় রুহুল আমীনের সঙ্গে দেখা করে অনেক অনুনয় করেও কোনো ফল পাননি। পরে এসপি মঈনুল হক বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। ঘটনার ২১ দিন পর (৬ আগস্ট) নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ এলাকা থেকে উদ্ধার হন উজ্জ্বল। ওই ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা ও উজ্জ্বলের পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে এবং যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে এসব তথ্য। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন এসপি ও বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলার এসপি মঈনুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘ভার্চুয়ালি (প্রকাশ্যে না হলেও কার্যত) আমরা বুঝতে পারছিলাম, রুহুল আমীনের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। কিছু বিষয় হয়তো বোঝা যাচ্ছিল, তবে প্রমাণ করার মতো অবস্থানে যেতে পারিনি। যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে না পারায়, ওই মামলাটি আমরা ইস্ট্যাবলিশড করতে পারিনি।’ নির্যাতনের শিকার যুবলীগ নেতা উজ্জ্বলের অভিযোগ, ২নং হোগলা ইউপি নির্বাচনে রুহুল আমীনের চাচা সাবেক চেয়ারম্যান ইসলাম উদ্দিন সরকারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। আর এ কারণেই তাকে গুম করতে অপহরণ করেন রুহুল আমীন। শুধু ওই ঘটনাই নয়, একের পর এক ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাময়িক বরখাস্ত হওয়া সহকারী কমিশনার (এসি) রুহুল আমীন সরকার। পূর্বধলা উপজেলার স্থানীয়দের অভিযোগ, যতই দিন যাচ্ছে, তিনি (রুহুল আমীন) যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছেন। গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলার মানুষের কাছে তিনি রীতিমতো আতঙ্কে পরিণত হয়েছেন।
এমনকি ছোটবেলার বন্ধুও তার হাত থেকে রেহাই পাননি। সর্বশেষ ১৮ এপ্রিল ডিবির টিম নিয়ে রুহুল আমীন রাজধানীর কাফরুলে একটি ক্লাবে ফিল্মি স্টাইলে হানা দেন এবং লুটপাট করেন। পরে পালিয়ে যাওয়ার সময় তিনিসহ টিম সদস্যরা মিলিটারি পুলিশের হাতে আটক হন। এ ঘটনায় রুহুল আমীনসহ ১১ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, এর আগেও (১৬ মার্চ) ওই ক্লাবে এসি রুহুল আমীনের নেতৃত্বে হানা দেয়ার ঘটনা ঘটেছিল। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, রুহুল আমীন একের পর এক ঘটনার জন্ম দিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। যুবলীগ নেতা উজ্জ্বল উদ্ধার হওয়ার পর পুলিশ অপহরণ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। উজ্জ্বল বলেন, ‘তৎকালীন এসপি (মঈনুল হক) আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, বিষয়টি নিয়ে আর না এগোতে। এ কারণে তখন আর এ নিয়ে কিছু করিনি।’ তবে এসপি মঈনুল হক বলেন, এ বিষয়ে আমি উজ্জ্বলকে এ ধরনের কোনো কথা বলিনি। যুবলীগ নেতা উজ্জ্বলকে অপহরণের পর বিষয়টি নিয়ে ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ প্রযুক্তিগত তদন্তের মাধ্যমে অপহরণের পুরো ঘটনাটি জেনে যায়। ওই তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তার ভাষ্য, প্রযুক্তিগত তদন্তে রুহুল আমীনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি জানা যায়। উজ্জ্বলকে অপহরণের পর ওই ঘটনা তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন ডিবির এসআই মফিজুল ইসলাম এ বিষয়ে উজ্জ্বলকে অনেক তথ্য দিয়েছেন। উজ্জ্বলের সঙ্গে ওই কর্মকর্তার মোবাইল ফোনের কথোপকথনের একটি রেকর্ড যুগান্তরের হাতে এসেছে। সেখানে ওই কর্মকর্তা উজ্জ্বলকে বলেছেন, ‘মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হয়েছিলাম রুহুল আমীন আপনার (উজ্জ্বল) অপহরণের সঙ্গে যুক্ত। এসপি মহোদয় (মঈনুল হক) পুলিশ সদর দফতরে রুহুল আমীনের বিরুদ্ধে একটি গোপন প্রতিবেদনও পাঠিয়েছেন। এসপি মহোদয় সব জানেন।’ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মফিজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর উজ্জ্বল উদ্ধার হয়েছেন। তিনি সব জানেন। আপনি তার কাছ থেকে জেনে নিন।’ তদন্তে রুহুল আমীনের সম্পৃক্ততা পাওয়ার পরও ওই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন কিভাবে হল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি বিষয়টা বোঝেন না, এটা কী বুঝিয়ে বলতে হবে। উজ্জ্বল এ ব্যাপারে মুখ খুলতে সাহস পাননি। তিনি আদালতে বলেননি কেন, কারা, কিভাবে তাকে অপহরণ করেছে। এ কারণে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।’ গোপন প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে মঈনুল হক যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের কোনো প্রতিবেদন পাঠাইনি। রুহুল আমীন জড়িত এমন নিশ্চিত প্রমাণ আমাদের কাছে ছিল না। তবে উজ্জ্বলকে অপহরণের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এসি রুহুল আমীন সরকার। বুধবার তিনি টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘উজ্জ্বলের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। তাকে আমি অপহরণ করতে যাব কেন? আমার চাচা (ইসলাম উদ্দিন) আওয়ামী লীগ করেন। তার সঙ্গে উজ্জ্বলের রাজনৈতিক বিরোধ থাকতে পারে। এ কারণে তিনি এ ধরনের অভিযোগ করছেন। তাছাড়া কাফরুলের ঘটনা নিয়ে আমি এখন বিপদে আছি। এ কারণে বিভিন্ন অভিযোগ করে আরও বিপদে ফেলার চেষ্টা করছেন তারা।’
২১ দিনের নির্মম নির্যাতন : ‘ভেবেছিলাম হয় তো আর বেঁচে ফিরতে পারব না। ছোট্ট একটি কক্ষে রাখা হয়েছিল আমাকে। সেখানে হাঁটাচলা করারও উপায় ছিল না। সামনে লোহার শিক ছিল। সেখানেই দেয়া হতো খাবার। কখনও কখনও নিয়ে যাওয়া হতো গোসলের জন্য। মাঝে মাঝে চোখ বেঁধে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নিয়ে যাওয়া হতো। ওই কক্ষে চেয়ারে বসিয়ে হাত বেঁধে চলত নির্মম নির্যাতন। তখন তারা বলত, ‘স্বীকার কর তুই অনেক হত্যা মামলার আসামি। তোকে ক্রসফায়ারে দেয়া হবে।’ কখনও কখনও বলত, ‘নির্বাচন করবি না, তোর নির্বাচনের খায়েশ মেটাচ্ছি। এই বলে শুরু হতো মারধর।’ তখন আপনজনের চেহারাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠত। এভাবে যুগান্তরের কাছে নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দেন যুবলীগ নেতা উজ্জ্বল। রোববার (৩০ এপ্রিল) পূর্বধলা উপজেলা কার্যালয়ের পাশে অবস্থিত একটি দোকানে বসে সেই ২১ দিন আটকের বিভিন্ন মর্মস্পর্শী মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘প্রায়ই শুনতাম ফিসফিস করে কেউ একজন কথা বলছে। ওই ব্যক্তিই বেশি মারধর করেছিল। রুহুল আমীন আমার পরিচিত হওয়ার কারণে তার কণ্ঠস্বর আমি চিনি। এ কারণেই হয়তো ফিসফিস করে কথা বলত। এক সময় বুঝতে পারি, নির্বাচন করতে চাওয়ার কারণে রুহুল আমীন আমাকে অপহরণ করেছে। গুম করতে চাইছে।’ কিভাবে মুক্তি পেলেন জানতে চাইলে তিনি (উজ্জ্বল) বলেন, ‘একদিন দু’জন এসে চোখ বেঁধে আমার দাড়ি কাটতে শুরু করে। আমি তখন ভেবেছিলাম হয় তো আমাকে ক্রসফায়ারে দেয়া হবে। তখন শুধু আল্লাহর নাম জপেছি। তারা চোখ ও হাত-পা বেঁধে আমাকে একটি গাড়িতে করে নিয়ে যায়। তারপর হাতের বাঁধন খুলে সোনারগাঁ এলাকায় ফেলে আসে। তখন আমি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিছুক্ষণ পর সোনারগাঁ থানা পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।’ উজ্জ্বলের মা আসমিনা খানম যুগান্তরকে বলেন, উজ্জ্বলকে অপহরণের বিষয়টি রুহুল আমীনের এক বন্ধুর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি। আমি রুহুল আমীনের বাসায় যাই। তখন রুহুল আমীন বলেন তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না। অনেক অনুনয় করলেও উজ্জ্বলকে অপহরণের কথা তিনি স্বীকার করেননি। বন্ধুকে চোখ বেঁধে আটক, দুই লাখ টাকা আদায় : অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছেলেবেলার বন্ধু ছিলেন রুহুল আমীন ও সাখাওয়াত হোসেন সোহাগ। রুহুল আমীন পুলিশে চাকরি করেন। আর সোহাগ এখন একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তার অফিস উত্তরায়। ৬ এপ্রিল পরিচিত এক ব্যক্তি এবং উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই খায়রুল ইসলামকে (সোহাগের পূর্ব পরিচিত) নিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় খাচ্ছিলেন সোহাগ। ওই সময় রুহুল আমীনের সঙ্গে কয়েকজন ওই রেস্তোরাঁয় ঢোকেন। তখন রুহুল আমীনের কাছে খায়রুল ইসলাম নিজের পরিচয় দেন। খায়রুলকে বাদ দিয়ে সোহাগ এবং তার পরিচিত ব্যক্তির চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়। পরে সোহাগের মোবাইল ফোন থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিপণ দাবি করেন রুহুল আমীন। পরে এক লাখ ৭৮ হাজার টাকা দিয়ে সোহাগ ও তার বন্ধু মুক্তি পান। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এসআই খায়রুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শুনেছি ‘সামারি’ (টাকা নিয়ে) করে সোহাগ ও তার সঙ্গে থাকা লোকটিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন রুহুল আমীন স্যার। এ নিয়ে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে সোহাগ যুগান্তরকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।’ তবে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি। এ বিষয়ে এসি রুহুল আমীন সরকার বলেন, ‘সোহাগ নামে আমি কাউকে চিনি না। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এলাকার কিছু লোক আমাকে বিপদে ফেলতে এ ধরনের অভিযোগ করছে।’ চাচার বিরোধিতা করায় মাদক মামলায় নিরীহ বজলুর : বজলুর রহমান ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। ২০১৫ সালের ৫ মে তিনি ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি পূর্বধলার কালিহর হাটখলায় যান। সন্ধ্যার পর তিনি এলাকার কয়েকজনের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এ সময় পুলিশ তাকেসহ ১০ জনকে থানায় নিয়ে যায়। পরে মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। এ বিষয়ে বজলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের কাছে কোনো ধরনের মাদক ছিল না। আমি তখনকার ওসি মুশফিকুর রহমানকে বললাম- স্যার, আপনি তো জানেন আমরা মাদক ব্যবসা তো দূরের কথা, মাদক সেবনও করি না। তখন তিনি একটি মোবাইল নম্বর দেখিয়ে বললেন, এ নম্বর থেকে ফোন এসেছে। উপরের চাপ আছে। যদি মামলা না দেই তবে আমার চাকরি নিয়ে সমস্যা হবে। ওই মোবাইল নম্বরটি ছিল রুহুল আমীনের। রুহুল আমীন আপনার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য পুলিশকে চাপ দিচ্ছে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০১০ সালের নির্বাচনে রুহুল আমীনের চাচা ইসলাম উদ্দিনের বিরোধিতা করেছিলাম। এ কারণে মাদক মামলায় আমাকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পূর্বধলার তৎকালীন ওসি মুসফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এটা তো অনেক আগের ঘটনা। আমার এ বিষয়টি মনে নেই। এসি রুহুল আমীন সরকার যুগান্তরকে বলেন, বিপদে পড়েছি। এখন আমার বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ আসবে। আপনি আমাকে দেখলে বলতে পারতেন, আমার পক্ষে এসব কাজ করা সম্ভব কিনা। এদিকে রুহুল আমীনের চাচা সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইসলাম উদ্দিন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
No comments