ভারতের উন্নয়ন পথ ও বৈপরীত্য by আনু মুহাম্মদ
শিগগিরই
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ দ্বিতীয় দফা ঋণচুক্তি করতে যাচ্ছে। প্রথম ঋণচুক্তির
তুলনায় আরও কঠিন শর্তে গ্রহণ করা হচ্ছে এই ঋণ। এই পর্বে ঋণের পরিমাণ ২০০
কোটি ডলার। উল্লেখ্য, এর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা বাংলাদেশের প্রবাসী
শ্রমিকেরা প্রতি দেড় মাসে দেশে পাঠান। এই ঋণের টাকায় ভারত থেকে ৫০০ ট্রাক ও
৫০০ বাস কেনা, ট্রানজিট রুটে অবকাঠামো উন্নয়নসহ ১৩টি প্রকল্প বাস্তবায়িত
হবে। এই চুক্তির আওতায় বিভিন্ন নির্মাণ ও পণ্য ক্রয়ের শতকরা ৬৫ ভাগ কিনতে
হবে ভারত থেকে। বিভিন্ন প্রকল্প পরামর্শকদের শতকরা ৭৫ ভাগ আসবেন ভারত থেকে।
প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ভারতীয় ব্যক্তিদের কর ও ভ্যাট শোধ করবে বাংলাদেশ।
(প্রথম আলো, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৬) বস্তুত বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণে
ভারতের ট্রানজিট রুট এখন সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশের অন্য মহাসড়ক ও
সড়কগুলোর দুর্দশা অব্যাহত আছে।
বলা বাহুল্য, ঋণচুক্তির এই মডেল বহু পুরোনো। ‘বিদেশি সাহায্য’ নামে এই ধরনের ঋণ দিয়েই বিশ্বের পশ্চিমা দেশগুলো প্রান্তিক দেশগুলোতে নিজেদের পণ্যবাজার তৈরি করেছে, নাগরিকদের কর্মসংস্থান করেছে, বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর বিনিয়োগের পথ তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির মতো সংস্থাগুলো এই ঋণের ফাঁদে ফেলেই বহুজাতিক পুঁজির পথ প্রশস্ত করেছে। ভারতের বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী সে রকম পরাশক্তির ভাব নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে এখন। চীন, যুক্তরাষ্ট্র কখনো প্রতিদ্বন্দ্বী, কখনো একই পথে ঐক্যবদ্ধ। সম্প্রতি নেপাল বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের শক্তি প্রদর্শনের নমুনা দেখেছে, তাকে মোকাবিলাও করেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি-রাজনীতির গতিমুখ নির্ধারণে ভারতের ভূমিকা, রাজনীতি এবং অর্থনীতির গতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্ধারক। কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও হয়ে থাকলেও বাংলাদেশে ভারতের পণ্য আমদানি, নিয়োগ ও বিনিয়োগ বাড়ছে। বাংলাদেশ এখন ভারতের প্রবাসী–আয়ের অন্যতম উৎস। ট্রানজিটের মধ্য দিয়ে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগোলিক–অর্থনৈতিক মানচিত্র পরিবর্তিত হওয়ার পথে।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটার পর জাতীয়তাবাদী উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ভারত যাত্রা শুরু করে। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলো সেই কাঠামোতেই গ্রহণ করা হয়। জাতীয় শিল্পের ভিত্তি নির্মাণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে জাতীয় প্রতিষ্ঠান ও দক্ষ জনশক্তির বিকাশ, বিভিন্ন রাজ্যে এবং কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ, শিক্ষা-চিকিৎসা সুবিধা সম্প্রসারণ এবং ভূমি সংস্কারের বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার মধ্য দিয়ে সত্তরের দশকের মধ্যে ভারত একটি টেকসই শিল্প ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়। এর ওপর দাঁড়িয়েই বিকশিত হয় বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী।
