ভাঙাগড়া by মাহবুব তালুকদার
মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী দুটি অত্যন্ত গোপনীয় তথ্য ফাঁস করেছেন। চাচা বললেন।
কি সেই গোপন তথ্য? আমি জানতে চাইলাম।
৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় ভাষণে তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার পুত্র আরাফাত রহমান কোকো হেরোইনসেবী ছিল। তাছাড়া, তার অপর ছেলে তারেক রহমান ‘পলাতক’।
মতিয়া চৌধুরী কীভাবে জানলেন যে কোকো মাদকসেবী ছিলেন?
তিনি সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন যে, তিনি কৃষিমন্ত্রী। নিজেকে হয়ত খাদ্যমন্ত্রী ভেবেছিলেন। এই সাময়িক বিস্মৃতির কারণেই তিনি কে কী খায়, না খায়, তা নজরদারিতে রেখেছেন।
এহেন উক্তি আমার কাছে অমানবিক বলে মনে হয়। কোকো’র ইন্তেকালের পর দু’মাসও অতিবাহিত হয়নি। তিনি কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন না, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তো নয়ই। মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে এরূপ নেতিবাচক উক্তি নিতান্ত অশোভন। কোকো’র জীবিতকালে যদি এমন উক্তি করা হতো তাহলেও একটা কথা ছিল।
আমি বললাম, চাচা! তারেক রহমান যে ‘পলাতক’ তা আমরা সবাই জানি। বেগম খালেদা জিয়াও যে ‘পলাতক’, একথা বলতে বেগম মতিয়া চৌধুরী সম্ভবত ভুলে গেছেন। পার্থক্য হচ্ছে, একজন দেশে ও অন্যজন বিদেশে পলাতক। তবে খালেদা জিয়ার মতো একজন পলাতক আসামিকে নিয়ে সরকারের টেনশনের অন্ত নেই। ‘পলাতক’ আসামিকে খুঁজে বের না করে তাকে রাজকীয় নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। বিদেশী কূটনীতিক বা রাষ্ট্রদূতরা অবশ্য গুলশানের ৮৬ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাড়িতে গেলে ‘পলাতক’ খালেদা জিয়াকে সেখানেই খুঁজে পাচ্ছেন।
চাচা জানালেন, মতিয়া চৌধুরী কাউকে পরোয়া করেন না। কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলেন না। বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটকে বাংলাদেশে দায়িত্ব গ্রহণের আগেই মতিয়া চৌধুরী কড়া ধমক দিয়েছিলেন। তাকে বলেছিলেন, ‘হিসাব করে কথা বলবেন।’ এরপর বার্নিকাট এদেশে এসে হিসাব কষে কষে কথা বলছেন।
ব্যাপারটা অবশ্য আমিও জানি। বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে পেশাদার কূটনীতিবিদ মার্শা স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট গত ১৮ই জুলাই সিনেটের ফরেন রিলেশনস কমিটির শুনানিতে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিঃসন্দেহে ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর জরুরিভিত্তিতে গঠনমূলক সংলাপে বসা প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার যে দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন।’ এ কথার প্রতিক্রিয়ায় শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে গত ২২শে জুলাই মতিয়া চৌধুরী কঠোরভাবে বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী দেশের মানুষের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়েছে। অথচ নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে না এসেই আমেরিকায় বসে নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন। উনি কি নির্বাচন স্বপ্নে দেখেছেন?’ কথাটা খুবই যৌক্তিক। তবে সিনেট ফরেন রিলেশন কমিটির কেউ প্রশ্ন তুলল না, ‘আপনি বাংলাদেশে না গিয়ে সরেজমিনে না দেখে তাদের নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বললেন কিভাবে?’ এখানেই শেষ নয়। সিনেট কমিটির শুনানিতে উত্তীর্ণ হয়ে বার্নিকাট রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত হন ও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও তাকে নিয়োগ প্রদান করেন।
এ সম্পর্কে আমার আরো কিছু বক্তব্য আছে। পূর্ববর্তী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে বেসরকারি পর্যায়ে নাতিশীতোষ্ণভাবে এবং সরকারি পর্যায়ে শীতলভাবে বাংলাদেশ থেকে বিদায় জানানো হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বিদায় সাক্ষাৎকার পর্যন্ত মঞ্জুর করেননি। সুতরাং বার্নিকাটের ওই বক্তব্য ও মতিয়া চৌধুরীর তীব্র প্রতিবাদের ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্জীব ভূমিকা কেন পালন করলো বুঝলাম না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে মতিয়া চৌধুরীর পাশে দাঁড়িয়ে বার্নিকাটকে ‘এগ্রিমো’ না দিলেই পারতো। বার্নিকাটকে এদেশে গ্রহণ না করলেও তাতে কূটনৈতিক বিধি-বিধানের ব্যত্যয় ঘটতো না।
আমার এক বন্ধু সেদিন টেলিফোনে জানিয়েছেন, যারা ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আওয়ামী লীগে এসেছেন কিংবা যারা বাম ঘরানা থেকে আগত মন্ত্রী বা উচ্চপদে আসীন, তাদের আচার-আচরণে এক ধরনের ভিন্নতা আছে। অগ্নিকন্যা খ্যাত মতিয়া চৌধুরী নাকি ব্যতিক্রম। তার অগ্নিমূর্তি নাকি তাকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। আমি অবশ্য মনে করি, রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি আওয়ামী লীগের মধ্যে ‘এক দেহে লীন’ হয়েছেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে তার মূল্যায়ন যা-ই হোক না কেন, মন্ত্রী হিসেবে তার সফলতাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে চাচা প্রশ্ন করলেন, কী ভাবছো? মতিয়া চৌধুরীর কথাই তো?
জ্বি। তাঁর কথাই ভাবছি।
ভাবতেই হবে। আগে তাকে ‘অগ্নিকন্যা’ বলা হতো। এখন তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে বলতেই হবে তিনি ‘আয়রন ওম্যান’। সেদিন তিনি কী বলেছেন, জানো?
কী?
তিনি বলেছেন, যারা বর্তমান পরিস্থিতিতে সংলাপের কথা বলে, তারা সবাই পাগল। চাচা জানালেন, এটা খুব সোজা-সাপটা কথা।
তা বটে! বলতে গিয়ে আমি থেমে গেলাম।
কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আমার মস্তিষ্কে ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হলো। যারা বর্তমান সঙ্কট উত্তরণে সংলাপ চেয়েছেন, মনে মনে তাদের একটা তালিকা তৈরির চেষ্টা করলাম। এ মুহূর্তে যাদের নাম স্মরণ করতে পারছি, তারা হলেন: জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতবৃন্দ, মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার গ্রেগ উইলকক, জাপানের রাষ্ট্রদূত শিরো সাদোসিমাসহ অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতবৃন্দ, নাগরিক সংলাপের উদ্যোক্তা ড. এটিএম শামসুল হুদা ও তার সহযোগীবৃন্দ। এরা সত্যি সত্যি পাগল হলে এত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন কী করে? ব্যাপারটা আমার মাথায় রীতিমত তালগোল পাকিয়ে ফেলল।
দু’দিন পরে গুলশানের কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন। চাচা ও আমি একত্রে বসে টেলিভিশনে সংবাদ সম্মেলন দেখছি। ওখানে প্রচুর সাংবাদিকের সমাগম দেখে চাচা বলে উঠলেন, কাণ্ডটা দেখেছ?
কী কাণ্ড?
একজন হত্যার আসামির প্রেস কনফারেন্সে এত লোক হবে কেন? এটা কি তার জনসভা?
চাচা! ওরা তো সবাই সাংবাদিক।
তাই বলে টিভি চ্যানেলগুলো ওই সংবাদ সম্মেলনকে ‘লাইভ’ দেখাবে কেন? দেশে কি কোন আইন-কানুন নেই?
আইন-কানুন তো নিশ্চয়ই আছে?
আইন থাকলে তার প্রয়োগ কোথায়? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করেটা কি? উনি যা ইচ্ছা তা বলে যাবেন, আর আমাদেরকে সেটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হবে? শুনতে হবে?
টেলিভিশনে তাকিয়ে দেখা আর শোনা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি আমরা? আমি বললাম, চাচা! ব্যাপারটা অন্যদিক থেকে ভেবে দেখুন। বাংলাদেশে যে বাক- স্বাধীনতা আছে, মিডিয়ার স্বাধীনতা আছে, এতে কিন্তু তা-ই প্রমাণিত হয়।
চাচা কিঞ্চিৎ নরম হলেন। শান্তকণ্ঠে বললেন, তোমার কথা ঠিক। কিন্তু বিদেশীরা সরকারের এই উদারতা বুঝতে পারবে তো? খালেদা জিয়ার প্রেস কনফারেন্সের খবরটা তাহলে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়া উচিত। কী বল?
কথাটার অর্থ আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
টেলিভিশন দেখা শেষ হলে চাচা বললেন, তোমাকে আরেকটা গোপন খবর শোনাব।
কী খবর?
কাউকে বলো না, বিএনপি’র সঙ্গে ইতোমধ্যে সরকারের সংলাপ শুরু হয়ে গেছে।
কী বলছেন আপনি!
আমি এতটুকু মিথ্যা বলছি না কিংবা বাড়িয়েও বলছি না।
তবে যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপির সঙ্গে যে কোন ধরনের সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন।
চাচা মৃদু হেসে বললেন, প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। গত ৪ঠা জানুয়ারি সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘উনার (বেগম জিয়ার) অনেক সাবেক এমপি’র সঙ্গে কথা হয়েছে। তারাও এ রকম কর্মকাণ্ড (খালেদা জিয়া আন্দোলনের নামে যা করছেন) পছন্দ করছেন না।’
আমাদের আলোচনার এই পর্যায়ে চাচি ঘরে ঢুকলেন। বললেন, কী বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে?
আমরা একটা গোপন বিষয়ে আলোচনা করছি। চাচা বললেন।
আমার কি শুনতে বা জানতে মানা আছে?
না, না। তা হবে কেন? আমি বললাম, চাচি! আপনি বসুন। যত গোপনই হোক, আপনার কাছে আমাদের লুকোবার কিছুই নেই।
চাচি আমাদের পাশে বসলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, গোপন কথাটি কী?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপি’র সাবেক এমপিদের সঙ্গে সংলাপ চালাচ্ছেন।
এ আর গোপন কথা কী? প্রধানমন্ত্রী নিজেই জাতীয় সংসদে একথা বলেছেন।
চাচা বললেন, বিএনপির নেতারা যদি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে দেশটা বর্তমান দুর্যোগ থেকে বেঁচে যায়। সরকারের উচিত দেশের স্বার্থে তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করা।
সরকার কি বসে আছে? চাচি জানালেন, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা আছে কি করতে? বাংলাদেশের রাজনীতিতে গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা অতীতে ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। রাজনৈতিক দল ভাঙা-গড়ার ব্যাপারটা তারা বেশ ভালোই করতে পারেন। এক-এগারোর সময়ের কথা তোমরা কি ভুলে গেলে?
তুমি এর মধ্যে আবার তাদের টেনে আনলে কেন?
আমি টেনে আনার কে? তারা এসব কাজে সর্বদাই সক্রিয়। বিএনপিকে এখন ভাঙার ষড়যন্ত্র চলছে। ২০১৩ সালেও বিএনপিকে ভাঙার ষড়যন্ত্র হয়েছিল।
চাচা বললেন, বিএনপিকে টুকরো করে দেশের সঙ্কটাপন্ন অবস্থার যদি অবসান ঘটে, সে তো ভালো কথা। তুমি এটাকে ষড়যন্ত্র বলছো কেন? খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে নতুন বিএনপি গড়া হলে দেশের মানুষ খুশি হবে।
দেশের মানুষ বুঝি তোমার কানে কানে এসে একথা বলে গেছে?
চাচির বক্তব্য শুনে চাচা বক্রদৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে।
কথার মোড় ঘুরিয়ে দিতে আমি বললাম, বিএনপির নাম দিয়ে আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রাক্তন সংসদ সদস্য আবু হেনা ও শহীদুল হক জামালকে দাঁড় করিয়ে দিলে হয়। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সুবিধা হচ্ছে যে, তা নির্দলীয় নির্বাচনের আবরণে দলীয় নির্বাচন। সরকার দেশে-বিদেশে প্রচার করতে পারে যে, বিএনপি নির্বাচনে আছে। সরকার চাইলে একটা পদ তাদেরকে ছেড়েও দিতে পারে।
অসম্ভব! তোমার কথার মধ্যে কেমন ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চাচা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নতুন বিএনপি গড়ার ব্যাপারটা তোমরা পজিটিভলি নিচ্ছো না কেন? যে দু’জন পুরোনো বিএনপি নেতা নতুন বিএনপি গড়ার জন্য এগিয়ে এসেছেন, তাদের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে।
নতুন বিএনপি গড়ার জন্য, না পুরোনো বিএনপি ভাঙার জন্য? চাচির প্রশ্ন।
দুটোই হতে পারে। বিএনপি যদি ভঙ্গুর দল হয়, তা ভেঙে যাওয়াই উচিত। আমি অন্তত নতুন দলকে স্বাগত জানাবো।
শোন। আমাদের কথা শুনে চাচি শান্তকণ্ঠে বললেন, বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা অতীতে বহুবার হয়েছে। তাতে কোন লাভ হয়নি। দলছুটরা কোনোদিনই মূল দলের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। তাহলে এতদিন বাকশাল টিকে থাকতো। একটু থেমে চাচি আবার বললেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলার নামের তলে ইতিহাসে আরেকটি নাম লিপিবদ্ধ আছে। আশা করি তার নাম বুঝতে তোমাদের অসুবিধা হবে না।
কি সেই গোপন তথ্য? আমি জানতে চাইলাম।
৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় ভাষণে তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার পুত্র আরাফাত রহমান কোকো হেরোইনসেবী ছিল। তাছাড়া, তার অপর ছেলে তারেক রহমান ‘পলাতক’।
মতিয়া চৌধুরী কীভাবে জানলেন যে কোকো মাদকসেবী ছিলেন?
তিনি সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন যে, তিনি কৃষিমন্ত্রী। নিজেকে হয়ত খাদ্যমন্ত্রী ভেবেছিলেন। এই সাময়িক বিস্মৃতির কারণেই তিনি কে কী খায়, না খায়, তা নজরদারিতে রেখেছেন।
এহেন উক্তি আমার কাছে অমানবিক বলে মনে হয়। কোকো’র ইন্তেকালের পর দু’মাসও অতিবাহিত হয়নি। তিনি কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন না, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তো নয়ই। মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে এরূপ নেতিবাচক উক্তি নিতান্ত অশোভন। কোকো’র জীবিতকালে যদি এমন উক্তি করা হতো তাহলেও একটা কথা ছিল।
আমি বললাম, চাচা! তারেক রহমান যে ‘পলাতক’ তা আমরা সবাই জানি। বেগম খালেদা জিয়াও যে ‘পলাতক’, একথা বলতে বেগম মতিয়া চৌধুরী সম্ভবত ভুলে গেছেন। পার্থক্য হচ্ছে, একজন দেশে ও অন্যজন বিদেশে পলাতক। তবে খালেদা জিয়ার মতো একজন পলাতক আসামিকে নিয়ে সরকারের টেনশনের অন্ত নেই। ‘পলাতক’ আসামিকে খুঁজে বের না করে তাকে রাজকীয় নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। বিদেশী কূটনীতিক বা রাষ্ট্রদূতরা অবশ্য গুলশানের ৮৬ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাড়িতে গেলে ‘পলাতক’ খালেদা জিয়াকে সেখানেই খুঁজে পাচ্ছেন।
চাচা জানালেন, মতিয়া চৌধুরী কাউকে পরোয়া করেন না। কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলেন না। বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটকে বাংলাদেশে দায়িত্ব গ্রহণের আগেই মতিয়া চৌধুরী কড়া ধমক দিয়েছিলেন। তাকে বলেছিলেন, ‘হিসাব করে কথা বলবেন।’ এরপর বার্নিকাট এদেশে এসে হিসাব কষে কষে কথা বলছেন।
ব্যাপারটা অবশ্য আমিও জানি। বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে পেশাদার কূটনীতিবিদ মার্শা স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট গত ১৮ই জুলাই সিনেটের ফরেন রিলেশনস কমিটির শুনানিতে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিঃসন্দেহে ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর জরুরিভিত্তিতে গঠনমূলক সংলাপে বসা প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার যে দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন।’ এ কথার প্রতিক্রিয়ায় শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে গত ২২শে জুলাই মতিয়া চৌধুরী কঠোরভাবে বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী দেশের মানুষের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়েছে। অথচ নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে না এসেই আমেরিকায় বসে নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন। উনি কি নির্বাচন স্বপ্নে দেখেছেন?’ কথাটা খুবই যৌক্তিক। তবে সিনেট ফরেন রিলেশন কমিটির কেউ প্রশ্ন তুলল না, ‘আপনি বাংলাদেশে না গিয়ে সরেজমিনে না দেখে তাদের নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বললেন কিভাবে?’ এখানেই শেষ নয়। সিনেট কমিটির শুনানিতে উত্তীর্ণ হয়ে বার্নিকাট রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত হন ও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও তাকে নিয়োগ প্রদান করেন।
এ সম্পর্কে আমার আরো কিছু বক্তব্য আছে। পূর্ববর্তী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে বেসরকারি পর্যায়ে নাতিশীতোষ্ণভাবে এবং সরকারি পর্যায়ে শীতলভাবে বাংলাদেশ থেকে বিদায় জানানো হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বিদায় সাক্ষাৎকার পর্যন্ত মঞ্জুর করেননি। সুতরাং বার্নিকাটের ওই বক্তব্য ও মতিয়া চৌধুরীর তীব্র প্রতিবাদের ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্জীব ভূমিকা কেন পালন করলো বুঝলাম না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে মতিয়া চৌধুরীর পাশে দাঁড়িয়ে বার্নিকাটকে ‘এগ্রিমো’ না দিলেই পারতো। বার্নিকাটকে এদেশে গ্রহণ না করলেও তাতে কূটনৈতিক বিধি-বিধানের ব্যত্যয় ঘটতো না।
আমার এক বন্ধু সেদিন টেলিফোনে জানিয়েছেন, যারা ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আওয়ামী লীগে এসেছেন কিংবা যারা বাম ঘরানা থেকে আগত মন্ত্রী বা উচ্চপদে আসীন, তাদের আচার-আচরণে এক ধরনের ভিন্নতা আছে। অগ্নিকন্যা খ্যাত মতিয়া চৌধুরী নাকি ব্যতিক্রম। তার অগ্নিমূর্তি নাকি তাকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। আমি অবশ্য মনে করি, রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি আওয়ামী লীগের মধ্যে ‘এক দেহে লীন’ হয়েছেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে তার মূল্যায়ন যা-ই হোক না কেন, মন্ত্রী হিসেবে তার সফলতাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে চাচা প্রশ্ন করলেন, কী ভাবছো? মতিয়া চৌধুরীর কথাই তো?
জ্বি। তাঁর কথাই ভাবছি।
ভাবতেই হবে। আগে তাকে ‘অগ্নিকন্যা’ বলা হতো। এখন তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে বলতেই হবে তিনি ‘আয়রন ওম্যান’। সেদিন তিনি কী বলেছেন, জানো?
কী?
তিনি বলেছেন, যারা বর্তমান পরিস্থিতিতে সংলাপের কথা বলে, তারা সবাই পাগল। চাচা জানালেন, এটা খুব সোজা-সাপটা কথা।
তা বটে! বলতে গিয়ে আমি থেমে গেলাম।
কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আমার মস্তিষ্কে ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হলো। যারা বর্তমান সঙ্কট উত্তরণে সংলাপ চেয়েছেন, মনে মনে তাদের একটা তালিকা তৈরির চেষ্টা করলাম। এ মুহূর্তে যাদের নাম স্মরণ করতে পারছি, তারা হলেন: জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতবৃন্দ, মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার গ্রেগ উইলকক, জাপানের রাষ্ট্রদূত শিরো সাদোসিমাসহ অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতবৃন্দ, নাগরিক সংলাপের উদ্যোক্তা ড. এটিএম শামসুল হুদা ও তার সহযোগীবৃন্দ। এরা সত্যি সত্যি পাগল হলে এত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন কী করে? ব্যাপারটা আমার মাথায় রীতিমত তালগোল পাকিয়ে ফেলল।
দু’দিন পরে গুলশানের কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন। চাচা ও আমি একত্রে বসে টেলিভিশনে সংবাদ সম্মেলন দেখছি। ওখানে প্রচুর সাংবাদিকের সমাগম দেখে চাচা বলে উঠলেন, কাণ্ডটা দেখেছ?
কী কাণ্ড?
একজন হত্যার আসামির প্রেস কনফারেন্সে এত লোক হবে কেন? এটা কি তার জনসভা?
চাচা! ওরা তো সবাই সাংবাদিক।
তাই বলে টিভি চ্যানেলগুলো ওই সংবাদ সম্মেলনকে ‘লাইভ’ দেখাবে কেন? দেশে কি কোন আইন-কানুন নেই?
আইন-কানুন তো নিশ্চয়ই আছে?
আইন থাকলে তার প্রয়োগ কোথায়? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করেটা কি? উনি যা ইচ্ছা তা বলে যাবেন, আর আমাদেরকে সেটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হবে? শুনতে হবে?
টেলিভিশনে তাকিয়ে দেখা আর শোনা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি আমরা? আমি বললাম, চাচা! ব্যাপারটা অন্যদিক থেকে ভেবে দেখুন। বাংলাদেশে যে বাক- স্বাধীনতা আছে, মিডিয়ার স্বাধীনতা আছে, এতে কিন্তু তা-ই প্রমাণিত হয়।
চাচা কিঞ্চিৎ নরম হলেন। শান্তকণ্ঠে বললেন, তোমার কথা ঠিক। কিন্তু বিদেশীরা সরকারের এই উদারতা বুঝতে পারবে তো? খালেদা জিয়ার প্রেস কনফারেন্সের খবরটা তাহলে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়া উচিত। কী বল?
কথাটার অর্থ আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
টেলিভিশন দেখা শেষ হলে চাচা বললেন, তোমাকে আরেকটা গোপন খবর শোনাব।
কী খবর?
কাউকে বলো না, বিএনপি’র সঙ্গে ইতোমধ্যে সরকারের সংলাপ শুরু হয়ে গেছে।
কী বলছেন আপনি!
আমি এতটুকু মিথ্যা বলছি না কিংবা বাড়িয়েও বলছি না।
তবে যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপির সঙ্গে যে কোন ধরনের সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন।
চাচা মৃদু হেসে বললেন, প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। গত ৪ঠা জানুয়ারি সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘উনার (বেগম জিয়ার) অনেক সাবেক এমপি’র সঙ্গে কথা হয়েছে। তারাও এ রকম কর্মকাণ্ড (খালেদা জিয়া আন্দোলনের নামে যা করছেন) পছন্দ করছেন না।’
আমাদের আলোচনার এই পর্যায়ে চাচি ঘরে ঢুকলেন। বললেন, কী বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে?
আমরা একটা গোপন বিষয়ে আলোচনা করছি। চাচা বললেন।
আমার কি শুনতে বা জানতে মানা আছে?
না, না। তা হবে কেন? আমি বললাম, চাচি! আপনি বসুন। যত গোপনই হোক, আপনার কাছে আমাদের লুকোবার কিছুই নেই।
চাচি আমাদের পাশে বসলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, গোপন কথাটি কী?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপি’র সাবেক এমপিদের সঙ্গে সংলাপ চালাচ্ছেন।
এ আর গোপন কথা কী? প্রধানমন্ত্রী নিজেই জাতীয় সংসদে একথা বলেছেন।
চাচা বললেন, বিএনপির নেতারা যদি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে দেশটা বর্তমান দুর্যোগ থেকে বেঁচে যায়। সরকারের উচিত দেশের স্বার্থে তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করা।
সরকার কি বসে আছে? চাচি জানালেন, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা আছে কি করতে? বাংলাদেশের রাজনীতিতে গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা অতীতে ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। রাজনৈতিক দল ভাঙা-গড়ার ব্যাপারটা তারা বেশ ভালোই করতে পারেন। এক-এগারোর সময়ের কথা তোমরা কি ভুলে গেলে?
তুমি এর মধ্যে আবার তাদের টেনে আনলে কেন?
আমি টেনে আনার কে? তারা এসব কাজে সর্বদাই সক্রিয়। বিএনপিকে এখন ভাঙার ষড়যন্ত্র চলছে। ২০১৩ সালেও বিএনপিকে ভাঙার ষড়যন্ত্র হয়েছিল।
চাচা বললেন, বিএনপিকে টুকরো করে দেশের সঙ্কটাপন্ন অবস্থার যদি অবসান ঘটে, সে তো ভালো কথা। তুমি এটাকে ষড়যন্ত্র বলছো কেন? খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে নতুন বিএনপি গড়া হলে দেশের মানুষ খুশি হবে।
দেশের মানুষ বুঝি তোমার কানে কানে এসে একথা বলে গেছে?
চাচির বক্তব্য শুনে চাচা বক্রদৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে।
কথার মোড় ঘুরিয়ে দিতে আমি বললাম, বিএনপির নাম দিয়ে আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রাক্তন সংসদ সদস্য আবু হেনা ও শহীদুল হক জামালকে দাঁড় করিয়ে দিলে হয়। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সুবিধা হচ্ছে যে, তা নির্দলীয় নির্বাচনের আবরণে দলীয় নির্বাচন। সরকার দেশে-বিদেশে প্রচার করতে পারে যে, বিএনপি নির্বাচনে আছে। সরকার চাইলে একটা পদ তাদেরকে ছেড়েও দিতে পারে।
অসম্ভব! তোমার কথার মধ্যে কেমন ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চাচা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নতুন বিএনপি গড়ার ব্যাপারটা তোমরা পজিটিভলি নিচ্ছো না কেন? যে দু’জন পুরোনো বিএনপি নেতা নতুন বিএনপি গড়ার জন্য এগিয়ে এসেছেন, তাদের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে।
নতুন বিএনপি গড়ার জন্য, না পুরোনো বিএনপি ভাঙার জন্য? চাচির প্রশ্ন।
দুটোই হতে পারে। বিএনপি যদি ভঙ্গুর দল হয়, তা ভেঙে যাওয়াই উচিত। আমি অন্তত নতুন দলকে স্বাগত জানাবো।
শোন। আমাদের কথা শুনে চাচি শান্তকণ্ঠে বললেন, বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা অতীতে বহুবার হয়েছে। তাতে কোন লাভ হয়নি। দলছুটরা কোনোদিনই মূল দলের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। তাহলে এতদিন বাকশাল টিকে থাকতো। একটু থেমে চাচি আবার বললেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলার নামের তলে ইতিহাসে আরেকটি নাম লিপিবদ্ধ আছে। আশা করি তার নাম বুঝতে তোমাদের অসুবিধা হবে না।
No comments