হারিয়ে যাওয়া মানুষ যায় কোথায়? by কাজী সুমন
১০ই
মার্চ রাত ১০টা। উত্তরার একটি বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বিএনপির যুগ্ম
মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে। তার পরিবারের দাবি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
সদস্যরাই নিয়ে গেছে তাকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনাও তাই। এরপর এখন পর্যন্ত
হদিস মিলেনি তার। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে এভাবে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন বহু
মানুষ। গত ৫ বছরে নিখোঁজ হয়েছেন শতাধিক। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ তাদের
এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত দুই মাসে সারা দেশে ২১ জন মানুষ গুম
হয়েছেন। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ১৪ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে নিখোঁজ হয়েছেন ৭ জন।
ওদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, গত দুই মাসে বিরোধী জোটের ৩৬ জন
নেতাকর্মী গুম হয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। কয়েকজনকে
আদালতে হাজির করা হয়েছে। বাকি ১৮ জন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। এর আগে ২০১৩ সালে
সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন বিরোধী জোটের ৬৫ জন নেতাকর্মী গুম হয়েছেন বলে
অভিযোগ করেছিল বিএনপি। সবগুলো গুমের ঘটনার ধরন ছিল একই। আইনশৃঙ্খলা
বাহিনীর পরিচয়ে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাদের আর কোন খোঁজ মেলেনি।
তবে ভাগ্যক্রমে নিখোঁজের সাড়ে তিন মাস পর সিলেটের যুক্তরাজ্য প্রবাসী নেতা
মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজন ছাত্রদল নেতাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এভাবে মানুষ
নিখোঁজের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মানবাধিকার
সংগঠন। নিখোঁজ হওয়াদের উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন কোন
তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি।
এ ব্যাপারে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর নির্বাহী পরিচালক নাসিরউদ্দিন এলান মানবজমিনকে বলেন, প্রতি মাসেই মানুষ নিখোঁজ হচ্ছে। আমরা এই তালিকা প্রকাশ করছি। কিন্তু এ ধরনের জলজ্যান্ত মানুষ হারিয়ে যাওয়া খুবই উদ্বেগজনক এবং অগ্রহণযোগ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি মানুষগুলোকে না নিয়ে থাকে তাহলে তো খুঁজে বের করার দায়িত্ব তাদের। সে যে দলেরই হোক কিংবা যে মতেরই হোক। এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য খারাপ ফল বয়ে আনবে। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে মানুষ নিখোঁজ হচ্ছে। আমরা এসব ঘটনায় উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়ে আসছি। কিন্তু এসব মানুষ নিখোঁজের পর সরকারের উচ্চ মহল থেকে যে ধরনের কথাবার্তা বলা হচ্ছে, এতে যারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছেন তারা আরও উৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে এ ধরনের ঘটনা না কমে ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতিবিদদের গুমের সংস্কৃতি শুরু হয়। ২০১৩ সালের শেষদিকে তা উদ্বেগজনকহারে বেড়ে যায়। চলতি বছরের শুরুতেই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেয় বিরোধী জোট। ফের শুরু হয় গুমের ঘটনা। গত ৫ই জানুয়ারি পুলিশ পরিচয়ে হাফিজুর রহমান (৪০) ও সাগর আলী (২৫) নামে দুজনকে আটক করা হয়। এরপর থেকে তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ৯ই জানুয়ারি কবি নজরুল সরকারি কলেজের ছাত্রদল নেতা জসিমউদ্দিন, সুজন চন্দ্র দাস, রোমান আহমেদ, কেএম নজরুল হাসান ও ইরফান আহমেদ ওরফে ফাহিমকে ডিবি পরিচয়ে আটক করা হয়। চারদিন পর তাদের মিরপুর থানায় একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। ১৫ই জানুয়ারি দুপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকের কয়েকজন লোক চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কল্যাণপুর স্কুল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে মতিউর রহমান, মোজাম্মেল হোসেন মোজা, মো. আবু তাহের শিশির, শ্যামল কুমারসহ ৫ জনকে। এরমধ্যে মতিউর রহমানকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। ৮ দিন পর ককটেলসহ মোজাম্মেল হোসেন মোজা, মো. শিশিরসহ চারজনকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। ১০ই ফেব্রুয়ারি বিএনপির সমর্থক আইনজীবী সোহেল রানা বন্ধু রিংকুসহ নিখোঁজ হন। উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টর থেকে তাদের তুলে নিয়ে যায় ১০-১২ জন যুবক। এরপর রিংকুকে ছেড়ে দিলেও এখনও হদিস মেলেনি সোহেল রানার। গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের বোনের ছেলে মাজেদুর রশীদ (৪৫) কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। এরপর কয়েকদফা সংবাদ সম্মেলন করে মাজেদুরকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান তার স্ত্রী। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার কোন হদিস মেলেনি। গত ২২শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে বসুন্ধরার এক বাসা থেকে বনানী থানা বিএনপির নেতা ও জিয়া পরিষদ ঢাকা মহানগরের আহ্বায়ক এডভোকেট রেজাউর রহমান ফাহিমকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় এক মাস পার হলেও এখনও পর্যন্ত তার কোন হদিস পাচ্ছে না পরিবার। বিভিন্ন থানা, ডিবি অফিস ও র্যাব তাকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাতে গুলশানের বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আটক করা হয় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে। ২১ ঘণ্টা পর ধানমন্ডি থেকে আটক দেখিয়ে তাকে গুলশান থানায় হস্তান্তর করা হয়। ২৬শে ফেব্রুয়ারি দুপুর সোয়া দুইটার দিকে যমুনা ফিউচার পার্কের দ্বিতীয়তলা থেকে ছাত্রদল তিতুমীর কলেজ শাখার কর্মী মেহেদী হাসান রুয়েলকে আটক করে সাদা পোশাকধারী পুলিশ। এ সময় তার সঙ্গে একই কলেজের শুভ নামে আরেক ছাত্রকেও আটক করা হয়। কিন্তু শুভকে এয়ারপোর্ট এলাকায় ছেড়ে দেয়া হলেও খোঁজ মেলেনি মেহেদী হাসানের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে মেহেদীকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। গত ৬ই মার্চ রাজধানীর শুক্রাবাদ এলাকা থেকে ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। এখন পর্যন্ত তার কোন হদিস পায়নি পরিবার।
এর আগে গুমের প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০১০ সালের ২৫শে জুন। ওই দিন রাতে রাজধানীর ইন্দিরা রোড থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬নং ওয়ার্ড কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমকে সাদা পোশাকের কিছু লোক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যায়। এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছরেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ২০১২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে ফেরার পথে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র আল-মোকাদ্দেস ও ওয়ালিউল্লাহকে হানিফ এন্টারপ্রাইজের গাড়ি থেকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। ওই বছরের ১লা এপ্রিল রাজধানীর উত্তরা থেকে র্যাব পরিচয় তুলে নিয়ে যায় সিলেট জেলা ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক ইফতেখার আহমদ দিনারকে। ২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল গুমের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটে। ওই দিন রাত সোয়া ১২টার দিকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সিলেট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী ও তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক মো. আনসার আলীকে। নিজের বাসায় ফেরার পথে বনানীর ২ নম্বর সড়ক থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তাদের তুলে নিয়ে যায়। ২০১৩ সালের ২৭শে নভেম্বর কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। ওই বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে রাজধানী থেকে গুম হন সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি খালেদ হাসান সোহেল, বংশাল থানা ছাত্রদলের সহসভাপতি মো. সোহেল, বিএনপি নেতা মো. হোসেন চঞ্চল, বংশাল ৭১নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মো. পারভেজ, একই ওয়ার্ডের ছাত্রদল নেতা মো. জহির, ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন, একই ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা তানভীর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল নেতা আসাদুজ্জামান রানা, মাজহারুল ইসলাম রাসেল ও আল আমিন, তেজগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা কাউসার ও এসএম আদনান চৌধুরী, তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক মো. তরিকুল ইসলাম, সবুজবাগ থানা ছাত্রদল সভাপতি মাহবুব হাসান সুজন, একই থানার ছাত্রদল নেতা ফরহাদ হোসেন, মুন্সীগঞ্জ কে কে গভর্মেন্ট হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র কামরুল হাসান কনক, সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টু, ৫৭নং ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক সোহেল ও রানা। গত বছরের ৪ঠা মে সুনামগঞ্জ শহীদ মিনারে এক অনশন শেষে সিলেট ফেরার পথে টুকেরবাজার এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সুনামগঞ্জের বাসিন্দা ও যুক্তরাজ্য যুবদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রবাসী মুজিবুর রহমানকে গাড়িচালকসহ তুলে নিয়ে যায়। সৌভাগ্যবশত পরে তাদের খোঁজ মিলে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি- বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা আহসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিকীও সৌভাগ্যবান। নিখোঁজের পর তাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনের অবশ্য তেমন সৌভাগ্য হয়নি। নিখোঁজের পর তাদের লাশ পাওয়া যায় নদীতে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনেও বলেছেন, গুমের ঘটনাগুলো তদন্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আর প্রায় সব গুমের ক্ষেত্রেই অভিযোগ উঠেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে। এখন সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে প্রশ্নটি- হারিয়ে যাওয়া মানুষ যায় কোথায়?
এ ব্যাপারে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর নির্বাহী পরিচালক নাসিরউদ্দিন এলান মানবজমিনকে বলেন, প্রতি মাসেই মানুষ নিখোঁজ হচ্ছে। আমরা এই তালিকা প্রকাশ করছি। কিন্তু এ ধরনের জলজ্যান্ত মানুষ হারিয়ে যাওয়া খুবই উদ্বেগজনক এবং অগ্রহণযোগ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি মানুষগুলোকে না নিয়ে থাকে তাহলে তো খুঁজে বের করার দায়িত্ব তাদের। সে যে দলেরই হোক কিংবা যে মতেরই হোক। এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য খারাপ ফল বয়ে আনবে। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে মানুষ নিখোঁজ হচ্ছে। আমরা এসব ঘটনায় উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়ে আসছি। কিন্তু এসব মানুষ নিখোঁজের পর সরকারের উচ্চ মহল থেকে যে ধরনের কথাবার্তা বলা হচ্ছে, এতে যারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছেন তারা আরও উৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে এ ধরনের ঘটনা না কমে ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতিবিদদের গুমের সংস্কৃতি শুরু হয়। ২০১৩ সালের শেষদিকে তা উদ্বেগজনকহারে বেড়ে যায়। চলতি বছরের শুরুতেই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেয় বিরোধী জোট। ফের শুরু হয় গুমের ঘটনা। গত ৫ই জানুয়ারি পুলিশ পরিচয়ে হাফিজুর রহমান (৪০) ও সাগর আলী (২৫) নামে দুজনকে আটক করা হয়। এরপর থেকে তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ৯ই জানুয়ারি কবি নজরুল সরকারি কলেজের ছাত্রদল নেতা জসিমউদ্দিন, সুজন চন্দ্র দাস, রোমান আহমেদ, কেএম নজরুল হাসান ও ইরফান আহমেদ ওরফে ফাহিমকে ডিবি পরিচয়ে আটক করা হয়। চারদিন পর তাদের মিরপুর থানায় একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। ১৫ই জানুয়ারি দুপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকের কয়েকজন লোক চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কল্যাণপুর স্কুল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে মতিউর রহমান, মোজাম্মেল হোসেন মোজা, মো. আবু তাহের শিশির, শ্যামল কুমারসহ ৫ জনকে। এরমধ্যে মতিউর রহমানকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। ৮ দিন পর ককটেলসহ মোজাম্মেল হোসেন মোজা, মো. শিশিরসহ চারজনকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। ১০ই ফেব্রুয়ারি বিএনপির সমর্থক আইনজীবী সোহেল রানা বন্ধু রিংকুসহ নিখোঁজ হন। উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টর থেকে তাদের তুলে নিয়ে যায় ১০-১২ জন যুবক। এরপর রিংকুকে ছেড়ে দিলেও এখনও হদিস মেলেনি সোহেল রানার। গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের বোনের ছেলে মাজেদুর রশীদ (৪৫) কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। এরপর কয়েকদফা সংবাদ সম্মেলন করে মাজেদুরকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান তার স্ত্রী। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার কোন হদিস মেলেনি। গত ২২শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে বসুন্ধরার এক বাসা থেকে বনানী থানা বিএনপির নেতা ও জিয়া পরিষদ ঢাকা মহানগরের আহ্বায়ক এডভোকেট রেজাউর রহমান ফাহিমকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় এক মাস পার হলেও এখনও পর্যন্ত তার কোন হদিস পাচ্ছে না পরিবার। বিভিন্ন থানা, ডিবি অফিস ও র্যাব তাকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাতে গুলশানের বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আটক করা হয় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে। ২১ ঘণ্টা পর ধানমন্ডি থেকে আটক দেখিয়ে তাকে গুলশান থানায় হস্তান্তর করা হয়। ২৬শে ফেব্রুয়ারি দুপুর সোয়া দুইটার দিকে যমুনা ফিউচার পার্কের দ্বিতীয়তলা থেকে ছাত্রদল তিতুমীর কলেজ শাখার কর্মী মেহেদী হাসান রুয়েলকে আটক করে সাদা পোশাকধারী পুলিশ। এ সময় তার সঙ্গে একই কলেজের শুভ নামে আরেক ছাত্রকেও আটক করা হয়। কিন্তু শুভকে এয়ারপোর্ট এলাকায় ছেড়ে দেয়া হলেও খোঁজ মেলেনি মেহেদী হাসানের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে মেহেদীকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। গত ৬ই মার্চ রাজধানীর শুক্রাবাদ এলাকা থেকে ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। এখন পর্যন্ত তার কোন হদিস পায়নি পরিবার।
এর আগে গুমের প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০১০ সালের ২৫শে জুন। ওই দিন রাতে রাজধানীর ইন্দিরা রোড থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬নং ওয়ার্ড কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমকে সাদা পোশাকের কিছু লোক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যায়। এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছরেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ২০১২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে ফেরার পথে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র আল-মোকাদ্দেস ও ওয়ালিউল্লাহকে হানিফ এন্টারপ্রাইজের গাড়ি থেকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। ওই বছরের ১লা এপ্রিল রাজধানীর উত্তরা থেকে র্যাব পরিচয় তুলে নিয়ে যায় সিলেট জেলা ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক ইফতেখার আহমদ দিনারকে। ২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল গুমের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটে। ওই দিন রাত সোয়া ১২টার দিকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সিলেট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী ও তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক মো. আনসার আলীকে। নিজের বাসায় ফেরার পথে বনানীর ২ নম্বর সড়ক থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তাদের তুলে নিয়ে যায়। ২০১৩ সালের ২৭শে নভেম্বর কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। ওই বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে রাজধানী থেকে গুম হন সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি খালেদ হাসান সোহেল, বংশাল থানা ছাত্রদলের সহসভাপতি মো. সোহেল, বিএনপি নেতা মো. হোসেন চঞ্চল, বংশাল ৭১নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মো. পারভেজ, একই ওয়ার্ডের ছাত্রদল নেতা মো. জহির, ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন, একই ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা তানভীর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল নেতা আসাদুজ্জামান রানা, মাজহারুল ইসলাম রাসেল ও আল আমিন, তেজগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা কাউসার ও এসএম আদনান চৌধুরী, তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক মো. তরিকুল ইসলাম, সবুজবাগ থানা ছাত্রদল সভাপতি মাহবুব হাসান সুজন, একই থানার ছাত্রদল নেতা ফরহাদ হোসেন, মুন্সীগঞ্জ কে কে গভর্মেন্ট হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র কামরুল হাসান কনক, সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টু, ৫৭নং ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক সোহেল ও রানা। গত বছরের ৪ঠা মে সুনামগঞ্জ শহীদ মিনারে এক অনশন শেষে সিলেট ফেরার পথে টুকেরবাজার এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সুনামগঞ্জের বাসিন্দা ও যুক্তরাজ্য যুবদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রবাসী মুজিবুর রহমানকে গাড়িচালকসহ তুলে নিয়ে যায়। সৌভাগ্যবশত পরে তাদের খোঁজ মিলে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি- বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা আহসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিকীও সৌভাগ্যবান। নিখোঁজের পর তাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনের অবশ্য তেমন সৌভাগ্য হয়নি। নিখোঁজের পর তাদের লাশ পাওয়া যায় নদীতে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনেও বলেছেন, গুমের ঘটনাগুলো তদন্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আর প্রায় সব গুমের ক্ষেত্রেই অভিযোগ উঠেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে। এখন সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে প্রশ্নটি- হারিয়ে যাওয়া মানুষ যায় কোথায়?
No comments