মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে অনিশ্চয়তা by মাসুম খলিলী
বাংলাদেশের
দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে মিয়ানমার সম্পর্র্কে এ দেশের মানুষের স্বচ্ছ
ধারণা কমই রয়েছে। অথচ দেশটির চলমান বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের সাথে এ দেশের
নানা স্বার্থ ও ভবিষ্যৎ জড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ যে পূর্বমুখী অভিযাত্রার
স্বপ্ন দেখে আসছে, তা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না যদি মিয়ানমারের বন্ধ দরজা
খোলার যে প্রক্রিয়া বা সংস্কার চলছে সেটি আবার অচল হয়ে পড়ে। তেমন একটি
আশঙ্কা জোরালো হচ্ছে আগামী নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে। ২০১০ সালে
মিয়ানমারে সেনা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের সূচনার পর থেকে একটি মুক্ত
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে যাত্রার ব্যাপারে অঙ্গীকার করে আসছিলেন দেশটির
নেতারা। এর ধারাবাহিকতায় রাজনীতি এবং অর্থনীতি দুটোর ওপরেই তারা
বিনিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে বিরোধী নেতা অং সান সু
কির দল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসিকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আনতে এর অন্তরীণ নেতাদের
মুক্তি দেয়া হয়। সীমিত সংখ্যক আসনের উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে অং সান সু কি
নিজে এবং তার দল সংসদের দুই কক্ষে প্রবেশ করে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে
মুক্তভাবে ভোট দেয়ার প্রত্যাশায় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কার্যক্রম শুরু করে।
এ লক্ষ্যে ২০০৮ সালে সামরিক জান্তা প্রণীত সংবিধানে সংস্কার এনে বিরোধী
নেতা অং সান সু কির নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথ প্রশস্ত করার অঙ্গীকারও করেন
শাসক দলের নেতারা। কিন্তু সে অঙ্গীকার থেকে তারা সরে আসার ইঙ্গিত দিতে শুরু
করেছেন এখন। শাসক দলের প্রধান ও সংসদের নিম্নকক্ষের স্পিকার শোয়ে মান
বলেছেন, ২০১৫ সালে নির্বাচনের আগে সংবিধানে কোনো সংশোধনী আনা যাবে না।
অর্থাৎ অং সান সু কি দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে পারছেন না। তিনি নিজেকে
রেখেছেন দেশটির সম্ভাব্য প্রেসিডেন্টের তালিকায়।
২০০৮ সালে মিয়ানমারের সংবিধানটি এমনভাবে সামরিক জান্তা প্রণয়ন করে যে, সরকার সম্মত না হলে এর মধ্যে কোনো ধরনের সংশোধনী আনা সম্ভব নয়। সংসদের উচ্চ কক্ষ এবং নিম্ন কক্ষ- দু’টিতেই সেনাবাহিনীর সংরক্ষিত আসন রয়েছে ২৫ শতাংশ। উচ্চ কক্ষের ২২৪ আসনের মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য রয়েছেন ৫৬ জন। আর নিম্ন কক্ষের ৪৪০ জনের মধ্যে রয়েছেন ১১০ জন। কেবল বাকি আসনগুলোতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। দুই কক্ষে ৭৫ শতাংশ সদস্যের ভোটে যেকোনো সংশোধনী অনুমোদন হতে হয়। এরপরও সংবিধান সংশোধনীর ব্যাপারে ভেটো দিয়ে তা অকার্যকর করে দিতে পারে সেনাবাহিনী। এসব ব্যবস্থার কারণে শাসকেরা সম্মত না হলে সে সংস্কার কোনো সময় আনা যাবে না। এই সংবিধানে একটি অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছে- মিয়ানমারের কোনো নাগরিকের স্বামী-স্ত্রী বা সন্তান বিদেশের নাগরিক হলে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এটি যে বিরোধী নেতা সু কিকে লক্ষ্য করেই তৈরি হয়েছে, তাতে সংশয় নেই। এটি সংশোধন করা না হলে সু কির পক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হবে না। অন্য দিকে প্রেসিডেন্ট সরকারের প্রধান নির্বাহী পদ হওয়ায় তার ক্ষমতা ছাড়া কার্যত দেশটিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনার সুযোগও নেই।
রাজনৈতিক দিক ছাড়াও আরো দু’টি প্রধান ইস্যু রয়েছে মিয়ানমারে। এর একটি হলো ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পথ খোলা। আরেকটি হলো দেশটি বিভিন্ন অঞ্চলের সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে মূল ধারার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা। রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি এ দু’টিও সংস্কার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রেসিডেন্ট থিন শেইনের সরকার দেশটিতে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে চীনা অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ প্রকল্প মিথস্টোন হাইড্রো বাঁধ নির্মাণ স্থগিত করে পশ্চিমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয় মিয়ানমার সরকার। এর পর থেকে মিয়ানমারে কার্যত আর একতরফা চীনা বিনিয়োগ হচ্ছে না। মুক্তভাবে বড় বড় প্রকল্পে অন্য দেশের কোম্পানিকেও প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। এ জন্য বিশ্বব্যাংক ও অন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারও আনা হচ্ছে। বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন মিয়ানমারে বিনিয়োগ করতে পারছে। ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুর, জাপান, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকান কোম্পানিগুলো মিয়ানমারে বিনিয়োগ শুরু করেছে। বিদেশী ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতে সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে কোনো ক্ষেত্রেই এই উন্মুক্ততা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে করা হচ্ছে না। বিদেশী ব্যাংকগুলোকে স্থানীয় কোম্পানিতে বিনিয়োগ বা ঋণ দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। তেল এবং গ্যাস খাতে এখনো বড় বিনিয়োগ নিয়ে আসতে পাশ্চাত্যের কোম্পানিগুলো ভরসা পাচ্ছে না।
অর্থনৈতিক সংস্কারে মাঝে মধ্যে শ্লথগতি সৃষ্টি হওয়ায় পাশ্চাত্যও সতর্ক নীতি নিয়ে চলেছে মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার ক্ষেত্রে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আমেরিকা এখনো পুরো নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়নি মিয়ানমারের ওপর থেকে। ২০১৫ সালের নির্বাচন এবং অন্য প্রধান ক্ষেত্রগুলো সংস্কারের অগ্রগতি দেখে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে পুরোপুরি একাত্ম হওয়ার সুযোগ দিতে চাইতে পারে দেশটিকে। কিন্তু এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না, সে পথে শেষ পর্যন্ত কতটা হাঁটতে পারবে বেসামরিক মোড়কের বর্তমান সেনা সরকার।
বেসামরিক পোশাকের জান্তা সরকারের সংস্কার কর্মসূচির মধ্যে পরিবর্তনের আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো নৃতাত্ত্বিক সমস্যা। মিয়ানমারের জটিল নৃতাত্ত্বিক সঙ্কটের রাতারাতি সমাধান যে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, সেটি সব পক্ষই জানেন। এ সঙ্কটের দোহাই দিয়ে দেশটিতে বারবার সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। দেশটিকে সাতটি রাজ্য এবং সাতটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। রাজ্যগুলোতে রয়েছে সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর গরিষ্ঠতা আর অঞ্চলগুলোতে রয়েছে সংখ্যাগুরু বর্মীদের প্রাধান্য। সাত রাজ্যের মধ্যে প্রায় সবগুলোতেই রয়েছে কম-বেশি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা নৃতাত্ত্বিক বঞ্চনাজনিত অসন্তোষ। মিয়ানমারের পাঁচ কোটি ১৪ লাখ মানুষের মধ্যে ৬৮ শতাংশ হলো বর্মী নৃতাত্ত্বিক ধারার। এর বাইরে ১০ শতাংশ শান, সাত শতাংশ কারেন, চার শতাংশ রাখাইন এবং তিন শতাংশ চীনা রয়েছে। এর বাইরে রোহিঙ্গাসহ আরো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। মোট জনসংখ্যার বিচারে তাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য না হলেও বিভিন্ন রাজ্য ও অঞ্চলে রয়েছে তাদের সংখ্যাধিক্য। এসব অঞ্চলে অনেক ক্ষেত্রে দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। বার্মিজ সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের সাথে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে তাদের দমন করার চেষ্টাই করেছে বারবার। ফলে প্রতিবেশী বাংলাদেশ থাইল্যান্ড চীন এমনকি মালয়েশিয়াকেও বিপুলসংখ্যক বর্মী উদ্বাস্তুর ভার দশকের পর দশক ধরে বইতে হচ্ছে।
সংস্কারের অংশ হিসেবে বর্তমান সরকার নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর সাথে সমঝোতায় আসার উদ্যোগও নেয়। কিন্তু এই উদ্যোগের কোনোটাই সেভাবে পূর্ণতা পাচ্ছে না। অধিকন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় এসব নৃতাত্ত্বিক বিরোধের বিষয়কে নতুন করে চাঙ্গা করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। গত ৯ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে চীনা সীমান্তবর্তী কোকাং অঞ্চলে কোকাং মিয়ানমার ডেমোক্র্যাটিক এলায়েন্স আর্মির সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর মারাত্মক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ৫০ জন সেনাসদস্য নিহত হন। ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট সেখানে জরুরি অবস্থা জারি করেন। ২০০৯ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কোকাংয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর ৩০ হাজার লোক চীনা সীমান্ত পার হয়ে আশ্রয় নেয়। এর পর থেকে কোকাং বাহিনীর সাথে মাঝে মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ হচ্ছে। এর মধ্যে মিয়ানমারের বিমানবাহিনীর হামলায় চীনের অভ্যন্তরে সে দেশের ছয় আখচাষি নিহত হওয়ার ঘটনা নতুন করে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ায়। অন্য দিকে মিয়ানমারের ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম যাদের সাময়িক রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছিল, তাদের আগামী নির্বাচনে ভোট দেয়ার অধিকার ঘোষণার অল্প কয়েক দিন পর চরমপন্থী বৌদ্ধদের বিক্ষোভের মুখে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। সশস্ত্রভাবে সংঘাতে লিপ্ত ১৩টি গ্রুপের মধ্যে সরকার নির্বাচনের আগে পরিস্থিতিকে ঠাণ্ডা করে মূল ধারার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সবাইকে নিয়ে আসার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে মাত্র চারটি গ্রুপের সাথে অস্ত্রবিরতি স্বাক্ষর করতে পেরেছে। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি অন্য গ্রুপগুলোর সাথেও সমঝোতার ব্যাপারে সরকারের দৃঢ় কোনো সংকল্পের পরিচয় না দেয়ার মধ্যে অনেকে নির্বাচন ও সংস্কারের ব্যাপারে সরকারের নেপথ্য ক্ষমতাধরদের কতটা আন্তরিকতা রয়েছে তা নিয়ে সংশয় দেখতে পাচ্ছেন।
সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোতে মিয়ানমারের সংস্কার এবং গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রার ব্যাপারে একসময় যে উৎসাহ দেখা যেত, সেটি এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। বরং বিভিন্ন নেতিবাচক খবরগুলো এখন ফলাও করে প্রকাশ হতে দেখা যাচ্ছে। কোকাং নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সাথে সংঘর্ষ এবং রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার দেয়ার ঘোষণার পর তা থেকে সরে আসা এবং বিভিন্ন মানবাধিকার হরণমূলক কর্মকাণ্ড এখন নিয়মিতভাবে আসছে ইউরোপ-আমেরিকার পত্রপত্রিকায়।
গত ডিসেম্বরে এশিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পুরো মিয়ানমারে একটি ব্যাপকভিত্তিক জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এই জরিপটি ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ‘মিয়ানমার ২০১৪ : সিবিক নলেজ অ্যান্ড ভেলুজ ইন এ চেঞ্জিং সোসাইটি’ শীর্ষক এই জরিপের অংশগ্রহণকারী ৬২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে, দেশটির সংস্কার সঠিক নির্দেশনায় এগিয়ে যাচ্ছে। এ সময় ৯৩ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছিল তারা আগামী অক্টোবর/নভেম্বরের অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ভোট দেবে। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৬৮ শতাংশের আশা ছিল তারা মুক্তভাবেই ভোট দিতে পারবে। তবে সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী প্রধান রাজ্যগুলোতে ৫৬ শতাংশ এ ব্যাপারে ইতিবাচক আশাবাদ প্রকাশ করে; যদিও সংখ্যাগুরু বর্মীপ্রধান অঞ্চলে ৭২ শতাংশ অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে বলে আশা করেছিল।
এই জরিপে সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনে কতটা পরিবর্তন আনতে পেরেছে তার জবাবটিও পাওয়া যায়। অর্ধেক মানুষ জানায়, তাদের অবস্থার তেমন কোনো হেরফের হয়নি। ৩৫ শতাংশ বলেছে, তাদের অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। আর ১৪ শতাংশ তাদের অবস্থার অবনতি ঘটেছে বলে জানায়। রাজনৈতিক সংস্কারের পর কিছুটা মুক্ত বলে নিজেদের অনুভব করছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ৬৬ শতাংশ বলেছিল, হ্যাঁ, কিছুটা ভারমুক্ত মনে হচ্ছে তাদের। ২৫ ভাগ মানুষ বলেছে তারা নিজেদের এখনো তেমন মুক্ত ভাবতে পারছে না। এ সংখ্যাটা রাজ্য অঞ্চলগুলোতে বেশি।
স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মিয়ানমারের বাস্তবতা হলো সেখানে গণতন্ত্রের চর্চা হতে পেরেছে খুবই অল্প সময়ের জন্য। ফলে গণতন্ত্রের ব্যাপারে তাদের প্রত্যাশা রয়েছে কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজ কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে সামান্য ধারণা তাদের রয়েছে। সর্বাত্মকবাদী শাসন তাদের মধ্যে এমন এক অসচেতনতা সৃষ্টি করেছে যে, প্রেসিডেন্ট কি জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন, নাকি সংসদ সদস্যরা তাকে নির্বাচিত করেন সেটি বলতে পারেনি ৪৪ শতাংশ নাগরিক। তারা জাতীয় এবং গ্রাম পর্যায়ে কী হয় সে সম্পর্কে কিছু ধারণা রাখে। কিন্তু এর মাঝে কী হচ্ছে সে সম্পর্কে ধারণা খুব কমই তাদের রয়েছে।
কিছু দিন আগ পর্যন্ত পশ্চিমা পর্যবেক্ষকেরা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক যাত্রার ব্যাপারে বেশ উচ্চাশা প্রকাশ করে বলতেন, দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছেই শুধু নয়, এই দেশটি একটি পুরোপুরি গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল এ জন্য প্রস্তুতিও শুরু করেছে। তারা প্রার্থী বাছাই এবং প্রচারণার কৌশল কী হবে তা নিয়ে কাজ করছে। নৃতাত্ত্বিক ছোট গ্রুপগুলো নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার উদ্যোগও নিয়েছে। কিন্তু তাৎপর্যের বিষয়টি হলো, বহু দশক ধরে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা সামরিক জেনারেলরা শেষ পর্যন্ত কী করবে সে সম্পকের্ কেউই নিশ্চিত হতে পারছে না। কোকাং ও রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার নিয়ে ঘটনা ছাড়াও আরো কিছু হচ্ছে যা নিয়ে গণতান্ত্রিক আশাবাদকে মাঝে মধ্যে কালো মেঘ ঢেকে দিচ্ছে। এমনো বলা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে জেনারেলদের স্বার্থ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা না গেলে আবারো নৃতাত্ত্বিক সঙ্ঘাত সংঘর্ষ বাধিয়ে দিয়ে ঘড়ির কাঁটাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হবে। যার সাথে বর্তমানের বিশ্ব শক্তিগুলোর মধ্যে নবপর্যায়ে যে স্নাযুযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তার যুগসূত্র থাকবে। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট কোন পথে যাবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বিচ্ছিন্নতাবাদ নতুন করে দানা বাধার আলামত দেখা যাচ্ছে, তার সাথেও এর যুগসূত্র সৃষ্টি হতে পারে।
২০০৮ সালে মিয়ানমারের সংবিধানটি এমনভাবে সামরিক জান্তা প্রণয়ন করে যে, সরকার সম্মত না হলে এর মধ্যে কোনো ধরনের সংশোধনী আনা সম্ভব নয়। সংসদের উচ্চ কক্ষ এবং নিম্ন কক্ষ- দু’টিতেই সেনাবাহিনীর সংরক্ষিত আসন রয়েছে ২৫ শতাংশ। উচ্চ কক্ষের ২২৪ আসনের মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য রয়েছেন ৫৬ জন। আর নিম্ন কক্ষের ৪৪০ জনের মধ্যে রয়েছেন ১১০ জন। কেবল বাকি আসনগুলোতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। দুই কক্ষে ৭৫ শতাংশ সদস্যের ভোটে যেকোনো সংশোধনী অনুমোদন হতে হয়। এরপরও সংবিধান সংশোধনীর ব্যাপারে ভেটো দিয়ে তা অকার্যকর করে দিতে পারে সেনাবাহিনী। এসব ব্যবস্থার কারণে শাসকেরা সম্মত না হলে সে সংস্কার কোনো সময় আনা যাবে না। এই সংবিধানে একটি অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছে- মিয়ানমারের কোনো নাগরিকের স্বামী-স্ত্রী বা সন্তান বিদেশের নাগরিক হলে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এটি যে বিরোধী নেতা সু কিকে লক্ষ্য করেই তৈরি হয়েছে, তাতে সংশয় নেই। এটি সংশোধন করা না হলে সু কির পক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হবে না। অন্য দিকে প্রেসিডেন্ট সরকারের প্রধান নির্বাহী পদ হওয়ায় তার ক্ষমতা ছাড়া কার্যত দেশটিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনার সুযোগও নেই।
রাজনৈতিক দিক ছাড়াও আরো দু’টি প্রধান ইস্যু রয়েছে মিয়ানমারে। এর একটি হলো ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পথ খোলা। আরেকটি হলো দেশটি বিভিন্ন অঞ্চলের সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে মূল ধারার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা। রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি এ দু’টিও সংস্কার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রেসিডেন্ট থিন শেইনের সরকার দেশটিতে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে চীনা অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ প্রকল্প মিথস্টোন হাইড্রো বাঁধ নির্মাণ স্থগিত করে পশ্চিমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয় মিয়ানমার সরকার। এর পর থেকে মিয়ানমারে কার্যত আর একতরফা চীনা বিনিয়োগ হচ্ছে না। মুক্তভাবে বড় বড় প্রকল্পে অন্য দেশের কোম্পানিকেও প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। এ জন্য বিশ্বব্যাংক ও অন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারও আনা হচ্ছে। বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন মিয়ানমারে বিনিয়োগ করতে পারছে। ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুর, জাপান, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকান কোম্পানিগুলো মিয়ানমারে বিনিয়োগ শুরু করেছে। বিদেশী ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতে সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে কোনো ক্ষেত্রেই এই উন্মুক্ততা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে করা হচ্ছে না। বিদেশী ব্যাংকগুলোকে স্থানীয় কোম্পানিতে বিনিয়োগ বা ঋণ দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। তেল এবং গ্যাস খাতে এখনো বড় বিনিয়োগ নিয়ে আসতে পাশ্চাত্যের কোম্পানিগুলো ভরসা পাচ্ছে না।
অর্থনৈতিক সংস্কারে মাঝে মধ্যে শ্লথগতি সৃষ্টি হওয়ায় পাশ্চাত্যও সতর্ক নীতি নিয়ে চলেছে মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার ক্ষেত্রে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আমেরিকা এখনো পুরো নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়নি মিয়ানমারের ওপর থেকে। ২০১৫ সালের নির্বাচন এবং অন্য প্রধান ক্ষেত্রগুলো সংস্কারের অগ্রগতি দেখে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে পুরোপুরি একাত্ম হওয়ার সুযোগ দিতে চাইতে পারে দেশটিকে। কিন্তু এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না, সে পথে শেষ পর্যন্ত কতটা হাঁটতে পারবে বেসামরিক মোড়কের বর্তমান সেনা সরকার।
বেসামরিক পোশাকের জান্তা সরকারের সংস্কার কর্মসূচির মধ্যে পরিবর্তনের আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো নৃতাত্ত্বিক সমস্যা। মিয়ানমারের জটিল নৃতাত্ত্বিক সঙ্কটের রাতারাতি সমাধান যে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, সেটি সব পক্ষই জানেন। এ সঙ্কটের দোহাই দিয়ে দেশটিতে বারবার সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। দেশটিকে সাতটি রাজ্য এবং সাতটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। রাজ্যগুলোতে রয়েছে সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর গরিষ্ঠতা আর অঞ্চলগুলোতে রয়েছে সংখ্যাগুরু বর্মীদের প্রাধান্য। সাত রাজ্যের মধ্যে প্রায় সবগুলোতেই রয়েছে কম-বেশি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা নৃতাত্ত্বিক বঞ্চনাজনিত অসন্তোষ। মিয়ানমারের পাঁচ কোটি ১৪ লাখ মানুষের মধ্যে ৬৮ শতাংশ হলো বর্মী নৃতাত্ত্বিক ধারার। এর বাইরে ১০ শতাংশ শান, সাত শতাংশ কারেন, চার শতাংশ রাখাইন এবং তিন শতাংশ চীনা রয়েছে। এর বাইরে রোহিঙ্গাসহ আরো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। মোট জনসংখ্যার বিচারে তাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য না হলেও বিভিন্ন রাজ্য ও অঞ্চলে রয়েছে তাদের সংখ্যাধিক্য। এসব অঞ্চলে অনেক ক্ষেত্রে দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। বার্মিজ সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের সাথে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে তাদের দমন করার চেষ্টাই করেছে বারবার। ফলে প্রতিবেশী বাংলাদেশ থাইল্যান্ড চীন এমনকি মালয়েশিয়াকেও বিপুলসংখ্যক বর্মী উদ্বাস্তুর ভার দশকের পর দশক ধরে বইতে হচ্ছে।
সংস্কারের অংশ হিসেবে বর্তমান সরকার নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর সাথে সমঝোতায় আসার উদ্যোগও নেয়। কিন্তু এই উদ্যোগের কোনোটাই সেভাবে পূর্ণতা পাচ্ছে না। অধিকন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় এসব নৃতাত্ত্বিক বিরোধের বিষয়কে নতুন করে চাঙ্গা করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। গত ৯ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে চীনা সীমান্তবর্তী কোকাং অঞ্চলে কোকাং মিয়ানমার ডেমোক্র্যাটিক এলায়েন্স আর্মির সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর মারাত্মক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ৫০ জন সেনাসদস্য নিহত হন। ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট সেখানে জরুরি অবস্থা জারি করেন। ২০০৯ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কোকাংয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর ৩০ হাজার লোক চীনা সীমান্ত পার হয়ে আশ্রয় নেয়। এর পর থেকে কোকাং বাহিনীর সাথে মাঝে মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ হচ্ছে। এর মধ্যে মিয়ানমারের বিমানবাহিনীর হামলায় চীনের অভ্যন্তরে সে দেশের ছয় আখচাষি নিহত হওয়ার ঘটনা নতুন করে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ায়। অন্য দিকে মিয়ানমারের ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম যাদের সাময়িক রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছিল, তাদের আগামী নির্বাচনে ভোট দেয়ার অধিকার ঘোষণার অল্প কয়েক দিন পর চরমপন্থী বৌদ্ধদের বিক্ষোভের মুখে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। সশস্ত্রভাবে সংঘাতে লিপ্ত ১৩টি গ্রুপের মধ্যে সরকার নির্বাচনের আগে পরিস্থিতিকে ঠাণ্ডা করে মূল ধারার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সবাইকে নিয়ে আসার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে মাত্র চারটি গ্রুপের সাথে অস্ত্রবিরতি স্বাক্ষর করতে পেরেছে। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি অন্য গ্রুপগুলোর সাথেও সমঝোতার ব্যাপারে সরকারের দৃঢ় কোনো সংকল্পের পরিচয় না দেয়ার মধ্যে অনেকে নির্বাচন ও সংস্কারের ব্যাপারে সরকারের নেপথ্য ক্ষমতাধরদের কতটা আন্তরিকতা রয়েছে তা নিয়ে সংশয় দেখতে পাচ্ছেন।
সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোতে মিয়ানমারের সংস্কার এবং গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রার ব্যাপারে একসময় যে উৎসাহ দেখা যেত, সেটি এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। বরং বিভিন্ন নেতিবাচক খবরগুলো এখন ফলাও করে প্রকাশ হতে দেখা যাচ্ছে। কোকাং নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সাথে সংঘর্ষ এবং রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার দেয়ার ঘোষণার পর তা থেকে সরে আসা এবং বিভিন্ন মানবাধিকার হরণমূলক কর্মকাণ্ড এখন নিয়মিতভাবে আসছে ইউরোপ-আমেরিকার পত্রপত্রিকায়।
গত ডিসেম্বরে এশিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পুরো মিয়ানমারে একটি ব্যাপকভিত্তিক জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এই জরিপটি ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ‘মিয়ানমার ২০১৪ : সিবিক নলেজ অ্যান্ড ভেলুজ ইন এ চেঞ্জিং সোসাইটি’ শীর্ষক এই জরিপের অংশগ্রহণকারী ৬২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে, দেশটির সংস্কার সঠিক নির্দেশনায় এগিয়ে যাচ্ছে। এ সময় ৯৩ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছিল তারা আগামী অক্টোবর/নভেম্বরের অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ভোট দেবে। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৬৮ শতাংশের আশা ছিল তারা মুক্তভাবেই ভোট দিতে পারবে। তবে সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী প্রধান রাজ্যগুলোতে ৫৬ শতাংশ এ ব্যাপারে ইতিবাচক আশাবাদ প্রকাশ করে; যদিও সংখ্যাগুরু বর্মীপ্রধান অঞ্চলে ৭২ শতাংশ অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে বলে আশা করেছিল।
এই জরিপে সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনে কতটা পরিবর্তন আনতে পেরেছে তার জবাবটিও পাওয়া যায়। অর্ধেক মানুষ জানায়, তাদের অবস্থার তেমন কোনো হেরফের হয়নি। ৩৫ শতাংশ বলেছে, তাদের অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। আর ১৪ শতাংশ তাদের অবস্থার অবনতি ঘটেছে বলে জানায়। রাজনৈতিক সংস্কারের পর কিছুটা মুক্ত বলে নিজেদের অনুভব করছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ৬৬ শতাংশ বলেছিল, হ্যাঁ, কিছুটা ভারমুক্ত মনে হচ্ছে তাদের। ২৫ ভাগ মানুষ বলেছে তারা নিজেদের এখনো তেমন মুক্ত ভাবতে পারছে না। এ সংখ্যাটা রাজ্য অঞ্চলগুলোতে বেশি।
স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মিয়ানমারের বাস্তবতা হলো সেখানে গণতন্ত্রের চর্চা হতে পেরেছে খুবই অল্প সময়ের জন্য। ফলে গণতন্ত্রের ব্যাপারে তাদের প্রত্যাশা রয়েছে কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজ কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে সামান্য ধারণা তাদের রয়েছে। সর্বাত্মকবাদী শাসন তাদের মধ্যে এমন এক অসচেতনতা সৃষ্টি করেছে যে, প্রেসিডেন্ট কি জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন, নাকি সংসদ সদস্যরা তাকে নির্বাচিত করেন সেটি বলতে পারেনি ৪৪ শতাংশ নাগরিক। তারা জাতীয় এবং গ্রাম পর্যায়ে কী হয় সে সম্পর্কে কিছু ধারণা রাখে। কিন্তু এর মাঝে কী হচ্ছে সে সম্পর্কে ধারণা খুব কমই তাদের রয়েছে।
কিছু দিন আগ পর্যন্ত পশ্চিমা পর্যবেক্ষকেরা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক যাত্রার ব্যাপারে বেশ উচ্চাশা প্রকাশ করে বলতেন, দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছেই শুধু নয়, এই দেশটি একটি পুরোপুরি গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল এ জন্য প্রস্তুতিও শুরু করেছে। তারা প্রার্থী বাছাই এবং প্রচারণার কৌশল কী হবে তা নিয়ে কাজ করছে। নৃতাত্ত্বিক ছোট গ্রুপগুলো নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার উদ্যোগও নিয়েছে। কিন্তু তাৎপর্যের বিষয়টি হলো, বহু দশক ধরে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা সামরিক জেনারেলরা শেষ পর্যন্ত কী করবে সে সম্পকের্ কেউই নিশ্চিত হতে পারছে না। কোকাং ও রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার নিয়ে ঘটনা ছাড়াও আরো কিছু হচ্ছে যা নিয়ে গণতান্ত্রিক আশাবাদকে মাঝে মধ্যে কালো মেঘ ঢেকে দিচ্ছে। এমনো বলা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে জেনারেলদের স্বার্থ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা না গেলে আবারো নৃতাত্ত্বিক সঙ্ঘাত সংঘর্ষ বাধিয়ে দিয়ে ঘড়ির কাঁটাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হবে। যার সাথে বর্তমানের বিশ্ব শক্তিগুলোর মধ্যে নবপর্যায়ে যে স্নাযুযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তার যুগসূত্র থাকবে। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট কোন পথে যাবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বিচ্ছিন্নতাবাদ নতুন করে দানা বাধার আলামত দেখা যাচ্ছে, তার সাথেও এর যুগসূত্র সৃষ্টি হতে পারে।
No comments