১৬ বছরে বিয়ের সিদ্ধান্ত নারীর ক্ষমতায়নের পরিপন্থী by মইনুল ইসলাম
দেশের
চলমান পেট্রলবোমা ও ককটেল-সন্ত্রাস এবং হরতাল-অবরোধের মতো বিপর্যয়কর
সংকটের মাঝখানে সরকার নিজে থেকে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় একটা ইস্যু সৃষ্টি
করায় এ ব্যাপারে কলম ধরতে হচ্ছে। এর অভিঘাত মারাত্মক নেতিবাচক হবে।
সম্প্রতি মন্ত্রিসভা নারীর বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছরে অপরিবর্তিত রাখার
পাশাপাশি একটা অপ্রয়োজনীয় ধারা এতৎসম্পর্কীয় আইনে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত
নিয়েছে যে মা-বাবা সিদ্ধান্ত নিলে আদালতের অনুমতি নিয়ে মেয়েকে ১৬ বছরেও
বিয়ে দিতে পারবেন। নারীর বিয়ের বয়স কমানোর জন্য কোনো গণদাবি না থাকা
সত্ত্বেও সরকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নারীর ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে
বিশেষ ক্ষেত্রে ১৬ করার তাগিদ কেন অনুভব করছে, বুঝতে পারছি না। মন্ত্রিসভার
এই প্রস্তাব অবিমৃশ্যকারী। এটা নিয়ে সরকারের খামাখা এত মাথাব্যথা কেন,
তা-ও রহস্যজনক। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত শেখ হাসিনা
যেখানে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র জঙ্গিবাদী তাণ্ডব নিয়ে মহাবিপদে
রয়েছেন, সেখানে নারীর ক্ষমতায়নের পরিপন্থী এ রকম একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিতে
যাচ্ছেন কেন? সে জন্য শুরুতেই বলছি, আল্লাহর ওয়াস্তে ক্ষান্ত দিন। আর
অগ্রসর হবেন না, প্লিজ! ১৮ বছরেই থাকুক আইনগতভাবে নারীর বিয়ের ন্যূনতম বয়স।
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ স্বল্পোন্নত দেশ, যেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বর্তমান পর্যায়ে প্রায় ১ হাজার ১২০ জনের বসবাস। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন-তত্ত্বে বর্ণিত দ্বিতীয় পর্যায়ে (আরলি এক্সপান্ডিং ফেজ) প্রবেশ করেছিল, যেটাকে জনগণের বোধগম্য ভাষায় ‘জনসংখ্যা বিস্ফোরণের পর্যায়’ বলে অভিহিত করা যায়। ওই পর্যায়ে জনসংখ্যা প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি হারে বেড়েছে এ দেশে। ফলে ১৯৪৭ সাল থেকে ২৫ বছরের কম সময়েই সত্তরের দশকের শুরুতে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’ আখ্যায়িত করার পেছনে কারণ ছিল, ওই সময়ের সাত কোটি মানুষকে আমরা খাদ্য জোগানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি। তখন বিশ্বব্যাপী বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে ওই জনসংখ্যা যখন পরবর্তী ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ১৫ কোটি ছাড়িয়ে যাবে, তখন ভূমি-দরিদ্র ঘনবসতির এ দেশে জনগণকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশ্বের জনগণের কাছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ধরনা দেওয়া ছাড়া আর কী উপায় থাকবে? (ওই সময় আমাদের খাদ্যশস্যের প্রয়োজন হতো দেড় কোটি টন, আর উৎপাদন হতো মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন।)
ওটা শুধু কিসিঞ্জারের ধারণা ছিল না, দুনিয়ার অনেক উন্নয়ন চিন্তাবিদের গবেষণায়ও একই রকম বিপদের আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল। একদল ম্যালথুসীয় ঘরানার তাত্ত্বিক তো বলেই বসল যে বাংলাদেশ একটা ‘পপুলেশন টাইম বোমার’ ওপর বসে রয়েছে। যখন বোমাটি ফাটবে, তখন এ দেশের দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণকে বাঁচানোর জন্য আগেভাগেই বিশ্বের ধনী দেশগুলোর পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। জনসংখ্যার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞানের বিকাশ আরও এগিয়ে যাওয়ার পর অবশ্য এ ধরনের আতঙ্কবাদী ভবিষ্যদ্বাণী দেওয়ার হিড়িক সাম্প্রতিক কালে কমেছে। বিশেষ করে ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন-তত্ত্বে