সুস্থ রাজনীতিতে অপশাসনের স্থান নেই by রফিকুল ইসলাম মিয়া
পত্রিকায়
প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী পেট্রলবোমা হামলা ও আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ৫৬
জন। বন্দুকযুদ্ধে ৩৩, গুলিবিদ্ধ লাশ ৭, গণপিটুনিতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩। মানুষ
মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাত। জীবন্ত, নিরীহ ও অসহায়
আদম সন্তানকে মেরে হত্যা করার হৃদয়বিদারক দৃশ্য অসহনীয়। সভ্যতা, গণতন্ত্র,
মানবতা সবই যেন নীরব ও নিথর হয়ে যায় এ অমানবিক বীভৎস রূপ দেখে। যে কোনো
মূল্যে তার অবসান ঘটাতে হবে অনতিবিলম্বে। মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে
বলেছেন- একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করা। আরও
বলেছেন, সৎ কর্মে আদেশ প্রদান করবে, অসৎ কর্মে নিষেধ করবে এবং বিপদে ধৈর্য
ধারণ করবে। সূরা লোকমান এর ১৭ আয়াতে বলা হয়েছে- হে প্রিয় বৎস যদি কোনো
বস্তু সরিষার বীজ পরিমাণও হয় আর তা পাথরের অভ্যন্তরে কিংবা আকাশে বা
পাতালের অভ্যন্তরে থাকে তাও এনে আল্লাহ উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ বড়ই
সূক্ষ্মদর্শী, প্রজ্ঞাময়। মানুষ হত্যাসহ সব অপরাধের বিচার করবেন কেয়ামতের
দিনে। সেই বিচারে দুনিয়ায় সাক্ষ্য আইন কার্যকর নয়। মানুষের হাত, পা ও
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহ কথা বলার অধিকার দেবেন এবং সেই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ
সাক্ষী প্রদান করবে। সুতরাং কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট সাক্ষী দেওয়ার
সুযোগ থাকবে না।
আমাদের আইনে প্রত্যক্ষ সাক্ষীই সর্ব উৎকৃষ্ট সাক্ষী। প্রত্যক্ষ সাক্ষী না পাওয়া গেলে অন্যের কাছে ঘটনার বিবরণ শোনার সাক্ষী বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে প্রকৃত ঘটনার উৎপাটন করার বিধান রয়েছে। পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, বোমা তৈরির বিস্ফোরক আমদানিতে সব দলের লোকই জড়িত। কোন দলের তার সংখ্যাও উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে না পারলে ভয়ঙ্কর এ হত্যাকাণ্ড থেকে জাতিকে রক্ষা করা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। হত্যাকারী বা অপরাধকারীদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে পারে না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হত্যাকারীদের কেউই ব্যবহার করতে পারে না। এ জাতীয় রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে যাতে কোনো অবস্থাতেই অপরাধচক্র ব্যবহৃত হতে না পারে সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সবচেয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে।
সুশাসনের অভাবে অপরাধচক্রই দানা বাঁধে এবং ক্রমান্বয়ে শক্তি সংগ্রহ করে দানবে পরিণত হয়। আমরা যে যাই বলি না কেন মানুষের বিবেক কখনো মিথ্যা ও অন্যায়ের আশ্রয় দেয় না। সে জন্যই মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। মিথ্যাচার, অন্যায়, পাপে লিপ্ত হলে আমাদের বিবেকের আয়নায় কালো পর্দা পড়ে। অন্যায় সীমারেখা ছাড়িয়ে গেলে বিবেকের স্বচ্ছ আয়নায় কালো দাগ ঘনীভূত হয়। বিবেকের পবিত্র নূর আচ্ছাদিত করে ফেলে। তখন ন্যায়-অন্যায় ভুলে গিয়ে লোভ-লালসার বশীভূত হয়ে পাশবিক কাজে মানুষ নিয়োজিত হয়। আল্লাহর ওপর গভীর বিশ্বাস, আস্থা ও আল্লাহর নির্দেশ মান্য করলেই বিবেকের পবিত্র নূর সব সময় উজ্জীবিত থাকে এবং সব ধরনের মিথ্যাচার লোভ-লালসা ও অন্যায় থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়। মানুষকে ফাঁকি দেওয়া যায়, মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করা যায়, মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে তা হয়তো প্রমাণ করা যায়, দুনিয়ার আদালতে বিচারে দণ্ডও দেওয়া যায়; কিন্তু আল্লাহ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব জানেন। আল্লাহর রসুল যখন মদিনায় হিজরত করাকালীন শত্রুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন তখন একমাত্র সাথী হজরত আবু বকর (রা.) বলেছিলেন আমরা এই গুহায় দুজন নই, তিনজন। আল্লাহ সব সময় আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহতায়ালা সব সৃষ্টি বস্তুকে বেষ্টন করে আছেন। সৃষ্টির কোনো কিছুই তার সীমারেখার বাইরে নয়। আমরা কে কি করছি ভালো-মন্দ সবই আল্লাহ জানেন এবং দেখেন।
