ওবামা-মোদির ‘তৃতীয় দেশ’ এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতি by ড. এম মুজিবুর রহমান
আমেরিকার
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তিন দিনের ভারত সফর করে গেলেন। সফর সংপ্তি করে
সৌদি আরবের নতুন বাদশাহকে সম্মান জানাতে তিনি সে দেশ সফর করেন। ওবামা ভারত
ত্যাগের পরদিনই নাটকীয়ভাবে মোদি তার পররাষ্ট্র সচিব, সাবেক গোয়েন্দা
প্রধানের কন্যা এবং সোনিয়া গান্ধীর বান্ধবী সুজাতা সিংকে বরখাস্ত করেন। ভারতের
পররাষ্ট্র সচিবের মতো একটি সরকারি পদের রদবদল বা বরখাস্তের বিষয়টি এতটা
গুরত্ব বহন করত না, যদি ওই পদ ব্যবহার করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে
নগ্ন ভূমিকা পালন করা না হতো। তাই সুজাতা সিং বাংলাদেশেও বিপুল আলোচিত ও
সমালোচিত। পর্যবেকেরা মনে করেন, সুজাতা সিংয়ের ভূমিকার কারণেই প্রধান
বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্তত ৩০টি দলকে বাদ দিয়ে ৫ জানুয়ারির একতরফা
ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছে। একদলীয় এই নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ সফরের সময়
সুজাতা সিং একতরফা নির্বাচনের পে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন। এমনকি সেই
সময় জাতীয় পার্টিকেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য কূটনৈতিক রীতিবহির্ভূতভাবে
চাপ দেন। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, নির্বাচনে এরশাদের অংশগ্রহণ করা উচিত, তা
না হলে মৌলবাদীরা মতায় আসবে।
ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, “নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য। সব দলের অংশগ্রহণে হবে না ‘অধিকসংখ্যক’ দলের অংশগ্রহণে হবে, তা বাংলাদেশের জনগণই নির্ধারণ করবে। ভারত প্রত্যাশা করে, এখানে সহিংসতামুক্ত একটি নির্বাচন হবে।” অর্থাৎ কিছু দল অংশগ্রহণ করলেই হলো, প্রধান বিরোধী দলের বা জোটের অংশগ্রহণ থাকবে কি না, সে ব্যাপারে তাদের মাথাব্যথা নেই।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে ২০১৪ সালের ১ জুলাই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার সাাৎকার প্রকাশ করে ভারতীয় দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। সুজাতা সিং বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বিশেষভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন বলে সেই সাাৎকারে জানান খালেদা জিয়া। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘কমনওয়েলথ ও জাতিসঙ্ঘ বলেছিল তারা কোনো একদলীয় নির্বাচন সমর্থন করে না। তাদের কোনো নির্বাচন পর্যবেকও ছিলেন না, তাই তারা এটা গ্রহণ করেনি। সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শিগগিরই একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন দিতে বলছে।’ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দেশের মধ্যে একমাত্র ভারত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এ ছাড়াও নির্বাচনের আগে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা ভারত সফরে যান এবং সুজাতা সিংয়ের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে সুজাতা অত্যন্ত শীতল মনোভাব দেখান বলে জানা যায়। সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন ভূমিকাকে তিনি নিরুৎসাহিত করেন।
সুজাতা সিংয়ের বরখাস্তের বিষয়ে অনেক বিশ্লেষণ আসছে। সাউথ ব্লক সূত্রের খবর অনুযায়ী, ভারতের বর্তমান মোদি সরকারের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক, কংগ্রেসের প্রতি তার অতিরিক্ত টান ও বিদেশনীতিতে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তার প্রতি আস্থার সঙ্কটের সাথে পার্শ্ববর্তী দেশসগুলোর সাথে, বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যাপারে তার অতীত ভূমিকা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। কয়েক মাস পরেই সুজাতা সিংয়ের অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। তাকে অন্য কম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে স্থানান্তর অথবা ওএসডি করাসহ অন্য কোনো পদপে না নিয়ে চাকরির শেষ সময়ে বরখাস্তের বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। মোদি সরকারের নীতি বাস্তবায়নে বিরাট বাধা বা হুমকির পাশাপাশি অন্য কোনো প্রভাবশালী দেশকে হয়তো একটা স্পষ্ট বার্তা দেয়া মোদি সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিধায় ‘বরখাস্তের’ মতো শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সুজাতা সিংয়ের বরখাস্তের খবরে বাংলাদেশের ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের মধ্যে অস্বস্তি বিরাজ করেছে। কারণ ভারতে পররাষ্ট্র সচিবের পদে নতুন কেউ দায়িত্ব পেলে ঢাকার তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দন জানানোর রেওয়াজ রয়েছে।
ওবামা যে সময় ভারত সফরে ছিলেন বাংলাদেশে তখন ভোটের অধিকার আর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লাগাতার অবরোধ চলছিল। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্বের নেতিবাচক মনোভাব সবার জানা। বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের জন্য আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর তাগাদা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সরকার এ উৎকণ্ঠাকে নিজেদের শাসনের প্রতি হুমকি মনে করে বিধায় বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনীতিকের সাথে শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করতে দ্বিধাবোধ করছে না। এটা তার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দেউলিয়াত্বকে প্রকটভাবে তুলে ধরছে। দু-একটি রাষ্ট্র তাদের নিজেদের স্বার্থে সরকারকে পরো সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছিল। তা-ও এখন নিরঙ্কুশ নয়। গণতান্ত্রিক বিশ্বের মতামতকে উপো করে এখন কোনো সরকারের পে দেশ শাসন সম্ভব নয়। বিশ্বায়নের যুগে প্রতিটি রাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে একে অপরের পরিপূরক।
ওবামার ভারত সফর নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ওবামা-মোদি ঘোষণায় নির্দিষ্ট করে বলেছেন, দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের বাইরেও ‘অতিরিক্ত তৃতীয় দেশে’ তারা ‘সহযোগিতামূলক’ সম্পর্ক এগিয়ে নেবে। ‘তৃতীয় দেশ’ নাম বলা হয়নি। তবে, এর আগে ওয়াশিংটনে ওবামা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছিল। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আমেরিকা ও ভারত তাদের বিদেশনীতি পরিচালনায় এই নীতির কথা মনে রাখবে।
এই সফরে ধর্মীয় বিভক্তি থাকলে ভারত সফল হতে পারবে না বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ওবামা এক ভাষণে বলেন, 'ভারত তখনই সফল হবে, যখন দেশটি ধর্মের ভিত্তিতে খণ্ডিত চেতনা ধারণ করবে না।' ভারতে সম্প্রতি ধর্মীয় প্রতিহিংসা ও গোঁড়ামি আগে থেকেই আছে। এখন জোর করে সংখ্যালঘুদের ধর্মান্তরকরণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে উগ্রপন্থীরা। দিল্লিতে সম্প্রতি তিনটি গির্জা আক্রান্ত হয়েছে। ভেঙে দেয়া হচ্ছে অন্য ধর্মের উপাসনালয়। এতে বিজেপির নীরবতা রহস্যময়। তাই ওবামার দেয়া এ ভাষণকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন কূটনীতিবিদেরা।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে দিল্লি-ওয়াশিংটনের মনোভাব পত্রপত্রিকায় আলোচিত। ২০১৩ সালের অক্টোবরে ভারতের ইকনোমিক টাইমস খবর দিয়েছিল, বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা আমন্ত্রিত না হয়েও তার সরকারের (যুক্তরাষ্ট্র) নির্দেশে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করতে দিল্লি গিয়েছিলেন। তিনটি ইস্যু আলোচনায় আসে। প্রথমত বাংলাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা, দ্বিতীয়ত সব দলের অংশগ্রহণসাপে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, তৃতীয়ত সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা মোকাবেলা।
তিনটি বিষয়ের দিকে ল করলে দেখা যায়, সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থাকে মোকাবেলা করার জন্য প্রথম দু’টি ইস্যুর বাস্তবায়ন জরুরি। আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের কংগ্রেস সরকার আন্তর্জাতিক বিশ্বের মতামতকে তোয়াক্কা করেনি। ভারতের নির্বাচনে কংগ্রেসের লজ্জাকর পরাজয়ে এ বিষয়টি কিছুটা প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন অনেকে। এবার ১২ জানুয়ারি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিন বাংলাদেশে চলমান আন্দোলন সম্পর্কে বলেন, ‘এটা বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের বিষয় যে, তারা যেসব ইস্যুতে বিরোধের সম্মুখীন হচ্ছেন তা মোকাবেলায় কিভাবে তারা অগ্রসর হবেন। আমরা শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও নিরাপদ বাংলাদেশ চাই।’ অনেক পর্যবেক মনে করেন, ভারতীয় মুখপাত্রের এই অবস্থান তার আগের সরকারের অবস্থান থেকে পৃথক। কারণ গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে তৎকালীন ভারতীয় সরকার বাংলাদেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল তথা জনগণের কথা বাদ দিয়ে এবং নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তা করে কথিত ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ রার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিল। অনেকেই মনে করেন, কংগ্রেস সরকারের বাংলাদেশের জনগণের পাশে না থেকে বিশেষ দলের প্রতি সমর্থনের কারণেই বাংলাদেশে আজকের এই অচলাবস্থা।
পর্যবেকেরা বলছেন, ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা স্বীকার করেন, বাংলাদেশসহ ভারতের প্রতিবেশীরা অস্থিতিশীলতার মধ্যে থাকলে তা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের অনকূলে যায় না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র দণি এশিয়ায় একটি নিরাপদ ঘাঁটি করতে চাইছে, যাতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মনিটর করাসহ ভারত ও রাশিয়াকে ধরাছোঁয়ায় রাখতে পারে। এ েেত্র ভূরাজনৈতিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের প্রতি তাদের দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ওবামা এবারের ভারত সফরে মোদি সরকারের প্রতি কিছু গুরত্বপূর্ণ বার্তা দিয়ে থাকতে পারেন। বিশ্ববাসীর কাছে যদি এটা প্রতীয়মান হয় যে, ভারতের একপেশে সমর্থনের কারণে বাংলাদেশে অস্থিরতা বিরাজ করছে এবং দেশটি গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত তাহলে ভারতের অর্থনীতির জন্য বিরাট তির কারণ হয়ে যেতে পারে। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলের প্রতি ােভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ইসরাইলি পণ্য বয়কটে সারা ইউরোপে বিরাট ধাক্কা লেগেছে। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে কয়েক মিলিয়ন প্রবাসীর বসবাসসহ বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগের কারণে পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার দেখতে চাইবে বিধায় ভারতের একপেশে নীতি বুমেরাং হতে বাধ্য। সর্বোপরি, বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের মতো একটি ভূরাজনৈতিক ও স্ট্র্যাটেজিকভাবে গুরত্বপূর্ণ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে নিরাপত্তা বিঘিœত হোক, তা কারো কাম্য হতে পারে না।
এসব বিবেচনায় সরকারে বিরাজ করছে একধরনের অস্থিরতা। প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের আচরণ ও বক্তব্যে তা প্রকট হয়ে ধরা পড়ছে। সরকারের দায়িত্বশীলদের উচিত হবে, অর্থনীতির চাকাকে পেছনের দিকে ঠেলে না দিয়ে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা। হিংসা, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়লে শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্টের পাশাপাশি দেশ-জাতি হুমকির মূখে পড়বে, যা থেকে আমরা কেউ রেহাই পাবো না। শান্তিশৃঙ্খলা ও রাজনীতিতে সহনশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। তা না হলে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধিক্কার জানাবে।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, “নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য। সব দলের অংশগ্রহণে হবে না ‘অধিকসংখ্যক’ দলের অংশগ্রহণে হবে, তা বাংলাদেশের জনগণই নির্ধারণ করবে। ভারত প্রত্যাশা করে, এখানে সহিংসতামুক্ত একটি নির্বাচন হবে।” অর্থাৎ কিছু দল অংশগ্রহণ করলেই হলো, প্রধান বিরোধী দলের বা জোটের অংশগ্রহণ থাকবে কি না, সে ব্যাপারে তাদের মাথাব্যথা নেই।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে ২০১৪ সালের ১ জুলাই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার সাাৎকার প্রকাশ করে ভারতীয় দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। সুজাতা সিং বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বিশেষভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন বলে সেই সাাৎকারে জানান খালেদা জিয়া। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘কমনওয়েলথ ও জাতিসঙ্ঘ বলেছিল তারা কোনো একদলীয় নির্বাচন সমর্থন করে না। তাদের কোনো নির্বাচন পর্যবেকও ছিলেন না, তাই তারা এটা গ্রহণ করেনি। সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শিগগিরই একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন দিতে বলছে।’ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দেশের মধ্যে একমাত্র ভারত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এ ছাড়াও নির্বাচনের আগে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা ভারত সফরে যান এবং সুজাতা সিংয়ের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে সুজাতা অত্যন্ত শীতল মনোভাব দেখান বলে জানা যায়। সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন ভূমিকাকে তিনি নিরুৎসাহিত করেন।
সুজাতা সিংয়ের বরখাস্তের বিষয়ে অনেক বিশ্লেষণ আসছে। সাউথ ব্লক সূত্রের খবর অনুযায়ী, ভারতের বর্তমান মোদি সরকারের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক, কংগ্রেসের প্রতি তার অতিরিক্ত টান ও বিদেশনীতিতে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তার প্রতি আস্থার সঙ্কটের সাথে পার্শ্ববর্তী দেশসগুলোর সাথে, বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যাপারে তার অতীত ভূমিকা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। কয়েক মাস পরেই সুজাতা সিংয়ের অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। তাকে অন্য কম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে স্থানান্তর অথবা ওএসডি করাসহ অন্য কোনো পদপে না নিয়ে চাকরির শেষ সময়ে বরখাস্তের বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। মোদি সরকারের নীতি বাস্তবায়নে বিরাট বাধা বা হুমকির পাশাপাশি অন্য কোনো প্রভাবশালী দেশকে হয়তো একটা স্পষ্ট বার্তা দেয়া মোদি সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিধায় ‘বরখাস্তের’ মতো শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সুজাতা সিংয়ের বরখাস্তের খবরে বাংলাদেশের ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের মধ্যে অস্বস্তি বিরাজ করেছে। কারণ ভারতে পররাষ্ট্র সচিবের পদে নতুন কেউ দায়িত্ব পেলে ঢাকার তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দন জানানোর রেওয়াজ রয়েছে।
ওবামা যে সময় ভারত সফরে ছিলেন বাংলাদেশে তখন ভোটের অধিকার আর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লাগাতার অবরোধ চলছিল। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্বের নেতিবাচক মনোভাব সবার জানা। বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের জন্য আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর তাগাদা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সরকার এ উৎকণ্ঠাকে নিজেদের শাসনের প্রতি হুমকি মনে করে বিধায় বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনীতিকের সাথে শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করতে দ্বিধাবোধ করছে না। এটা তার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দেউলিয়াত্বকে প্রকটভাবে তুলে ধরছে। দু-একটি রাষ্ট্র তাদের নিজেদের স্বার্থে সরকারকে পরো সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছিল। তা-ও এখন নিরঙ্কুশ নয়। গণতান্ত্রিক বিশ্বের মতামতকে উপো করে এখন কোনো সরকারের পে দেশ শাসন সম্ভব নয়। বিশ্বায়নের যুগে প্রতিটি রাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে একে অপরের পরিপূরক।
ওবামার ভারত সফর নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ওবামা-মোদি ঘোষণায় নির্দিষ্ট করে বলেছেন, দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের বাইরেও ‘অতিরিক্ত তৃতীয় দেশে’ তারা ‘সহযোগিতামূলক’ সম্পর্ক এগিয়ে নেবে। ‘তৃতীয় দেশ’ নাম বলা হয়নি। তবে, এর আগে ওয়াশিংটনে ওবামা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছিল। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আমেরিকা ও ভারত তাদের বিদেশনীতি পরিচালনায় এই নীতির কথা মনে রাখবে।
এই সফরে ধর্মীয় বিভক্তি থাকলে ভারত সফল হতে পারবে না বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ওবামা এক ভাষণে বলেন, 'ভারত তখনই সফল হবে, যখন দেশটি ধর্মের ভিত্তিতে খণ্ডিত চেতনা ধারণ করবে না।' ভারতে সম্প্রতি ধর্মীয় প্রতিহিংসা ও গোঁড়ামি আগে থেকেই আছে। এখন জোর করে সংখ্যালঘুদের ধর্মান্তরকরণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে উগ্রপন্থীরা। দিল্লিতে সম্প্রতি তিনটি গির্জা আক্রান্ত হয়েছে। ভেঙে দেয়া হচ্ছে অন্য ধর্মের উপাসনালয়। এতে বিজেপির নীরবতা রহস্যময়। তাই ওবামার দেয়া এ ভাষণকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন কূটনীতিবিদেরা।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে দিল্লি-ওয়াশিংটনের মনোভাব পত্রপত্রিকায় আলোচিত। ২০১৩ সালের অক্টোবরে ভারতের ইকনোমিক টাইমস খবর দিয়েছিল, বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা আমন্ত্রিত না হয়েও তার সরকারের (যুক্তরাষ্ট্র) নির্দেশে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করতে দিল্লি গিয়েছিলেন। তিনটি ইস্যু আলোচনায় আসে। প্রথমত বাংলাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা, দ্বিতীয়ত সব দলের অংশগ্রহণসাপে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, তৃতীয়ত সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা মোকাবেলা।
তিনটি বিষয়ের দিকে ল করলে দেখা যায়, সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থাকে মোকাবেলা করার জন্য প্রথম দু’টি ইস্যুর বাস্তবায়ন জরুরি। আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের কংগ্রেস সরকার আন্তর্জাতিক বিশ্বের মতামতকে তোয়াক্কা করেনি। ভারতের নির্বাচনে কংগ্রেসের লজ্জাকর পরাজয়ে এ বিষয়টি কিছুটা প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন অনেকে। এবার ১২ জানুয়ারি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিন বাংলাদেশে চলমান আন্দোলন সম্পর্কে বলেন, ‘এটা বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের বিষয় যে, তারা যেসব ইস্যুতে বিরোধের সম্মুখীন হচ্ছেন তা মোকাবেলায় কিভাবে তারা অগ্রসর হবেন। আমরা শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও নিরাপদ বাংলাদেশ চাই।’ অনেক পর্যবেক মনে করেন, ভারতীয় মুখপাত্রের এই অবস্থান তার আগের সরকারের অবস্থান থেকে পৃথক। কারণ গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে তৎকালীন ভারতীয় সরকার বাংলাদেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল তথা জনগণের কথা বাদ দিয়ে এবং নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তা করে কথিত ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ রার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিল। অনেকেই মনে করেন, কংগ্রেস সরকারের বাংলাদেশের জনগণের পাশে না থেকে বিশেষ দলের প্রতি সমর্থনের কারণেই বাংলাদেশে আজকের এই অচলাবস্থা।
পর্যবেকেরা বলছেন, ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা স্বীকার করেন, বাংলাদেশসহ ভারতের প্রতিবেশীরা অস্থিতিশীলতার মধ্যে থাকলে তা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের অনকূলে যায় না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র দণি এশিয়ায় একটি নিরাপদ ঘাঁটি করতে চাইছে, যাতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মনিটর করাসহ ভারত ও রাশিয়াকে ধরাছোঁয়ায় রাখতে পারে। এ েেত্র ভূরাজনৈতিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের প্রতি তাদের দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ওবামা এবারের ভারত সফরে মোদি সরকারের প্রতি কিছু গুরত্বপূর্ণ বার্তা দিয়ে থাকতে পারেন। বিশ্ববাসীর কাছে যদি এটা প্রতীয়মান হয় যে, ভারতের একপেশে সমর্থনের কারণে বাংলাদেশে অস্থিরতা বিরাজ করছে এবং দেশটি গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত তাহলে ভারতের অর্থনীতির জন্য বিরাট তির কারণ হয়ে যেতে পারে। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলের প্রতি ােভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ইসরাইলি পণ্য বয়কটে সারা ইউরোপে বিরাট ধাক্কা লেগেছে। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে কয়েক মিলিয়ন প্রবাসীর বসবাসসহ বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগের কারণে পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার দেখতে চাইবে বিধায় ভারতের একপেশে নীতি বুমেরাং হতে বাধ্য। সর্বোপরি, বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের মতো একটি ভূরাজনৈতিক ও স্ট্র্যাটেজিকভাবে গুরত্বপূর্ণ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে নিরাপত্তা বিঘিœত হোক, তা কারো কাম্য হতে পারে না।
এসব বিবেচনায় সরকারে বিরাজ করছে একধরনের অস্থিরতা। প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের আচরণ ও বক্তব্যে তা প্রকট হয়ে ধরা পড়ছে। সরকারের দায়িত্বশীলদের উচিত হবে, অর্থনীতির চাকাকে পেছনের দিকে ঠেলে না দিয়ে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা। হিংসা, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়লে শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্টের পাশাপাশি দেশ-জাতি হুমকির মূখে পড়বে, যা থেকে আমরা কেউ রেহাই পাবো না। শান্তিশৃঙ্খলা ও রাজনীতিতে সহনশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। তা না হলে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধিক্কার জানাবে।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
No comments