ভারতের অর্থনৈতিক নীতি স্তরে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে নব্বই দশকের শুরুতে মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে। তখন সর্বজনের সম্পদ বৃহৎ ব্যক্তিগোষ্ঠী মালিকানায় স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই পুঁজিমুখী বা ‘নয়া উদারতাবাদী’ সংস্কারের মধ্য দিয়ে অর্থনীতির ওপর বৃহৎ বেসরকারি শিল্প ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর আধিপত্য সম্প্রসারিত হয়েছে। তারপরও নবরত্ন বলে পরিচিত নয়টি বড় বড় ক্ষেত্র (তেল, গ্যাস, এনার্জিসহ আরও অন্যান্য খাত) রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায়, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পরিচালিত হতে থাকে। এখন পর্যন্ত মাইনিং কিংবা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলনের ব্যাপারে ভারতীয় সংস্থা রাষ্ট্রীয়ভাবে ৮০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে। বিদ্যুৎ খাতের বড় অংশও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে।
আশির দশক থেকে বাংলাদেশ যেভাবে নির্বিচার আমদানি বৃদ্ধি করেছে, যেভাবে জাতীয় সম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার পথ নিয়েছে, ভারত সে রকম উৎসাহ কখনোই দেখায়নি। বরং বাংলাদেশের নির্বিচার আমদানি ও বিদেশি কোম্পানি–নির্ভরতার পথ ভারতের এসব শিল্পগোষ্ঠীর জন্য সুবিধাজনক হয়েছে। এখন এসব সংস্থা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করছে, সমুদ্রে তেল, গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে কাজ করছে। মোদি সরকারের আমলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর টাটা, রিলায়েন্স, আদানিসহ বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর অংশীদারত্ব বৃদ্ধির চেষ্টা বেড়েছে। ভারতে নতুনভাবে বিন্যস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত খাত, বেসরকারি খাত, যৌথ বিনিয়োগ, একক বিদেশি বিনিয়োগ—সব মিলিয়ে ভারতে দেশি বৃহৎ পুঁজি, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পুঁজি ও বহুজাতিক পুঁজির যে মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে, তার সংবর্ধন, পুঞ্জিভবন ও সম্প্রসারণের অনেক বেশি চাপ এখন। এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে দেশের ভেতরে ও বাইরে ভারতের সামরিক ব্যয় ও তৎপরতাও বাড়ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বড় অংশীদার।
তবে এই উন্নয়নধারার ভেতরেই আছে বৈপরীত্যের চাপ, আছে একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধি ও বঞ্চনা বৃদ্ধির উপাদান। তাই ভারত প্রসঙ্গে অরুন্ধতী রায় ২০০১ থেকে শুরু করে এই শতকের প্রথম দশকের প্রবণতা সারসংক্ষেপ করেছেন এই বলে যে এই দশক ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আবার বিশ্বসভায় অর্থনৈতিক ও পারমাণবিক শক্তি হিসেবে ভারতের আবির্ভাবকাল। এই বছরগুলো কারও কারও জন্য অভাবনীয় সম্পদ ও সমৃদ্ধি এনেছে, অন্যদের জন্য তা এমন দুস্থতা, অনাহার, এমন হতাশা এনেছে যে তাদের জীবনকে আর মনুষ্যজীবন বলা যায় না। গুজরাটের মুসলমানদের জন্য তা এনেছে গণহত্যা। ভারতের মুসলমানদের জন্য তা হিন্দু ফ্যাসিবাদের ভূত। লক্ষাধিক কৃষকের জন্য তা এনেছে আত্মহত্যা। করপোরেশনগুলোর জন্য এই সময় দিয়েছে বিপুল মুনাফা। দান্তেওয়াদার আদিবাসীর জন্য এই বছরগুলো এনেছে বলপ্রয়োগে উচ্ছেদ এবং সরকারি নিষ্ঠুর গৃহযুদ্ধ। কাশ্মীর, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের মানুষের জন্য তা এনেছে ‘স্বাভাবিকতা’র নামে অবিরাম সামরিক দখলদারি।’ (দ্য শেইপ অব দ্য বিস্ট, ২০০৮)
উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের বিশাল অঙ্ক বেকারত্বের কোনো সুরাহা দেখাতে সক্ষম হয়নি। অরুন্ধতী রায় ভারত প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য, ‘কোটি কোটি মানুষের জমি দখল করে রাষ্ট্র তা “জনস্বার্থে” তুলে দিচ্ছে বৃহৎ করপোরেশনগুলোর হাতে। ২০ বছরের বিশাল প্রবৃদ্ধির পর ভারতের মোট শ্রমশক্তির ৬০ শতাংশ মানুষকেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে। শতকরা ৯০ ভাগ শ্রমিক কাজ করছেন অসংগঠিত খাতে।’ (ক্যাপিটালিজম, এ ঘোস্ট স্টোরি, ২০১২)
কৃষি বিপর্যয়ের কারণে ভারতে প্রতিবছর কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। কৃষিতে বৈশ্বিক বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য বিস্তার, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নীতি ও সরকারের বৈরী নীতির কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা যে শুধু অব্যাহত থাকছে তা-ই নয়, কোনো কোনো অঞ্চলে তা বেড়েছে। ২০১৫ সালে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জয়তী ঘোষ এক গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘গত বছরের তুলনায় এই বছরে মহারাষ্ট্রে আত্মহত্যা বেড়েছে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ। শুধু বর্ধমানেই এ বছরে আত্মহত্যার সংখ্যা উঠেছে ১০৬ জনে। এ ছাড়া রাজস্থান ও পাঞ্জাব থেকেও আত্মহত্যার নতুন নতুন খবর পাওয়া যাচ্ছে।’ (বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: সর্বজনকথা, আগস্ট ২০১৫)
ভারতের প্রবীণ শিক্ষক ও গবেষক উষা পাটনায়েক ভারতের দারিদ্র্য হ্রাসের সরকারি দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিস্তৃত বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে ২০০৪-০৫-এর তুলনায় দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উষা বলেছেন, ‘ইতিমধ্যে ভারতের মধ্যেই আরেকটি সাব-সাহারান আফ্রিকা তৈরি হয়েছে। ভারতের গ্রামীণ মানুষের শতকরা ৫০ ভাগ বা ৩৫ কোটিরও বেশি মানুষ সাব-সাহারান আফ্রিকার গড় পরিমাণের চেয়ে কম খাদ্যশক্তি গ্রহণ করে।’ দারিদ্র্য নিয়ে তথ্য-উপাত্তের এই ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তি বাংলাদেশের জন্যও সত্য।
ভারতে কৃষি, বন, নদী, পানি, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক-এডিবি-সমর্থিত বিভিন্ন প্রকল্প জনগণের সম্পদ বেসরকারীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের আয়োজন করেছে। এসব প্রকল্প ভারতের মানুষকে ছাপিয়ে এখন প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কা বাঁধ সব সময়ই একটি মরণফাঁদ, আর এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে গজলডোবাসহ আরও অনেক বাঁধ এবং আরও ভয়ংকর আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প। বাংলাদেশ অংশে তিস্তাসহ অনেক নদী এখন মরণাপন্ন। ব্রহ্মপুত্র নদে বাঁধ দেওয়ার চীনা পরিকল্পনা ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের জন্যই হুমকি হয়ে উঠেছে। সুন্দরবন ধ্বংস করে হলেও ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি এনটিপিসি তার বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বন, নদী, জমি দখল এখন এই অঞ্চলের উন্নয়নের প্রধান ভাষা।
