একটি চিঠি ও রাজনীতিকের নানা রঙের জীবন by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি মহিউদ্দিন চৌধুরী |
একটা
মেয়ে চিঠি লিখেছে তার বাবাকে। ইংরেজিতে লেখা চিঠি। অনুবাদ করলে মোটামুটি
দাঁড়ায় এ রকম: ‘প্রিয় আব্বু, আমি জানি না এ চিঠি কোনো দিন তোমার কাছে
পৌঁছে দিতে পারব কি না। কিন্তু তোমাকে নিয়ে আমার অনুভূতি প্রকাশের জন্য এ
চিঠি আমাকে লিখতেই হবে।...আমি এ পর্যন্ত যা দেখেছি, তুমি হচ্ছ পৃথিবীর
শ্রেষ্ঠ বাবা। অবশ্য যেকোনো মেয়েই তার বাবা সম্পর্কে এ কথা বলতে পারে।
তবে আমি মনে করি, যদি তুমি কাউকে ভালোবাসো, তাদের তোমার এভাবে বলতে হবে
না। তারা জানবে। যেকোনোভাবেই হোক, তারা তা জানবে। ‘আমি কখনো তোমাকে
বলতে পারিনি, তুমি আমার কাছে কী! তোমার কাছে কোনো দিন মনের অনুভূতি
প্রকাশ করতে পারিনি। শুধু এটুকু বলতে পারি, যখন এ চিঠি লিখছি, আমার চোখ
ছাপিয়ে পানি নামছে। আমি তো কখনো তোমাকে বলতে পারিনি তুমি শ্রেষ্ঠ বাবা,
তুমি আমার আদর্শ।
‘আব্বু, তোমাকে কি একটা প্রশ্ন করতে পারি? তুমি তো আল্লাহকে বিশ্বাস করো। একজন ভালো মানুষের সব গুণ তোমার মধ্যে আছে। তোমার ঈশ্বর কি সেটা দেখছেন না? তিনি কি দেখছেন না তুমি কী কষ্ট পাচ্ছ? এত কিছুর পর আমি কি আল্লাহর ওপর আস্থা রাখব? কিন্তু আমি রাখছি।
‘সেই সকালবেলাগুলো আজ খুব মিস করছি, যখন তুমি খুব ভোরবেলা উঠে ছড়া আবৃত্তি করতে...। আব্বু, তোমাকে আজ হাজারবার ডাকতে ইচ্ছা করছে...চিৎকার করে তোমাকে ডাকতে ইচ্ছা করছে।
‘...লবণাক্ত অশ্রুর বিন্দু ছাড়া আমি আর তোমাকে কী দিতে পারি? যে কাগজটাতে লিখছি, সেটা আমি আর দেখতে পাচ্ছি না। আমার চোখের পানিতে কাগজটা ভিজে যাচ্ছে।
‘তুমি আমার হৃদয়ের সবচেয়ে গভীরতম স্থানটিতে আছ, চিরকাল সেখানেই তুমি থাকবে। —তোমার টুম্পা।’
বাবার কাছে লেখা মেয়ের আবেগঘন সাধারণ একটি চিঠি। যেকোনো মেয়েই তার বাবাকে এ রকম একটি চিঠি লিখতে পারে। কিন্তু যখন আমরা জানব, ক্যানসারে আক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী টুম্পা এই চিঠিটি লিখেছে তার কারান্তরীণ বাবার কাছে, মৃত্যুর আগে একবার শেষ দেখাটিও হয়নি বাবা-মেয়ের, তখন মনটা বেদনায় ভারী হয়ে ওঠে। জেল থেকে বেরিয়ে মেয়ের চিঠিটি পেয়ে বাবার মনের অবস্থা কী ছিল, তা সহজেই অনুমেয়।
এই হচ্ছে রাজনীতিকের জীবন। ভালো-মন্দ নানা কাজের জন্য তাঁরা কখনো নন্দিত হন, কখনো নিন্দিত। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক জীবনের অনেক কাহিনিই থেকে যায় সাধারণ মানুষের অগোচরে। সেই জীবনকাহিনিতে অনেক সময়ই থাকে প্রায় উপন্যাসের উপাদান। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর জীবনও সে রকমই ঘটনাবহুল নানা উপাদানে ভরা।
সম্প্রতি সাংবাদিক মোয়াজ্জেমুল হক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা নামের একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর জীবন ও রাজনীতি নিয়ে। সেখানে উঠে এসেছে তাঁর জীবনের জানা-অজানা অনেক কথা।
প্রায় কৈশোরেই ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন মহিউদ্দিন। উনসত্তরের অগ্নিঝরা সময়ে মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়েই অস্ত্রসমেত কয়েকজন সহযোদ্ধার সঙ্গে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। অমানবিক নির্যাতনের শিকার হলেও শেষ পর্যন্ত ভাগ্যক্রমে মুক্তি পেয়েছিলেন। এরপর রামগড় হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে হরিনা ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছান। তিনি মারা গেছেন—এ রকম খবর পেয়ে ভারতের হরিনা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে তখন ‘শহীদ মহিউদ্দিন ব্যারাক’ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে জীবিত ফিরে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন সতীর্থরা। ট্রেনিং শেষ করে মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস বীর বিক্রমে লড়াই করে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরেছিলেন তিনি। উঠে এসেছে স্বাধীন দেশের নানা পালাবদলে তাঁর ভূমিকা, আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। এই অঞ্চলের মানুষের প্রিয় নেতা হয়ে ওঠার ধারাবাহিক পর্ব।
শুধু রাজনীতি নয়, যেকোনো প্রয়োজনের মুহূর্তে অসহায় মানুষের পাশে থাকার এমন নজির অন্তত এ অঞ্চলে দ্বিতীয়টি নেই। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর বহু বেওয়ারিশ লাশ নিজ কাঁধে বহন করে দাফন ও সৎকার করেছেন। অস্থায়ী হাসপাতাল গড়ে তুলে চিকিৎসকদের জড়ো করেছিলেন, প্রাণ রক্ষা করেছিলেন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শত শত রোগীর। কালুরঘাটে গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু বা বন্দরটিলায় নৌবাহিনীর সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিদের দাফন-কাফন, সৎকারে সবার আগে এগিয়ে এসেছিলেন মহিউদ্দিনই। তাই একবার ১৯৯৫ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করার পর যেভাবে ফুঁসে উঠেছিল চট্টগ্রামের মানুষ, সে রকম জনরোষের নজির এ অঞ্চলে আর নেই।
তিন দফায় প্রায় ১৭ বছর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন তিনি। মেয়র থাকাকালে তাঁর জনহিতকর কাজগুলো যেমন প্রশংসিত হয়েছিল, তেমনি কিছু একগুঁয়ে সিদ্ধান্তের কারণে সমালোচিতও হয়েছেন তিনি। চট্টগ্রাম শহরকে একটি পরিচ্ছন্ন নগর হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সিটি করপোরেশন পরিচালিত সেবা সদনগুলোয় বেসরকারি ক্লিনিকের মানের সেবা প্রদান নিশ্চিত করেছিলেন। করপোরেশনের স্কুল-কলেজের মান উন্নীত হয়েছিল। সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য মিলনায়তন নির্মাণ (থিয়েটার ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম) বা আগ্রাবাদ এক্সেস রোড ও সিটি গেট থেকে জাকির হোসেন রোড সম্প্রসারণ ছিল তাঁর দূরদর্শী চিন্তার প্রতিফলন। কিন্তু অপর্ণাচরণ স্কুলের প্রাঙ্গণজুড়ে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ, প্রবর্তক মোড়ে একটি বড় নালার ওপর প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ করে পানিনিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি পশুশালার জমিতে স্থাপনা তৈরির উদ্যোগ বা কর্ণফুলী সেতু থেকে শহর অভিমুখী সড়কে নদীর তীর ঘেঁষে দোকানপাট নির্মাণের পরিকল্পনার সঙ্গে একমত হতে পারেননি নগর পরিকল্পনাবিদসহ সচেতন নাগরিক সমাজ। এসব বিরোধ ক্রমেই তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ হয়ে উঠেছিল। তাই ২০১০ সালের মেয়র নির্বাচনে তিনি যখন তাঁরই এককালের শিষ্য মন্জুর আলমের কাছে পরাজিত হন, তখন অনেকেই এটাকে ‘বিনয়ের কাছে দম্ভের হার’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
মহিউদ্দিন তাঁর দলের সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়েও অনেক সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বা আন্দোলন করতে দ্বিধা করেননি। যেমন মার্কিন প্রতিষ্ঠান স্টিভিডোর সার্ভিসেস অব আমেরিকার (এসএসএ) সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রাইভেট কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনের চুক্তির উদ্যোগ থেকে সরকারকে সরে আসতে হয়েছিল মহিউদ্দিনের কালাপাহাড়ি মনোভাবের কারণে। পরে মহিউদ্দিনের বিরোধিতার যুক্তি অনুধাবন করতে পেরেছিল সবাই। একইভাবে বছরে মাত্র ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর থাই কোম্পানিকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিলেন মহিউদ্দিন। এখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি বছরে গড়ে ৩৫ কোটি টাকারও বেশি আয় করে প্রমাণ করেছে যে সিদ্ধান্তটি ছিল হঠকারী।
যে চিঠিটির কথা শুরুতে উল্লেখ করেছি, সেটি লেখা হয়েছিল এক-এগারোর সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে। জীবনের শেষ সময়গুলোয় বাবাকে একনজর দেখার আশা পূরণ হয়নি টুম্পার। কারণ, তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার জন্য তৎকালীন সরকারের শর্ত ছিল, জীবনে আর রাজনীতি করবেন না এমন মুচলেকা দিতে হবে। এই শর্ত মেনে নেওয়া যে তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না, এ কথা মহিউদ্দিনকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা তো জানেন। চিরদিন মাঠের রাজনীতি করেছেন তিনি। নির্বাচনে জিতেছেন, হেরেছেনও। কিন্তু মাঠ ছাড়েননি কোনো দিন। তাঁর ভালো কাজের মূল্যায়ন করেছে মানুষ, আবার খারাপ কাজের জন্য উপযুক্ত জবাব দিতেও ছাড়েনি।
কিছুদিন আগে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব হয়ে গেল। সেখানে অন্যতম বক্তা সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল একপর্যায়ে টুম্পার চিঠিটা পাঠ করে শোনালে শ্রোতারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। আপাতকঠিন হৃদয়ের মানুষ মহিউদ্দিনও পারেননি অশ্রুসংবরণ করতে। রাজনীতিকের জীবনের এটিই হয়তো প্রকৃত বাস্তবতা।
জীবিত ব্যক্তির জীবনী লেখা খুবই কঠিন কাজ। এ ক্ষেত্রে নির্মোহ থাকা খুবই দুরূহ। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা গ্রন্থের লেখকও যতটা অনুরাগ আর আবেগ নিয়ে এ গ্রন্থ রচনা করেছেন, ততটা আলোকপাত করতে পারেননি মহিউদ্দিনের জীবন ও রাজনীতির ত্রুটি বা অসংগতির দিকগুলো নিয়ে। এই সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখেও বলি, এ রকম একটি কাজের জন্য গ্রন্থকার ধন্যবাদার্হ। ভবিষ্যতে আরও অধিকতর মূল্যায়ন ও চুলচেরা বিশ্লেষণের সুযোগ তো থাকলই।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com
‘আব্বু, তোমাকে কি একটা প্রশ্ন করতে পারি? তুমি তো আল্লাহকে বিশ্বাস করো। একজন ভালো মানুষের সব গুণ তোমার মধ্যে আছে। তোমার ঈশ্বর কি সেটা দেখছেন না? তিনি কি দেখছেন না তুমি কী কষ্ট পাচ্ছ? এত কিছুর পর আমি কি আল্লাহর ওপর আস্থা রাখব? কিন্তু আমি রাখছি।
‘সেই সকালবেলাগুলো আজ খুব মিস করছি, যখন তুমি খুব ভোরবেলা উঠে ছড়া আবৃত্তি করতে...। আব্বু, তোমাকে আজ হাজারবার ডাকতে ইচ্ছা করছে...চিৎকার করে তোমাকে ডাকতে ইচ্ছা করছে।
‘...লবণাক্ত অশ্রুর বিন্দু ছাড়া আমি আর তোমাকে কী দিতে পারি? যে কাগজটাতে লিখছি, সেটা আমি আর দেখতে পাচ্ছি না। আমার চোখের পানিতে কাগজটা ভিজে যাচ্ছে।
‘তুমি আমার হৃদয়ের সবচেয়ে গভীরতম স্থানটিতে আছ, চিরকাল সেখানেই তুমি থাকবে। —তোমার টুম্পা।’
বাবার কাছে লেখা মেয়ের আবেগঘন সাধারণ একটি চিঠি। যেকোনো মেয়েই তার বাবাকে এ রকম একটি চিঠি লিখতে পারে। কিন্তু যখন আমরা জানব, ক্যানসারে আক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী টুম্পা এই চিঠিটি লিখেছে তার কারান্তরীণ বাবার কাছে, মৃত্যুর আগে একবার শেষ দেখাটিও হয়নি বাবা-মেয়ের, তখন মনটা বেদনায় ভারী হয়ে ওঠে। জেল থেকে বেরিয়ে মেয়ের চিঠিটি পেয়ে বাবার মনের অবস্থা কী ছিল, তা সহজেই অনুমেয়।
এই হচ্ছে রাজনীতিকের জীবন। ভালো-মন্দ নানা কাজের জন্য তাঁরা কখনো নন্দিত হন, কখনো নিন্দিত। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক জীবনের অনেক কাহিনিই থেকে যায় সাধারণ মানুষের অগোচরে। সেই জীবনকাহিনিতে অনেক সময়ই থাকে প্রায় উপন্যাসের উপাদান। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর জীবনও সে রকমই ঘটনাবহুল নানা উপাদানে ভরা।
সম্প্রতি সাংবাদিক মোয়াজ্জেমুল হক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা নামের একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর জীবন ও রাজনীতি নিয়ে। সেখানে উঠে এসেছে তাঁর জীবনের জানা-অজানা অনেক কথা।
প্রায় কৈশোরেই ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন মহিউদ্দিন। উনসত্তরের অগ্নিঝরা সময়ে মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়েই অস্ত্রসমেত কয়েকজন সহযোদ্ধার সঙ্গে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। অমানবিক নির্যাতনের শিকার হলেও শেষ পর্যন্ত ভাগ্যক্রমে মুক্তি পেয়েছিলেন। এরপর রামগড় হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে হরিনা ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছান। তিনি মারা গেছেন—এ রকম খবর পেয়ে ভারতের হরিনা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে তখন ‘শহীদ মহিউদ্দিন ব্যারাক’ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে জীবিত ফিরে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন সতীর্থরা। ট্রেনিং শেষ করে মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস বীর বিক্রমে লড়াই করে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরেছিলেন তিনি। উঠে এসেছে স্বাধীন দেশের নানা পালাবদলে তাঁর ভূমিকা, আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। এই অঞ্চলের মানুষের প্রিয় নেতা হয়ে ওঠার ধারাবাহিক পর্ব।
শুধু রাজনীতি নয়, যেকোনো প্রয়োজনের মুহূর্তে অসহায় মানুষের পাশে থাকার এমন নজির অন্তত এ অঞ্চলে দ্বিতীয়টি নেই। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর বহু বেওয়ারিশ লাশ নিজ কাঁধে বহন করে দাফন ও সৎকার করেছেন। অস্থায়ী হাসপাতাল গড়ে তুলে চিকিৎসকদের জড়ো করেছিলেন, প্রাণ রক্ষা করেছিলেন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শত শত রোগীর। কালুরঘাটে গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু বা বন্দরটিলায় নৌবাহিনীর সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিদের দাফন-কাফন, সৎকারে সবার আগে এগিয়ে এসেছিলেন মহিউদ্দিনই। তাই একবার ১৯৯৫ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করার পর যেভাবে ফুঁসে উঠেছিল চট্টগ্রামের মানুষ, সে রকম জনরোষের নজির এ অঞ্চলে আর নেই।
তিন দফায় প্রায় ১৭ বছর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন তিনি। মেয়র থাকাকালে তাঁর জনহিতকর কাজগুলো যেমন প্রশংসিত হয়েছিল, তেমনি কিছু একগুঁয়ে সিদ্ধান্তের কারণে সমালোচিতও হয়েছেন তিনি। চট্টগ্রাম শহরকে একটি পরিচ্ছন্ন নগর হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সিটি করপোরেশন পরিচালিত সেবা সদনগুলোয় বেসরকারি ক্লিনিকের মানের সেবা প্রদান নিশ্চিত করেছিলেন। করপোরেশনের স্কুল-কলেজের মান উন্নীত হয়েছিল। সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য মিলনায়তন নির্মাণ (থিয়েটার ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম) বা আগ্রাবাদ এক্সেস রোড ও সিটি গেট থেকে জাকির হোসেন রোড সম্প্রসারণ ছিল তাঁর দূরদর্শী চিন্তার প্রতিফলন। কিন্তু অপর্ণাচরণ স্কুলের প্রাঙ্গণজুড়ে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ, প্রবর্তক মোড়ে একটি বড় নালার ওপর প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ করে পানিনিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি পশুশালার জমিতে স্থাপনা তৈরির উদ্যোগ বা কর্ণফুলী সেতু থেকে শহর অভিমুখী সড়কে নদীর তীর ঘেঁষে দোকানপাট নির্মাণের পরিকল্পনার সঙ্গে একমত হতে পারেননি নগর পরিকল্পনাবিদসহ সচেতন নাগরিক সমাজ। এসব বিরোধ ক্রমেই তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ হয়ে উঠেছিল। তাই ২০১০ সালের মেয়র নির্বাচনে তিনি যখন তাঁরই এককালের শিষ্য মন্জুর আলমের কাছে পরাজিত হন, তখন অনেকেই এটাকে ‘বিনয়ের কাছে দম্ভের হার’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
মহিউদ্দিন তাঁর দলের সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়েও অনেক সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বা আন্দোলন করতে দ্বিধা করেননি। যেমন মার্কিন প্রতিষ্ঠান স্টিভিডোর সার্ভিসেস অব আমেরিকার (এসএসএ) সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রাইভেট কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনের চুক্তির উদ্যোগ থেকে সরকারকে সরে আসতে হয়েছিল মহিউদ্দিনের কালাপাহাড়ি মনোভাবের কারণে। পরে মহিউদ্দিনের বিরোধিতার যুক্তি অনুধাবন করতে পেরেছিল সবাই। একইভাবে বছরে মাত্র ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর থাই কোম্পানিকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিলেন মহিউদ্দিন। এখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি বছরে গড়ে ৩৫ কোটি টাকারও বেশি আয় করে প্রমাণ করেছে যে সিদ্ধান্তটি ছিল হঠকারী।
যে চিঠিটির কথা শুরুতে উল্লেখ করেছি, সেটি লেখা হয়েছিল এক-এগারোর সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে। জীবনের শেষ সময়গুলোয় বাবাকে একনজর দেখার আশা পূরণ হয়নি টুম্পার। কারণ, তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার জন্য তৎকালীন সরকারের শর্ত ছিল, জীবনে আর রাজনীতি করবেন না এমন মুচলেকা দিতে হবে। এই শর্ত মেনে নেওয়া যে তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না, এ কথা মহিউদ্দিনকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা তো জানেন। চিরদিন মাঠের রাজনীতি করেছেন তিনি। নির্বাচনে জিতেছেন, হেরেছেনও। কিন্তু মাঠ ছাড়েননি কোনো দিন। তাঁর ভালো কাজের মূল্যায়ন করেছে মানুষ, আবার খারাপ কাজের জন্য উপযুক্ত জবাব দিতেও ছাড়েনি।
কিছুদিন আগে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব হয়ে গেল। সেখানে অন্যতম বক্তা সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল একপর্যায়ে টুম্পার চিঠিটা পাঠ করে শোনালে শ্রোতারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। আপাতকঠিন হৃদয়ের মানুষ মহিউদ্দিনও পারেননি অশ্রুসংবরণ করতে। রাজনীতিকের জীবনের এটিই হয়তো প্রকৃত বাস্তবতা।
জীবিত ব্যক্তির জীবনী লেখা খুবই কঠিন কাজ। এ ক্ষেত্রে নির্মোহ থাকা খুবই দুরূহ। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা গ্রন্থের লেখকও যতটা অনুরাগ আর আবেগ নিয়ে এ গ্রন্থ রচনা করেছেন, ততটা আলোকপাত করতে পারেননি মহিউদ্দিনের জীবন ও রাজনীতির ত্রুটি বা অসংগতির দিকগুলো নিয়ে। এই সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখেও বলি, এ রকম একটি কাজের জন্য গ্রন্থকার ধন্যবাদার্হ। ভবিষ্যতে আরও অধিকতর মূল্যায়ন ও চুলচেরা বিশ্লেষণের সুযোগ তো থাকলই।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com
No comments