নেপালের বিরুদ্ধে অঘোষিত অবরোধ by আলী রীয়াজ
ঢাকা
থেকে কাঠমান্ডু কত দূর? গত মাসখানেক বাংলাদেশের গণমাধ্যম, বিশেষত
সংবাদপত্র দেখে মনে হয়েছে যে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু অনেক দূর। নেপালের
ঘটনাপ্রবাহ কিঞ্চিতের অধিক জায়গা পায়নি বাংলাদেশের সংবাদপত্রে। এ নিয়ে
আলোচনা চোখে পড়েছে সামান্যই। কিন্তু আমরা কি এ কথা জানি না যে গত ৩০ দিনের
বেশি সময় ধরে দেশটি একধরনের অবরোধের মধ্যে রয়েছে? ২ কোটি ৭৮ লাখ নাগরিকের
কেউই কার্যত এই অবরোধের প্রতিক্রিয়ামুক্ত নয়। খাদ্য ও জ্বালানি তেলের অভাব
এমন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সেখানে কর্মরত মানবতামূলক সেবা
সংস্থাগুলো বলছে, সেখানে একটি মানবিক বিপর্যয় ঘটতে চলেছে।
নেপাল এ বছরের এপ্রিল মাসে যে ভয়াবহ ভূমিকম্পের শিকার হয়েছিল, তাতে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ মারা গেছে, আহত ব্যক্তির সংখ্যা ২৩ হাজারের বেশি। সেই সময় থেকেই এই সেবা সংস্থাগুলো সেখানে কাজ করেছে। ভূমিকম্পের সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নেপালের খবর এবং সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে এমন মনে হওয়াই স্বাভাবিক ছিল যে নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ একধরনের আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করে। সেটাকে সাময়িক মানবিকতা বলে ধরলেও এ কথা অস্বীকারের উপায় কী যে বাংলাদেশের প্রকৃতি নেপালের ওপর নির্ভরশীল?
এসব বিষয় না হয় আপাতত তোলা থাক। এটাও না হয় বাদ দিই যে আঞ্চলিক সহযোগিতা, প্রতিবেশীদের মধ্যে আদান-প্রদান বিষয়ে কথাবার্তা বলা একটা অভ্যাসের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ কথা বিস্মৃত হই কী করে যে আট বছর ধরে রাজনীতিবিদদের মধ্যে অব্যাহত টানাপোড়েন এবং কয়েক দফা ব্যর্থতার পর নেপাল ২০ সেপ্টেম্বর যখন নতুন সংবিধান কার্যকর করে, তখন অনেকেই সোৎসাহে সমর্থন দিয়েছিলেন, কিন্তু এখন সেই সংবিধানের বাংলাদেশের সমর্থকেরা পর্যন্ত খুব বেশি কিছু বলেছেন, এমন চোখে পড়েনি। ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়াগুলো ধর্তব্যে না নিলেও গণমাধ্যমের একধরনের নীরবতা নিঃসন্দেহে চোখে পড়ে। প্রতিবেশী একটি দেশের এই মানবিক বিপর্যয়ের কথা কেন বাংলাদেশের পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের আরও ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ তৈরি হয় না? কেন এই মানবিক বিপর্যয়ের পেছনে যে রাজনীতি কাজ করে, তা বিশ্লেষিত হয় না?