বৃহৎ পুঁজির আত্মসম্প্রসারণের তাগিদ পূরণে ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী তৎপরতার একটি বড় ক্ষেত্র এখন ভূমি। কৃষকের জমি কিংবা সাধারণ সম্পত্তি হিসেবে এখনো টিকে থাকা জমি উন্নয়নের নামে ব্যক্তিমালিকানায় অর্থাৎ বৃহৎ করপোরেট গ্রুপের হাতে তুলে নেওয়ার জন্য আইন সংস্কার থেকে বলপ্রয়োগ—সবই চলছে। ২০০৫ সালে গৃহীত সেজ (স্পেশাল ইকোনমিক জোন) অ্যাক্টের মাধ্যমে বৃহদায়তন কৃষিজমি খুব কম দামে বৃহৎ ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার আইনি ব্যবস্থা হয়। কর, শুল্ক ও বিধিমালা যতটা সম্ভব ছাড় দিয়ে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কংগ্রেস আমলে এ-বিষয়ক একটি বিল সংসদে পাস হয়েছিল। ২০১৫ সালে তার সংস্কার করে ভূমি দখল বা অধিগ্রহণকে আরও নিরাপদ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আগে রুটিনমাফিক জনসম্মতি ও সামাজিক অভিঘাত সমীক্ষার যা কিছু বিধান রাখা হয়েছিল, সেগুলোও তুলে নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ভারতজুড়ে একদিকে দখলদার বা অধিগ্রহণের সুবিধাভোগীদের উন্মাদনা, অন্যদিকে কৃষক ও গ্রামীণ মজুরদের আর্তনাদ, প্রতিবাদ ও সংঘাত চলছে।
ভারতে ‘জনস্বার্থে’ ভূমি অধিগ্রহণের নামে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর হাতে জমি তুলে দেওয়ার নীতি ও কর্মসূচি বিষয়ে গবেষণা করে সমাজবিজ্ঞানী মাইকেল লেভিন দেখিয়েছেন, ‘রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠীর জমির দালালে পরিণত হয়েছে।’ কৃষকসহ গ্রামীণ মানুষদের উচ্ছেদ করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিলাসবহুল হোটেল, গলফ মাঠ, ক্যাসিনো, বহুতল আবাসিক ভবন, সুপার মার্কেট তৈরির মহাযজ্ঞ চলছে। গ্রামীণ বেকারত্ব বাড়ছে, তবে গ্রামীণ ধনীদের জমির মূল্য বৃদ্ধিতে লাভ হচ্ছে, গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
ভূমির ওপর ভারতের বড় ব্যবসায়ীদের এই আগ্রাসন এখন সীমান্ত অতিক্রম করতে ছটফট করছে। বাংলাদেশে দেশি বড় ব্যবসায়ী দখলদারেরা ইতিমধ্যে নদী, বন, পাহাড়, জমি দখলে অনেক এগিয়ে। দুই দেশেই এ ক্ষেত্রে বহুজাতিক পুঁজি, বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী, দেশি বৃহৎ ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু, আমলা, সন্ত্রাসী, কনসালট্যান্ট ও সরকার—সবাই একাকার।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anu@juniv.edu/anujuniv@gmail.com
বলা বাহুল্য, ঋণচুক্তির এই মডেল বহু পুরোনো। ‘বিদেশি সাহায্য’ নামে এই ধরনের ঋণ দিয়েই বিশ্বের পশ্চিমা দেশগুলো প্রান্তিক দেশগুলোতে নিজেদের পণ্যবাজার তৈরি করেছে, নাগরিকদের কর্মসংস্থান করেছে, বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর বিনিয়োগের পথ তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির মতো সংস্থাগুলো এই ঋণের ফাঁদে ফেলেই বহুজাতিক পুঁজির পথ প্রশস্ত করেছে। ভারতের বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী সে রকম পরাশক্তির ভাব নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে এখন। চীন, যুক্তরাষ্ট্র কখনো প্রতিদ্বন্দ্বী, কখনো একই পথে ঐক্যবদ্ধ। সম্প্রতি নেপাল বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের শক্তি প্রদর্শনের নমুনা দেখেছে, তাকে মোকাবিলাও করেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি-রাজনীতির গতিমুখ নির্ধারণে ভারতের ভূমিকা, রাজনীতি এবং অর্থনীতির গতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্ধারক। কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও হয়ে থাকলেও বাংলাদেশে ভারতের পণ্য আমদানি, নিয়োগ ও বিনিয়োগ বাড়ছে। বাংলাদেশ এখন ভারতের প্রবাসী–আয়ের অন্যতম উৎস। ট্রানজিটের মধ্য দিয়ে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগোলিক–অর্থনৈতিক মানচিত্র পরিবর্তিত হওয়ার পথে।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটার পর জাতীয়তাবাদী উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ভারত যাত্রা শুরু করে। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলো সেই কাঠামোতেই গ্রহণ করা হয়। জাতীয় শিল্পের ভিত্তি নির্মাণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে জাতীয় প্রতিষ্ঠান ও দক্ষ জনশক্তির বিকাশ, বিভিন্ন রাজ্যে এবং কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ, শিক্ষা-চিকিৎসা সুবিধা সম্প্রসারণ এবং ভূমি সংস্কারের বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার মধ্য দিয়ে সত্তরের দশকের মধ্যে ভারত একটি টেকসই শিল্প ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়। এর ওপর দাঁড়িয়েই বিকশিত হয় বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী।
ভারতের অর্থনৈতিক নীতি স্তরে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে নব্বই দশকের শুরুতে মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে। তখন সর্বজনের সম্পদ বৃহৎ ব্যক্তিগোষ্ঠী মালিকানায় স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই পুঁজিমুখী বা ‘নয়া উদারতাবাদী’ সংস্কারের মধ্য দিয়ে অর্থনীতির ওপর বৃহৎ বেসরকারি শিল্প ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর আধিপত্য সম্প্রসারিত হয়েছে। তারপরও নবরত্ন বলে পরিচিত নয়টি বড় বড় ক্ষেত্র (তেল, গ্যাস, এনার্জিসহ আরও অন্যান্য খাত) রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায়, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পরিচালিত হতে থাকে। এখন পর্যন্ত মাইনিং কিংবা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলনের ব্যাপারে ভারতীয় সংস্থা রাষ্ট্রীয়ভাবে ৮০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে। বিদ্যুৎ খাতের বড় অংশও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে।
আশির দশক থেকে বাংলাদেশ যেভাবে নির্বিচার আমদানি বৃদ্ধি করেছে, যেভাবে জাতীয় সম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার পথ নিয়েছে, ভারত সে রকম উৎসাহ কখনোই দেখায়নি। বরং বাংলাদেশের নির্বিচার আমদানি ও বিদেশি কোম্পানি–নির্ভরতার পথ ভারতের এসব শিল্পগোষ্ঠীর জন্য সুবিধাজনক হয়েছে। এখন এসব সংস্থা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করছে, সমুদ্রে তেল, গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে কাজ করছে। মোদি সরকারের আমলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর টাটা, রিলায়েন্স, আদানিসহ বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর অংশীদারত্ব বৃদ্ধির চেষ্টা বেড়েছে। ভারতে নতুনভাবে বিন্যস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত খাত, বেসরকারি খাত, যৌথ বিনিয়োগ, একক বিদেশি বিনিয়োগ—সব মিলিয়ে ভারতে দেশি বৃহৎ পুঁজি, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পুঁজি ও বহুজাতিক পুঁজির যে মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে, তার সংবর্ধন, পুঞ্জিভবন ও সম্প্রসারণের অনেক বেশি চাপ এখন। এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে দেশের ভেতরে ও বাইরে ভারতের সামরিক ব্যয় ও তৎপরতাও বাড়ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বড় অংশীদার।
তবে এই উন্নয়নধারার ভেতরেই আছে বৈপরীত্যের চাপ, আছে একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধি ও বঞ্চনা বৃদ্ধির উপাদান। তাই ভারত প্রসঙ্গে অরুন্ধতী রায় ২০০১ থেকে শুরু করে এই শতকের প্রথম দশকের প্রবণতা সারসংক্ষেপ করেছেন এই বলে যে এই দশক ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আবার বিশ্বসভায় অর্থনৈতিক ও পারমাণবিক শক্তি হিসেবে ভারতের আবির্ভাবকাল। এই বছরগুলো কারও কারও জন্য অভাবনীয় সম্পদ ও সমৃদ্ধি এনেছে, অন্যদের জন্য তা এমন দুস্থতা, অনাহার, এমন হতাশা এনেছে যে তাদের জীবনকে আর মনুষ্যজীবন বলা যায় না। গুজরাটের মুসলমানদের জন্য তা এনেছে গণহত্যা। ভারতের মুসলমানদের জন্য তা হিন্দু ফ্যাসিবাদের ভূত। লক্ষাধিক কৃষকের জন্য তা এনেছে আত্মহত্যা। করপোরেশনগুলোর জন্য এই সময় দিয়েছে বিপুল মুনাফা। দান্তেওয়াদার আদিবাসীর জন্য এই বছরগুলো এনেছে বলপ্রয়োগে উচ্ছেদ এবং সরকারি নিষ্ঠুর গৃহযুদ্ধ। কাশ্মীর, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের মানুষের জন্য তা এনেছে ‘স্বাভাবিকতা’র নামে অবিরাম সামরিক দখলদারি।’ (দ্য শেইপ অব দ্য বিস্ট, ২০০৮)
উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের বিশাল অঙ্ক বেকারত্বের কোনো সুরাহা দেখাতে সক্ষম হয়নি। অরুন্ধতী রায় ভারত প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য, ‘কোটি কোটি মানুষের জমি দখল করে রাষ্ট্র তা “জনস্বার্থে” তুলে দিচ্ছে বৃহৎ করপোরেশনগুলোর হাতে। ২০ বছরের বিশাল প্রবৃদ্ধির পর ভারতের মোট শ্রমশক্তির ৬০ শতাংশ মানুষকেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে। শতকরা ৯০ ভাগ শ্রমিক কাজ করছেন অসংগঠিত খাতে।’ (ক্যাপিটালিজম, এ ঘোস্ট স্টোরি, ২০১২)
কৃষি বিপর্যয়ের কারণে ভারতে প্রতিবছর কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। কৃষিতে বৈশ্বিক বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য বিস্তার, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নীতি ও সরকারের বৈরী নীতির কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা যে শুধু অব্যাহত থাকছে তা-ই নয়, কোনো কোনো অঞ্চলে তা বেড়েছে। ২০১৫ সালে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জয়তী ঘোষ এক গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘গত বছরের তুলনায় এই বছরে মহারাষ্ট্রে আত্মহত্যা বেড়েছে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ। শুধু বর্ধমানেই এ বছরে আত্মহত্যার সংখ্যা উঠেছে ১০৬ জনে। এ ছাড়া রাজস্থান ও পাঞ্জাব থেকেও আত্মহত্যার নতুন নতুন খবর পাওয়া যাচ্ছে।’ (বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: সর্বজনকথা, আগস্ট ২০১৫)
ভারতের প্রবীণ শিক্ষক ও গবেষক উষা পাটনায়েক ভারতের দারিদ্র্য হ্রাসের সরকারি দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিস্তৃত বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে ২০০৪-০৫-এর তুলনায় দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উষা বলেছেন, ‘ইতিমধ্যে ভারতের মধ্যেই আরেকটি সাব-সাহারান আফ্রিকা তৈরি হয়েছে। ভারতের গ্রামীণ মানুষের শতকরা ৫০ ভাগ বা ৩৫ কোটিরও বেশি মানুষ সাব-সাহারান আফ্রিকার গড় পরিমাণের চেয়ে কম খাদ্যশক্তি গ্রহণ করে।’ দারিদ্র্য নিয়ে তথ্য-উপাত্তের এই ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তি বাংলাদেশের জন্যও সত্য।