নিরাশার মধ্যে আমি আশায় বুক বেঁধে আছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বর্তমান মহাসংকটের হাত থেকে এ জাতি শিগগিরই মুক্তি পাবে। বোমা মেরে হত্যা, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান ঘটবে। সভ্যতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিজয় হবে। আকাশের কালো মেঘের অবসান ঘটবে। অমাবস্যার তিরোধানের পর পূর্ণচন্দ্র উদ্ভাসিত হবে। আমার আশার কারণ এ দেশের সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ শান্তি চায়, খেয়েপরে বাঁচতে চায়। তারা পরিশ্রমী, উদ্যোগী, উদার ও গণতন্ত্রকামী। উগ্রবাদী মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। এদেশের মানুষ চরমপন্থি ও উগ্রবাদকে পছন্দ করে না। তারা ধর্মপরায়ণ। কিন্তু ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। হজরত শাহজালাল, শাহ পরানের দেশের মানুষ উদার। হিন্দু-মুসলমান, খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষ শত শত বছর ধরে একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করছে। ইসলামে উগ্রবাদের কোনো স্থান নেই। আল্লাহর নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। পবিত্র কোরআনে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করা হয়েছে।
এ দেশের মূল ধারার রাজনীতিতে জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদের কোনো স্থান নেই। মুসলিমপ্রধান দেশ হয়েই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি উদার সহনশীল রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা সবাই একই ভাষায় কথা বলি। দলমত নির্বিশেষে সবাই মহান ভাষা আন্দোলন ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন করি। আমাদের দেশে অল্প সংখ্যক উপজাতিও রয়েছে- তারাও বাংলা ভাষার চর্চা করে। আমাদের ভাষা যেমন এক, তেমনি সংস্কৃতিও এক। এ রকম ভাষা সংস্কৃতির অধিকারী রাষ্ট্র পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। আমাদের দেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা একজন উপজাতি। দল-মত নির্বিশেষে সবাই প্রধান বিচারপতিকে সংবর্ধনা প্রদান করেছেন।
জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদী চরমপন্থিদের উত্থান ঠেকাতে হলে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। উগ্রবাদীরা যাতে সমাজে কোনো স্থান না পায় সে জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। একতাবদ্ধভাবে উগ্রবাদকে রুখে দাঁড়াতে হবে। শুধু বক্তব্য প্রদান করেই বিষবৃক্ষের অস্তিত্ব সমূলে বিনষ্ট করা যাবে না। সেই বিষবৃক্ষকে অঙ্কুরেই উৎখাত করতে হবে। ইনসাফভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা, দুর্নীতি অপশাসন শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা এবং সব শ্রেণির মানুষের ন্যূনতম বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করা, চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা, অর্থনৈতিক লুণ্ঠনের অবসান এবং সর্বোপরি গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠা চরমপন্থিদের অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার মূল হাতিয়ার। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার অবসান ঘটিয়ে জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব বিনাশ করতে হবে অঙ্কুরেই। দেশপ্রেম ও সব মানুষের প্রতি ভালোবাসা রাজনীতির পাথেয় হওয়া উচিত। বঞ্চিত অসহায় হতদরিদ্র, দুর্বল শ্রেণির মানুষেরও বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। তা মনেপ্রাণে গ্রহণ করা ব্যতীত সত্যিকারের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যেনতেনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার এবং যেভাবে হোক ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ গণতন্ত্রে নেই। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া এবং জনগণের ম্যান্ডেটেই ক্ষমতায় টিকে থাকা গণতন্ত্রের মূল শর্ত। এ সত্যকে পাশ কাটিয়ে গণতান্ত্রিক সমাজ কায়েম করা সম্ভব নয়। জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার স্বীকার না করে এবং এসব অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তবমুখী কোনো কর্মসূচি গ্রহণ না করে শুধু কথায় কথায় গণতন্ত্রের কথা বলা হলে গণতন্ত্র বিকশিত হয় না। সুস্থ রাজনীতিতে হত্যা, গুম, খুন, মিথ্যা মামলা, হামলা, দুর্নীতি, অপশাসনের কোনো স্থান নেই।
বর্তমানে দেশে কোনো রাজনীতির সমস্যা নেই, আছে শুধু আইনশৃঙ্খলা সমস্যা। এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করলে বিরাজমান পরিস্থিতির কোনো যৌক্তিক সমাধান সম্ভব নয়। টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। কঠিন বাস্তবতাকে সবার উপলব্ধি করতে হবে। সমস্যার গভীরে যেতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে কেউ কাউকে উৎখাত করা সম্ভব নয়। সত্যিকারের অপরাধীদের বিচার করতে হবে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান ঘটাতে হবে। প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের যেমন আইন মোতাবেক বিচার করতে হবে, তেমনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার অভিযুক্তদের রিমান্ডে এনে অহেতুক হয়রানিরও অবসান ঘটাতে হবে। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী সবাইকে ভোগের পরিবর্তে ত্যাগের বিষয়টি স্মরণ রাখতে হবে। ভোগই সব সর্বনাশের মূল। ভোগের স্থলে ত্যাগই হোক আজকের দাবি।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে কোনো মানুষের হক নষ্ট করলে আল্লাহ তা কখনো ক্ষমা করবেন না। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে মানুষের হক বিনষ্ট করা থেকে আমাদের নিবৃত হতে হবে। তবেই আমরা বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি পাব এবং পরকালে আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন। আমিন।
লেখক : রাজনীতিক।
আমাদের আইনে প্রত্যক্ষ সাক্ষীই সর্ব উৎকৃষ্ট সাক্ষী। প্রত্যক্ষ সাক্ষী না পাওয়া গেলে অন্যের কাছে ঘটনার বিবরণ শোনার সাক্ষী বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে প্রকৃত ঘটনার উৎপাটন করার বিধান রয়েছে। পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, বোমা তৈরির বিস্ফোরক আমদানিতে সব দলের লোকই জড়িত। কোন দলের তার সংখ্যাও উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে না পারলে ভয়ঙ্কর এ হত্যাকাণ্ড থেকে জাতিকে রক্ষা করা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। হত্যাকারী বা অপরাধকারীদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে পারে না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হত্যাকারীদের কেউই ব্যবহার করতে পারে না। এ জাতীয় রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে যাতে কোনো অবস্থাতেই অপরাধচক্র ব্যবহৃত হতে না পারে সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সবচেয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে।
সুশাসনের অভাবে অপরাধচক্রই দানা বাঁধে এবং ক্রমান্বয়ে শক্তি সংগ্রহ করে দানবে পরিণত হয়। আমরা যে যাই বলি না কেন মানুষের বিবেক কখনো মিথ্যা ও অন্যায়ের আশ্রয় দেয় না। সে জন্যই মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। মিথ্যাচার, অন্যায়, পাপে লিপ্ত হলে আমাদের বিবেকের আয়নায় কালো পর্দা পড়ে। অন্যায় সীমারেখা ছাড়িয়ে গেলে বিবেকের স্বচ্ছ আয়নায় কালো দাগ ঘনীভূত হয়। বিবেকের পবিত্র নূর আচ্ছাদিত করে ফেলে। তখন ন্যায়-অন্যায় ভুলে গিয়ে লোভ-লালসার বশীভূত হয়ে পাশবিক কাজে মানুষ নিয়োজিত হয়। আল্লাহর ওপর গভীর বিশ্বাস, আস্থা ও আল্লাহর নির্দেশ মান্য করলেই বিবেকের পবিত্র নূর সব সময় উজ্জীবিত থাকে এবং সব ধরনের মিথ্যাচার লোভ-লালসা ও অন্যায় থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়। মানুষকে ফাঁকি দেওয়া যায়, মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করা যায়, মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে তা হয়তো প্রমাণ করা যায়, দুনিয়ার আদালতে বিচারে দণ্ডও দেওয়া যায়; কিন্তু আল্লাহ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব জানেন। আল্লাহর রসুল যখন মদিনায় হিজরত করাকালীন শত্রুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন তখন একমাত্র সাথী হজরত আবু বকর (রা.) বলেছিলেন আমরা এই গুহায় দুজন নই, তিনজন। আল্লাহ সব সময় আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহতায়ালা সব সৃষ্টি বস্তুকে বেষ্টন করে আছেন। সৃষ্টির কোনো কিছুই তার সীমারেখার বাইরে নয়। আমরা কে কি করছি ভালো-মন্দ সবই আল্লাহ জানেন এবং দেখেন।
নিরাশার মধ্যে আমি আশায় বুক বেঁধে আছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বর্তমান মহাসংকটের হাত থেকে এ জাতি শিগগিরই মুক্তি পাবে। বোমা মেরে হত্যা, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান ঘটবে। সভ্যতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিজয় হবে। আকাশের কালো মেঘের অবসান ঘটবে। অমাবস্যার তিরোধানের পর পূর্ণচন্দ্র উদ্ভাসিত হবে। আমার আশার কারণ এ দেশের সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ শান্তি চায়, খেয়েপরে বাঁচতে চায়। তারা পরিশ্রমী, উদ্যোগী, উদার ও গণতন্ত্রকামী। উগ্রবাদী মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। এদেশের মানুষ চরমপন্থি ও উগ্রবাদকে পছন্দ করে না। তারা ধর্মপরায়ণ। কিন্তু ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। হজরত শাহজালাল, শাহ পরানের দেশের মানুষ উদার। হিন্দু-মুসলমান, খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষ শত শত বছর ধরে একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করছে। ইসলামে উগ্রবাদের কোনো স্থান নেই। আল্লাহর নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। পবিত্র কোরআনে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করা হয়েছে।
এ দেশের মূল ধারার রাজনীতিতে জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদের কোনো স্থান নেই। মুসলিমপ্রধান দেশ হয়েই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি উদার সহনশীল রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা সবাই একই ভাষায় কথা বলি। দলমত নির্বিশেষে সবাই মহান ভাষা আন্দোলন ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন করি। আমাদের দেশে অল্প সংখ্যক উপজাতিও রয়েছে- তারাও বাংলা ভাষার চর্চা করে। আমাদের ভাষা যেমন এক, তেমনি সংস্কৃতিও এক। এ রকম ভাষা সংস্কৃতির অধিকারী রাষ্ট্র পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। আমাদের দেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা একজন উপজাতি। দল-মত নির্বিশেষে সবাই প্রধান বিচারপতিকে সংবর্ধনা প্রদান করেছেন।
জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদী চরমপন্থিদের উত্থান ঠেকাতে হলে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। উগ্রবাদীরা যাতে সমাজে কোনো স্থান না পায় সে জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। একতাবদ্ধভাবে উগ্রবাদকে রুখে দাঁড়াতে হবে। শুধু বক্তব্য প্রদান করেই বিষবৃক্ষের অস্তিত্ব সমূলে বিনষ্ট করা যাবে না। সেই বিষবৃক্ষকে অঙ্কুরেই উৎখাত করতে হবে। ইনসাফভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা, দুর্নীতি অপশাসন শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা এবং সব শ্রেণির মানুষের ন্যূনতম বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করা, চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা, অর্থনৈতিক লুণ্ঠনের অবসান এবং সর্বোপরি গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠা চরমপন্থিদের অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার মূল হাতিয়ার। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার অবসান ঘটিয়ে জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব বিনাশ করতে হবে অঙ্কুরেই। দেশপ্রেম ও সব মানুষের প্রতি ভালোবাসা রাজনীতির পাথেয় হওয়া উচিত। বঞ্চিত অসহায় হতদরিদ্র, দুর্বল শ্রেণির মানুষেরও বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। তা মনেপ্রাণে গ্রহণ করা ব্যতীত সত্যিকারের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যেনতেনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার এবং যেভাবে হোক ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ গণতন্ত্রে নেই। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া এবং জনগণের ম্যান্ডেটেই ক্ষমতায় টিকে থাকা গণতন্ত্রের মূল শর্ত। এ সত্যকে পাশ কাটিয়ে গণতান্ত্রিক সমাজ কায়েম করা সম্ভব নয়। জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার স্বীকার না করে এবং এসব অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তবমুখী কোনো কর্মসূচি গ্রহণ না করে শুধু কথায় কথায় গণতন্ত্রের কথা বলা হলে গণতন্ত্র বিকশিত হয় না। সুস্থ রাজনীতিতে হত্যা, গুম, খুন, মিথ্যা মামলা, হামলা, দুর্নীতি, অপশাসনের কোনো স্থান নেই।
বর্তমানে দেশে কোনো রাজনীতির সমস্যা নেই, আছে শুধু আইনশৃঙ্খলা সমস্যা। এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করলে বিরাজমান পরিস্থিতির কোনো যৌক্তিক সমাধান সম্ভব নয়। টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। কঠিন বাস্তবতাকে সবার উপলব্ধি করতে হবে। সমস্যার গভীরে যেতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে কেউ কাউকে উৎখাত করা সম্ভব নয়। সত্যিকারের অপরাধীদের বিচার করতে হবে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান ঘটাতে হবে। প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের যেমন আইন মোতাবেক বিচার করতে হবে, তেমনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার অভিযুক্তদের রিমান্ডে এনে অহেতুক হয়রানিরও অবসান ঘটাতে হবে। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী সবাইকে ভোগের পরিবর্তে ত্যাগের বিষয়টি স্মরণ রাখতে হবে। ভোগই সব সর্বনাশের মূল। ভোগের স্থলে ত্যাগই হোক আজকের দাবি।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে কোনো মানুষের হক নষ্ট করলে আল্লাহ তা কখনো ক্ষমা করবেন না। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে মানুষের হক বিনষ্ট করা থেকে আমাদের নিবৃত হতে হবে। তবেই আমরা বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি পাব এবং পরকালে আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন। আমিন।
লেখক : রাজনীতিক।
No comments