এরশাদের রাজনীতির গন্তব্য by আলফাজ আনাম
বাংলাদেশের
বিনোদনমূলক রাজনীতির প্রধান নায়ক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নানা সময়ে
নিস্তরঙ্গ রাজনীতিতে তিনি প্রধান চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। চলে আসেন
আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তার প্রতিষ্ঠিত দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একসময়ের
ফার্স্ট লেডি এবং সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশনের সাথে এরশাদের বিরোধ নতুন
নয়। এবার তিনি সামনে এনেছেন তার ভাইকে। ভাই, ভাবী আর দেবরের কাজিয়া এখন
সাধারণ মানুষের চর্চার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর এভাবে জাতীয় পার্টি নামের
রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বের কথা মানুষ জানতে পারছে। বাস্তবতা হচ্ছে, যত দিন
এই বিরোধ থাকবে তত দিন জাতীয় পার্টির নাম উচ্চারিত হবে। যখন আর বিরোধ থাকবে
না তখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। এ কারণে
মাঝে মাঝে জাতীয় পার্টির মালিক ও কর্মীরা নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে
নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দেন।
বাংলাদেশে অনেক অদ্ভুত রাজনীতির জন্ম দিয়েছে জাতীয় পার্টি। এখন যেমন দলটি একই সাথে বিরোধী দল আবার একই সাথে ক্ষমতাসীন দলের অংশ। এরশাদের কোন কথাটি নিজের আর কোনটি অন্যের তা বোঝা খুব দুষ্কর। তবে তিনি সম্প্রতি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিজের প্রয়োজনে, নির্বাচনের প্রয়োজনে জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করবে। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় পার্টি আর আওয়ামী লীগের রাজনীতি পরস্পরের পরিপূরক। এই রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি হয়েছে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের পরিকল্পনার শুরু থেকেই। এ কারণে উর্দি পরে এরশাদ যখন নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তখন আওয়ামী লীগ অখুশি হয়নি। এরপর বৈধতার সঙ্কটে থাকা এরশাদকে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বৈধতা দেয়ার দায়িত্বটি সানন্দে করেছে আওয়ামী লীগ। তখন আওয়ামী লীগের রাজনীতির একটি নাটাই ছিল এরশাদের হাতে। এরশাদের আকাক্সক্ষার বাইরে আওয়ামী লীগ যেতে পারেনি। সময়ের বিবর্তনে শুধু পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ’৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেমন এরশাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল তেমনি ’৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে তার প্রতিদান এরশাদকে দিতে হয়েছে। এর পরের নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের সাথে ছিলেন এরশাদ। এরশাদের জাতীয় পার্টির রাজনীতির নাটাই এখন আওয়ামী লীগের হাতে। এরশাদ এখন যে সিদ্ধান্ত নিতে চান না কেন আওয়ামী লীগের ইচ্ছা পূরণ করেই তা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও মন্ত্রিসভা থেকে সরে আসার বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে সম্মানিত করেছেন। এখন হুট করে আলোচনা ছাড়া পদ ছেড়ে দিতে পারি না। আমরা আশা করি দলের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী আমাদের সহযোগিতা করবেন।’ এই বক্তব্যর মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট যে, এরশাদের স্বাধীনভাবে দলের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। প্রধানমন্ত্রী যতটা স্বাধীনভাবে চলার সুযোগ দেবেন তিনি ততটুকুই পাবেন-এর বেশি কিছু নয়।
এরশাদের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হচ্ছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রয়োজনে জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করবে। এখানে শক্তিশালী না বলে বরং বলতে পারি জাতীয় পার্টিকে টিকিয়ে রাখবে। কারণ ভোটের রাজনীতির হিসাব। জাতীয় পার্টি অনেক আগেই একটি আঞ্চলিক দলে পরিণত হয়েছে। বৃহত্তর রংপুর ও সিলেটের দু-একটি উপজেলা ছাড়া সারা দেশে জাতীয় পার্টির কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নেই। কিন্তু গত কয়েক বছরের স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল বলছে দেশের উত্তরাঞ্চলে জাতীয় পার্টি অবস্থান হারিয়ে ফেলছে। বৃহত্তর রংপুরের গাইবান্ধা, রংপুরের একাংশ, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামে উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভা নির্বাচনে জামায়াত ও বিএনপি প্রার্থীরা বেশির ভাগ উপজেলা ও পৌরসভায় বিজয়ী হয়েছেন। ঐতিহ্যগতভাবে এ অঞ্চলে আওয়ামী লীগের অবস্থান দুর্বল। এ ছাড়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে যেভাবে দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে তাতে বিেেরাধী দলের প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ও জনসমর্থন আরো বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবে আগামীতে যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে বৃহত্তর রংপুরে জাতীয় পার্টি অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারবে না। এ অঞ্চলে জাতীয় পার্টি দুর্বল হওয়ার অর্থ হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াতের শক্তি বৃদ্ধি। কারণ জাতীয় পার্টির স্থান আওয়ামী লীগ দখল করতে পারবে না। ভোটের রাজনীতির হিসাবের কারণে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগ টিকিয়ে রাখবে।
জাতীয় পার্টির জন্য সঙ্কট হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের বলয় থেকে যেমন বের হতে পারবে না, তেমনি ক্ষমতাসীনদের সমর্থনে টিকে থাকতে চাইলে ন্যূনতম জনসমর্থন হারাতে হবে। উভয় সঙ্কটে পড়ে জাতীয় পার্টি একটি মাঝামাঝি পথ খুঁজতে চাইছে। সরকারের আশ্রয়ে থেকে বিরোধী দলের ভূমিকা নেয়া। কিন্তু সেই কাজটি সহজ নয়। কারণ নির্বাচন ছাড়াই যারা এবারে মন্ত্রী ও এমপি হয়েছেন তারা তো পদ-পদবি ছাড়তে চাইবেন না। অপর দিকে ক্ষমতাসীন দল পুরোপুরি বিরোধী দলের ভূমিকায় জাতীয় পার্টিকে নামিয়ে নাটাই হাতছাড়া করতে রাজি হবে না। এই পরিস্থিতি এরশাদ বোঝেন না এমন নয়।
এখন এরশাদ তার গৃহপালিত বিরোধী দলের ইমেজ কাটিয়ে উঠতে চান। যাতে আগামী দিনে অন্তত রংপুরের মানুষের কাছে ভোট চাইতে পারেন। এই কৌশলের অংশ হিসেবে তিনি তার ভাইকে সামনে এনেছেন। তিনি বোঝাতে চাইছেন জি এম কাদের শুধু তার উত্তরসূরি নন তার অবস্থান সরকারবিরোধী। জাতীয় পার্টিকে তিনি বিরোধী দলের ভূমিকায় নিতে চান। কিন্তু জি এম কাদের আবার বলছেন তাকে কো-চেয়ারম্যান করার প্রস্তাবটি তার ভাবীর কাছ থেকে এসেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, পারিবারিক সম্পত্তি জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে ভাই, ভাবী ও দেবরের মধ্যে এক ধরনের আলোচনা আগেই হয়েছে। জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করার গল্প নিজেই বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘একটি পারিবারিক কারণে রওশনের সাথে সাক্ষাৎ করি। তখন তিনি নিজেই বললেন, দল বাঁচাতে হবে। তোমার ভাই তোমাকে কো-চেয়ারম্যান করতে পারেন। আমি বললাম, এমন পদ তো গঠনতন্ত্রে নেই। তিনি বললেন, চেয়ারম্যানের ক্ষমতা আছে পদ সৃষ্টি করার। পরে তা আমি ভাইকে জানাই।’ (প্রথম আলো, ২১ জানুয়ারি ২০১৬)। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বাবলু-আনিস আর রাঙ্গার ভবিষ্যৎ নিয়ে। কারণ জাতীয় পার্টি যদি কিছুটা খোলস বদলাতে চায় তাহলে দলের মধ্যেও কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। এ ক্ষেত্রে বাবলু-আনিসের প্রভাব স্বাভাবিকভাবে কমে আসবে। কারণ একসময় রওশনের সমর্থন নিয়ে জি এম কাদেরকে তারা কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। এরা জাতীয় পার্টির ভবিষ্যতের চেয়েও নিজেদের স্বার্থ বড় করে দেখেছেন। এখন রওশন পুরোপুরিভাবে এদের পরিত্যাগ করতে পারছেন না। ফলে মুখরক্ষার জন্য এরশাদের কাছে তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছেন। কিন্তু ইতোমধ্যে এরশাদ সে আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। ফলে রহুল আমিন হাওলাদারকে নিয়ে জি এম কাদের মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা এ কথা বলতে চাইছেন আমরা আওয়ামী লীগের অনুগ্রহপুষ্ট নই, স্বাধীন বিরোধী দল হতে চাই।