ভারতে কৃষি, বন, নদী, পানি, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক-এডিবি-সমর্থিত বিভিন্ন প্রকল্প জনগণের সম্পদ বেসরকারীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের আয়োজন করেছে। এসব প্রকল্প ভারতের মানুষকে ছাপিয়ে এখন প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কা বাঁধ সব সময়ই একটি মরণফাঁদ, আর এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে গজলডোবাসহ আরও অনেক বাঁধ এবং আরও ভয়ংকর আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প। বাংলাদেশ অংশে তিস্তাসহ অনেক নদী এখন মরণাপন্ন। ব্রহ্মপুত্র নদে বাঁধ দেওয়ার চীনা পরিকল্পনা ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের জন্যই হুমকি হয়ে উঠেছে। সুন্দরবন ধ্বংস করে হলেও ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি এনটিপিসি তার বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বন, নদী, জমি দখল এখন এই অঞ্চলের উন্নয়নের প্রধান ভাষা।
বৃহৎ পুঁজির আত্মসম্প্রসারণের তাগিদ পূরণে ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী তৎপরতার একটি বড় ক্ষেত্র এখন ভূমি। কৃষকের জমি কিংবা সাধারণ সম্পত্তি হিসেবে এখনো টিকে থাকা জমি উন্নয়নের নামে ব্যক্তিমালিকানায় অর্থাৎ বৃহৎ করপোরেট গ্রুপের হাতে তুলে নেওয়ার জন্য আইন সংস্কার থেকে বলপ্রয়োগ—সবই চলছে। ২০০৫ সালে গৃহীত সেজ (স্পেশাল ইকোনমিক জোন) অ্যাক্টের মাধ্যমে বৃহদায়তন কৃষিজমি খুব কম দামে বৃহৎ ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার আইনি ব্যবস্থা হয়। কর, শুল্ক ও বিধিমালা যতটা সম্ভব ছাড় দিয়ে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কংগ্রেস আমলে এ-বিষয়ক একটি বিল সংসদে পাস হয়েছিল। ২০১৫ সালে তার সংস্কার করে ভূমি দখল বা অধিগ্রহণকে আরও নিরাপদ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আগে রুটিনমাফিক জনসম্মতি ও সামাজিক অভিঘাত সমীক্ষার যা কিছু বিধান রাখা হয়েছিল, সেগুলোও তুলে নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ভারতজুড়ে একদিকে দখলদার বা অধিগ্রহণের সুবিধাভোগীদের উন্মাদনা, অন্যদিকে কৃষক ও গ্রামীণ মজুরদের আর্তনাদ, প্রতিবাদ ও সংঘাত চলছে।
ভারতে ‘জনস্বার্থে’ ভূমি অধিগ্রহণের নামে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর হাতে জমি তুলে দেওয়ার নীতি ও কর্মসূচি বিষয়ে গবেষণা করে সমাজবিজ্ঞানী মাইকেল লেভিন দেখিয়েছেন, ‘রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠীর জমির দালালে পরিণত হয়েছে।’ কৃষকসহ গ্রামীণ মানুষদের উচ্ছেদ করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিলাসবহুল হোটেল, গলফ মাঠ, ক্যাসিনো, বহুতল আবাসিক ভবন, সুপার মার্কেট তৈরির মহাযজ্ঞ চলছে। গ্রামীণ বেকারত্ব বাড়ছে, তবে গ্রামীণ ধনীদের জমির মূল্য বৃদ্ধিতে লাভ হচ্ছে, গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
ভূমির ওপর ভারতের বড় ব্যবসায়ীদের এই আগ্রাসন এখন সীমান্ত অতিক্রম করতে ছটফট করছে। বাংলাদেশে দেশি বড় ব্যবসায়ী দখলদারেরা ইতিমধ্যে নদী, বন, পাহাড়, জমি দখলে অনেক এগিয়ে। দুই দেশেই এ ক্ষেত্রে বহুজাতিক পুঁজি, বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী, দেশি বৃহৎ ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু, আমলা, সন্ত্রাসী, কনসালট্যান্ট ও সরকার—সবাই একাকার।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anu@juniv.edu/anujuniv@gmail.com
No comments