উল্লিখিত চারটি পর্যায় যে ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বের সব দেশকেই পেরোতে হবে কিংবা হয়েছে, সেটা তথ্য-উপাত্তসহকারে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার পর জনসংখ্যা-তাত্ত্বিকদের মনোযোগ এখন নিবদ্ধ হয়েছে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দ্বিতীয় পর্যায় কীভাবে সংক্ষিপ্ত করে বিভিন্ন জনবহুল দেশ যথাসম্ভব দ্রুত তৃতীয় পর্যায়ের ‘লেট এক্সপান্ডিং ফেজ’-এ প্রবেশ করতে পারে, সে প্রয়াস জোরদার করা। এই তৃতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে মোট জন্মহার এবং মোট মৃত্যুহার উভয়ই দ্রুত কমে যায় বা যাবে, কিন্তু এ দুটি হারের পার্থক্য কমানোর মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দ্রুত কমিয়ে আনায় সাফল্য অর্জন করতে পারলে জনসংখ্যা নিয়ে আর আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কারণ থাকবে না। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জনসংখ্যাকে বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ ঘোষণা করার পর প্রায় এক দশকজুড়ে পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিরোধ নিয়ে বিদেশি দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর মাতামাতির ব্যাপারটা হয়তো এখনো অনেকের মনে আছে।
জনগণকে ‘এক নম্বর সমস্যা’ বিবেচনা করার দৃষ্টিভঙ্গি একটি নেতিবাচক মানসিকতার প্রতিফলন, যার বিরুদ্ধে একজন গবেষক হিসেবে আমার অবস্থান বরাবরই উচ্চকিত। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে যথাসম্ভব দ্রুত ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশনের চতুর্থ পর্যায়ে, মানে ‘স্থিতিশীল জনসংখ্যা’র স্তরে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্বকে আমরা কেউ অস্বীকার করি না। জনসংখ্যা বাড়ার হার দ্রুত কমাতে গণচীন জবরদস্তির পথ বেছে নিয়েছিল। তারা জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি নাটকীয়ভাবে কমিয়ে ফেলেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই জবরদস্তির কুফলগুলো পরিস্ফুট হতে শুরু করায় তারা ধীরে ধীরে ওই নীতি থেকে সরে আসছে। জবরদস্তির পথে না গিয়েও যে জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধিকে অতিদ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব, সেটা বিশ্বের সামনে প্রমাণ করেছে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। মানুষকে সুশিক্ষিত ও সচেতন করতে পারলে, সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা হলে, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা গেলে এবং পরিবার পরিকল্পনার সহায়তাকারী জন্মনিরোধ পদ্ধতিগুলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলে জনগণ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের পরিবারের আকার ছোট করতে উদ্বুদ্ধ হয়—এই সত্যটা প্রমাণিত হয়েছে উল্লিখিত তিনটি ক্ষেত্রে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কমবেশি সফলতা অর্জনকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এর বিপরীতে নাইজেরিয়া ও পাকিস্তান জনসংখ্যা বাড়ার হার তেমন কমাতে সক্ষম না হওয়ায় এ দুটি দেশের জনসংখ্যা বেড়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে।