এ কথা অবশ্যই বলা দরকার যে নেপালের সংকট খুব সহজ নয়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা যে মুখ্য, সেটাও সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য। নেপালে সংবিধান প্রণয়নের এই চূড়ান্ত পর্যায়ের সময়ই প্রতিবেশী ভারত জানিয়ে দিয়েছিল যে তারা অত্যন্ত গভীরভাবে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। নেপালের ইতিহাস বলে, বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতকে সমঝে না চলে ক্ষুদ্র নেপালের উপায় নেই। ১৯৮৯ সালে নেপালের বিরুদ্ধে ভারতের অবরোধ চলেছিল ১৩ মাস। ট্রানজিট চুক্তি বিষয়ে মতভিন্নতা উপলক্ষ ছিল মাত্র, আসল কারণ ভারতীয় প্রভাববলয়ের বাইরে গিয়ে চীনের কাছ থেকে অস্ত্র আমদানির চেষ্টা। ভারত শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টায় বিজয়ী হয়েছিল। নেপালের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৯৮৮ সালে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ১৯৮৯ সালে নেমে এসেছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশে (তথ্যসূত্র: ইকোনমিক স্টেটক্রাফট অ্যান্ড ফরেন পলিসি)। এই চাপ নেওয়ার শক্তি যে নেপালের সাধারণ মানুষের ছিল না, সেটা বাস্তববাদী মানুষমাত্রই বুঝতে পারেন। তদুপরি তৎকালীন শাসনব্যবস্থা, অর্থাৎ রাজতন্ত্র ও রাজা বীরেন্দ্র—কেউই জনগণের সমর্থনপুষ্ট ছিলেন না। এই চাপের মুখে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও পরিবর্তন ঘটেছিল, জন-আন্দোলনের জোয়ারের মুখে রাজাকে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করতে হয়। ১৯৯০ সালে প্রণীত নতুন সংবিধানের আওতায় ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী নেপালি কংগ্রেসের নেতা গিরিজা প্রসাদ কৈরালা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দিল্লি সফর করে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করার পর অবরোধের অবসান ঘটে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ রূপ নেয়।
এবার ভারতের পক্ষ থেকে সংবিধান নিয়ে যে আপত্তি তোলা হয়েছে কেবল পরোক্ষভাবে তা নয়, সংবিধান পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পর এবং তা কার্যকর হওয়ার আগে ভারত সরকার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে পররাষ্ট্রসচিব জয়শংকরকে কাঠমান্ডু পাঠান ১৮ সেপ্টেম্বর। সেখানে তিনি সুস্পষ্টভাবেই জানিয়ে এসেছিলেন যে ভারত সংবিধান নিয়ে অখুশি, ভারত সাতটি ধারার সংশোধন চায়। এমনকি সংবিধান কার্যকর করার দিনও ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালার সঙ্গে দেখা করে ভারতের আপত্তি জানান। সংবিধান পাস করার পর ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতি ছিল কঠোর। ভারতের যুক্তি এই যে এই সংবিধানের আওতায় মধেশি ও থারু জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হবে। মধেশিরাও সংবিধান নিয়ে বিক্ষোভ করছিল কয়েক সপ্তাহ ধরে, তাদের বিক্ষোভের সময় সহিংসতায় কমপক্ষে ৪০ জন মারা গেছে। নেপালের মধেশি ও থারু জনগোষ্ঠী দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ, কিন্তু তড়াই অঞ্চলের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ, অন্যদিকে পাহাড়ি এলাকার উচ্চবর্ণের হিন্দু যারা সংখ্যায় ১৫ শতাংশ, তারাই সুবিধাভোগী বলে বলা হয়ে থাকে। নতুন সংবিধান দেশকে সাতটি প্রদেশে বিভক্ত করে ফেডারেল–ব্যবস্থা চালু করেছে। মধেশিদের অভিযোগ, দেশের তড়াই এলাকার আটটি জেলা নিয়ে মাত্র একটি প্রদেশ তৈরি করা হয়েছে, বাকি ১৪টি জেলাকে অন্য পাহাড়ি জেলার সঙ্গে যুক্ত করে ভিন্ন প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে মধেশিরা সর্বত্রই সংখ্যালঘু হিসেবে থাকবে। মধেশিদের আরেকটি বড় অভিযোগ হচ্ছে, ওখানে যেভাবে সংসদের আসন বণ্টন করা হয়েছে এবং যেভাবে নির্বাচনী এলাকা তৈরি করা হয়েছে, তাতে ১৬৫ আসনের ১০০টি থাকবে পাহাড়ি এলাকায়, অন্যদিকে মাত্র ৬৫টি আসন দেওয়া হয়েছে তড়াই মাদেশি এলাকায়।
মধেশিদের নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কারণ এই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতের জাতিগত যোগাযোগ। মধেশিরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বললেও তাদের এক বড় অংশ কথা বলে মৈথিলি ভাষায়, ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ভাষা মৈথিলি। মধেশি জনগোষ্ঠীর একাংশ ভারত থেকে অভিবাসী হিসেবে নেপালে গেছে। ২০০৬ সালে নেপালি নাগরিকত্ব আইন জারি না হওয়া পর্যন্ত তাদের অনেকে নেপালের নাগরিকত্ব লাভ করতে পারেনি। নতুন সংবিধানে যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাতে নেপালের প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, পার্লামেন্টের স্পিকারসহ বেশ কিছু উচ্চপদে আসীন হতে পারবেন তাঁরাই, যাঁরা জন্মসূত্রে নেপালি। সংবিধানের ২৮৩ ধারা, যেখানে এ ব্যবস্থা করা হয়েছে, ভারত তা বাতিল বা সংশোধন করতে বলেছে। ভারতের জন্য এসব উদ্বেগ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন ভারত যে অবরোধ চাপিয়ে দিয়েছে, তার পেছনে একটি কারণ হচ্ছে বিহারের নির্বাচন। বিহারে নির্বাচন হচ্ছে পাঁচ পর্বে, ১২ অক্টোবর থেকে ৫ নভেম্বর। বিহারের ২৪৩ আসনের এই নির্বাচন ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তার পরীক্ষা। মধেশিদের বিক্ষোভের কারণে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে বিহারে প্রবেশ করে কি না, তা ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন হয়ে ওঠে কি না, সেটি মোদি সরকার অগ্রগণ্য বলে বিবেচনা করেছে।
মধেশিদের এই বিক্ষোভের পেছনে ‘ভারতের হাত আছে’ বলে যে নেপালিরা মনে করে, তাদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা মধেশিদের ন্যায়সংগত দাবিদাওয়াকে অবহেলা করতে চায়। কিন্তু সেটা রাজনৈতিকভাবে তাদের জন্য এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নেপালের জন্য ক্ষতিকর। ইতিমধ্যে নেপালের প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন, যেন সরকার মধেশিদের সঙ্গে আলোচনা করে। নেপালের সরকার ও রাজনৈতিক নেতারা অভ্যন্তরীণ এই পরিস্থিতি নিশ্চয় মোকাবিলা করবেন। কিন্তু ইতিমধ্যে ভারতের চাপিয়ে দেওয়া এই অবরোধ নেপালে ও গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বিরুদ্ধে নীরবে হলেও জনমত তৈরি করা ছাড়া আর কিছু করবে বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, তাঁর নীতি হবে ‘প্রতিবেশী প্রথম’, কিন্তু নেপালের ঘটনা প্রমাণ করছে যে ভারত তার প্রতিবেশীদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপে আগের নীতিতেই অনড় রয়েছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনের সময় ভারতের ভূমিকা বিষয়ে বিস্তারিত বলা বাহুল্য। শ্রীলঙ্কায় ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে ভারত সরকার ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকার বিষয়টি বহুল আলোচিত। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ভুটানের পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে ভুটানের পেট্রোলিয়াম ও কেরোসিনের ওপর ভারতের দেওয়া ভর্তুকি প্রত্যাহারের ঘটনা নির্বাচনের ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলেছে এমন মনে করাই সঠিক। তার পরিণতি হয়েছে ক্ষমতাসীনদের পরাজয়।
নেপালের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই দ্বিতীয় অবরোধ ভারতের নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় আশু লাভজনক মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তার ফল ভালো হবে না। বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করতে চাইলে ভারতের বিবেচনা করা দরকার যে প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের চোখে সে কীভাবে বিবেচিত হচ্ছে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
নেপাল এ বছরের এপ্রিল মাসে যে ভয়াবহ ভূমিকম্পের শিকার হয়েছিল, তাতে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ মারা গেছে, আহত ব্যক্তির সংখ্যা ২৩ হাজারের বেশি। সেই সময় থেকেই এই সেবা সংস্থাগুলো সেখানে কাজ করেছে। ভূমিকম্পের সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নেপালের খবর এবং সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে এমন মনে হওয়াই স্বাভাবিক ছিল যে নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ একধরনের আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করে। সেটাকে সাময়িক মানবিকতা বলে ধরলেও এ কথা অস্বীকারের উপায় কী যে বাংলাদেশের প্রকৃতি নেপালের ওপর নির্ভরশীল?
এসব বিষয় না হয় আপাতত তোলা থাক। এটাও না হয় বাদ দিই যে আঞ্চলিক সহযোগিতা, প্রতিবেশীদের মধ্যে আদান-প্রদান বিষয়ে কথাবার্তা বলা একটা অভ্যাসের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ কথা বিস্মৃত হই কী করে যে আট বছর ধরে রাজনীতিবিদদের মধ্যে অব্যাহত টানাপোড়েন এবং কয়েক দফা ব্যর্থতার পর নেপাল ২০ সেপ্টেম্বর যখন নতুন সংবিধান কার্যকর করে, তখন অনেকেই সোৎসাহে সমর্থন দিয়েছিলেন, কিন্তু এখন সেই সংবিধানের বাংলাদেশের সমর্থকেরা পর্যন্ত খুব বেশি কিছু বলেছেন, এমন চোখে পড়েনি। ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়াগুলো ধর্তব্যে না নিলেও গণমাধ্যমের একধরনের নীরবতা নিঃসন্দেহে চোখে পড়ে। প্রতিবেশী একটি দেশের এই মানবিক বিপর্যয়ের কথা কেন বাংলাদেশের পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের আরও ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ তৈরি হয় না? কেন এই মানবিক বিপর্যয়ের পেছনে যে রাজনীতি কাজ করে, তা বিশ্লেষিত হয় না?
