রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অধীনে জাতীয় সরকার এবং সংবিধান by ইকতেদার আহমেদ
বাংলাদেশের
সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ
ভোটে নির্বাচিত হন। অপর দিকে যে সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের
আস্থাভাজন মর্মে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তিনি
প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ লাভ করেন। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বা
প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হলেও তাদের উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা
পর্যন্ত তারা নিজ নিজ পদে বহাল থাকেন। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী চার কারণে
রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হতে পারে। এ চারটি কারণের প্রথমটি হলো মেয়াদ অবসানের
কারণে পদ শূন্য হওয়া, আর অপর তিনটি হলো মৃত্যু, পদত্যাগ বা অপসারণের কারণে
পদ শূন্য হওয়া।
প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হওয়া বিষয়ে সংবিধানে যে বিধানাবলি রয়েছে তাতে উল্লেখ আছে- প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হবে যদি তিনি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগপত্র দেন অথবা তিনি সংসদ সদস্য না থাকেন। তা ছাড়া সংবিধানে উল্লেখ আছে, প্রধানমন্ত্রী সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে পদত্যাগ করবেন কিংবা সংসদ ভেঙে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে লিখিতভাবে পরামর্শ দেবেন। এরূপ পরামর্শের ক্ষেত্রে অন্য কোনো সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন নন এ মর্মে রাষ্ট্রপতি সন্তুষ্ট হলে তিনি সংসদ ভেঙে দেবেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যিনি নিয়োগ লাভ করেন তিনি একজন সংসদ সদস্য। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হবে যদি (ক) তার নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ হতে ৯০ দিনের মধ্যে তিনি তৃতীয় তফসিলের নির্ধারিত শপথ নিতে ও শপথপত্রে স্বাক্ষর দিতে অসমর্থ হন; (খ) সংসদের অনুমতি না নিয়ে তিনি একাদিক্রমে ৯০ বৈঠক দিবস অনুপস্থিত থাকেন; (গ) যদি সংসদ ভেঙে যায়; (ঘ) তিনি সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন অযোগ্য হয়ে যান অথবা (ঙ) এ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
উপর্যুক্ত কারণ ছাড়াও একজন সংসদ সদস্য স্পিকারের কাছে স্বাক্ষরয্ক্তু পত্রযোগে নিজে পদত্যাগ করতে পারেন এবং এরূপ ক্ষেত্রে স্পিকার যে তারিখে পত্র পাবেন ওই তারিখ থেকে পদত্যাগী সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হয়ে যায়।
উপর্যুক্ত বিধানে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন অযোগ্য হওয়া অথবা ৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া বিষয়ের উল্লেখ থাকায় উভয় অনুচ্ছেদের বিধানাবলি অবলোকন অত্যাবশ্যক। অনুচ্ছেদ ৬৬(২) এ উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবেন না যদি (ক) কোনো উপযুক্ত আদালত তাকে অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা করেন; (খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি লাভ না করে থাকেন; (গ) তিনি কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন; (ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দু’বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তি লাভের পর পাঁচ বছরকাল অতিবাহিত না হয়ে থাকে; (ঙ) তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হয়ে থাকেন; (চ) আইনের মাধ্যমে পদধারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না, এমন পদ ছাড়া তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন অথবা (ছ) তিনি কোনো আইনের অধীন অনুরূপ নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হন।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৭০ রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার কারণে আসন শূন্য হওয়া সংক্রান্ত। এ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে।
রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর পদ অথবা একজন সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হওয়া বিষয়ে সংবিধানে যেসব বিধান উল্লেখ রয়েছে তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মৃত্যুর কারণে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হওয়ার বিষয় সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও একই কারণে প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের পদ বা আসন শূন্য হবে কি না সে বিষয়ে সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। যদিও ইতঃপূর্বে সংসদ সদস্যের মৃত্যু হওয়া-পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শূন্য পদ পূরণের অসংখ্য নজির রয়েছে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা বহাল থাকা আস্থায় এ পর্যন্ত কোনো প্রধামন্ত্রীর পদে বহাল থাকাকালীন মৃত্যু হয়নি। মৃত্যু-পরবর্তী কে প্রধানমন্ত্রী হবেন এ বিষয়ে সংবিধান নিশ্চুপ থাকলেও এরূপ ক্ষেত্রে যিনি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন তাকে যে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন, এ প্রশ্নে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই।
আমাদের দেশ বর্তমানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এ ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান। আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে যেরূপ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এরূপ ক্ষমতা সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা অনুসৃত হয়, এমন অন্য কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীর নেই। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে যত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এর প্রতিটিতে ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হওয়ার কারণে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় না, দেশের সাধারণ জনমানুষের মধ্যে এমন বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে। এ ধারণার কারণেই দেখা যায়, মেয়াদ অবসান বা মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে কোন ধরনের সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এ প্রশ্নে বড় দু’টি দল দ্বিধাবিভক্ত।
বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দাবি সূত্রেই একসময় আমাদের দেশে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার চালু করা হয়েছিল। এরপর আওয়ামী লীগ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে একতরফাভাবে এ ব্যবস্থাটির অবসান ঘটিয়ে দলীয় সরকারের অধীন সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। নবপ্রবর্তিত ব্যবস্থায় একটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশের প্রধান বিরোধী দল, এর জোটভুক্ত অপরাপর দল এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র দলের বর্জনের মুখে এ নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এ নির্বাচনটিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের জন্য উন্মুক্ত আসনের অর্ধেকেরও বেশি প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। অবশিষ্ট যেসব আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে ভোটার উপস্থিতি এত নগণ্য ছিল যে গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে এগুলোকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলার অবকাশ নেই। দেশে-বিদেশে সব মহল এমনটিই বলেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে এর মূলে রয়েছে নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি কী হবে সে প্রশ্নে বড় দু’টি দলের বিপরীতমুখী অবস্থান। এ বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে এক দিকে দেশের স্থিতিশীলতা ক্ষুণœ হচ্ছে, অপর দিকে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের সচেতন মানুষ যেমন উদ্বিগ্ন, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রও উদ্বিগ্ন। এ বাস্তবতায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশবাসীর সামনে বর্তমানে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব রয়েছে। এর প্রথমোক্তটি হলো রাষ্ট্রপতির অধীন জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা। দ্বিতীয়টি হলো প্রধানমন্ত্রীর অধীন জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা। আর শেষোক্তটি হলো জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে প্রধানমন্ত্রীর অধীন জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা। এ বিকল্প প্রস্তাবগুলোর কূটনৈতিক সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্মুখে উপস্থাপন করা হলে আওয়ামী লীগ অদ্যাবধি তাদের মতামত ব্যক্ত করেনি, যদিও তিনটি বিকল্পের প্রথমোক্ত ও শেষোক্তটি বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য দলটির একাধিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এমন মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একাধিক নেতা উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রপতির অধীন জাতীয় সরকার গঠনের কোনো বিধান সংবিধানে না থাকায় এরূপ সরকার গঠন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ প্রশ্নে দেশের সচেতন জনমানুষের অভিমত সংবিধানে কী আছে বা নেই তার চেয়ে বড় কথা দেশের সাধারণ জনমানুষের অভিপ্রায় বা আকাক্সক্ষা কী বা তারা কী চায়। প্রণিধানযোগ্য, ’৯০-এর গণ-আন্দোলনপরবর্তী কর্মরত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান করে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছিল তা সংবিধানসম্মত ছিল না। পঞ্চম সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ অস্থায়ী ব্যবস্থাটিকে বৈধতা দেয়া হয়। অনুরূপ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন যে নবম সংসদ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়, সে সরকারও সংবিধান সম্মতভাবে গঠন করা হয়নি। সে সরকারটিকে আজ পর্যন্ত সংসদের মাধ্যমে অনুমোদনও দেয়া হয়নি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলসংক্রান্ত মামলার আপিলের রায় দেয়ার সময় যদিও প্রসঙ্গক্রমে মামলার বিষয়বস্তু না হওয়া সত্ত্বেও অপ্রাসঙ্গিকভাবে এ সরকারটির কার্যক্রমকে বৈধতা দেয়া হয়েছে, কিন্তু সংসদের বৈধতার অনুপস্থিতিতে সে বৈধতা কতটুকু সিদ্ধ, এ প্রশ্নটির সন্তোষজনক সুরাহা প্রয়োজন।
আমাদের সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের কিছু বিষয় সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সে গণভোটব্যবস্থা রহিত করা হয়। সংবিধানবহির্ভূত যেকোনো বিষয়ে গণভোট আয়োজনে সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে কোনো বিধিনিষেধ নেই। ইতঃপূর্বে আমাদের দেশে জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি রাষ্ট্রপতি হিসেবে জনগণের আস্থা আছে কি না এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে কর্মরত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি আস্থা যাচনা করে তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ তিনটি গণভোট সংবিধান ও দেশের আইন দিয়ে সমর্থিত না হলেও দেশের জনগণের সমর্থন ও সম্মতির মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। এ তিনটি গণভোটে প্রদত্ত ভোটের হার বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও জনগণের কাছে এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে বিতর্ক নেই। আমাদের আগামী সংসদ নির্বাচন রাষ্ট্রপতি না প্রধানমন্ত্রীর অধীন জাতীয় সরকার দিয়ে অথবা জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে জাতীয় সরকার দিয়ে অনুষ্ঠান প্রশ্নে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের আকাক্সক্ষা বা অভিপ্রায় জানতে চাওয়া হলে তা কোনোভাবেই সংবিধান বা আইনের পরিপন্থী হবে না, বরং দেশের স্থিতিশীলতার সপক্ষে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হওয়া বিষয়ে সংবিধানে যে বিধানাবলি রয়েছে তাতে উল্লেখ আছে- প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হবে যদি তিনি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগপত্র দেন অথবা তিনি সংসদ সদস্য না থাকেন। তা ছাড়া সংবিধানে উল্লেখ আছে, প্রধানমন্ত্রী সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে পদত্যাগ করবেন কিংবা সংসদ ভেঙে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে লিখিতভাবে পরামর্শ দেবেন। এরূপ পরামর্শের ক্ষেত্রে অন্য কোনো সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন নন এ মর্মে রাষ্ট্রপতি সন্তুষ্ট হলে তিনি সংসদ ভেঙে দেবেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যিনি নিয়োগ লাভ করেন তিনি একজন সংসদ সদস্য। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হবে যদি (ক) তার নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ হতে ৯০ দিনের মধ্যে তিনি তৃতীয় তফসিলের নির্ধারিত শপথ নিতে ও শপথপত্রে স্বাক্ষর দিতে অসমর্থ হন; (খ) সংসদের অনুমতি না নিয়ে তিনি একাদিক্রমে ৯০ বৈঠক দিবস অনুপস্থিত থাকেন; (গ) যদি সংসদ ভেঙে যায়; (ঘ) তিনি সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন অযোগ্য হয়ে যান অথবা (ঙ) এ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
উপর্যুক্ত কারণ ছাড়াও একজন সংসদ সদস্য স্পিকারের কাছে স্বাক্ষরয্ক্তু পত্রযোগে নিজে পদত্যাগ করতে পারেন এবং এরূপ ক্ষেত্রে স্পিকার যে তারিখে পত্র পাবেন ওই তারিখ থেকে পদত্যাগী সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হয়ে যায়।
উপর্যুক্ত বিধানে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন অযোগ্য হওয়া অথবা ৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া বিষয়ের উল্লেখ থাকায় উভয় অনুচ্ছেদের বিধানাবলি অবলোকন অত্যাবশ্যক। অনুচ্ছেদ ৬৬(২) এ উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবেন না যদি (ক) কোনো উপযুক্ত আদালত তাকে অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা করেন; (খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি লাভ না করে থাকেন; (গ) তিনি কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন; (ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দু’বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তি লাভের পর পাঁচ বছরকাল অতিবাহিত না হয়ে থাকে; (ঙ) তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হয়ে থাকেন; (চ) আইনের মাধ্যমে পদধারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না, এমন পদ ছাড়া তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন অথবা (ছ) তিনি কোনো আইনের অধীন অনুরূপ নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হন।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৭০ রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার কারণে আসন শূন্য হওয়া সংক্রান্ত। এ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে।
রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর পদ অথবা একজন সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হওয়া বিষয়ে সংবিধানে যেসব বিধান উল্লেখ রয়েছে তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মৃত্যুর কারণে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হওয়ার বিষয় সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও একই কারণে প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের পদ বা আসন শূন্য হবে কি না সে বিষয়ে সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। যদিও ইতঃপূর্বে সংসদ সদস্যের মৃত্যু হওয়া-পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শূন্য পদ পূরণের অসংখ্য নজির রয়েছে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা বহাল থাকা আস্থায় এ পর্যন্ত কোনো প্রধামন্ত্রীর পদে বহাল থাকাকালীন মৃত্যু হয়নি। মৃত্যু-পরবর্তী কে প্রধানমন্ত্রী হবেন এ বিষয়ে সংবিধান নিশ্চুপ থাকলেও এরূপ ক্ষেত্রে যিনি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন তাকে যে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন, এ প্রশ্নে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই।
আমাদের দেশ বর্তমানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এ ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান। আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে যেরূপ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এরূপ ক্ষমতা সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা অনুসৃত হয়, এমন অন্য কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীর নেই। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে যত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এর প্রতিটিতে ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হওয়ার কারণে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় না, দেশের সাধারণ জনমানুষের মধ্যে এমন বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে। এ ধারণার কারণেই দেখা যায়, মেয়াদ অবসান বা মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে কোন ধরনের সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এ প্রশ্নে বড় দু’টি দল দ্বিধাবিভক্ত।
বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দাবি সূত্রেই একসময় আমাদের দেশে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার চালু করা হয়েছিল। এরপর আওয়ামী লীগ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে একতরফাভাবে এ ব্যবস্থাটির অবসান ঘটিয়ে দলীয় সরকারের অধীন সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। নবপ্রবর্তিত ব্যবস্থায় একটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশের প্রধান বিরোধী দল, এর জোটভুক্ত অপরাপর দল এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র দলের বর্জনের মুখে এ নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এ নির্বাচনটিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের জন্য উন্মুক্ত আসনের অর্ধেকেরও বেশি প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। অবশিষ্ট যেসব আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে ভোটার উপস্থিতি এত নগণ্য ছিল যে গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে এগুলোকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলার অবকাশ নেই। দেশে-বিদেশে সব মহল এমনটিই বলেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে এর মূলে রয়েছে নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি কী হবে সে প্রশ্নে বড় দু’টি দলের বিপরীতমুখী অবস্থান। এ বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে এক দিকে দেশের স্থিতিশীলতা ক্ষুণœ হচ্ছে, অপর দিকে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের সচেতন মানুষ যেমন উদ্বিগ্ন, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রও উদ্বিগ্ন। এ বাস্তবতায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশবাসীর সামনে বর্তমানে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব রয়েছে। এর প্রথমোক্তটি হলো রাষ্ট্রপতির অধীন জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা। দ্বিতীয়টি হলো প্রধানমন্ত্রীর অধীন জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা। আর শেষোক্তটি হলো জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে প্রধানমন্ত্রীর অধীন জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা। এ বিকল্প প্রস্তাবগুলোর কূটনৈতিক সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্মুখে উপস্থাপন করা হলে আওয়ামী লীগ অদ্যাবধি তাদের মতামত ব্যক্ত করেনি, যদিও তিনটি বিকল্পের প্রথমোক্ত ও শেষোক্তটি বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য দলটির একাধিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এমন মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একাধিক নেতা উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রপতির অধীন জাতীয় সরকার গঠনের কোনো বিধান সংবিধানে না থাকায় এরূপ সরকার গঠন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ প্রশ্নে দেশের সচেতন জনমানুষের অভিমত সংবিধানে কী আছে বা নেই তার চেয়ে বড় কথা দেশের সাধারণ জনমানুষের অভিপ্রায় বা আকাক্সক্ষা কী বা তারা কী চায়। প্রণিধানযোগ্য, ’৯০-এর গণ-আন্দোলনপরবর্তী কর্মরত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান করে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছিল তা সংবিধানসম্মত ছিল না। পঞ্চম সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ অস্থায়ী ব্যবস্থাটিকে বৈধতা দেয়া হয়। অনুরূপ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন যে নবম সংসদ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়, সে সরকারও সংবিধান সম্মতভাবে গঠন করা হয়নি। সে সরকারটিকে আজ পর্যন্ত সংসদের মাধ্যমে অনুমোদনও দেয়া হয়নি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলসংক্রান্ত মামলার আপিলের রায় দেয়ার সময় যদিও প্রসঙ্গক্রমে মামলার বিষয়বস্তু না হওয়া সত্ত্বেও অপ্রাসঙ্গিকভাবে এ সরকারটির কার্যক্রমকে বৈধতা দেয়া হয়েছে, কিন্তু সংসদের বৈধতার অনুপস্থিতিতে সে বৈধতা কতটুকু সিদ্ধ, এ প্রশ্নটির সন্তোষজনক সুরাহা প্রয়োজন।
আমাদের সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের কিছু বিষয় সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সে গণভোটব্যবস্থা রহিত করা হয়। সংবিধানবহির্ভূত যেকোনো বিষয়ে গণভোট আয়োজনে সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে কোনো বিধিনিষেধ নেই। ইতঃপূর্বে আমাদের দেশে জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি রাষ্ট্রপতি হিসেবে জনগণের আস্থা আছে কি না এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে কর্মরত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি আস্থা যাচনা করে তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ তিনটি গণভোট সংবিধান ও দেশের আইন দিয়ে সমর্থিত না হলেও দেশের জনগণের সমর্থন ও সম্মতির মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। এ তিনটি গণভোটে প্রদত্ত ভোটের হার বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও জনগণের কাছে এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে বিতর্ক নেই। আমাদের আগামী সংসদ নির্বাচন রাষ্ট্রপতি না প্রধানমন্ত্রীর অধীন জাতীয় সরকার দিয়ে অথবা জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে জাতীয় সরকার দিয়ে অনুষ্ঠান প্রশ্নে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের আকাক্সক্ষা বা অভিপ্রায় জানতে চাওয়া হলে তা কোনোভাবেই সংবিধান বা আইনের পরিপন্থী হবে না, বরং দেশের স্থিতিশীলতার সপক্ষে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
ইকতেদার আহমেদ |
বাংলাদেশ
রাষ্ট্রটি বাংলা ভাষাভাষী একটি জাতির সমন্বয়ে বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত।
রাষ্ট্র গঠনে একই জাতির সমরূপতা একটি বিরল বিষয়। এরূপ দেশ ও জাতি দ্রুত
সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে শুধু রাজনৈতিক
অস্থিতিশীলতা এ বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। আমাদের দেশের জনগণ এসব
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে পরিত্রাণ চায়। আর তাই অতিসত্বর সংসদ
নির্বাচনের ব্যবস্থা করে কী ধরনের জাতীয় সরকারের অধীন যে সংসদ নির্বাচন এবং
পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সে বিষয়ে সমঝোতায় উপনীত হওয়া জরুরি। এ
বিষয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মনোভাব ইতিবাচক বলে সরকারের মনোভাবও
ইতিবাচক হবে এমন প্রত্যাশা পূরণ হলে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির অগ্রযাত্রাকে
কোনো অশুভ শক্তি ব্যাহত করতে পারবে না।
লেখক : সাবেক জজ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com
লেখক : সাবেক জজ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com
No comments