প্রশ্ন হচ্ছে, গৃহপালিত বিরোধী দল থেকে স্বাধীন বিরোধী দলে রূপান্তর হওয়ার এই নাটকে কি ক্ষমতাসীনদের সায় আছে? ঘটনা পরম্পরায় মনে হচ্ছে পুরো প্রক্রিয়াটা পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে। মনে রাখতে হবে জি এম কাদের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণের বিরোধিতা করলেও ক্ষমতাসীন দলের সাথে তার বরাবরই ভালো যোগাযোগ। তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টির সম্পর্কের রসায়ন তিনি খোলাসা করেছেন। তিনি বলছেন, অতীতের রাজনীতিতে আমরা শক্তিশালী ছিলাম বলে আওয়ামী লীগকে আমরা সহযোগিতা করতে পেরেছি। আমাদের সহযোগিতা ছাড়া আওয়ামী লীগ কখনো সরকার গঠন করতে পারেনি। জাপাকে তাদের লাগবে। শুধু এখানেই থেমে থাকেননি তিনি, অতীত সম্পর্কের ব্যাখাও দিয়েছেন। বলেছেন, ১৯৯৬ সালে জাপাকে নিয়ে তারা (আওয়ামী লীগ) সরকার গঠন করেছে। ২০০১ সালে আমাদের সাথে তারা জোট করেনি, হেরেছে। ২০০৮ সালে মহাজোট করেছে, জিতেছে। ২০১৪ সালেও তারা জাপাকে নিয়েই সরকার গঠন করেছে। জি এম কাদের আওয়ামী লীগের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্কের যে দিকটি তুলে ধরেছেন তা আওয়ামী লীগের অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতা এরশাদ-জি এম কাদের যেমন বোঝেন, প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও বোঝেন। জি এম কাদের আগাম নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির ভেতরের এই পরিবর্তনের পেছনে কি তাহলে ছোট পরিসরের গৃহপালিত বিরোধী দল থেকে বড় পরিসরের বিরোধী দলের পরিকল্পনা কাজ করছে? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের হয়তো আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
বিএনপির বিকল্প বিরোধী দল হওয়ার স্বপ্ন এরশাদ বা জি এম কাদের দেখলেও ভোটের রাজনীতির বাস্তবতা ভিন্ন। জাতীয় পার্টি এখন ক্ষয়িষ্ণু এক রাজনৈতিক দল। বুড়ো ঘোড়াকে যত চেষ্টা করা হোক আর যৌবন ফিরে পাবে না। এমনকি বৃহত্তর রংপুরেও জাতীয় পার্টি আগের অবস্থানে ফিরে আসতে পারবে না। রদবদল আর রূপান্তরের যত নাটক করা হোক না, জাতীয় পার্টি-আওয়ামী লীগ সমঝোতার রাজনীতি শুধু রওশন এরশাদের মতো বিরোধী দলের নেতা তৈরি করবে। প্রকৃত বিরোধী রাজনীতির কোনো ক্ষেত্র জাতীয় পার্টি তৈরি করতে পারবে না। সে সক্ষমতাও নেই।
alfazanambd@yahoo.com
বাংলাদেশে অনেক অদ্ভুত রাজনীতির জন্ম দিয়েছে জাতীয় পার্টি। এখন যেমন দলটি একই সাথে বিরোধী দল আবার একই সাথে ক্ষমতাসীন দলের অংশ। এরশাদের কোন কথাটি নিজের আর কোনটি অন্যের তা বোঝা খুব দুষ্কর। তবে তিনি সম্প্রতি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিজের প্রয়োজনে, নির্বাচনের প্রয়োজনে জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করবে। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় পার্টি আর আওয়ামী লীগের রাজনীতি পরস্পরের পরিপূরক। এই রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি হয়েছে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের পরিকল্পনার শুরু থেকেই। এ কারণে উর্দি পরে এরশাদ যখন নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তখন আওয়ামী লীগ অখুশি হয়নি। এরপর বৈধতার সঙ্কটে থাকা এরশাদকে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বৈধতা দেয়ার দায়িত্বটি সানন্দে করেছে আওয়ামী লীগ। তখন আওয়ামী লীগের রাজনীতির একটি নাটাই ছিল এরশাদের হাতে। এরশাদের আকাক্সক্ষার বাইরে আওয়ামী লীগ যেতে পারেনি। সময়ের বিবর্তনে শুধু পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ’৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেমন এরশাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল তেমনি ’৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে তার প্রতিদান এরশাদকে দিতে হয়েছে। এর পরের নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের সাথে ছিলেন এরশাদ। এরশাদের জাতীয় পার্টির রাজনীতির নাটাই এখন আওয়ামী লীগের হাতে। এরশাদ এখন যে সিদ্ধান্ত নিতে চান না কেন আওয়ামী লীগের ইচ্ছা পূরণ করেই তা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও মন্ত্রিসভা থেকে সরে আসার বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে সম্মানিত করেছেন। এখন হুট করে আলোচনা ছাড়া পদ ছেড়ে দিতে পারি না। আমরা আশা করি দলের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী আমাদের সহযোগিতা করবেন।’ এই বক্তব্যর মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট যে, এরশাদের স্বাধীনভাবে দলের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। প্রধানমন্ত্রী যতটা স্বাধীনভাবে চলার সুযোগ দেবেন তিনি ততটুকুই পাবেন-এর বেশি কিছু নয়।
এরশাদের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হচ্ছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রয়োজনে জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করবে। এখানে শক্তিশালী না বলে বরং বলতে পারি জাতীয় পার্টিকে টিকিয়ে রাখবে। কারণ ভোটের রাজনীতির হিসাব। জাতীয় পার্টি অনেক আগেই একটি আঞ্চলিক দলে পরিণত হয়েছে। বৃহত্তর রংপুর ও সিলেটের দু-একটি উপজেলা ছাড়া সারা দেশে জাতীয় পার্টির কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নেই। কিন্তু গত কয়েক বছরের স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল বলছে দেশের উত্তরাঞ্চলে জাতীয় পার্টি অবস্থান হারিয়ে ফেলছে। বৃহত্তর রংপুরের গাইবান্ধা, রংপুরের একাংশ, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামে উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভা নির্বাচনে জামায়াত ও বিএনপি প্রার্থীরা বেশির ভাগ উপজেলা ও পৌরসভায় বিজয়ী হয়েছেন। ঐতিহ্যগতভাবে এ অঞ্চলে আওয়ামী লীগের অবস্থান দুর্বল। এ ছাড়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে যেভাবে দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে তাতে বিেেরাধী দলের প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ও জনসমর্থন আরো বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবে আগামীতে যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে বৃহত্তর রংপুরে জাতীয় পার্টি অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারবে না। এ অঞ্চলে জাতীয় পার্টি দুর্বল হওয়ার অর্থ হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াতের শক্তি বৃদ্ধি। কারণ জাতীয় পার্টির স্থান আওয়ামী লীগ দখল করতে পারবে না। ভোটের রাজনীতির হিসাবের কারণে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগ টিকিয়ে রাখবে।
জাতীয় পার্টির জন্য সঙ্কট হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের বলয় থেকে যেমন বের হতে পারবে না, তেমনি ক্ষমতাসীনদের সমর্থনে টিকে থাকতে চাইলে ন্যূনতম জনসমর্থন হারাতে হবে। উভয় সঙ্কটে পড়ে জাতীয় পার্টি একটি মাঝামাঝি পথ খুঁজতে চাইছে। সরকারের আশ্রয়ে থেকে বিরোধী দলের ভূমিকা নেয়া। কিন্তু সেই কাজটি সহজ নয়। কারণ নির্বাচন ছাড়াই যারা এবারে মন্ত্রী ও এমপি হয়েছেন তারা তো পদ-পদবি ছাড়তে চাইবেন না। অপর দিকে ক্ষমতাসীন দল পুরোপুরি বিরোধী দলের ভূমিকায় জাতীয় পার্টিকে নামিয়ে নাটাই হাতছাড়া করতে রাজি হবে না। এই পরিস্থিতি এরশাদ বোঝেন না এমন নয়।
