রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক আলোচনা জরুরি by আলী রীয়াজ
দেশের
বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বিএনপির
নেতৃত্বাধীন জোটের আন্দোলনে সাফল্যের আশু সম্ভাবনা নেই এবং বিএনপির নেতা
খালেদা জিয়া ইতিমধ্যেই তাঁর দাবি থেকে খানিকটা সরে এসেছেন, কিন্তু অকার্যকর
রাজনৈতিক কৌশল অনুসরণ করে চলেছেন; সরকার ও সরকারি দল রাষ্ট্রশক্তির জোরে
আন্দোলন দমনের প্রক্রিয়ায় এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যাতে সাময়িক সাফল্য
অর্জিত হয়েছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এক অনিশ্চয়তার পথ উন্মুক্ত হয়েছে; এবং
সাধারণ নাগরিকেরা একটি অস্বস্তিকর শঙ্কাজনক অবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করছে।
এই অবস্থায় সরকার ও বিএনপির কী করণীয় এবং কী ঘটতে পারে, সেই প্রশ্নের উত্তর
খোঁজা দরকার।
যদিও সরকার এত দিন ধরে কোনো ধরনের আলোচনা না করার কথা বলে এসেছে। কেননা এতে তাদের দুর্বলতার প্রকাশ ঘটবে বলেই তাদের মনে হয়েছে। তারা বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে দুর্বল অবস্থান থেকে আলোচনায় অংশ নিতে চায়নি। কিন্তু এখন যেহেতু বিএনপি তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থানে উপনীত হয়েছে, সেহেতু সরকারের জন্য এটাই হচ্ছে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিষয়ে আলোচনা শুরু করার অনুকূল সময়। মনে রাখা দরকার যে আলোচনা বলতে আমি সরকার ও বিএনপি কিংবা ‘দুই নেত্রী’র আলোচনার কথা বলছি না। কেবল দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সংকটের সমাধান হবে, এমন মনে করারও কারণ নেই। যদিও এটা ঠিক যে ২০১৪ সালের একপক্ষীয় নির্বাচনের কারণে বর্তমান সংকটের সূচনা হয়েছে, কিন্তু এখন তড়িঘড়ি আরেকটা নির্বাচনই এই সমস্যার পেছনে যেসব কারণ বিদ্যমান, তার সমাধান দেবে না। একটি বা দুটি দলের হাতে এই সমস্যার সমাধান আছে মনে করার কোনো কারণ নেই।
বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে যেসব বিষয় উপস্থিত—নির্বাচনপদ্ধতি, আগামী নির্বাচনের সময়ে সাংবিধানিক কাঠামো ও সময়, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণ, নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা ও তার নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা বিধান, প্রশাসনে দলীয়করণ বন্ধ করা, ভবিষ্যতে সহিংসতার পথ বন্ধ করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়া ইত্যাকার বিষয় নিয়েই জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দল ও শক্তির মধ্যে আলোচনা হতে হবে। তার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির কাজে সরকার এগিয়ে এলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, যারা এই অবস্থার স্থায়ী সমাধান চায়, তাদের পক্ষে পিছিয়ে থাকার সুযোগ থাকবে না। এ ধরনের চেষ্টায় বিএনপিকে ছাড় দেওয়ার অর্থ হলো তাদের এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার বাধ্যবাধকতার মধ্যে ফেলে দেওয়া। এসব ছাড় কী, সেটা সহজেই বোঝা যায়, দলের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে, তাদের আটক রেখে সে আলোচনা হবে না। বিএনপি এই প্রচেষ্টায় অংশ না নিলেও অন্যান্য দল এবং নাগরিকদের কাছ থেকেই তারা চাপের মুখে পড়বে।
এখানে অনেকেই বিএনপির শরিক দল জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার প্রশ্ন তুলবেন। বিএনপি গত বছর থেকে বলে এসেছে সে জামায়াতের সঙ্গে তার ঐক্য আদর্শিক নয়, চিরস্থায়ীও নয়; নির্বাচনের ঐক্য মাত্র। সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য এটা প্রমাণ করার সুযোগ থাকবে যে দলগতভাবে রাজনৈতিক কাঠামোগত পরিবর্তনের স্বার্থে তারা এই পদক্ষেপ নেবে কি না। গত বছরগুলোয় সহিংসতায়, বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ের পর সহিংসতায়, জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হলেও সে বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ায় সরকারের অনীহা প্রশ্নসাপেক্ষ। বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের পরামর্শ দেওয়ার বদলে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকার জন্য দলটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিষিদ্ধ করার যে দাবি, সেটা বাস্তবায়নে সরকারের আগ্রহ সম্ভবত এই অবস্থার অবসানের সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ।
অনেকেই হয়তো আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন যে সরকার আলোচনায় আগ্রহী নয় এবং আলোচনার কথা যাঁরা বলেন, তাঁদের আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপির পক্ষের লোক বলেই মনে করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বক্তব্য উদ্ধৃত করতে চাই: ‘সাধারণ মানুষের জীবনে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার যেকোনো প্রচেষ্টাকে অগ্রসর হতে হবে রাজপথের সহিংসতার কিংবা রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের শক্তির ওপরে নির্ভর করে নয় বরঞ্চ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এর পরিণতি অবশ্যই হতে হবে এমন এক রাজনৈতিক সমঝোতা, যা একটি অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, যার ভিত্তি হবে বর্তমান সরকারের জন্য ন্যায্যভাবে অর্জিত একটি গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট। এই রাজনৈতিক সমাধান সুনির্দিষ্টভাবে কীভাবে অর্জন করা যাবে, তা বেরিয়ে আসবে আলোচনার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে; যে আলোচনার ভিত্তি হচ্ছে এই ধারণা যে গণতান্ত্রিক রাজনীতি আপসের ওপরে নির্ভর করে গড়ে ওঠে; এক পক্ষ তার সবচেয়ে বেশি শক্তি ব্যবহার করে সব লক্ষ্য অর্জন করবে, সেটার ওপরে ভিত্তি করে নয়।’ ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ট্রিবিউন-এ প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি সাম্প্রতিক কালে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সংলাপের বিষয়ে সরকারি দলের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘সম্ভবত তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার মধ্যে, অথবা ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে, অথবা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় কিসিঞ্জার ও লি ডাক থোর মধ্যে, এমনকি সাম্প্রতিক কালে গোপনে ইউএইতে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান তালেবানের মধ্যে সংলাপের কথা’ (ঢাকা ট্রিবিউন, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। অধ্যাপক সোবহানের মতোই অধ্যাপক মইনুল ইসলাম লিখেছেন: ‘পাকিস্তানি মডেল রুখতে চাইলে সংলাপের নীতিগত সম্মতি দিতে শেখ হাসিনার বিলম্ব করা উচিত হবে না।’ (প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০১৫)।
সরকারের এই ধরনের পদক্ষেপ ত্বরান্বিত করার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়ার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া জরুরি। এখন বিএনপির অবস্থানগত দুর্বলতার কারণে তাদেরই এখন সুস্পষ্টভাবে বলতে হবে যে অকার্যকর কৌশলের পথ থেকে তারা সরে আসছে। এই পদক্ষেপ যদিও তাদের সাফল্যের ইঙ্গিত দেয় না এবং তারা এই পদক্ষেপ আগে নিলে হয়তো আরও বেশি জনসমর্থন আশা করতে পারত এবং অবশ্যই অনেক মানুষের জীবননাশ ঘটত না। কিন্তু এর আপাতত বিকল্প সামান্যই। বিএনপিকে বিবেচনায় নিতে হবে যে তাদের আন্দোলনের কারণে রাষ্ট্রশক্তির লাগামহীন ব্যবহার যদি বৈধতা লাভ করে, তবে দীর্ঘ মেয়াদে তার দায় তাকেও নিতে হবে। সেটা কেবল সাংগঠনিকভাবে হবে, তা নয়। আমি আগেই বলেছি যে রাষ্ট্রশক্তির ব্যবহার এবং গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম সীমিত হলে উগ্রপন্থীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। বলা বাহুল্য, ওই পরিস্থিতিতে বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ইতিমধ্যে যতটা সংকুচিত হয়েছে, তার চেয়েও বেশি মাত্রায় সংকুচিত হয়ে পড়বে—এর কোনোটাই বিএনপির জন্য ইতিবাচক নয়। ইতিমধ্যে সাংগঠনিকভাবে যে ক্ষতি হয়েছে, সেই বিবেচনার পাশাপাশি সাধারণ জনগণের মনোভাব ও জীবন-জীবিকার বিষয়ে তার দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন করা জরুরি। বিএনপির এই পদক্ষেপের জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়া গেলে সেটি নিশ্চয় নাগরিকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না।
এই আলোচনার পর এই প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে—কে পদক্ষেপ আগে নেবে, আদৌ এসবের কিছু হবে কি না। সেটা নির্ভর করে নেতৃত্বের দূরদর্শিতার ওপর। সরকারের পক্ষে যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়া সহজতর, ফলে তার ওপরেই দায়িত্ব বেশি বর্তায়। তার পরও বিএনপির নেতৃত্ব বিষয়গুলো বিবেচনা করে দেখতে পারে যে তারা এই ঝুঁকি নিতে চায় কি না।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভারসিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
যদিও সরকার এত দিন ধরে কোনো ধরনের আলোচনা না করার কথা বলে এসেছে। কেননা এতে তাদের দুর্বলতার প্রকাশ ঘটবে বলেই তাদের মনে হয়েছে। তারা বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে দুর্বল অবস্থান থেকে আলোচনায় অংশ নিতে চায়নি। কিন্তু এখন যেহেতু বিএনপি তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থানে উপনীত হয়েছে, সেহেতু সরকারের জন্য এটাই হচ্ছে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিষয়ে আলোচনা শুরু করার অনুকূল সময়। মনে রাখা দরকার যে আলোচনা বলতে আমি সরকার ও বিএনপি কিংবা ‘দুই নেত্রী’র আলোচনার কথা বলছি না। কেবল দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সংকটের সমাধান হবে, এমন মনে করারও কারণ নেই। যদিও এটা ঠিক যে ২০১৪ সালের একপক্ষীয় নির্বাচনের কারণে বর্তমান সংকটের সূচনা হয়েছে, কিন্তু এখন তড়িঘড়ি আরেকটা নির্বাচনই এই সমস্যার পেছনে যেসব কারণ বিদ্যমান, তার সমাধান দেবে না। একটি বা দুটি দলের হাতে এই সমস্যার সমাধান আছে মনে করার কোনো কারণ নেই।
বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে যেসব বিষয় উপস্থিত—নির্বাচনপদ্ধতি, আগামী নির্বাচনের সময়ে সাংবিধানিক কাঠামো ও সময়, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণ, নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা ও তার নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা বিধান, প্রশাসনে দলীয়করণ বন্ধ করা, ভবিষ্যতে সহিংসতার পথ বন্ধ করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়া ইত্যাকার বিষয় নিয়েই জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দল ও শক্তির মধ্যে আলোচনা হতে হবে। তার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির কাজে সরকার এগিয়ে এলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, যারা এই অবস্থার স্থায়ী সমাধান চায়, তাদের পক্ষে পিছিয়ে থাকার সুযোগ থাকবে না। এ ধরনের চেষ্টায় বিএনপিকে ছাড় দেওয়ার অর্থ হলো তাদের এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার বাধ্যবাধকতার মধ্যে ফেলে দেওয়া। এসব ছাড় কী, সেটা সহজেই বোঝা যায়, দলের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে, তাদের আটক রেখে সে আলোচনা হবে না। বিএনপি এই প্রচেষ্টায় অংশ না নিলেও অন্যান্য দল এবং নাগরিকদের কাছ থেকেই তারা চাপের মুখে পড়বে।
এখানে অনেকেই বিএনপির শরিক দল জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার প্রশ্ন তুলবেন। বিএনপি গত বছর থেকে বলে এসেছে সে জামায়াতের সঙ্গে তার ঐক্য আদর্শিক নয়, চিরস্থায়ীও নয়; নির্বাচনের ঐক্য মাত্র। সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য এটা প্রমাণ করার সুযোগ থাকবে যে দলগতভাবে রাজনৈতিক কাঠামোগত পরিবর্তনের স্বার্থে তারা এই পদক্ষেপ নেবে কি না। গত বছরগুলোয় সহিংসতায়, বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ের পর সহিংসতায়, জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হলেও সে বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ায় সরকারের অনীহা প্রশ্নসাপেক্ষ। বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের পরামর্শ দেওয়ার বদলে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকার জন্য দলটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিষিদ্ধ করার যে দাবি, সেটা বাস্তবায়নে সরকারের আগ্রহ সম্ভবত এই অবস্থার অবসানের সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ।
অনেকেই হয়তো আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন যে সরকার আলোচনায় আগ্রহী নয় এবং আলোচনার কথা যাঁরা বলেন, তাঁদের আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপির পক্ষের লোক বলেই মনে করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বক্তব্য উদ্ধৃত করতে চাই: ‘সাধারণ মানুষের জীবনে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার যেকোনো প্রচেষ্টাকে অগ্রসর হতে হবে রাজপথের সহিংসতার কিংবা রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের শক্তির ওপরে নির্ভর করে নয় বরঞ্চ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এর পরিণতি অবশ্যই হতে হবে এমন এক রাজনৈতিক সমঝোতা, যা একটি অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, যার ভিত্তি হবে বর্তমান সরকারের জন্য ন্যায্যভাবে অর্জিত একটি গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট। এই রাজনৈতিক সমাধান সুনির্দিষ্টভাবে কীভাবে অর্জন করা যাবে, তা বেরিয়ে আসবে আলোচনার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে; যে আলোচনার ভিত্তি হচ্ছে এই ধারণা যে গণতান্ত্রিক রাজনীতি আপসের ওপরে নির্ভর করে গড়ে ওঠে; এক পক্ষ তার সবচেয়ে বেশি শক্তি ব্যবহার করে সব লক্ষ্য অর্জন করবে, সেটার ওপরে ভিত্তি করে নয়।’ ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ট্রিবিউন-এ প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি সাম্প্রতিক কালে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সংলাপের বিষয়ে সরকারি দলের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘সম্ভবত তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার মধ্যে, অথবা ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে, অথবা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় কিসিঞ্জার ও লি ডাক থোর মধ্যে, এমনকি সাম্প্রতিক কালে গোপনে ইউএইতে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান তালেবানের মধ্যে সংলাপের কথা’ (ঢাকা ট্রিবিউন, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। অধ্যাপক সোবহানের মতোই অধ্যাপক মইনুল ইসলাম লিখেছেন: ‘পাকিস্তানি মডেল রুখতে চাইলে সংলাপের নীতিগত সম্মতি দিতে শেখ হাসিনার বিলম্ব করা উচিত হবে না।’ (প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০১৫)।
সরকারের এই ধরনের পদক্ষেপ ত্বরান্বিত করার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়ার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া জরুরি। এখন বিএনপির অবস্থানগত দুর্বলতার কারণে তাদেরই এখন সুস্পষ্টভাবে বলতে হবে যে অকার্যকর কৌশলের পথ থেকে তারা সরে আসছে। এই পদক্ষেপ যদিও তাদের সাফল্যের ইঙ্গিত দেয় না এবং তারা এই পদক্ষেপ আগে নিলে হয়তো আরও বেশি জনসমর্থন আশা করতে পারত এবং অবশ্যই অনেক মানুষের জীবননাশ ঘটত না। কিন্তু এর আপাতত বিকল্প সামান্যই। বিএনপিকে বিবেচনায় নিতে হবে যে তাদের আন্দোলনের কারণে রাষ্ট্রশক্তির লাগামহীন ব্যবহার যদি বৈধতা লাভ করে, তবে দীর্ঘ মেয়াদে তার দায় তাকেও নিতে হবে। সেটা কেবল সাংগঠনিকভাবে হবে, তা নয়। আমি আগেই বলেছি যে রাষ্ট্রশক্তির ব্যবহার এবং গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম সীমিত হলে উগ্রপন্থীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। বলা বাহুল্য, ওই পরিস্থিতিতে বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ইতিমধ্যে যতটা সংকুচিত হয়েছে, তার চেয়েও বেশি মাত্রায় সংকুচিত হয়ে পড়বে—এর কোনোটাই বিএনপির জন্য ইতিবাচক নয়। ইতিমধ্যে সাংগঠনিকভাবে যে ক্ষতি হয়েছে, সেই বিবেচনার পাশাপাশি সাধারণ জনগণের মনোভাব ও জীবন-জীবিকার বিষয়ে তার দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন করা জরুরি। বিএনপির এই পদক্ষেপের জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়া গেলে সেটি নিশ্চয় নাগরিকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না।
এই আলোচনার পর এই প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে—কে পদক্ষেপ আগে নেবে, আদৌ এসবের কিছু হবে কি না। সেটা নির্ভর করে নেতৃত্বের দূরদর্শিতার ওপর। সরকারের পক্ষে যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়া সহজতর, ফলে তার ওপরেই দায়িত্ব বেশি বর্তায়। তার পরও বিএনপির নেতৃত্ব বিষয়গুলো বিবেচনা করে দেখতে পারে যে তারা এই ঝুঁকি নিতে চায় কি না।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভারসিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments