দেশটা সব ‘কানার হাটবাজার’? by হারুন-আর-রশিদ
বাংলাদেশের
জন্মদর্শনের মূল ভিত্তি ছিল সর্বজনীন গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এখন এই
দু’টি ক্ষেত্রেই আমরা গত ৪৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃসময় অতিক্রম করছি।
প্রায় দুই মাস হয়ে গেল দেশের বড় দু’টি দল রাষ্ট্রীয় সঙ্কটের জট খুলতে
ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এটা দেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। রাজনীতিকদের
জন্য আরো লজ্জার। কারণ রাজনীতিকেরাই দেশ পরিচালনা করে থাকেন। সেহেতু তারা
কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারবেন না। দেশে সন্ত্রাস এখন চরমপর্যায়ে পৌঁছেছে।
হরতাল ও অবরোধের সুযোগে সন্ত্রাস, অন্যটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের নামে
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সন্ত্রাস। গত ৬১ দিনে এসব সন্ত্রাসে নিহত হয়েছেন ১১৬ জন।
এর মধ্যে পেট্রলবোমা ও আগুনে নিহত হয়েছেন ৬৩ জন এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর
হাতে নিহত ৫৩ জন। অপরাধ দমনের নামে বন্দুকযুদ্ধের গল্প শোনানো হচ্ছে পুরনো
স্টাইলে। অন্য দিকে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দোষী-নির্দোষ বাছবিচার না করে
প্রতিদিন শতাধিক মানুষকে গ্রেফতার করে হাজতে ঢোকানোর কাজে। যারা জনগণের
জানমালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থেকে দেশে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করবেÑ
তাদের দেখলে জনগণের মধ্যে ভীতির উদ্বেগ ঘটে। এভাবে অন্তত একটি গণতান্ত্রিক
দেশ চলতে পারে না।
আমরা এমন এক দেশে বাস করছি, যেখানে রাজনৈতিক ঘটনায় মৃত্যু হলেও সবার মৃত্যুকে মৃত্যু বলে গণ্য করা হয় না। ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী কেঁদেছেন। অনেকেই মানববন্ধনসহ মিটিং-মিছিল করেছেন বিশেষ করে সরকারি দল ও তাদের সমর্থক গোষ্ঠী। সব ধর্মগ্রন্থে হত্যাকাণ্ড পাপ ও মানবতাবিরোধী কাজ। হরতাল-অবরোধের কারণে দেশের মানুষের জানমালের ক্ষতি হয় ঠিক; তেমনি ভাষাশহীদের আত্মত্যাগের মাসে আরো অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এই মৃত্যুগুলোও ছিল অস্বাভাবিক। কিন্তু এই মৃত্যুগুলোর সাথে রাজনীতির সম্পর্ক নেই বলে সরকারের নির্বাহী প্রধানসহ তার মন্ত্রী মহোদয়গণ একেবারেই নিশ্চুপ। অর্থাৎ তাদের দৃষ্টিতে এই মৃত্যুগুলো যেন মূল্যহীন। সহিংস ঘটনায় ৪ মার্চ পর্যন্ত ৫৮ দিনে (৬ জানুয়ারি থেকে) ১১৪ জন মানুষের মৃত্যুর জন্য আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে গেছেনÑ এ কথা মন্ত্রী না বললেও বলা হয়, বেগম খালেদা জিয়াই এই মৃত্যুর জন্য দায়ী। এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে তাকে হুকুমের আসামি করা হয়।
অবশ্যই চলমান অবরোধের ঘোষণা প্রথমে আসে সরকার থেকেই বেগম জিয়াকে তার নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখার পর থেকে। দিনটি ছিল ৩ জানুয়ারি। ঢাকায় বেগম জিয়াকে ৫ জানুয়ারিতে কোনো সমাবেশ-মিটিং-মিছিল করতে দেয়া হবে নাÑ এ ধরনের একটি বার্তা সরকারপক্ষ থেকে আসার পর গুলশান কার্যালয়ে প্রায় এক ডজন ইট বালুবোঝাই ট্রাক দ্বারা বেষ্টনীর মধ্যে আটকা পড়ে যান বেগম খালেদা জিয়া। ওই সময়ে সেখানে কয়েক শত র্যাব, পুলিশ, সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দা বাহিনী এবং জলকামান, রায়টকারসহ পুলিশের গাড়ি অ্যাম্বুলেন্স রাখা হয়। ঢাকার সাথে বিভিন্ন জেলা শহরের যাতায়াতব্যবস্থা বন্ধ করে দেয় সরকার, যাতে জনসভায় কোনো মানুষ ঢাকায় আসতে না পারেন। বেগম জিয়া ৫ জানুয়ারি জনসভা অভিমুখে যখন যাত্রা শুরু করবেন তখনই কার্যালয়ের সব গেটে তালা লাগিয়ে দেয়া হয় এবং অফিসের ভেতরে পেপার স্প্রে নিক্ষেপ করা হয়। এতে বেগম জিয়া ও সাংবাদিকসহ দলের লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসব কিছুই হয়েছে সরকারের ওপরমহলের নির্দেশে। বেগম জিয়া অসুস্থ অবস্থায় (পেপার স্প্রের কারণে) একটি কথাই বলেছেনÑ সরকার দেশে যখন গাড়িচলাচল বন্ধ করে দিয়ে অবরোধ শুরু করে দিয়েছে, তখন এই অবরোধ আগামীকাল থেকে চলতে থাকবে (৬ জানুয়ারি ২০১৫) যতক্ষণ পর্যন্ত না জনগণের প্রত্যাশিত একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবেÑ যেখানে সব দলের অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটবে। গণতন্ত্র তখনই তার স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসবে। তিনি এ কথাও বলেছেন, সরকার ঘোষিত এই অবরোধ আমরা ৬ জানুয়ারি থেকে চলমান রাখব সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে, যাতে সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি না হয়। এ কথাগুলোই ৬ জানুয়ারি প্রায় সব ক’টি জাতীয় দৈনিকে লিড নিউজ হয়েছে। এই আসল কথাকে বাদ দিয়ে রঙ লাগিয়ে নকল কথা দ্বারা সাজিয়ে গুছিয়ে মিডিয়ায় প্রচার করতে দেখি সরকারি দলকে। নিয়ন্ত্রিত সব মিডিয়ায়, এসব কথা প্রচার করতেও বাধ্য করা হয়েছে। মধ্যরাতেও দেখি অনেকটা সদা মিথ্যা কথা বলিবেÑ এ ছবক দ্বারা জাতিকে উপদেশ বা নসিহত টকশোর মাধ্যমে কেউ কেউ বলে যাচ্ছেন। বোঝা যায় তারা দলপ্রেমিক। দেশপ্রেমিক কোনো লোক নন। ক্ষিপ্ত আচরণে মাঝে মধ্যে অনুষ্ঠান গুলিস্তান বা পল্টনে রাজনৈতিক কলহ বা বিবাদের আকার রূপ ধারণ করে। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মিডিয়ায় এই ধরনের আচরণ নজিরবিহীন। এখন প্রশ্ন গত ৫৮ দিনে ১১৪ জনের খুনের আসামি কে বা কারা? উল্লিখিত বক্তব্যে তা সচেতন জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। অবরুদ্ধ একজন মানুষ কী করে ১১৪ জনের খুনের আসামি হয় তা জনগণের মাথায় আসছে না। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে সহিংস রূপ দিয়ে একটি দলকে বহির্বিশ্বে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত করার পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি-নাÑ তা ও ভাবতে হবে। ৩ জানুয়ারি থেকে চলমান ঘটনার নেপথ্য ভূমিকায় আসলে কারা, তা কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ওই দিনই গণতন্ত্রের পথে সবচেয়ে বড় ব্যারিকেডটি দেয় পুলিশ প্রশাসন সরকারি দলের উচ্চ মহলের ইঙ্গিতে।
গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথে যখন প্রতিবন্ধকতা আসবে, তখনই প্রতিক্রিয়া সহিংস রূপ ধারণ করবে। প্রকৃতির ধর্ম এটাই। কথা বলার অধিকার হরণ করার আরেক নাম স্বেচ্ছাচারী শাসন। এর অর্থ হলোÑ শাসকদল কথা বলবে এবং সে কথা সবাই মেনে চলতে হবে। অন্য কোনো দল বা মানুষের কোনো কথা বলার সুযোগ থাকবে না।’ এর নাম গণতন্ত্র হতে পারে না।
কেন দেশে আজ হরতাল হচ্ছেÑ তা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়। শত্রুর সাথেও কথা বলতে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। আত্মীয় বা প্রতিবেশী কোনো মানুষের সাথে কোনো কারণে যদি কথা বন্ধ থাকেÑ তা মিটিয়ে ফেলার জন্য মহানবী সা: নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আগে সালাম দেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন। এতে বেশি পুণ্য হাসিল হয়। এসব কথা আমরা ভুলতে বসেছি বলেই দেশে আজ এত অশান্তি বিরাজমান।
অস্বাভাবিকভাবে দেশে প্রতিদিনই গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন। প্রথম আলো ১ মার্চ সংখ্যায় একজন সচেতন পাঠক অন লাইনে বলেছেনÑ ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মায় লঞ্চডুবিতে ৭৮ জন সাধারণ মানুষ মারা গেলেনÑ নেতানেত্রীরা কাঁদলেন না। কেউ মানববন্ধন করল না। সিলেটের এক হাসপাতালে এক দিনেই ১০ শিশুসহ ৩২ জন প্রাণ হারালেন চিকিৎসকদের গাফিলতির কারণে। নেতানেত্রীরা কেউ কাঁদলেন না। ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে গিয়ে নেতানেত্রীদের কান্নার যে মহড়া মিডিয়ায় দেখলামÑ সে রকম কোনো দৃশ্য দেখলাম না। একটি প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ১০ জন মারা গেলেন কেউ কাঁদল না। মানববন্ধনও কেউ করল না। সৌদি আরবে কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে পাঁচজন বাংলাদেশী মারা গেলেন; কিন্তু নেতারা কেউ কাঁদলেন নাÑ কেউ সাহায্য প্রদানও করল না। ১১ ফেব্রুয়ারি ওমানে আগুনে পুড়ে চার বাংলাদেশী মারা গেলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি আবুধাবিতে অগ্নিকাণ্ডে তিনজন বাংলাদেশী মারা গেলেন। তাদের জন্যও নেতানেত্রীরা কেউ কাঁদলেন না, দুঃখ প্রকাশ পর্যন্ত কেউ করল না। ৩ জানুয়ারি থেকে ১ মার্চ জাতীয় দৈনিকের হিসাবে ৭০-এর অধিক মানুষ ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ, গণপিটুনিতে মারা গেছেন। এসব মৃত্যুতে অনেকেই হয়তো কাঁদবেন না, মানববন্ধন করবেন না। কারণ, এগুলো রাজনৈতিক নয়। তাদের মৃত্যুতে চোখের পানি ফেললে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল হবে না। দেশটা যেন সব কানার হাটবাজার হয়ে গেছে। খিলগাঁওয়ে শিশু জেহাদের করুণ মৃত্যু গোটা দেশের মানুষকে কাঁদিয়েছে। কিন্তু কাঁদাতে পারেনি শাসকদলকে। কারণ তাদের অব্যবস্থার কারণেই শিশুটি নিহত হয়। বইমেলায় পুলিশের নাকের ডগার ওপর অভিজিৎ-এর হত্যাকাণ্ড নিন্দনীয়। এখানেও রাজনীতিকে টেনে আনা হয়েছে। এমন মন্তব্য এসেছে ‘খোকা-মান্নার ফোনালাপের প্রথম লাশ হলো অভিজিৎ।’ দেশে এ রকম আরো অনেক অভিজিৎ-এর মৃত্যু হচ্ছে। সব হত্যাই নিন্দনীয়। প্রশাসন এসব হত্যাকাণ্ডের দায় কিভাবে এড়াবে? এত পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার; তারপরও খুন হচ্ছে মানুষ। এসব মৃত্যু নিয়ে একশ্রেণীর দলকানা এবং জ্ঞানপাপী ফায়দা লুটার কাজে ব্যস্ত। একটি দেশের মানুষ, যে ভিন্ন ভিন্ন মতে, ভিন্ন ধর্মে বা আদর্শে বিশ্বাসী হতে পারে। হতে পারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোক। তাই বলে একটি মৃত্যুকে যথার্থ বলে বাহবা দেয়া, আরেকটি মৃত্যুকে নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করাÑ তা কোনো মতেই মানবতা নয়। হত্যার আইনি বিচার জনগণ প্রত্যাশা করে। অথচ অগণিত খুনের বিচার হয়নি। জামিন পেয়ে গেছে খুনের এমন আসামি কম নয়।
রাজধানীর কাজীপাড়ায় ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে তিন তরুণ গুলিতে নিহত হন। দু’জন পরিবহন শ্রমিক। তাদের শরীরে মোট ৫৪টি গুলির ক্ষত রয়েছে। পুলিশ বলছে, জনতার পিটুনিতে তারা নিহত হয়েছেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো লিখেছে বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ৫১ দিনে নিহত ৪৭ জন্য, এর মধ্যে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৩৩ জন, গুলিবিদ্ধ লাশ সাত, পালাতে গিয়ে বাসচাপা পড়ে চার এবং গণপিটুনিতে নিহত তিন। পত্রিকার প্রতিবেদক রংপুর, মিঠাপুকুর থেকে জানিয়েছেনÑ এক পরিবারে তিনজনের সন্ধান নেই দেড় মাসেও। দেশে চলছে মিডিয়া ট্রায়াল। সরকার করছে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ। দেশের বৃহত্তম বিরোধী দলবিহীন মিডিয়া। এ দিকে বিশিষ্ট লেখক, প্রতিবেদক, এমনকি সম্পাদকীয় মন্তব্যও লেখা হচ্ছে গণতন্ত্রের বেহালদশা নিয়ে। একজন টেলিভিশন দর্শক যদি এক দিনে ২০টি চ্যানেলের সংবাদ নিয়ে জরিপ চালান, তা হলে তিনি অবশ্যই বুঝতে পারবেনÑ দেশে গণতন্ত্র কতটুকু আছে। হিসাব করে দেখা গেছে ২০টি টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিদিন ৫ ঘণ্টা প্রধানমন্ত্রীর জন্য সময় ব্যয় করে। এবার সিঙ্গাপুরে ১০ দিন থেকে দেখেছিÑ সেই দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সেই দেশেরই একটি চ্যানেলে ১০ দিনে মাত্র একবার দেখার সুযোগ ঘটেছে তা-ও ২ থেকে ৩ মিনিট সময় মাত্র। একতরফাভাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে সরকারি দল সুযোগ নিচ্ছে প্রচারের কাজে। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে এমন সব বক্তব্য দেয়া হয়Ñ যার অধিকাংশই হিংসা ও বিদ্বেষপূর্ণ।
বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রটির জন্ম নিয়েছিলÑ একটি ফুলকে বাঁচানোর শপথ নিয়ে। সেখানে বেড়েছে বিরুদ্ধ মতের বিপরীতে প্রবল সহিংসতা। জাতির সব অর্জন ব্যাহত হয়ে যাবেÑ যদি এই বিভাজনের সমাপ্তি ঘটানো না হয় সব দলের সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে। বাইরের শক্তি দিয়ে স্থায়ী শান্তি আসবে না।
যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, বাংলাদেশে ভিন্ন মতের ব্যক্তিরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ ‘গত পাঁচ বছরে সরকার নিজ দলের লোকদের বিরুদ্ধে থাকা মোট সাত হাজার ১৭৭টি মামলা প্রত্যাহার করেছে। এর মধ্যে অন্তত ১০টি হত্যা মামলাও রয়েছে। কিন্তু অন্য কোনো দলের একটি মামলাও প্রত্যাহার করা হয়নি।’
আমাদের দেশের সমস্যাগুলো অনেক দিনের পুরনো। জটিল সমস্যার আবর্ত থেকে বের হওয়ার জন্য প্রয়োজন শুধু সব দল নয়Ñ জ্ঞানী-গুণী দেশপ্রেমিক সব শ্রেণীর-পেশার মানুষকে নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় সংলাপ।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট
E.m : harunroshid or@gmail.com
আমরা এমন এক দেশে বাস করছি, যেখানে রাজনৈতিক ঘটনায় মৃত্যু হলেও সবার মৃত্যুকে মৃত্যু বলে গণ্য করা হয় না। ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী কেঁদেছেন। অনেকেই মানববন্ধনসহ মিটিং-মিছিল করেছেন বিশেষ করে সরকারি দল ও তাদের সমর্থক গোষ্ঠী। সব ধর্মগ্রন্থে হত্যাকাণ্ড পাপ ও মানবতাবিরোধী কাজ। হরতাল-অবরোধের কারণে দেশের মানুষের জানমালের ক্ষতি হয় ঠিক; তেমনি ভাষাশহীদের আত্মত্যাগের মাসে আরো অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এই মৃত্যুগুলোও ছিল অস্বাভাবিক। কিন্তু এই মৃত্যুগুলোর সাথে রাজনীতির সম্পর্ক নেই বলে সরকারের নির্বাহী প্রধানসহ তার মন্ত্রী মহোদয়গণ একেবারেই নিশ্চুপ। অর্থাৎ তাদের দৃষ্টিতে এই মৃত্যুগুলো যেন মূল্যহীন। সহিংস ঘটনায় ৪ মার্চ পর্যন্ত ৫৮ দিনে (৬ জানুয়ারি থেকে) ১১৪ জন মানুষের মৃত্যুর জন্য আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে গেছেনÑ এ কথা মন্ত্রী না বললেও বলা হয়, বেগম খালেদা জিয়াই এই মৃত্যুর জন্য দায়ী। এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে তাকে হুকুমের আসামি করা হয়।
অবশ্যই চলমান অবরোধের ঘোষণা প্রথমে আসে সরকার থেকেই বেগম জিয়াকে তার নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখার পর থেকে। দিনটি ছিল ৩ জানুয়ারি। ঢাকায় বেগম জিয়াকে ৫ জানুয়ারিতে কোনো সমাবেশ-মিটিং-মিছিল করতে দেয়া হবে নাÑ এ ধরনের একটি বার্তা সরকারপক্ষ থেকে আসার পর গুলশান কার্যালয়ে প্রায় এক ডজন ইট বালুবোঝাই ট্রাক দ্বারা বেষ্টনীর মধ্যে আটকা পড়ে যান বেগম খালেদা জিয়া। ওই সময়ে সেখানে কয়েক শত র্যাব, পুলিশ, সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দা বাহিনী এবং জলকামান, রায়টকারসহ পুলিশের গাড়ি অ্যাম্বুলেন্স রাখা হয়। ঢাকার সাথে বিভিন্ন জেলা শহরের যাতায়াতব্যবস্থা বন্ধ করে দেয় সরকার, যাতে জনসভায় কোনো মানুষ ঢাকায় আসতে না পারেন। বেগম জিয়া ৫ জানুয়ারি জনসভা অভিমুখে যখন যাত্রা শুরু করবেন তখনই কার্যালয়ের সব গেটে তালা লাগিয়ে দেয়া হয় এবং অফিসের ভেতরে পেপার স্প্রে নিক্ষেপ করা হয়। এতে বেগম জিয়া ও সাংবাদিকসহ দলের লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসব কিছুই হয়েছে সরকারের ওপরমহলের নির্দেশে। বেগম জিয়া অসুস্থ অবস্থায় (পেপার স্প্রের কারণে) একটি কথাই বলেছেনÑ সরকার দেশে যখন গাড়িচলাচল বন্ধ করে দিয়ে অবরোধ শুরু করে দিয়েছে, তখন এই অবরোধ আগামীকাল থেকে চলতে থাকবে (৬ জানুয়ারি ২০১৫) যতক্ষণ পর্যন্ত না জনগণের প্রত্যাশিত একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবেÑ যেখানে সব দলের অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটবে। গণতন্ত্র তখনই তার স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসবে। তিনি এ কথাও বলেছেন, সরকার ঘোষিত এই অবরোধ আমরা ৬ জানুয়ারি থেকে চলমান রাখব সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে, যাতে সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি না হয়। এ কথাগুলোই ৬ জানুয়ারি প্রায় সব ক’টি জাতীয় দৈনিকে লিড নিউজ হয়েছে। এই আসল কথাকে বাদ দিয়ে রঙ লাগিয়ে নকল কথা দ্বারা সাজিয়ে গুছিয়ে মিডিয়ায় প্রচার করতে দেখি সরকারি দলকে। নিয়ন্ত্রিত সব মিডিয়ায়, এসব কথা প্রচার করতেও বাধ্য করা হয়েছে। মধ্যরাতেও দেখি অনেকটা সদা মিথ্যা কথা বলিবেÑ এ ছবক দ্বারা জাতিকে উপদেশ বা নসিহত টকশোর মাধ্যমে কেউ কেউ বলে যাচ্ছেন। বোঝা যায় তারা দলপ্রেমিক। দেশপ্রেমিক কোনো লোক নন। ক্ষিপ্ত আচরণে মাঝে মধ্যে অনুষ্ঠান গুলিস্তান বা পল্টনে রাজনৈতিক কলহ বা বিবাদের আকার রূপ ধারণ করে। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মিডিয়ায় এই ধরনের আচরণ নজিরবিহীন। এখন প্রশ্ন গত ৫৮ দিনে ১১৪ জনের খুনের আসামি কে বা কারা? উল্লিখিত বক্তব্যে তা সচেতন জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। অবরুদ্ধ একজন মানুষ কী করে ১১৪ জনের খুনের আসামি হয় তা জনগণের মাথায় আসছে না। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে সহিংস রূপ দিয়ে একটি দলকে বহির্বিশ্বে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত করার পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি-নাÑ তা ও ভাবতে হবে। ৩ জানুয়ারি থেকে চলমান ঘটনার নেপথ্য ভূমিকায় আসলে কারা, তা কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ওই দিনই গণতন্ত্রের পথে সবচেয়ে বড় ব্যারিকেডটি দেয় পুলিশ প্রশাসন সরকারি দলের উচ্চ মহলের ইঙ্গিতে।
গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথে যখন প্রতিবন্ধকতা আসবে, তখনই প্রতিক্রিয়া সহিংস রূপ ধারণ করবে। প্রকৃতির ধর্ম এটাই। কথা বলার অধিকার হরণ করার আরেক নাম স্বেচ্ছাচারী শাসন। এর অর্থ হলোÑ শাসকদল কথা বলবে এবং সে কথা সবাই মেনে চলতে হবে। অন্য কোনো দল বা মানুষের কোনো কথা বলার সুযোগ থাকবে না।’ এর নাম গণতন্ত্র হতে পারে না।
কেন দেশে আজ হরতাল হচ্ছেÑ তা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়। শত্রুর সাথেও কথা বলতে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। আত্মীয় বা প্রতিবেশী কোনো মানুষের সাথে কোনো কারণে যদি কথা বন্ধ থাকেÑ তা মিটিয়ে ফেলার জন্য মহানবী সা: নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আগে সালাম দেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন। এতে বেশি পুণ্য হাসিল হয়। এসব কথা আমরা ভুলতে বসেছি বলেই দেশে আজ এত অশান্তি বিরাজমান।
অস্বাভাবিকভাবে দেশে প্রতিদিনই গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন। প্রথম আলো ১ মার্চ সংখ্যায় একজন সচেতন পাঠক অন লাইনে বলেছেনÑ ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মায় লঞ্চডুবিতে ৭৮ জন সাধারণ মানুষ মারা গেলেনÑ নেতানেত্রীরা কাঁদলেন না। কেউ মানববন্ধন করল না। সিলেটের এক হাসপাতালে এক দিনেই ১০ শিশুসহ ৩২ জন প্রাণ হারালেন চিকিৎসকদের গাফিলতির কারণে। নেতানেত্রীরা কেউ কাঁদলেন না। ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে গিয়ে নেতানেত্রীদের কান্নার যে মহড়া মিডিয়ায় দেখলামÑ সে রকম কোনো দৃশ্য দেখলাম না। একটি প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ১০ জন মারা গেলেন কেউ কাঁদল না। মানববন্ধনও কেউ করল না। সৌদি আরবে কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে পাঁচজন বাংলাদেশী মারা গেলেন; কিন্তু নেতারা কেউ কাঁদলেন নাÑ কেউ সাহায্য প্রদানও করল না। ১১ ফেব্রুয়ারি ওমানে আগুনে পুড়ে চার বাংলাদেশী মারা গেলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি আবুধাবিতে অগ্নিকাণ্ডে তিনজন বাংলাদেশী মারা গেলেন। তাদের জন্যও নেতানেত্রীরা কেউ কাঁদলেন না, দুঃখ প্রকাশ পর্যন্ত কেউ করল না। ৩ জানুয়ারি থেকে ১ মার্চ জাতীয় দৈনিকের হিসাবে ৭০-এর অধিক মানুষ ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ, গণপিটুনিতে মারা গেছেন। এসব মৃত্যুতে অনেকেই হয়তো কাঁদবেন না, মানববন্ধন করবেন না। কারণ, এগুলো রাজনৈতিক নয়। তাদের মৃত্যুতে চোখের পানি ফেললে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল হবে না। দেশটা যেন সব কানার হাটবাজার হয়ে গেছে। খিলগাঁওয়ে শিশু জেহাদের করুণ মৃত্যু গোটা দেশের মানুষকে কাঁদিয়েছে। কিন্তু কাঁদাতে পারেনি শাসকদলকে। কারণ তাদের অব্যবস্থার কারণেই শিশুটি নিহত হয়। বইমেলায় পুলিশের নাকের ডগার ওপর অভিজিৎ-এর হত্যাকাণ্ড নিন্দনীয়। এখানেও রাজনীতিকে টেনে আনা হয়েছে। এমন মন্তব্য এসেছে ‘খোকা-মান্নার ফোনালাপের প্রথম লাশ হলো অভিজিৎ।’ দেশে এ রকম আরো অনেক অভিজিৎ-এর মৃত্যু হচ্ছে। সব হত্যাই নিন্দনীয়। প্রশাসন এসব হত্যাকাণ্ডের দায় কিভাবে এড়াবে? এত পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার; তারপরও খুন হচ্ছে মানুষ। এসব মৃত্যু নিয়ে একশ্রেণীর দলকানা এবং জ্ঞানপাপী ফায়দা লুটার কাজে ব্যস্ত। একটি দেশের মানুষ, যে ভিন্ন ভিন্ন মতে, ভিন্ন ধর্মে বা আদর্শে বিশ্বাসী হতে পারে। হতে পারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোক। তাই বলে একটি মৃত্যুকে যথার্থ বলে বাহবা দেয়া, আরেকটি মৃত্যুকে নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করাÑ তা কোনো মতেই মানবতা নয়। হত্যার আইনি বিচার জনগণ প্রত্যাশা করে। অথচ অগণিত খুনের বিচার হয়নি। জামিন পেয়ে গেছে খুনের এমন আসামি কম নয়।
রাজধানীর কাজীপাড়ায় ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে তিন তরুণ গুলিতে নিহত হন। দু’জন পরিবহন শ্রমিক। তাদের শরীরে মোট ৫৪টি গুলির ক্ষত রয়েছে। পুলিশ বলছে, জনতার পিটুনিতে তারা নিহত হয়েছেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো লিখেছে বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ৫১ দিনে নিহত ৪৭ জন্য, এর মধ্যে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৩৩ জন, গুলিবিদ্ধ লাশ সাত, পালাতে গিয়ে বাসচাপা পড়ে চার এবং গণপিটুনিতে নিহত তিন। পত্রিকার প্রতিবেদক রংপুর, মিঠাপুকুর থেকে জানিয়েছেনÑ এক পরিবারে তিনজনের সন্ধান নেই দেড় মাসেও। দেশে চলছে মিডিয়া ট্রায়াল। সরকার করছে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ। দেশের বৃহত্তম বিরোধী দলবিহীন মিডিয়া। এ দিকে বিশিষ্ট লেখক, প্রতিবেদক, এমনকি সম্পাদকীয় মন্তব্যও লেখা হচ্ছে গণতন্ত্রের বেহালদশা নিয়ে। একজন টেলিভিশন দর্শক যদি এক দিনে ২০টি চ্যানেলের সংবাদ নিয়ে জরিপ চালান, তা হলে তিনি অবশ্যই বুঝতে পারবেনÑ দেশে গণতন্ত্র কতটুকু আছে। হিসাব করে দেখা গেছে ২০টি টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিদিন ৫ ঘণ্টা প্রধানমন্ত্রীর জন্য সময় ব্যয় করে। এবার সিঙ্গাপুরে ১০ দিন থেকে দেখেছিÑ সেই দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সেই দেশেরই একটি চ্যানেলে ১০ দিনে মাত্র একবার দেখার সুযোগ ঘটেছে তা-ও ২ থেকে ৩ মিনিট সময় মাত্র। একতরফাভাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে সরকারি দল সুযোগ নিচ্ছে প্রচারের কাজে। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে এমন সব বক্তব্য দেয়া হয়Ñ যার অধিকাংশই হিংসা ও বিদ্বেষপূর্ণ।
বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রটির জন্ম নিয়েছিলÑ একটি ফুলকে বাঁচানোর শপথ নিয়ে। সেখানে বেড়েছে বিরুদ্ধ মতের বিপরীতে প্রবল সহিংসতা। জাতির সব অর্জন ব্যাহত হয়ে যাবেÑ যদি এই বিভাজনের সমাপ্তি ঘটানো না হয় সব দলের সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে। বাইরের শক্তি দিয়ে স্থায়ী শান্তি আসবে না।
যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, বাংলাদেশে ভিন্ন মতের ব্যক্তিরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ ‘গত পাঁচ বছরে সরকার নিজ দলের লোকদের বিরুদ্ধে থাকা মোট সাত হাজার ১৭৭টি মামলা প্রত্যাহার করেছে। এর মধ্যে অন্তত ১০টি হত্যা মামলাও রয়েছে। কিন্তু অন্য কোনো দলের একটি মামলাও প্রত্যাহার করা হয়নি।’
আমাদের দেশের সমস্যাগুলো অনেক দিনের পুরনো। জটিল সমস্যার আবর্ত থেকে বের হওয়ার জন্য প্রয়োজন শুধু সব দল নয়Ñ জ্ঞানী-গুণী দেশপ্রেমিক সব শ্রেণীর-পেশার মানুষকে নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় সংলাপ।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট
E.m : harunroshid or@gmail.com
No comments