শেষের খেলা by আলফাজ আনাম
বিরোধী
দলের ডাকা অবরোধ ও হরতালের কর্মসূচি দুই মাসের বেশি সময় পার হয়েছে।
ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে কোনো আলোচনার উদ্যোগ নেই।
বিরোধী দলের আন্দোলন ধীরে ধীরে মরে যাবে বলে সরকারের মন্ত্রীরা আশা করলেও
তা হয়নি। এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলা হলেও আট সপ্তাহ
চলে গেলেও দেশের পরিস্থিতি মোটেও স্বাভাবিক নয়। অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে
পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে। গ্রেফতারি
পরোয়ানা জারি করার পরও রহস্যময় কারণে বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা
সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত সরকারকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে।
মন্ত্রীরা যেমন আগে বলতেন বিএনপির আন্দোলন করার কোনো মুরোদ নেই। এখন আর তেমন কথা বলছেন না। অর্থাৎ বিএনপির আন্দোলনের মুরোদ আছে এটা হয়তো তারা এখন বুঝতে পারছেন। এখন বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। বিএনপিকে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠন আইএসের সাথে তুলনা করে আন্তর্জাতিক মহলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলো সরকারের এই প্রচারণায় হয়তো বিস্মিত। কারণ আইএসের কিভাবে জন্ম আর এর পেছনেই বা কারা আছে, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর চেয়ে আর কারো ভালো জানার কথা নয়। ফলে এসব প্রচারণা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। উল্টো আমরা দেখছি, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূত একযোগে খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।
বিরোধী দলের টানা অবরোধ ও হরতাল শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে সঙ্কট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা যেমন বেড়েছে, তেমনি আন্দোলনের মোড় যেকোনো সময় যেকোনো দিকে ঘুরে যেতে পারে, সাধারণ মানুষের মধ্যে সে বিশ্বাসও গড়ে উঠেছে। বিএনপি নেতারাও হয়তো আশা করেননি টানা দুই মাস আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারবেন। সন্দেহ নেই বর্তমানে আন্দোলনে কিছুটা শিথিলতা এসেছে। দৈনন্দিন প্রয়োজনের জন্য মানুষকে বাইরে বের হতে হচ্ছে কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, বিরোধী দলের প্রতি জনসমর্থন কমে গেছে। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনের ফল চায়। যৌক্তিক পরিণতি দেখতে চায়।
সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বিরোধী দলকে আন্দোলনের কৌশল যেমন বদলাতে হচ্ছে, তেমনি আন্দোলন দীর্ঘ হচ্ছে। এ যেন টিকে থাকার এক মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। যে পক্ষ হাল ছেড়ে দেবে, সেই পক্ষই পরাজিত হবে। এ কারণে আমরা দেখছি বিরোধী দল হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। অপর দিকে, ক্ষমতাসীনেরাও নিপীড়ন নির্যাতনের সর্বশেষ মাত্রা অতিক্রম করছেন। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করেই তারা থামছে না। গুম, অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, পঙ্গু করার মতো চরম অমানবিক পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। দেশকে পরিণত করা হয়েছে আক্ষরিক অর্থে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট দেখছে শেষের খেলা হিসেবে। সাময়িকীটি লিখেছে, বাংলাদেশে শেষের খেলা শুরু হয়েছে। খেলা শেষ হতে সময় নেবে।
সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক অধিকার যেভাবে হরণ করা হয়েছে, তাতে বিরোধী দলের আন্দোলন থামার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা সরকারের চরম নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, তার আর ঘরে ফেরার উপায় নেই। হয় জেলে যেতে হবে না হলে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীরা আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। রাজপথ তার কাছে বেশি নিরাপদ হয়ে উঠছে। সরকার দমনের পথে গিয়ে তাদের সে দিকে ঠেলে দিয়েছে।
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত, আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থনহীন সরকার মূলত টিকে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্তির ওপর ভর করে। জনসমর্থন সরকারের কাছে এখন আর বিবেচনার বিষয় নয়। সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা লক্ষ করছি, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত এমনকি তারা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছেন। নড়াইলের একজন ওয়ার্ড কমিশনার ঢাকায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। রংপুরের মিঠাপুকুরের একজন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এক মাসের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা দাবি করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে গুম করেছে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য নেই। জনপ্রতিনিধিরা যদি এভাবে গুম বা খুন হন, তাহলে তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না গণতান্ত্রিক পরিবেশ এখন দেশে কতটা বিরাজ করছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের যেখানে জীবনের নিরাপত্তা নেই, সেখানে সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে পড়ছে।
দেশের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে, পুলিশ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা থাকবেন কী থাকবেন না। রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে বরখাস্ত করার দাবি করেছে পুলিশ। এ জন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের জুন মাসে মেয়র নির্বাচিত হন মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। তিনি পেয়েছিলেন এক লাখ ৩১ হাজার ভোট। পুলিশের অভিযোগ, মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল রাষ্ট্রবিরোধী ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের নির্দেশদাতা ও মদদদাতা। পুলিশের পরামর্শ, তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা প্রয়োজন। এখন আমাদের বিশ^াস করতে হচ্ছে, রাজশাহী মহানগরীর লক্ষাধিক ভোটার একজন রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিকে নির্বাচিত করেছেন। এ দেশের মানুষের মনে হয় সত্যিই কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। মোসাদ্দেক হোসেনকে ভোট দিয়ে এসব ভোটাররাও হয়তো রাষ্ট্রবিরোধী কাজে সমর্থন দিয়েছেন। এদের বিরুদ্ধেও পুলিশের ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন হয়ে পড়বে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
শুধু মোসাদ্দেক হোসেন নন, ২০১৩ সালের জুন মাসে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন। এই চারজনকেই এখন বরখাস্তের প্রক্রিয়া চলছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এর মধ্যে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েক মাস আগে জেলে পাঠানো হয়েছে। গাজীপুরের মেয়র আব্দুল মান্নানকেও করা হয়েছে জেলবন্দী। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা দেয়া হয়েছে। সেগুলোর চার্জশিট দেয়া হলে তাকে বরখাস্ত করা হবে। খুলনার মেয়র মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক মামলা। তিনি এক রকম পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ধারণা করা যায়, তাকেও হয়তো বরখাস্তের প্রক্রিয়া চলছে।
সিটি করপোরেশনের ভোটাররা সাধারণভাবে শিক্ষিত ও সচেতন হিসেবে ধরে নেয়া যায়। তারা বিপুল ভোটে এসব মেয়রকে নির্বাচিত করেছেন। সরকারের চোখে তারা এখন রাষ্ট্রবিরোধী ও সন্ত্রাসী। এখন তাদের কারাগারে পাঠিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা প্যানেল মেয়রদের দায়িত্ব দেয়া হবে।
বর্তমান সরকার রাষ্ট্র চালানোর কৌশল হিসেবে জনগণের সমর্থনের বিপরীত চিন্তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে বিরোধী দলকে দমন করে একদলীয় ও চূড়ান্তভাবে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করা। এ জন্য ভিন্নমতাবলম্বীদের মৌলিক অধিকার হরণ করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা। আমরা যদি লক্ষ করি তাহলে দেখব, সরকার এ ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিরোধী দল ও মতের লোকজনের ওপর নিপীড়নের লাইসেন্স দিয়েছে। কোনো লোককে আটক বা সন্দেহজনক গ্রেফতার করা হলেও তার সাথে বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা থাকলে নিপীড়ন ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকতে হচ্ছে। ভিন্নমতাবলম্বী নাগরিকেরা পুলিশের সাহায্যের কথা কল্পনাও করতে পারেন না। সরকার আবার সব পুলিশের ওপর নির্ভর করছে, তা নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে বিশেষ জেলার সদস্যদের বসানো হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পদে। বিভিন্ন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে দলীয় সম্পৃক্ততা প্রধান মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে সম্পূর্ণ দলীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থ বিবেচনার ভিত্তিতে। বাংলাদেশ যেন উত্তর কোরিয়া বা রাশিয়ার মতো একদলীয় শাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব দেশে বিরোধী দল বা মত বলে কিছু নেই। মাত্র কয়েক দিন আগে রাশিয়ায় একজন ভিন্নমতাবলম্বী নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে এমন অনেক ঘটনা ঘটলেও তা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হচ্ছে। ইলিয়াস আলীর কথা মানুষ ভুলে গেছে। দিনের পর দিন রুহুল কবির রিজভীকে রিমান্ডে রাখা হচ্ছে। মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো নেতাকে ভিলেনে পরিণত করা হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে বিরোধী দলের যেসব নেতাকর্মী গুম বা খুন হয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই স্থানীয় পর্যায়ে যথেষ্ট সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী। সরকারের কৌশল হচ্ছে বিএনপির বৃদ্ধ, অকর্মণ্য ও আপসকামী কেন্দ্রীয় নেতাদের নিরাপদ রেখে, সাংগঠনিক সক্ষমতা আছে এমন নেতাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা। এরাই জেলে যাচ্ছেন, পঙ্গু হচ্ছেন কিংবা অনেকে গুমের শিকার হয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে কি একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হবে? গত দুই মাসের আন্দোলন থেকে স্পষ্ট, এভাবে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না। সরকারের মন্ত্রীদের ভাষায়, ‘বিএনপির দুর্বল সাংগঠনিক শক্তি’ সত্ত্বেও মাসের পর মাস রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সক্ষমতা দলটির আছে তা এবার প্রমাণিত হয়েছে। এই সক্ষমতার মূল উৎস সাধারণ মানুষের সমর্থন। যেকোনো সময় বিএনপি এ ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারবে। এই জনসমর্থনের মূল কারণ হচ্ছে মানুষের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। ভোটাধিকার হারানোর বেদনা। আওয়ামী লীগ মানুষের এই অধিকার হারানোর দুঃখ অনুধাবন করতে পারছে না।
নিপীড়নের মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েমের এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ ’৭২-৭৪ সালেও ব্যর্থ হয়েছে। এবারো সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং সাধারণ মানুষের সাথে দলটির যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হচ্ছে, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য দীর্ঘ সময় লাগবে। এ ধরনের একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে নানাভাবে মানুষের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটতে থাকবে। ইকোনমিস্টের ভাষায় যে শেষের খেলা চলছে, তা হয়তো আরো কিছু দিন চলবে। শুধু সময় দীর্ঘ হতে পারে। বাড়বে ক্ষয়ক্ষতি। আরো কিছু মানুষ জীবন হারাবে, পঙ্গু হবে। নিপীড়ন নির্যাতন আর জেলজুলুমের শিকার হবে। ইতিহাস বলে এ দেশে কখনোই বল প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব হয়নি।
মন্ত্রীরা যেমন আগে বলতেন বিএনপির আন্দোলন করার কোনো মুরোদ নেই। এখন আর তেমন কথা বলছেন না। অর্থাৎ বিএনপির আন্দোলনের মুরোদ আছে এটা হয়তো তারা এখন বুঝতে পারছেন। এখন বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। বিএনপিকে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠন আইএসের সাথে তুলনা করে আন্তর্জাতিক মহলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলো সরকারের এই প্রচারণায় হয়তো বিস্মিত। কারণ আইএসের কিভাবে জন্ম আর এর পেছনেই বা কারা আছে, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর চেয়ে আর কারো ভালো জানার কথা নয়। ফলে এসব প্রচারণা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। উল্টো আমরা দেখছি, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূত একযোগে খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।
বিরোধী দলের টানা অবরোধ ও হরতাল শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে সঙ্কট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা যেমন বেড়েছে, তেমনি আন্দোলনের মোড় যেকোনো সময় যেকোনো দিকে ঘুরে যেতে পারে, সাধারণ মানুষের মধ্যে সে বিশ্বাসও গড়ে উঠেছে। বিএনপি নেতারাও হয়তো আশা করেননি টানা দুই মাস আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারবেন। সন্দেহ নেই বর্তমানে আন্দোলনে কিছুটা শিথিলতা এসেছে। দৈনন্দিন প্রয়োজনের জন্য মানুষকে বাইরে বের হতে হচ্ছে কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, বিরোধী দলের প্রতি জনসমর্থন কমে গেছে। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনের ফল চায়। যৌক্তিক পরিণতি দেখতে চায়।
সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বিরোধী দলকে আন্দোলনের কৌশল যেমন বদলাতে হচ্ছে, তেমনি আন্দোলন দীর্ঘ হচ্ছে। এ যেন টিকে থাকার এক মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। যে পক্ষ হাল ছেড়ে দেবে, সেই পক্ষই পরাজিত হবে। এ কারণে আমরা দেখছি বিরোধী দল হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। অপর দিকে, ক্ষমতাসীনেরাও নিপীড়ন নির্যাতনের সর্বশেষ মাত্রা অতিক্রম করছেন। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করেই তারা থামছে না। গুম, অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, পঙ্গু করার মতো চরম অমানবিক পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। দেশকে পরিণত করা হয়েছে আক্ষরিক অর্থে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট দেখছে শেষের খেলা হিসেবে। সাময়িকীটি লিখেছে, বাংলাদেশে শেষের খেলা শুরু হয়েছে। খেলা শেষ হতে সময় নেবে।
সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক অধিকার যেভাবে হরণ করা হয়েছে, তাতে বিরোধী দলের আন্দোলন থামার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা সরকারের চরম নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, তার আর ঘরে ফেরার উপায় নেই। হয় জেলে যেতে হবে না হলে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীরা আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। রাজপথ তার কাছে বেশি নিরাপদ হয়ে উঠছে। সরকার দমনের পথে গিয়ে তাদের সে দিকে ঠেলে দিয়েছে।
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত, আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থনহীন সরকার মূলত টিকে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্তির ওপর ভর করে। জনসমর্থন সরকারের কাছে এখন আর বিবেচনার বিষয় নয়। সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা লক্ষ করছি, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত এমনকি তারা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছেন। নড়াইলের একজন ওয়ার্ড কমিশনার ঢাকায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। রংপুরের মিঠাপুকুরের একজন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এক মাসের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা দাবি করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে গুম করেছে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য নেই। জনপ্রতিনিধিরা যদি এভাবে গুম বা খুন হন, তাহলে তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না গণতান্ত্রিক পরিবেশ এখন দেশে কতটা বিরাজ করছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের যেখানে জীবনের নিরাপত্তা নেই, সেখানে সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে পড়ছে।
দেশের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে, পুলিশ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা থাকবেন কী থাকবেন না। রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে বরখাস্ত করার দাবি করেছে পুলিশ। এ জন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের জুন মাসে মেয়র নির্বাচিত হন মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। তিনি পেয়েছিলেন এক লাখ ৩১ হাজার ভোট। পুলিশের অভিযোগ, মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল রাষ্ট্রবিরোধী ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের নির্দেশদাতা ও মদদদাতা। পুলিশের পরামর্শ, তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা প্রয়োজন। এখন আমাদের বিশ^াস করতে হচ্ছে, রাজশাহী মহানগরীর লক্ষাধিক ভোটার একজন রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিকে নির্বাচিত করেছেন। এ দেশের মানুষের মনে হয় সত্যিই কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। মোসাদ্দেক হোসেনকে ভোট দিয়ে এসব ভোটাররাও হয়তো রাষ্ট্রবিরোধী কাজে সমর্থন দিয়েছেন। এদের বিরুদ্ধেও পুলিশের ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন হয়ে পড়বে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
শুধু মোসাদ্দেক হোসেন নন, ২০১৩ সালের জুন মাসে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন। এই চারজনকেই এখন বরখাস্তের প্রক্রিয়া চলছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এর মধ্যে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েক মাস আগে জেলে পাঠানো হয়েছে। গাজীপুরের মেয়র আব্দুল মান্নানকেও করা হয়েছে জেলবন্দী। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা দেয়া হয়েছে। সেগুলোর চার্জশিট দেয়া হলে তাকে বরখাস্ত করা হবে। খুলনার মেয়র মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক মামলা। তিনি এক রকম পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ধারণা করা যায়, তাকেও হয়তো বরখাস্তের প্রক্রিয়া চলছে।
সিটি করপোরেশনের ভোটাররা সাধারণভাবে শিক্ষিত ও সচেতন হিসেবে ধরে নেয়া যায়। তারা বিপুল ভোটে এসব মেয়রকে নির্বাচিত করেছেন। সরকারের চোখে তারা এখন রাষ্ট্রবিরোধী ও সন্ত্রাসী। এখন তাদের কারাগারে পাঠিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা প্যানেল মেয়রদের দায়িত্ব দেয়া হবে।
বর্তমান সরকার রাষ্ট্র চালানোর কৌশল হিসেবে জনগণের সমর্থনের বিপরীত চিন্তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে বিরোধী দলকে দমন করে একদলীয় ও চূড়ান্তভাবে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করা। এ জন্য ভিন্নমতাবলম্বীদের মৌলিক অধিকার হরণ করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা। আমরা যদি লক্ষ করি তাহলে দেখব, সরকার এ ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিরোধী দল ও মতের লোকজনের ওপর নিপীড়নের লাইসেন্স দিয়েছে। কোনো লোককে আটক বা সন্দেহজনক গ্রেফতার করা হলেও তার সাথে বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা থাকলে নিপীড়ন ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকতে হচ্ছে। ভিন্নমতাবলম্বী নাগরিকেরা পুলিশের সাহায্যের কথা কল্পনাও করতে পারেন না। সরকার আবার সব পুলিশের ওপর নির্ভর করছে, তা নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে বিশেষ জেলার সদস্যদের বসানো হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পদে। বিভিন্ন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে দলীয় সম্পৃক্ততা প্রধান মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে সম্পূর্ণ দলীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থ বিবেচনার ভিত্তিতে। বাংলাদেশ যেন উত্তর কোরিয়া বা রাশিয়ার মতো একদলীয় শাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব দেশে বিরোধী দল বা মত বলে কিছু নেই। মাত্র কয়েক দিন আগে রাশিয়ায় একজন ভিন্নমতাবলম্বী নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে এমন অনেক ঘটনা ঘটলেও তা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হচ্ছে। ইলিয়াস আলীর কথা মানুষ ভুলে গেছে। দিনের পর দিন রুহুল কবির রিজভীকে রিমান্ডে রাখা হচ্ছে। মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো নেতাকে ভিলেনে পরিণত করা হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে বিরোধী দলের যেসব নেতাকর্মী গুম বা খুন হয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই স্থানীয় পর্যায়ে যথেষ্ট সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী। সরকারের কৌশল হচ্ছে বিএনপির বৃদ্ধ, অকর্মণ্য ও আপসকামী কেন্দ্রীয় নেতাদের নিরাপদ রেখে, সাংগঠনিক সক্ষমতা আছে এমন নেতাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা। এরাই জেলে যাচ্ছেন, পঙ্গু হচ্ছেন কিংবা অনেকে গুমের শিকার হয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে কি একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হবে? গত দুই মাসের আন্দোলন থেকে স্পষ্ট, এভাবে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না। সরকারের মন্ত্রীদের ভাষায়, ‘বিএনপির দুর্বল সাংগঠনিক শক্তি’ সত্ত্বেও মাসের পর মাস রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সক্ষমতা দলটির আছে তা এবার প্রমাণিত হয়েছে। এই সক্ষমতার মূল উৎস সাধারণ মানুষের সমর্থন। যেকোনো সময় বিএনপি এ ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারবে। এই জনসমর্থনের মূল কারণ হচ্ছে মানুষের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। ভোটাধিকার হারানোর বেদনা। আওয়ামী লীগ মানুষের এই অধিকার হারানোর দুঃখ অনুধাবন করতে পারছে না।
নিপীড়নের মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েমের এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ ’৭২-৭৪ সালেও ব্যর্থ হয়েছে। এবারো সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং সাধারণ মানুষের সাথে দলটির যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হচ্ছে, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য দীর্ঘ সময় লাগবে। এ ধরনের একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে নানাভাবে মানুষের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটতে থাকবে। ইকোনমিস্টের ভাষায় যে শেষের খেলা চলছে, তা হয়তো আরো কিছু দিন চলবে। শুধু সময় দীর্ঘ হতে পারে। বাড়বে ক্ষয়ক্ষতি। আরো কিছু মানুষ জীবন হারাবে, পঙ্গু হবে। নিপীড়ন নির্যাতন আর জেলজুলুমের শিকার হবে। ইতিহাস বলে এ দেশে কখনোই বল প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব হয়নি।
No comments