এ কথা অবশ্যই বলা দরকার যে নেপালের সংকট খুব সহজ নয়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা যে মুখ্য, সেটাও সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য। নেপালে সংবিধান প্রণয়নের এই চূড়ান্ত পর্যায়ের সময়ই প্রতিবেশী ভারত জানিয়ে দিয়েছিল যে তারা অত্যন্ত গভীরভাবে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। নেপালের ইতিহাস বলে, বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতকে সমঝে না চলে ক্ষুদ্র নেপালের উপায় নেই। ১৯৮৯ সালে নেপালের বিরুদ্ধে ভারতের অবরোধ চলেছিল ১৩ মাস। ট্রানজিট চুক্তি বিষয়ে মতভিন্নতা উপলক্ষ ছিল মাত্র, আসল কারণ ভারতীয় প্রভাববলয়ের বাইরে গিয়ে চীনের কাছ থেকে অস্ত্র আমদানির চেষ্টা। ভারত শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টায় বিজয়ী হয়েছিল। নেপালের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৯৮৮ সালে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ১৯৮৯ সালে নেমে এসেছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশে (তথ্যসূত্র: ইকোনমিক স্টেটক্রাফট অ্যান্ড ফরেন পলিসি)। এই চাপ নেওয়ার শক্তি যে নেপালের সাধারণ মানুষের ছিল না, সেটা বাস্তববাদী মানুষমাত্রই বুঝতে পারেন। তদুপরি তৎকালীন শাসনব্যবস্থা, অর্থাৎ রাজতন্ত্র ও রাজা বীরেন্দ্র—কেউই জনগণের সমর্থনপুষ্ট ছিলেন না। এই চাপের মুখে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও পরিবর্তন ঘটেছিল, জন-আন্দোলনের জোয়ারের মুখে রাজাকে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করতে হয়। ১৯৯০ সালে প্রণীত নতুন সংবিধানের আওতায় ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী নেপালি কংগ্রেসের নেতা গিরিজা প্রসাদ কৈরালা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দিল্লি সফর করে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করার পর অবরোধের অবসান ঘটে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ রূপ নেয়।
এবার ভারতের পক্ষ থেকে সংবিধান নিয়ে যে আপত্তি তোলা হয়েছে কেবল পরোক্ষভাবে তা নয়, সংবিধান পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পর এবং তা কার্যকর হওয়ার আগে ভারত সরকার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে পররাষ্ট্রসচিব জয়শংকরকে কাঠমান্ডু পাঠান ১৮ সেপ্টেম্বর। সেখানে তিনি সুস্পষ্টভাবেই জানিয়ে এসেছিলেন যে ভারত সংবিধান নিয়ে অখুশি, ভারত সাতটি ধারার সংশোধন চায়। এমনকি সংবিধান কার্যকর করার দিনও ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালার সঙ্গে দেখা করে ভারতের আপত্তি জানান। সংবিধান পাস করার পর ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতি ছিল কঠোর। ভারতের যুক্তি এই যে এই সংবিধানের আওতায় মধেশি ও থারু জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হবে। মধেশিরাও সংবিধান নিয়ে বিক্ষোভ করছিল কয়েক সপ্তাহ ধরে, তাদের বিক্ষোভের সময় সহিংসতায় কমপক্ষে ৪০ জন মারা গেছে। নেপালের মধেশি ও থারু জনগোষ্ঠী দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ, কিন্তু তড়াই অঞ্চলের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ, অন্যদিকে পাহাড়ি এলাকার উচ্চবর্ণের হিন্দু যারা সংখ্যায় ১৫ শতাংশ, তারাই সুবিধাভোগী বলে বলা হয়ে থাকে। নতুন সংবিধান দেশকে সাতটি প্রদেশে বিভক্ত করে ফেডারেল–ব্যবস্থা চালু করেছে। মধেশিদের অভিযোগ, দেশের তড়াই এলাকার আটটি জেলা নিয়ে মাত্র একটি প্রদেশ তৈরি করা হয়েছে, বাকি ১৪টি জেলাকে অন্য পাহাড়ি জেলার সঙ্গে যুক্ত করে ভিন্ন প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে মধেশিরা সর্বত্রই সংখ্যালঘু হিসেবে থাকবে। মধেশিদের আরেকটি বড় অভিযোগ হচ্ছে, ওখানে যেভাবে সংসদের আসন বণ্টন করা হয়েছে এবং যেভাবে নির্বাচনী এলাকা তৈরি করা হয়েছে, তাতে ১৬৫ আসনের ১০০টি থাকবে পাহাড়ি এলাকায়, অন্যদিকে মাত্র ৬৫টি আসন দেওয়া হয়েছে তড়াই মাদেশি এলাকায়।
মধেশিদের নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কারণ এই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতের জাতিগত যোগাযোগ। মধেশিরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বললেও তাদের এক বড় অংশ কথা বলে মৈথিলি ভাষায়, ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ভাষা মৈথিলি। মধেশি জনগোষ্ঠীর একাংশ ভারত থেকে অভিবাসী হিসেবে নেপালে গেছে। ২০০৬ সালে নেপালি নাগরিকত্ব আইন জারি না হওয়া পর্যন্ত তাদের অনেকে নেপালের নাগরিকত্ব লাভ করতে পারেনি। নতুন সংবিধানে যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাতে নেপালের প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, পার্লামেন্টের স্পিকারসহ বেশ কিছু উচ্চপদে আসীন হতে পারবেন তাঁরাই, যাঁরা জন্মসূত্রে নেপালি। সংবিধানের ২৮৩ ধারা, যেখানে এ ব্যবস্থা করা হয়েছে, ভারত তা বাতিল বা সংশোধন করতে বলেছে। ভারতের জন্য এসব উদ্বেগ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন ভারত যে অবরোধ চাপিয়ে দিয়েছে, তার পেছনে একটি কারণ হচ্ছে বিহারের নির্বাচন। বিহারে নির্বাচন হচ্ছে পাঁচ পর্বে, ১২ অক্টোবর থেকে ৫ নভেম্বর। বিহারের ২৪৩ আসনের এই নির্বাচন ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তার পরীক্ষা। মধেশিদের বিক্ষোভের কারণে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে বিহারে প্রবেশ করে কি না, তা ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন হয়ে ওঠে কি না, সেটি মোদি সরকার অগ্রগণ্য বলে বিবেচনা করেছে।
মধেশিদের এই বিক্ষোভের পেছনে ‘ভারতের হাত আছে’ বলে যে নেপালিরা মনে করে, তাদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা মধেশিদের ন্যায়সংগত দাবিদাওয়াকে অবহেলা করতে চায়। কিন্তু সেটা রাজনৈতিকভাবে তাদের জন্য এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নেপালের জন্য ক্ষতিকর। ইতিমধ্যে নেপালের প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন, যেন সরকার মধেশিদের সঙ্গে আলোচনা করে। নেপালের সরকার ও রাজনৈতিক নেতারা অভ্যন্তরীণ এই পরিস্থিতি নিশ্চয় মোকাবিলা করবেন। কিন্তু ইতিমধ্যে ভারতের চাপিয়ে দেওয়া এই অবরোধ নেপালে ও গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বিরুদ্ধে নীরবে হলেও জনমত তৈরি করা ছাড়া আর কিছু করবে বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, তাঁর নীতি হবে ‘প্রতিবেশী প্রথম’, কিন্তু নেপালের ঘটনা প্রমাণ করছে যে ভারত তার প্রতিবেশীদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপে আগের নীতিতেই অনড় রয়েছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনের সময় ভারতের ভূমিকা বিষয়ে বিস্তারিত বলা বাহুল্য। শ্রীলঙ্কায় ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে ভারত সরকার ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকার বিষয়টি বহুল আলোচিত। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ভুটানের পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে ভুটানের পেট্রোলিয়াম ও কেরোসিনের ওপর ভারতের দেওয়া ভর্তুকি প্রত্যাহারের ঘটনা নির্বাচনের ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলেছে এমন মনে করাই সঠিক। তার পরিণতি হয়েছে ক্ষমতাসীনদের পরাজয়।
নেপালের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই দ্বিতীয় অবরোধ ভারতের নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় আশু লাভজনক মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তার ফল ভালো হবে না। বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করতে চাইলে ভারতের বিবেচনা করা দরকার যে প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের চোখে সে কীভাবে বিবেচিত হচ্ছে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments