কালো ষাঁড় খাসি ও মোরগ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
পদ্মা সেতু নির্মাণের ঠিকাদারি নিয়ে আমাদের পদ্মা নদী এবং কানাডার ম্যাকেঞ্জি ও ওটাওয়া নদগুলোর পানি ঘোরতর ঘোলা হওয়ার পর এখন বিকল্প ব্যবস্থায় কাজ শুরু হয়েছে। পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে গত সপ্তায় মাওয়া চৌরাস্তা পয়েন্টে।
সেতুর মূল কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি তাদের রীতি অনুসারে দুটি কালো ষাঁড়, দুটি খাসি এবং দুটি মোরগ জবাই করে কিছু মাংস ও রক্ত নদীতে ভাসিয়ে দেয়। অবশিষ্ট মাংস প্রকল্পে কর্মরতদের ভোজের জন্য রাখা হয়। কাজের সফলতা ও দুর্ঘটনা রোধে প্রাচীন চৈনিক রীতিতে এই আনুষ্ঠানিকতা। বাংলার মাটিতে এ-জাতীয় চৈনিক রীতিতে কোনো সেতুর উদ্বোধনের কাজ এই প্রথম।
উৎসর্গীকৃত পশুগুলোর রক্ত-মাংসের কিছুটা দেবতাকে খুশি করতে পদ্মার পানিতে গেলেও পনেরো আনাই যাবে বঙ্গীয় কর্মকর্তাদের পেটে। সুতরাং হারাম-হালালের একটা ব্যাপার আছে। তাই সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা চৈনিক কর্মকর্তাদের বলেন, আপনাদের প্রাচীন প্রথাটি খুবই যুগোপযোগী। তবে আমাদের দাবি, প্রাণী ছয়টি যেন ইসলামি শরিয়ত অনুসারে হত্যা করা হয়। এ দেশে আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া কোনো দাবিই আদায় হয় না; চীনারা বাঙালির দাবি মেনে নিয়ে ইসলামি রীতিতেই জবাই করেন বলে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে।
যখন হতভাগ্য পশুগুলোর গলায় ছুরি চালানো হয়, তখন চারদিকে চকচক করছিল অনেকগুলো চোখ। কারও কারও মন বলেছে, এত বড় সেতু, মাত্র দুটো ষাঁড়, দুটো খাসি আর দুটো মোরগ কেন? এক শ ষাঁড়, দুই শ খাসি আর দুই ঝুড়ি মোরগ হলে ক্ষতি কী ছিল?
শুধু তো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নন, রয়েছেন বঙ্গীয় কর্মকর্তারা। তা ছাড়া রয়েছেন দলীয় ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও।
হারাম-হালালের বাহাস খুব বেশি দূর গড়ায়নি। কারণ, গোশত তো গোশতই। রান্নার পরে সব গোশতেরই একই স্বাদ। পার্থক্য হলো শিক কাবারের এক স্বাদ, ভুনা মাংসের আলাদা স্বাদ, রেজালার সোয়াদ অন্য রকম। চর্বিঅলা খাসির মাংসের রেজালার কথা ভাবতেই অনেকের জিবে পানি আসে এবং সশব্দে ঢোঁক গেলেন। কোনো কোনো বড় কর্মকর্তার আবার তাংরি কাবাব বা খাসির লেগ রোস্ট খুবই পছন্দ।
চৈনিক প্রথাটির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা খুবই প্রশংসার যোগ্য। ধর্মীয় কারণে গো-মাংস যিনি ছোঁবেন না, তাঁর জন্য আছে মাটন। গরু-খাসি দুটোতেই যাঁর অরুচি, তাঁর জন্য আছে মোরগ বা চিকেন। এই প্রথা ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্যই সমান সুযোগ করে দিচ্ছে। বৈষম্যের লেশমাত্র নেই।
বাংলার মাটিতে একবার যদি কেউ কোনো প্রথা প্রবর্তন করে, তা অতি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ, বাঙালির মধ্যে অনুকরণের প্রবণতা প্রবল। চৈনিকেরা আজ যে প্রথার প্রচলন করলেন, বঙ্গবাসী তা অপছন্দ করতেই পারেন না। অবিলম্বে যে এই প্রথা জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ খুবই কম।
এবং শুধু বড় বড় ব্রিজের পাইলিংয়ের কাজ শুরুতে নয়, গ্রামের ছোট খালের ওপর ১২ ফুট পুল নির্মাণে বা ছয় ফুট বাই নয় ফুট কালভার্ট নির্মাণে জবাই হবে দুই কালো ষাঁড় না হোক অন্তত একটি সাদা ষাঁড় ও একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট—যাদের বিএনপি-জামায়াত আমলে জাতীয় পশুর স্বীকৃতি পাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তখন এক কালো ছাগল পাজেরো গাড়িতে চড়ে সফর করেছে তিন উপজেলা কমপ্লেক্স।
চীন একটি বস্তুবাদী দেশ। কুসংস্কার তো দূরের কথা, হাজার হাজার বছরের পুরোনো ধর্মীয় আচারই তাদের কাছে অনাবশ্যক। কিন্তু বঙ্গীয় নদীতে ব্রিজ বানাতে এসে তাঁরা তাঁদের প্রাচীন প্রথা ও বিশ্বাসকে অগ্রাহ্য করলেন না। বস্তুবাদী সমাজে কোনো অন্ধ, অযৌক্তিক বা যুক্তিবিবর্জিত বিশ্বাসের মূল্য নেই। কোনো পাবলিক অনুষ্ঠানে কোনো সংস্কারের প্রয়োগ বাংলার মাটিতে এই প্রথম।
পদ্মা সেতু গরু, ছাগল ও মুরগির যাতায়াতের জন্য নির্মিত হচ্ছে না। তাতে যে যানবাহন চলাচল করবে, তাতে থাকবে মানুষ। ব্রিজের নিচে নদীতে লঞ্চ ডুবে সারা বছর যত লোকই মারা যাক, ব্রিজ ভেঙে পড়ে মানুষের যাতে জীবনহানি না ঘটে, সেটাই আমাদের কাম্য। ষাঁড়, খাসি ও মোরগ উৎসর্গের জন্যই হোক বা উন্নত মানের কাজের জন্যই হোক, দেশের মানুষ চায় সেতুটি মজবুত করে তৈরি হোক।
পাকশী-ভেড়ামারা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বানিয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার। এক শ বছরেও সেটি অটুট আছে। সেকালের চেয়ে এখন প্রযুক্তি আরও উন্নত হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে জাতির ভাগ্যে কী ঘটে কেউ জানে না।
তবু আমাদের প্রত্যাশা, পাঁচ শ বছরেও পদ্মা সেতুতে কোনো ফাটল দেখা দেবে না। পাইলিংয়ের শুভ উদ্বোধনের মুহূর্তে নির্মীয়মাণ সেতুর শুভকামনা করি। ভবিষ্যতে এই সেতুতে যাঁরা যাতায়াত করবেন, তাঁদের যাত্রা শুভ হবে—এই প্রার্থনা করি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
সেতুর মূল কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি তাদের রীতি অনুসারে দুটি কালো ষাঁড়, দুটি খাসি এবং দুটি মোরগ জবাই করে কিছু মাংস ও রক্ত নদীতে ভাসিয়ে দেয়। অবশিষ্ট মাংস প্রকল্পে কর্মরতদের ভোজের জন্য রাখা হয়। কাজের সফলতা ও দুর্ঘটনা রোধে প্রাচীন চৈনিক রীতিতে এই আনুষ্ঠানিকতা। বাংলার মাটিতে এ-জাতীয় চৈনিক রীতিতে কোনো সেতুর উদ্বোধনের কাজ এই প্রথম।
উৎসর্গীকৃত পশুগুলোর রক্ত-মাংসের কিছুটা দেবতাকে খুশি করতে পদ্মার পানিতে গেলেও পনেরো আনাই যাবে বঙ্গীয় কর্মকর্তাদের পেটে। সুতরাং হারাম-হালালের একটা ব্যাপার আছে। তাই সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা চৈনিক কর্মকর্তাদের বলেন, আপনাদের প্রাচীন প্রথাটি খুবই যুগোপযোগী। তবে আমাদের দাবি, প্রাণী ছয়টি যেন ইসলামি শরিয়ত অনুসারে হত্যা করা হয়। এ দেশে আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া কোনো দাবিই আদায় হয় না; চীনারা বাঙালির দাবি মেনে নিয়ে ইসলামি রীতিতেই জবাই করেন বলে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে।
যখন হতভাগ্য পশুগুলোর গলায় ছুরি চালানো হয়, তখন চারদিকে চকচক করছিল অনেকগুলো চোখ। কারও কারও মন বলেছে, এত বড় সেতু, মাত্র দুটো ষাঁড়, দুটো খাসি আর দুটো মোরগ কেন? এক শ ষাঁড়, দুই শ খাসি আর দুই ঝুড়ি মোরগ হলে ক্ষতি কী ছিল?
শুধু তো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নন, রয়েছেন বঙ্গীয় কর্মকর্তারা। তা ছাড়া রয়েছেন দলীয় ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও।
হারাম-হালালের বাহাস খুব বেশি দূর গড়ায়নি। কারণ, গোশত তো গোশতই। রান্নার পরে সব গোশতেরই একই স্বাদ। পার্থক্য হলো শিক কাবারের এক স্বাদ, ভুনা মাংসের আলাদা স্বাদ, রেজালার সোয়াদ অন্য রকম। চর্বিঅলা খাসির মাংসের রেজালার কথা ভাবতেই অনেকের জিবে পানি আসে এবং সশব্দে ঢোঁক গেলেন। কোনো কোনো বড় কর্মকর্তার আবার তাংরি কাবাব বা খাসির লেগ রোস্ট খুবই পছন্দ।
চৈনিক প্রথাটির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা খুবই প্রশংসার যোগ্য। ধর্মীয় কারণে গো-মাংস যিনি ছোঁবেন না, তাঁর জন্য আছে মাটন। গরু-খাসি দুটোতেই যাঁর অরুচি, তাঁর জন্য আছে মোরগ বা চিকেন। এই প্রথা ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্যই সমান সুযোগ করে দিচ্ছে। বৈষম্যের লেশমাত্র নেই।
বাংলার মাটিতে একবার যদি কেউ কোনো প্রথা প্রবর্তন করে, তা অতি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ, বাঙালির মধ্যে অনুকরণের প্রবণতা প্রবল। চৈনিকেরা আজ যে প্রথার প্রচলন করলেন, বঙ্গবাসী তা অপছন্দ করতেই পারেন না। অবিলম্বে যে এই প্রথা জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ খুবই কম।
এবং শুধু বড় বড় ব্রিজের পাইলিংয়ের কাজ শুরুতে নয়, গ্রামের ছোট খালের ওপর ১২ ফুট পুল নির্মাণে বা ছয় ফুট বাই নয় ফুট কালভার্ট নির্মাণে জবাই হবে দুই কালো ষাঁড় না হোক অন্তত একটি সাদা ষাঁড় ও একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট—যাদের বিএনপি-জামায়াত আমলে জাতীয় পশুর স্বীকৃতি পাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তখন এক কালো ছাগল পাজেরো গাড়িতে চড়ে সফর করেছে তিন উপজেলা কমপ্লেক্স।
চীন একটি বস্তুবাদী দেশ। কুসংস্কার তো দূরের কথা, হাজার হাজার বছরের পুরোনো ধর্মীয় আচারই তাদের কাছে অনাবশ্যক। কিন্তু বঙ্গীয় নদীতে ব্রিজ বানাতে এসে তাঁরা তাঁদের প্রাচীন প্রথা ও বিশ্বাসকে অগ্রাহ্য করলেন না। বস্তুবাদী সমাজে কোনো অন্ধ, অযৌক্তিক বা যুক্তিবিবর্জিত বিশ্বাসের মূল্য নেই। কোনো পাবলিক অনুষ্ঠানে কোনো সংস্কারের প্রয়োগ বাংলার মাটিতে এই প্রথম।
পদ্মা সেতু গরু, ছাগল ও মুরগির যাতায়াতের জন্য নির্মিত হচ্ছে না। তাতে যে যানবাহন চলাচল করবে, তাতে থাকবে মানুষ। ব্রিজের নিচে নদীতে লঞ্চ ডুবে সারা বছর যত লোকই মারা যাক, ব্রিজ ভেঙে পড়ে মানুষের যাতে জীবনহানি না ঘটে, সেটাই আমাদের কাম্য। ষাঁড়, খাসি ও মোরগ উৎসর্গের জন্যই হোক বা উন্নত মানের কাজের জন্যই হোক, দেশের মানুষ চায় সেতুটি মজবুত করে তৈরি হোক।
পাকশী-ভেড়ামারা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বানিয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার। এক শ বছরেও সেটি অটুট আছে। সেকালের চেয়ে এখন প্রযুক্তি আরও উন্নত হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে জাতির ভাগ্যে কী ঘটে কেউ জানে না।
তবু আমাদের প্রত্যাশা, পাঁচ শ বছরেও পদ্মা সেতুতে কোনো ফাটল দেখা দেবে না। পাইলিংয়ের শুভ উদ্বোধনের মুহূর্তে নির্মীয়মাণ সেতুর শুভকামনা করি। ভবিষ্যতে এই সেতুতে যাঁরা যাতায়াত করবেন, তাঁদের যাত্রা শুভ হবে—এই প্রার্থনা করি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments