জঙ্গিদের অস্ত্রের উৎস ‘পাহাড়’
জঙ্গিদের
এখন অস্ত্র সংগ্রহের বড় উৎস দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। দেশের বাইরে
থেকে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যবসায়ীদের সংগ্রহ করা
অস্ত্র হাতবদল হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে জঙ্গিদের কাছে। পাহাড়ে তারা অস্ত্রের মজুদ
গড়ে তুলছে। এমনকি দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়
অস্ত্রের কারখানার সন্ধান মিলছে। এসব কারখানা থেকেও জঙ্গিরা অস্ত্র কিনছে।
দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ার কারণে জঙ্গিরা
এখন দুর্গম পাহাড়ি এলাকাকে নিরাপদ ভাবছে। সেখানে তারা আস্তানা গাড়ছে। এমন
তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের উচ্চপর্যায়ে
প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়, ভারত ও মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী
বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের
সহায়তায় পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় সময় অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র এবং বিস্ফোরকের
চালান প্রবেশ করে। সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রবণতা আরও বেড়েছে। এসব সংগঠনের
মাধ্যমে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো অস্ত্রের চালান আমদানি করে থাকতে
পারে। এছাড়া পার্বত্য অঞ্চলের গণ্ডি পেরিয়ে এসব অস্ত্র দেশের বিভিন্ন
অঞ্চলে প্রবেশ করছে। যা তারা নাশকতার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে বলে
আশংকা রয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
গোয়েন্দারা বলছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ইস্যুটি জঙ্গিরা
কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। এ কারণে তারা এখন চট্টগ্রাম ও পার্বত্য
চট্টগ্রাম অঞ্চলে আস্তানা গড়ে তুলছে। বিশেষ করে নব্য জেএমবি এ বিষয়ে খুবই
সক্রিয়।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরেরসরাই ও সীতাকুণ্ডে নব্য জেএমবির
আস্তানার সন্ধান মিলেছে। একটি আস্তানায় অভিযানের সময় শিশুসহ পাঁচ আত্মঘাতী
জঙ্গি নিহত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জঙ্গিরা পাহাড়মুখী হলেও আরও তিন
উপায়ে অস্ত্র সংগ্রহ
করছে। তারা আন্তঃদেশীয় অপরাধী চক্রের কাছ থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ
অব্যাহত রেখেছে। ভারতে অবস্থানকারী জঙ্গিদের সহায়তায় এগুলো সীমান্ত এলাকা
দিয়ে দেশে আসছে। কখনও কখনও বিদেশী জঙ্গিগোষ্ঠীর সহায়তা নেয়া হচ্ছে। এর
বাইরে পরিচয় গোপন করে দেশীয় অপরাধী চক্রের কাছ থেকে ছোট অস্ত্র কিনছে
জঙ্গিরা। এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায় যুগান্তরকে
বলেন,
জঙ্গি আস্তানার সন্ধানে আমরা কাজ করছি। এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান
চালানো হয়েছে। অস্ত্রের সন্ধানে একাধিক সংস্থার সমন্বয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই
কাজ করছি। বিভিন্ন সময় একে-২২সহ অনেক অস্ত্র উদ্ধারও করা হয়েছে। তিনি
বলেন, মিয়ানমার সীমান্ত এলাকাটি খুবই দুর্গম। সন্ত্রাসীরা এর সুযোগ নিয়ে
থাকে। তবে আমরা সতর্ক আছি। র্যাব ৭-এর অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ
যুগান্তরকে বলেন,
বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যেন অস্ত্র দেশে নিয়ে আসতে না পারে সেজন্য সব সময়
সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। বাড়ানো হচ্ছে নজরদারি। এ বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি
বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ারুল আজিম
যুগান্তরকে বলেন, ‘এ জাতীয় খবর আমরাও পাই। তবে সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে
আমরা সতর্ক আছি। আমাদের সোর্সের মাধ্যমে এসব বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি।’
আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন
এলাকায় জঙ্গিদের কাছ থেকে একে-২২ ও এমকে-১১ মডেলের শক্তিশালী আগ্নেয়াস্ত্র
উদ্ধার করা হয়েছে।
কয়েক বছরে গ্রেনেড তৈরির প্রধান উপকরণ ডেটোনেটর, সাইকেল
বোমা, টেনিস বল বোমা এবং সুইসাইডাল ভেস্ট উদ্ধার করা হয়েছে। এমনকি নিজস্ব
তৈরি ড্রোন এবং হাতে তৈরি আগ্নেয়াস্ত্রও উদ্ধার করা হয়। গত ১০ বছরে দেশের
বিভিন্ন এলাকা থেকে সহস্রাধিক গ্রেনেড এবং শতাধিক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন
আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামে শহীদ
হামজা বিগ্রেডের জঙ্গিদের কাছ থেকে
একে-২২ উদ্ধার করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর এমকে-১১ রাইফেল এবং ২৫০
রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয় জেএমবির জঙ্গিদের কাছ থেকে। চট্টগ্রাম থেকে
উদ্ধারের পর জঙ্গিরা জানিয়েছিল এসব অস্ত্র তারা পাহাড়ি বিভিন্ন
বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এবং অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ক্রয় করে।
মিয়ানমারের পাঁচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মাধ্যমে আসছে অস্ত্র : মিয়ানমারে পাঁচ
বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে অস্ত্র। বান্দরবান,
রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকা অরক্ষিত হওয়ার কারণে এসব অস্ত্র খুব
সহজেই দেশে আসছে। বিশেষ করে পাহাড়ে সক্রিয় ইউপিডিএফ এবং জনসংহতি সমিতির
বিদ্রোহীদের মাধ্যমে অস্ত্র দেশে আসছে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে,
দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে এসব এলাকা অনেকটাই অরক্ষিত। এ সুযোগে
বিচ্ছিন্নতবাদী সংগঠন এবং অস্ত্র ব্যবসায়ীরা অস্ত্র ও বিস্ফোরক দেশে নিয়ে
আসছে। মিয়ানমারের যে পাঁচ বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং জঙ্গি সংগঠনের মাধ্যমে দেশে
অস্ত্র ও বিস্ফোরক আসছে এগুলো হল- আরাকান আর্মি (এএ), আরাকান লিবারেশন
পার্টি (এএলপি), ন্যাশনাল ইউনাইটেড পার্টি অব আরাকান (এনইউপিএ), পার্টি অব
আরাকান (পিএ), আরাকান রোহিঙ্গা ইসলামী ফ্রন্ট এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি অব
আরাকান। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বরে
মিয়ানমারের
কারেন্ট প্রদেশে ১৬টি একে-৪৭ রাইফেলসহ আরাকান লিবারেশন পার্টির (এএলপি)
অর্থ সম্পাদক ধরা পড়ে। এ অস্ত্রগুলো বাংলাদেশে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী
সংগঠনের কাছে আসার কথা ছিল। পাহাড়ে মিলছে অস্ত্রের কারখানা : আইনশৃংখলা
রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা
গেছে, কক্সবাজারের মহেশখালীতে অন্তত ৩০টি অস্ত্রের কারখানা রয়েছে।
জানুয়ারিতে সেখানে অভিযান চালিয়ে আবদুল মাবুদ ও আবুতাহেরকে গ্রেফতার করা
হয়। র্যাব জানায়, মহেশখালীর দুর্গম এলাকাতে অনেকগুলো অস্ত্রের কারখানা
রয়েছে। সেখানে তিন হাজার টাকাতেও মিলছে অস্ত্র। এ বিষয়ে র্যাব ৭-এর
অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে
বলেন, জানুয়ারিতে মহেশখালীতে কয়েকটি অস্ত্রের কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। এ
ধরনের অস্ত্রের কারখানা এখানে অনেক আগে থেকেই ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এ
এলাকায় আরও অস্ত্রের কারখানা থাকতে পারে। আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা ও গ্রেনেড
তৈরিতে সক্ষমতা বাড়ছে দেশীয় জঙ্গিদের :
আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা তৈরিতে সক্ষমতা বাড়ছে জঙ্গিদের। এভাবে দেশের বাইরে
থেকে আসা বিস্ফোরক দিয়ে তারা নিজেরাই শক্তিশালী বোমা ও গ্রেনেড তৈরি করছে।
গুলশান হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডগুলো দেশীয় জঙ্গিরা তৈরি করেছিল। নব্য
জেএমবির অস্ত্র ও বোমা বিশেষজ্ঞ জঙ্গি সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা
মাহফুজ এগুলো তৈরি করে হামলাকারীদের সরবরাহ করে। গুলশান হামলার কয়েকদিন পর
গাবতলী থেকে ৮৭৮টি ডেটোনেটরসহ নব্য জেএমবির চার জঙ্গিকে গ্রেফতার করে
পুলিশের জঙ্গি দমন ইউনিট। সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়,
একটি
ডেটোনেটর দিয়ে শক্তিশালী গ্রেনেড বানানো সম্ভব। এদিকে ২০১৫ সালের ২৩
অক্টোবর হোসনী দালানে বোমা হামলায় ব্যবহৃত
গ্রেনেডগুলো জঙ্গিরা নিজেরাই তৈরি করেছিল। এ গ্রেনেডগুলো দেশীয় প্রযুক্তিতে
তৈরি। ওই ঘটনার পর ২০১৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর ১৫ ঘণ্টার সাঁড়াশি অভিযানে
রাজধানীতে ১৬টি গ্রেনেড, দুটি হাতবোমা, সুইসাইডাল ভেস্ট, পাইপ বোমা এবং
অন্তত ২০০টি গ্রেনেড তৈরির উপকরণ উদ্ধার করে পুলিশ। সম্প্রতি গাজীপুরে
প্রিজন ভ্যানে হামলাকারী জঙ্গির কাছ থেকে মোবাইলের মতো
দেখতে একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। এটি দেশীয় জঙ্গিরা ব্যবহার করে
থাকে। এর আগে ২০১৫ সালে বাড্ডায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) কাছ থেকে এ
ধরনের একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছিল পুলিশ। গাজীপুর থেকে হাতে তৈরি
আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের পর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ
সুপার মোহাম্মদ সুলাইমান যুগান্তরকে বলেন, এটি দেখতে মোবাইলের মতো হওয়ায়
বহনে অনেক সুবিধা। এছাড়া খুব কাছ থেকে সুইচ টিপে গুলি করা যায়। জঙ্গিদের
অস্ত্র ও বোমা তৈরির বিষয়ে একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান,
কয়েকজন দুর্ধর্ষ জঙ্গি দেশের বাইরে থেকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে
অন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। নব্য জেএমবির এ ধরনের তিন দুর্ধর্ষ জঙ্গি এখনও
ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরা হল- সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদিসুর
রহমান সাগর এবং মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান। তারা সবাই বোমা বিশেষজ্ঞ।
নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহের মূল কারিগর তারাই। এমনকি
পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনের অনেক বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে এসে অস্ত্র ও বোমা তৈরির
প্রশিক্ষণ দিয়েছে। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল
ক্রাইম ইউনিটের সহকারী কমিশনার আহমেদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নব্য
জেএমবির তিন দুর্ধর্ষ জঙ্গিকে গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে।
No comments