এখন এরশাদ তার গৃহপালিত বিরোধী দলের ইমেজ কাটিয়ে উঠতে চান। যাতে আগামী দিনে অন্তত রংপুরের মানুষের কাছে ভোট চাইতে পারেন। এই কৌশলের অংশ হিসেবে তিনি তার ভাইকে সামনে এনেছেন। তিনি বোঝাতে চাইছেন জি এম কাদের শুধু তার উত্তরসূরি নন তার অবস্থান সরকারবিরোধী। জাতীয় পার্টিকে তিনি বিরোধী দলের ভূমিকায় নিতে চান। কিন্তু জি এম কাদের আবার বলছেন তাকে কো-চেয়ারম্যান করার প্রস্তাবটি তার ভাবীর কাছ থেকে এসেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, পারিবারিক সম্পত্তি জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে ভাই, ভাবী ও দেবরের মধ্যে এক ধরনের আলোচনা আগেই হয়েছে। জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করার গল্প নিজেই বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘একটি পারিবারিক কারণে রওশনের সাথে সাক্ষাৎ করি। তখন তিনি নিজেই বললেন, দল বাঁচাতে হবে। তোমার ভাই তোমাকে কো-চেয়ারম্যান করতে পারেন। আমি বললাম, এমন পদ তো গঠনতন্ত্রে নেই। তিনি বললেন, চেয়ারম্যানের ক্ষমতা আছে পদ সৃষ্টি করার। পরে তা আমি ভাইকে জানাই।’ (প্রথম আলো, ২১ জানুয়ারি ২০১৬)। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বাবলু-আনিস আর রাঙ্গার ভবিষ্যৎ নিয়ে। কারণ জাতীয় পার্টি যদি কিছুটা খোলস বদলাতে চায় তাহলে দলের মধ্যেও কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। এ ক্ষেত্রে বাবলু-আনিসের প্রভাব স্বাভাবিকভাবে কমে আসবে। কারণ একসময় রওশনের সমর্থন নিয়ে জি এম কাদেরকে তারা কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। এরা জাতীয় পার্টির ভবিষ্যতের চেয়েও নিজেদের স্বার্থ বড় করে দেখেছেন। এখন রওশন পুরোপুরিভাবে এদের পরিত্যাগ করতে পারছেন না। ফলে মুখরক্ষার জন্য এরশাদের কাছে তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছেন। কিন্তু ইতোমধ্যে এরশাদ সে আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। ফলে রহুল আমিন হাওলাদারকে নিয়ে জি এম কাদের মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা এ কথা বলতে চাইছেন আমরা আওয়ামী লীগের অনুগ্রহপুষ্ট নই, স্বাধীন বিরোধী দল হতে চাই।
প্রশ্ন হচ্ছে, গৃহপালিত বিরোধী দল থেকে স্বাধীন বিরোধী দলে রূপান্তর হওয়ার এই নাটকে কি ক্ষমতাসীনদের সায় আছে? ঘটনা পরম্পরায় মনে হচ্ছে পুরো প্রক্রিয়াটা পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে। মনে রাখতে হবে জি এম কাদের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণের বিরোধিতা করলেও ক্ষমতাসীন দলের সাথে তার বরাবরই ভালো যোগাযোগ। তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টির সম্পর্কের রসায়ন তিনি খোলাসা করেছেন। তিনি বলছেন, অতীতের রাজনীতিতে আমরা শক্তিশালী ছিলাম বলে আওয়ামী লীগকে আমরা সহযোগিতা করতে পেরেছি। আমাদের সহযোগিতা ছাড়া আওয়ামী লীগ কখনো সরকার গঠন করতে পারেনি। জাপাকে তাদের লাগবে। শুধু এখানেই থেমে থাকেননি তিনি, অতীত সম্পর্কের ব্যাখাও দিয়েছেন। বলেছেন, ১৯৯৬ সালে জাপাকে নিয়ে তারা (আওয়ামী লীগ) সরকার গঠন করেছে। ২০০১ সালে আমাদের সাথে তারা জোট করেনি, হেরেছে। ২০০৮ সালে মহাজোট করেছে, জিতেছে। ২০১৪ সালেও তারা জাপাকে নিয়েই সরকার গঠন করেছে। জি এম কাদের আওয়ামী লীগের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্কের যে দিকটি তুলে ধরেছেন তা আওয়ামী লীগের অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতা এরশাদ-জি এম কাদের যেমন বোঝেন, প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও বোঝেন। জি এম কাদের আগাম নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির ভেতরের এই পরিবর্তনের পেছনে কি তাহলে ছোট পরিসরের গৃহপালিত বিরোধী দল থেকে বড় পরিসরের বিরোধী দলের পরিকল্পনা কাজ করছে? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের হয়তো আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
বিএনপির বিকল্প বিরোধী দল হওয়ার স্বপ্ন এরশাদ বা জি এম কাদের দেখলেও ভোটের রাজনীতির বাস্তবতা ভিন্ন। জাতীয় পার্টি এখন ক্ষয়িষ্ণু এক রাজনৈতিক দল। বুড়ো ঘোড়াকে যত চেষ্টা করা হোক আর যৌবন ফিরে পাবে না। এমনকি বৃহত্তর রংপুরেও জাতীয় পার্টি আগের অবস্থানে ফিরে আসতে পারবে না। রদবদল আর রূপান্তরের যত নাটক করা হোক না, জাতীয় পার্টি-আওয়ামী লীগ সমঝোতার রাজনীতি শুধু রওশন এরশাদের মতো বিরোধী দলের নেতা তৈরি করবে। প্রকৃত বিরোধী রাজনীতির কোনো ক্ষেত্র জাতীয় পার্টি তৈরি করতে পারবে না। সে সক্ষমতাও নেই।
alfazanambd@yahoo.com
No comments