আশির দশকেই বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশনের তৃতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করেছে এবং গত তিন দশকে জনসংখ্যার ব্যাপারে আমাদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। অবশ্য বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়ার হার এখন ১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে গেছে বলে সরকার দাবি করলেও জাতিসংঘের জনসংখ্যা-সম্পর্কিত সংস্থা ইউএনএফপিএর জরিপ মোতাবেক তা এখনো ১ দশমিক ৪২ শতাংশে রয়ে গেছে বলে বলা হচ্ছে। এ দেশের মোট প্রজনন হার সত্তরের দশকে ছিল ছয়, মানে একজন নারী তাঁর সারা জীবনে কজন সন্তানের জন্ম দেন, তারই একটা পরিমাপক এটা। এই হার কমে এখন ২ দশমিক ৩-এ দাঁড়িয়েছে, যা একটা সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু এখানেই রয়ে গেছে আমাদের বিপৎসংকেত। এই হারটাকে গত এক দশকে আর কমানো যায়নি, এটা ২ দশমিক ৩-এ স্থির রয়েছে। এটাকে ২-এর নিচে নামাতেই হবে, যদি আমরা জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হারকে ১ শতাংশে নামাতে চাই। এর অন্যথা হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে গতি রয়েছে, সেটা ২০৩০ সালের পরও এ দেশের জনসংখ্যাকে আরও বহুদিন বাড়াতেই থাকবে। (পপুলেশন মোমেন্টাম বজায় থাকার মূল কারণ শিশুদের সম্ভাব্য মা-বাবারা তো ৩০-৪০-৫০ বছর আগেই জন্ম নিয়েছেন। অতএব, তাঁরা এখন দু-তিনজন শিশুর জন্ম দিলেও অনেক মা-বাবার সন্তান জন্মদান চলবে আরও অনেক বছর ধরে।) এই হার কমাতে না পারার জন্য যে কয়েকটি বিষয়কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, সেগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাল্যবিবাহ, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান সবার ওপরে। মানে, এ দেশে বাল্যবিবাহের হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।
স্বাধীনতার পর ৪৪ বছর পার হয়ে এসে এখন বাংলাদেশ এমন একটা ক্রান্তিকালে উপনীত হয়েছে, যখন এ দেশকে নিয়ে হতাশার পরিবর্তে বিশ্বব্যাপী নানা ধরনের আশার বাণী উচ্চারিত হচ্ছে। এই আশাবাদের জন্য যে কয়েকটি ইতিবাচক বিষয়কে চমকপ্রদ সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেগুলো হলো: ১) ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও কৃষি খাতের প্রশংসনীয় গতিশীলতা, ২) রপ্তানি খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি, ৩) প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের দ্রুত প্রবৃদ্ধি, ৪) ক্ষুদ্রঋণের সাফল্যজনক বিস্তার ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধির কারণে দারিদ্র্য নিরসনে গতিসঞ্চার, ৫) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় এনরোলমেন্ট বৃদ্ধির পাশাপাশি জেন্ডার সমতা অর্জন, ৬) শিশুমৃত্যুর হারের প্রশংসনীয় অবনমন, ৭) স্যানিটেশন-ব্যবস্থার ব্যাপক অগ্রগতি, ৮) তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির প্রসারে চমকপ্রদ সাফল্য এবং ৯) নারীর ক্ষমতায়ন।
নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অগ্রগামী বলে কিছুদিন আগে ড. অমর্ত্য সেন ঢাকায় এক বক্তৃতায় আবারও প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করেছেন। এই সাফল্যের জন্য সরকারের যেমন কৃতিত্ব প্রাপ্য, তেমনি গ্রামীণ ব্যাংক, গণমাধ্যম, ব্র্যাকসহ অন্য এনজিওগুলোর ভূমিকারও প্রশংসা করতেই হবে। গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৭ লাখ নারী সদস্যকে প্রতি সপ্তাহের সভায় যে ‘ষোল সিদ্ধান্ত’ দলগতভাবে উচ্চারণ করতে হয়, তার মধ্যে পরিবার ছোট রাখার ও মেয়েকে বাল্যবিবাহ না দেওয়ার অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমার জানামতে, শত শত এনজিওর সচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রমে এ দুটি বিষয়কে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জনগণ ক্রমেই সংগঠিতভাবে এগিয়ে আসছে। কন্যাশিশুর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বাংলাদেশের সাফল্য বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমার অবাক লাগছে যে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও নারীর ক্ষমতায়নে নেতৃত্ব প্রদানকারী বর্তমান সরকার কেন নারীর বিয়ের বয়স ১৬ বছরে নামানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে, যতই তা ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ হোক? ১৬ বছর বয়সে কোনো কিশোরীর কি ক্ষমতা হবে মা-বাবা বিয়ে দিতে চাইলে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে? ১৬ বছরে বিয়ে হয়ে গেলে কজন মেয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে? ১৬ বছরে প্রকৃত বিচারে কজন কিশোরী শারীরিকভাবে মা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়? ১৬ বছরে বিয়ে হওয়া কোনো বধূ কি সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে নিজের পছন্দ-অপছন্দ প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে? ওপরের প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে গেলেই আশা করি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপলব্ধি করতে পারবেন যে তাঁরা ভুল করছেন।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ স্বল্পোন্নত দেশ, যেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বর্তমান পর্যায়ে প্রায় ১ হাজার ১২০ জনের বসবাস। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন-তত্ত্বে বর্ণিত দ্বিতীয় পর্যায়ে (আরলি এক্সপান্ডিং ফেজ) প্রবেশ করেছিল, যেটাকে জনগণের বোধগম্য ভাষায় ‘জনসংখ্যা বিস্ফোরণের পর্যায়’ বলে অভিহিত করা যায়। ওই পর্যায়ে জনসংখ্যা প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি হারে বেড়েছে এ দেশে। ফলে ১৯৪৭ সাল থেকে ২৫ বছরের কম সময়েই সত্তরের দশকের শুরুতে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’ আখ্যায়িত করার পেছনে কারণ ছিল, ওই সময়ের সাত কোটি মানুষকে আমরা খাদ্য জোগানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি। তখন বিশ্বব্যাপী বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে ওই জনসংখ্যা যখন পরবর্তী ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ১৫ কোটি ছাড়িয়ে যাবে, তখন ভূমি-দরিদ্র ঘনবসতির এ দেশে জনগণকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশ্বের জনগণের কাছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ধরনা দেওয়া ছাড়া আর কী উপায় থাকবে? (ওই সময় আমাদের খাদ্যশস্যের প্রয়োজন হতো দেড় কোটি টন, আর উৎপাদন হতো মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন।)
ওটা শুধু কিসিঞ্জারের ধারণা ছিল না, দুনিয়ার অনেক উন্নয়ন চিন্তাবিদের গবেষণায়ও একই রকম বিপদের আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল। একদল ম্যালথুসীয় ঘরানার তাত্ত্বিক তো বলেই বসল যে বাংলাদেশ একটা ‘পপুলেশন টাইম বোমার’ ওপর বসে রয়েছে। যখন বোমাটি ফাটবে, তখন এ দেশের দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণকে বাঁচানোর জন্য আগেভাগেই বিশ্বের ধনী দেশগুলোর পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। জনসংখ্যার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞানের বিকাশ আরও এগিয়ে যাওয়ার পর অবশ্য এ ধরনের আতঙ্কবাদী ভবিষ্যদ্বাণী দেওয়ার হিড়িক সাম্প্রতিক কালে কমেছে। বিশেষ করে ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন-তত্ত্বে উল্লিখিত চারটি পর্যায় যে ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বের সব দেশকেই পেরোতে হবে কিংবা হয়েছে, সেটা তথ্য-উপাত্তসহকারে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার পর জনসংখ্যা-তাত্ত্বিকদের মনোযোগ এখন নিবদ্ধ হয়েছে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দ্বিতীয় পর্যায় কীভাবে সংক্ষিপ্ত করে বিভিন্ন জনবহুল দেশ যথাসম্ভব দ্রুত তৃতীয় পর্যায়ের ‘লেট এক্সপান্ডিং ফেজ’-এ প্রবেশ করতে পারে, সে প্রয়াস জোরদার করা। এই তৃতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে মোট জন্মহার এবং মোট মৃত্যুহার উভয়ই দ্রুত কমে যায় বা যাবে, কিন্তু এ দুটি হারের পার্থক্য কমানোর মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দ্রুত কমিয়ে আনায় সাফল্য অর্জন করতে পারলে জনসংখ্যা নিয়ে আর আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কারণ থাকবে না। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জনসংখ্যাকে বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ ঘোষণা করার পর প্রায় এক দশকজুড়ে পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিরোধ নিয়ে বিদেশি দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর মাতামাতির ব্যাপারটা হয়তো এখনো অনেকের মনে আছে।
জনগণকে ‘এক নম্বর সমস্যা’ বিবেচনা করার দৃষ্টিভঙ্গি একটি নেতিবাচক মানসিকতার প্রতিফলন, যার বিরুদ্ধে একজন গবেষক হিসেবে আমার অবস্থান বরাবরই উচ্চকিত। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে যথাসম্ভব দ্রুত ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশনের চতুর্থ পর্যায়ে, মানে ‘স্থিতিশীল জনসংখ্যা’র স্তরে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্বকে আমরা কেউ অস্বীকার করি না। জনসংখ্যা বাড়ার হার দ্রুত কমাতে গণচীন জবরদস্তির পথ বেছে নিয়েছিল। তারা জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি নাটকীয়ভাবে কমিয়ে ফেলেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই জবরদস্তির কুফলগুলো পরিস্ফুট হতে শুরু করায় তারা ধীরে ধীরে ওই নীতি থেকে সরে আসছে। জবরদস্তির পথে না গিয়েও যে জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধিকে অতিদ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব, সেটা বিশ্বের সামনে প্রমাণ করেছে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। মানুষকে সুশিক্ষিত ও সচেতন করতে পারলে, সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা হলে, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা গেলে এবং পরিবার পরিকল্পনার সহায়তাকারী জন্মনিরোধ পদ্ধতিগুলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলে জনগণ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের পরিবারের আকার ছোট করতে উদ্বুদ্ধ হয়—এই সত্যটা প্রমাণিত হয়েছে উল্লিখিত তিনটি ক্ষেত্রে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কমবেশি সফলতা অর্জনকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এর বিপরীতে নাইজেরিয়া ও পাকিস্তান জনসংখ্যা বাড়ার হার তেমন কমাতে সক্ষম না হওয়ায় এ দুটি দেশের জনসংখ্যা বেড়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে।
আশির দশকেই বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশনের তৃতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করেছে এবং গত তিন দশকে জনসংখ্যার ব্যাপারে আমাদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। অবশ্য বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়ার হার এখন ১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে গেছে বলে সরকার দাবি করলেও জাতিসংঘের জনসংখ্যা-সম্পর্কিত সংস্থা ইউএনএফপিএর জরিপ মোতাবেক তা এখনো ১ দশমিক ৪২ শতাংশে রয়ে গেছে বলে বলা হচ্ছে। এ দেশের মোট প্রজনন হার সত্তরের দশকে ছিল ছয়, মানে একজন নারী তাঁর সারা জীবনে কজন সন্তানের জন্ম দেন, তারই একটা পরিমাপক এটা। এই হার কমে এখন ২ দশমিক ৩-এ দাঁড়িয়েছে, যা একটা সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু এখানেই রয়ে গেছে আমাদের বিপৎসংকেত। এই হারটাকে গত এক দশকে আর কমানো যায়নি, এটা ২ দশমিক ৩-এ স্থির রয়েছে। এটাকে ২-এর নিচে নামাতেই হবে, যদি আমরা জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হারকে ১ শতাংশে নামাতে চাই। এর অন্যথা হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে গতি রয়েছে, সেটা ২০৩০ সালের পরও এ দেশের জনসংখ্যাকে আরও বহুদিন বাড়াতেই থাকবে। (পপুলেশন মোমেন্টাম বজায় থাকার মূল কারণ শিশুদের সম্ভাব্য মা-বাবারা তো ৩০-৪০-৫০ বছর আগেই জন্ম নিয়েছেন। অতএব, তাঁরা এখন দু-তিনজন শিশুর জন্ম দিলেও অনেক মা-বাবার সন্তান জন্মদান চলবে আরও অনেক বছর ধরে।) এই হার কমাতে না পারার জন্য যে কয়েকটি বিষয়কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, সেগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাল্যবিবাহ, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান সবার ওপরে। মানে, এ দেশে বাল্যবিবাহের হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।
স্বাধীনতার পর ৪৪ বছর পার হয়ে এসে এখন বাংলাদেশ এমন একটা ক্রান্তিকালে উপনীত হয়েছে, যখন এ দেশকে নিয়ে হতাশার পরিবর্তে বিশ্বব্যাপী নানা ধরনের আশার বাণী উচ্চারিত হচ্ছে। এই আশাবাদের জন্য যে কয়েকটি ইতিবাচক বিষয়কে চমকপ্রদ সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেগুলো হলো: ১) ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও কৃষি খাতের প্রশংসনীয় গতিশীলতা, ২) রপ্তানি খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি, ৩) প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের দ্রুত প্রবৃদ্ধি, ৪) ক্ষুদ্রঋণের সাফল্যজনক বিস্তার ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধির কারণে দারিদ্র্য নিরসনে গতিসঞ্চার, ৫) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় এনরোলমেন্ট বৃদ্ধির পাশাপাশি জেন্ডার সমতা অর্জন, ৬) শিশুমৃত্যুর হারের প্রশংসনীয় অবনমন, ৭) স্যানিটেশন-ব্যবস্থার ব্যাপক অগ্রগতি, ৮) তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির প্রসারে চমকপ্রদ সাফল্য এবং ৯) নারীর ক্ষমতায়ন।
নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অগ্রগামী বলে কিছুদিন আগে ড. অমর্ত্য সেন ঢাকায় এক বক্তৃতায় আবারও প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করেছেন। এই সাফল্যের জন্য সরকারের যেমন কৃতিত্ব প্রাপ্য, তেমনি গ্রামীণ ব্যাংক, গণমাধ্যম, ব্র্যাকসহ অন্য এনজিওগুলোর ভূমিকারও প্রশংসা করতেই হবে। গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৭ লাখ নারী সদস্যকে প্রতি সপ্তাহের সভায় যে ‘ষোল সিদ্ধান্ত’ দলগতভাবে উচ্চারণ করতে হয়, তার মধ্যে পরিবার ছোট রাখার ও মেয়েকে বাল্যবিবাহ না দেওয়ার অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমার জানামতে, শত শত এনজিওর সচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রমে এ দুটি বিষয়কে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জনগণ ক্রমেই সংগঠিতভাবে এগিয়ে আসছে। কন্যাশিশুর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বাংলাদেশের সাফল্য বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমার অবাক লাগছে যে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও নারীর ক্ষমতায়নে নেতৃত্ব প্রদানকারী বর্তমান সরকার কেন নারীর বিয়ের বয়স ১৬ বছরে নামানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে, যতই তা ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ হোক? ১৬ বছর বয়সে কোনো কিশোরীর কি ক্ষমতা হবে মা-বাবা বিয়ে দিতে চাইলে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে? ১৬ বছরে বিয়ে হয়ে গেলে কজন মেয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে? ১৬ বছরে প্রকৃত বিচারে কজন কিশোরী শারীরিকভাবে মা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়? ১৬ বছরে বিয়ে হওয়া কোনো বধূ কি সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে নিজের পছন্দ-অপছন্দ প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে? ওপরের প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে গেলেই আশা করি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপলব্ধি করতে পারবেন যে তাঁরা ভুল করছেন।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments