আমাদের নেতারা কি জবাব দেবেন? by হাসান ফেরদৌস
ভিন্ন
ফল হবে ভেবে একই কাজ বারবার করার অন্য নাম পাগলামি। বাংলাদেশে গত দুই মাস
থেকে ঠিক এই পাগলামিটাই হচ্ছে। লাগাতার অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল, বেপরোয়া
পেট্রলবোমা, গাড়ি ও বাসে আগুন। এসবের ফলে নিহত মানুষের সংখ্যা ১১৬ ছাড়িয়ে
গেছে। সারা শরীরে আগুনে পোড়া দগদগে ক্ষত নিয়ে কাতরাচ্ছে অনেক মানুষ।
আগামীকাল কার কপালে নেমে আসবে এই ভয়াবহ দুর্গতি, আমরা কেউ জানি না। বিরোধী জোটের নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে প্রশ্ন, আর কত দিন চলবে এই লাগাতার অবরোধ আর দফায় দফায় হরতাল? এই
প্রশ্ন খালেদা জিয়ার কাছে। কারণ, তিনি চাইলে কালকেই এই সর্বনাশা দুর্গতির
অবসান হতে পারে। তিনি যদি স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন, তাঁর নেতৃত্বাধীন জোট সকল
প্রকার সহিংসতার বিরুদ্ধে, অথবা এই কথা বলেন যে, তাঁর দলের কেউ পেট্রলবোমা
ছোড়া বা বাসে আগুন দেওয়ার সঙ্গে জড়িত—এ কথা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তাকে বা
তাদের অবিলম্বে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে, তাহলে অবস্থার পরিবর্তন হতে
বাধ্য।
আমি বলি না তিনি হরতাল বা অবরোধ তুলে নিন। এটি তাঁর রাজনৈতিক রণকৌশল, এই যুক্তিতে হরতাল নিয়ে তিনি পড়ে থাকতে পারেন, যদিও এক যাত্রায় ভিন্ন ফল হবে, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। আমরা শুধু বলি, আপনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানটি স্পষ্ট করুন। আপনার দেওয়া কর্মসূচির প্রথম দিন থেকেই আপনি দেখেছেন এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কারা। সাধারণ মানুষ, যাদের কাজে না গেলে পেটের ভাত জোটে না, বাসে না চড়ে উপায়ন্তর নেই, তারাই এই ভয়ের রাজনীতির শিকার। হরতাল করুন, লোকজনকে ঘরে বসে থাকতে বলুন। শুধু সমর্থকদের বলুন, তারা যেন কেউ বোমাবাজির পক্ষে নয়, তার বিপক্ষে থাকে। পুলিশের কাছে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিন, তারা কাগজে-কলমে প্রমাণ দিক আপনার দলের লোক বা ভাড়াটে সন্ত্রাসী বোমাবাজির সঙ্গে জড়িত।
রাজনৈতিক রণকৌশল সর্বদা এক থাকে না, অবস্থার বিবেচনায় তার পরিবর্তন হয়। গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের কথা ভাবুন। লবণ কর আদায়ের বিরুদ্ধে সে আন্দোলন সারা ভারতবর্ষে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। গান্ধী চেয়েছিলেন সম্পূর্ণ অহিংস পথে সে আন্দোলন চলবে। কিন্তু যেই মুহূর্তে তিনি বুঝলেন সত্যাগ্রহ তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে, গান্ধীজি তাঁর অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। তিনি স্বাধীনতার দাবি ত্যাগ করেননি, শুধু সে দাবি আদায়ের পথটি পরিবর্তন করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী, তাঁর সে সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
বিরোধী জোটের তরফে বারবার দাবি করা হয়েছে, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে, সরকার তাদের জন্য অন্য কোনো পথই আর খোলা রাখেনি। কথাটা যদি সত্য হয়, তাহলেও সন্ত্রাসের পথ অনুসরণের কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। দুই মাস অব্যাহত হরতাল-অবরোধের ফলে দেশের অর্থনীতি কোথায় পৌঁছেছে, সে কথা সবারই জানা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গত দেড়-দুই দশকের পরিশ্রমের পর যে ইতিবাচক বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তার পুরোটাই উল্টে যেতে পারে। ফিচ রেটিংসকে উদ্ধৃত করে ব্লুমবার্গ বিজনেস জানিয়েছে, রাজনৈতিক অচলাবস্থা অব্যাহত থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাবেন। গার্মেন্টস খাতের অনেক আগ্রহী ক্রেতা ইতিমধ্যে মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে পাড়ি জমানো শুরু করেছেন। একবার তাঁরা ফিরে গেলে এসব বিনিয়োগকারীকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।
এর চেয়েও ভয়ের কথা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। গত মাসে প্রকাশিত তাদের এক প্রতিবেদনে গ্রুপটি জানিয়েছে, অব্যাহত হানাহানির ফলে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম হবে, তাতে সবচেয়ে বেশি ফায়দা লুটবে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যদি বিগড়ে যায়, তার ফলে বড় ধরনের অসন্তোষের সৃষ্টি হবে। দেখা দেবে রাজনৈতিক শূন্যতা। আর সেই সুযোগে ঘাপটি মেরে বসে থাকা মৌলবাদীরা সবাই সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে। এর ফলে যে বিপদ তা শুধু বিরোধী দলগুলোর জন্য নয়, সরকারের জন্যও।
বিরোধী জোটের সঙ্গে কোনো রকম সংলাপ নয়, এই ধনুর্ভঙ্গপণ করে বসে আছে সরকারি মহল। কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, তাঁরা লাগাতার হরতালের ব্যাপারটাকে ‘পেইন ম্যানেজমেন্ট’-এর মতো একটা বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা হিসেবে ধরে নিয়েছেন। এমন অনেক লোক আছেন, যাঁদের পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা, জুতো পরতে গেলে চিনচিন করে, কিন্তু পরতে পরতে একসময় অভ্যাস হয়ে যায়। দিনে দু-চারটে বাস পোড়া বা খান কয়েক লাশ পড়া সে রকমই একটা কিছু।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রশ্ন, আপনারা কি ধরে নিয়েছেন বারবার ‘না, নো’ বলে মাথা নাড়লেই একসময় সব ঠান্ডা হয়ে যাবে?
ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষণ যদি সঠিক হয় এবং মৌলবাদীদের উত্থান ঘটে, তার ফলে বিরোধী জোট ও ক্ষমতাসীন মহল উভয়েই তাদের এ কূল-ও কূল দুই কূলই হারাবে। তার চেয়েও বড় কথা, এই অবাস্তব ও ক্ষতিকর রাজনীতির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে বাংলাদেশের। নেতাদের বিদেশি ব্যাংকে দেদার অর্থ, ছেলেমেয়েদের অধিকাংশই বিদেশে। তাঁদের হারানোর কিছু নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ডুবলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
আমি বলি না তিনি হরতাল বা অবরোধ তুলে নিন। এটি তাঁর রাজনৈতিক রণকৌশল, এই যুক্তিতে হরতাল নিয়ে তিনি পড়ে থাকতে পারেন, যদিও এক যাত্রায় ভিন্ন ফল হবে, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। আমরা শুধু বলি, আপনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানটি স্পষ্ট করুন। আপনার দেওয়া কর্মসূচির প্রথম দিন থেকেই আপনি দেখেছেন এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কারা। সাধারণ মানুষ, যাদের কাজে না গেলে পেটের ভাত জোটে না, বাসে না চড়ে উপায়ন্তর নেই, তারাই এই ভয়ের রাজনীতির শিকার। হরতাল করুন, লোকজনকে ঘরে বসে থাকতে বলুন। শুধু সমর্থকদের বলুন, তারা যেন কেউ বোমাবাজির পক্ষে নয়, তার বিপক্ষে থাকে। পুলিশের কাছে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিন, তারা কাগজে-কলমে প্রমাণ দিক আপনার দলের লোক বা ভাড়াটে সন্ত্রাসী বোমাবাজির সঙ্গে জড়িত।
রাজনৈতিক রণকৌশল সর্বদা এক থাকে না, অবস্থার বিবেচনায় তার পরিবর্তন হয়। গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের কথা ভাবুন। লবণ কর আদায়ের বিরুদ্ধে সে আন্দোলন সারা ভারতবর্ষে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। গান্ধী চেয়েছিলেন সম্পূর্ণ অহিংস পথে সে আন্দোলন চলবে। কিন্তু যেই মুহূর্তে তিনি বুঝলেন সত্যাগ্রহ তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে, গান্ধীজি তাঁর অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। তিনি স্বাধীনতার দাবি ত্যাগ করেননি, শুধু সে দাবি আদায়ের পথটি পরিবর্তন করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী, তাঁর সে সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
বিরোধী জোটের তরফে বারবার দাবি করা হয়েছে, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে, সরকার তাদের জন্য অন্য কোনো পথই আর খোলা রাখেনি। কথাটা যদি সত্য হয়, তাহলেও সন্ত্রাসের পথ অনুসরণের কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। দুই মাস অব্যাহত হরতাল-অবরোধের ফলে দেশের অর্থনীতি কোথায় পৌঁছেছে, সে কথা সবারই জানা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গত দেড়-দুই দশকের পরিশ্রমের পর যে ইতিবাচক বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তার পুরোটাই উল্টে যেতে পারে। ফিচ রেটিংসকে উদ্ধৃত করে ব্লুমবার্গ বিজনেস জানিয়েছে, রাজনৈতিক অচলাবস্থা অব্যাহত থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাবেন। গার্মেন্টস খাতের অনেক আগ্রহী ক্রেতা ইতিমধ্যে মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে পাড়ি জমানো শুরু করেছেন। একবার তাঁরা ফিরে গেলে এসব বিনিয়োগকারীকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।
এর চেয়েও ভয়ের কথা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। গত মাসে প্রকাশিত তাদের এক প্রতিবেদনে গ্রুপটি জানিয়েছে, অব্যাহত হানাহানির ফলে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম হবে, তাতে সবচেয়ে বেশি ফায়দা লুটবে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যদি বিগড়ে যায়, তার ফলে বড় ধরনের অসন্তোষের সৃষ্টি হবে। দেখা দেবে রাজনৈতিক শূন্যতা। আর সেই সুযোগে ঘাপটি মেরে বসে থাকা মৌলবাদীরা সবাই সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে। এর ফলে যে বিপদ তা শুধু বিরোধী দলগুলোর জন্য নয়, সরকারের জন্যও।
বিরোধী জোটের সঙ্গে কোনো রকম সংলাপ নয়, এই ধনুর্ভঙ্গপণ করে বসে আছে সরকারি মহল। কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, তাঁরা লাগাতার হরতালের ব্যাপারটাকে ‘পেইন ম্যানেজমেন্ট’-এর মতো একটা বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা হিসেবে ধরে নিয়েছেন। এমন অনেক লোক আছেন, যাঁদের পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা, জুতো পরতে গেলে চিনচিন করে, কিন্তু পরতে পরতে একসময় অভ্যাস হয়ে যায়। দিনে দু-চারটে বাস পোড়া বা খান কয়েক লাশ পড়া সে রকমই একটা কিছু।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রশ্ন, আপনারা কি ধরে নিয়েছেন বারবার ‘না, নো’ বলে মাথা নাড়লেই একসময় সব ঠান্ডা হয়ে যাবে?
ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষণ যদি সঠিক হয় এবং মৌলবাদীদের উত্থান ঘটে, তার ফলে বিরোধী জোট ও ক্ষমতাসীন মহল উভয়েই তাদের এ কূল-ও কূল দুই কূলই হারাবে। তার চেয়েও বড় কথা, এই অবাস্তব ও ক্ষতিকর রাজনীতির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে বাংলাদেশের। নেতাদের বিদেশি ব্যাংকে দেদার অর্থ, ছেলেমেয়েদের অধিকাংশই বিদেশে। তাঁদের হারানোর কিছু নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ডুবলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments