জনপ্রতিনিধিরা কেউ কারাগারে কেউ ফেরার
জনগণের
বিপুল সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন ৫ সিটি মেয়র। রাজনৈতিক মামলায় তাদের
৩ জনই কারাগারে। গ্রেপ্তার এড়াতে বাকি দুজন রয়েছেন আত্মগোপনে। এতে
অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে দেশের প্রধান এই নগরীগুলো। স্থবিরতা দেখা দিয়েছে
প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে। থেমে গেছে নগরীর উন্নয়নমূলক প্রকল্প। কমে যাচ্ছে
রাজস্ব আদায়। নগরবাসী বঞ্চিত হচ্ছেন নাগরিক সেবা থেকে। শুধু মেয়রই নন,
বিরোধী জোটের সমর্থক কাউন্সিলরদের অনেকে এখন ফেরারি। গ্রেপ্তার ও হয়রানি
এড়াতে অনেকে নির্বাচনী এলাকায় নেই। কেউ আবার চলে গেছেন দেশের বাইরে- এ
কারণে অনেক নিষ্প্রাণ অবস্থায় আছে সিটি করপোরেশনগুলো। একই অবস্থা দেশের আরও
কয়েকটি পৌরসভায়। এসব পৌরসভার মেয়র কাউন্সিলররা মামলা-হয়রানিতে বিপর্যস্ত
হওয়ায় ভেঙে পড়েছে সেবা কার্যক্রম। এমন অবস্থায় দেশের প্রধান তিন সিটি
করপোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। আগামী ২৮শে
এপ্রিল একযোগে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হবে।
চৌধুরী মুমতাজ আহমদ/ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে জানান, ‘অভিভাবকহীন’ সিলেট সিটি করপোরেশনে দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। গত তিন মাসে নাগরিক সেবা নিম্নগামী। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উন্নয়ন কাজ। রাজস্ব আদায়ের হারও কমে আসছে। একই সঙ্গে সিলেট নগরীর ফুটপাত ও রক্ষণাবেক্ষণ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। এতে দিন দিন বাড়ছে নাগরিক দুর্ভোগ। কোথাও কোথাও দুর্ভোগের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আসছে বর্ষা মওসুমেও জলাবদ্ধতা নিয়ে আগে থেকেই দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে। তবে সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান প্রশাসনিক কর্মকর্তারা অচলাবস্থা দূর করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কাউন্সিলররা বলছেন, নির্বাচিত মেয়র ছাড়া কোনভাবেই নাগরিক স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলার তৃতীয় দফা সম্পূরক চার্জশিটে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর প্রায় দেড় মাস আড়ালে ছিলেন তিনি। ওই মামলায় গত ৩০শে ডিসেম্বর হবিগঞ্জের বিচারিক আদালতে হাজির হলে তাকে জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়। আটকের পর অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে সিলেট সিটি করপোরেশন। ভারপ্রাপ্ত মেয়র নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। ভারপ্রাপ্ত মেয়র-১ রেজাউল হাসান কয়েছ লোদি ও ভারপ্রাপ্ত মেয়র-২ অ্যাডভোকেট সালেহ আহমদের পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েন কাউন্সিলররা। সর্বশেষ এ বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। ওদিকে, ভারপ্রাপ্ত মেয়র-৩ অ্যাডভোকেট রোকশানা বেগম শাহনাজ দায়িত্ব পাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের আবেদন জানিয়েও কোন কাজ হয়নি। ফলে সিলেট সিটি করপোরেশন ভারপ্রাপ্ত মেয়রও খুঁজে পায়নি। সঙ্কট কাটাতে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবিবের হাতে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সিলেট নগরীকে বদলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। শপথ নিয়ে সিলেট নগরীর উন্নয়ন কাজে হাত দেন। কাউন্সিলররা জানিয়েছেন, মেয়র আরিফ সিটির উন্নয়নের জন্য মাস্টার প্ল্যানসহ নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা করেন। একই সঙ্গে তিনি নগরীর অন্যতম সমস্যা জলাবদ্ধতা দূর করতে ছড়া-খাল উদ্ধার শুরু করেন। বেশ কয়েকটি ছড়ায় মেয়র কোটি কোটি টাকার উদ্ধার অভিযান চালিয়েছিলেন। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ছড়া উদ্ধার অভিযান শেষ হওয়ার কথা ছিল। নগরীর অন্যতম সমস্যা ছিল ফুটপাত দখল। মেয়র আরিফ ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে অভিযান শুরু করেন। টানা কয়েক দিন তিনি অভিযান চালিয়ে ফুটপাথকে দখলমুক্ত করেন। আর যানজট দূর করতে রিকশার লেন স্থাপন করেছিলেন। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব গার্ডও নিয়োগ দেয়া হয়েছিল রাস্তায়। কিন্তু মেয়র না থাকায় এখন সিলেটের ফুটপাথ হকারদের দখলে। লেনের খুঁটি চুরি হচ্ছে। রাস্তা এতটাই দখল হয়ে গেছে চলতি হরতাল-অবরোধে স্বল্প সংখ্যক যানবাহনে যানজট দেখা দেয় সিলেটে। বর্তমানে ফুটপাথ সমস্যাটি আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। নগরীর জিন্দাবাজার থেকে বন্দরবাজার, সুমরা পয়েন্ট, ওসমানী শিশুপার্ক পর্যন্ত এলাকা পুরোটাই চলে গেছে হকারদের দখলে। এদিকে, মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জেলে যাওয়ার পর সিলেট সিটি করপোরেশনের আর্থিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এতে করে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বন্ধসহ উন্নয়ন কাজ থেমে গিয়েছিল। পরে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেয়ায় কিছুটা গতি পায়। সিলেট সিটির ভারপ্রাপ্ত মেয়র-২ অ্যাডভোকেট সালেহ আহমদ মানবজমিনকে বলেন, নির্বাচিত মেয়র না থাকার কারণে প্রায় অচল সিলেট সিটি করপোরেশন। উন্নয়ন কাজ থেমে গেছে। এতে করে সিলেটবাসীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ের মাত্রাও কমে গেছে। প্যানেল মেয়র-১ রেজাউল হাসান কয়েছ লোদি জানিয়েছেন, সিলেট সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত মেয়র ও প্রশাসনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মেয়র জনপ্রতিনিধি। তিনি জনগণের সুখ-দুঃখ বুঝবেন। সেটি হয়তো প্রশাসন দ্বারা বুঝা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, মেয়র উন্নয়ন কাজে যে গতি আনতে পারবেন সেটি প্রশাসন দিয়ে সম্ভব নয়। একই বক্তব্য সিলেট সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র-৩ অ্যাডভোকেট রোকশানা বেগম শাহনাজের। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন জনপ্রতিনিধি দিয়ে চলবে। এটাই নিয়ম। মেয়র না থাকলে প্যানেল মেয়ররা আছেন। প্যানেল মেয়ররাও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কাজে গতি আনাসহ করপোরেশন সচল করতে প্যানেল মেয়রের হাতে ক্ষমতা দেয়ার দাবি জানান তিনি।
আসলাম-উদ-দৌলা, রাজশাহী থেকে জানান, গত তিন মাস ধরে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। নাগরিক সেবা বঞ্চিত হচ্ছে পদে পদে। উন্নয়ন কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০১৩ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর রাজশাহী সিটির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। এরপর সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় একে একে ১৬টি মামলা। গত ৫ই জানুয়ারির পর বিএনপি জোটের টানা হরতাল-অবরোধে যানবাহনে পেট্রলবোমা হামলার ঘটনার তিনটি মামলায় হুকুমের আসামি করা হয় মেয়র বুলবুলকে। এরপরই গ্রেপ্তার এড়াতে কৌশলী অবস্থানে চলে যান তিনি। এ ছাড়া কারাগারে প্যানেল মেয়রসহ দুই কাউন্সিলর। নাশকতার একাধিক মামলায় আত্মগোপনে বিএনপি-জাময়াতপন্থি আরও ২৬ কাউন্সিলর। সূত্র জানায়, মেয়র বুলবুলসহ সিটি করপোরেশনের ৩৭ কাউন্সিলের মধ্যে ২৮ জনই গা-ঢাকা দিয়েছেন। মাসিক সাধারণ সভা করা হচ্ছে না। কার্যক্রম না থাকায় করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ঝিমিয়ে পড়েছে। তবে জরুরি কাজে মাঝেমধ্যে মোবাইল ফোনে মেয়র পরামর্শ দিচ্ছেন বলেও সূত্র দাবি করে। এদিকে সিটি করপোরেশনের কোন প্রকল্পই এখন আর আলোর মুখ দেখছে না। অনেক আগে উদ্যোগ নেয়া হলেও নগরীর পদ্মা তীরবর্তী লালন শাহ পার্ক, রিক্রেশন পার্ক ও ল্যান্ড স্কাইপিং, পাঠানপাড়া শেড, পেপার স্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন প্রকল্প শুরুই করতে পারেনি তারা। অন্যদিকে শালবাগান মার্কেট, নওদাপাড়া মার্কেট, ভদ্রা মার্কেট, লক্ষ্মীপুর ক্লিনিক, বর্ণালী সিনেমা হলের পেছনের ট্রেনিং সেন্টার, আরডিএ মার্কেটের পাশে দোকানঘর নির্মাণকাজগুলো দরপত্র হওয়ার পরও বাতিল হয়েছে। থমকে রয়েছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের কাজও। ড্রেনের পানি উপচে পড়ে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। নগরজুড়ে বেড়েছে মশার অত্যাচার। মশা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ছিটানোর নেই কোন উদ্যোগ। গরমের শুরুতেই মশার আক্রমণে অতিষ্ঠ নগরবাসী। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে নগরজুড়ে বেড়েছে বে-ওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যাও। রাতে কুকুরের উৎপাতে সাধারণ মানুষ রাস্তা দিয়ে চলতে পারে না। ওদিকে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেমে থাকার পাশাপাশি বর্তমানে রাজস্ব আদায়েও গতি কমে গেছে। রাজস্ব আয় থেকেই কর্মচারীদের আংশিক বেতন পরিশোধ করা হয়। বর্তমানে নিয়মিত ৪৮২ জন ও মাস্টার রোলের দুই হাজার ১৬৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এদিকে মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারি বরাদ্দ ব্যাপকহারে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আগে যেখানে প্রতিবছর ২৫-৩০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ পাওয়া যেত। এখন সেই বরাদ্দ নেমে দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি টাকায়। প্যানেল মেয়র-৩ নূর নাহার বেগম সাময়িক অসুবিধার কথা স্বীকার করে বলেন, সমস্যা কাটিয়ে উঠতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তবে রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম মানবজমিনকে বলেন, মেয়র না থাকলে কোন সিদ্ধান্ত স্বাভাবিকভাবে নেয়া যায় না। সেই সঙ্গে অধিকাংশ স্থায়ী কমিটির সভাপতিসহ সদস্যরাও আত্মগোপনে থাকায় করপোরেশনের কর্মকাণ্ড বলা যায় থমকে আছে। এদিকে মেয়র বুলবুলকে বরখাস্তের সুপারিশ করে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি)।
ইকবাল আহমদ সরকার, গাজীপুর থেকে জানান, নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নানসহ ২৫ জন কাউন্সিলর কারাগারে কিংবা গা-ঢাকা দিয়েছেন। এতে নাগরিক সেবায় বিঘ্ন ঘটছে। নগরবাসী নানা ধরনের সেবা ও উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে ভারপ্রাপ্ত মেয়র ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরণ বলছেন, মেয়র না থাকায় কিছুদিন সিটির সেবা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন ঘটলেও এখন সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে। বরং মেয়র থাকাকালীন যে ধরনের কার্যক্রম হয়েছে তার চেয়ে এখন অনেক বেশি গতিশীল হয়েছে নগরের কার্যক্রমে। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে গাজীপুর সিটির প্রথম নির্বাচনে মেয়র, ৫৭ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ১৯ জন নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্ব নেয়ার মাত্র সোয়া বছরের মাথায় জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, সিটি মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নানের নামে গাড়ি ভাঙচুর, নাশকতায় উসকানির অভিযোগে ৪টি মামলা হয়। এরপর গত মাসে গ্রেপ্তার হন তিনি। মামলা ও আইনি প্রক্রিয়ার কারণে মেয়র পদ থেকে অধ্যাপক এমএ মান্নানকে বরখাস্ত করা হতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন অনেকেই। বিএনপির এই মেয়র ছাড়াও সিটি করপোরেশনের গাজীপুর, টঙ্গী, পূবাইল, শালনা, কাশিমপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের কমপক্ষে ২৫ জন বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত কাউন্সিলরদের নামেও নাশকতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা রয়েছে। মামলার তালিকায় শিরিন চাকলাদার ও রীনা হালিম নামের দুজন নারী কাউন্সিলরের নামেও মামলা রয়েছে। কাউন্সিলররা জানান, নগরের পূবাইল এলাকার একটি নাশকতার ঘটনায়ই মামলা হয়েছে নগরের ১৯ জন বিএনপিপন্থি কাউন্সিলরের নামে। নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলররা না থাকায় নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে নগরবাসীর। নগর পরিষদের কার্যক্রমে অনেকটা স্থবির হয়ে যায়। কারাগারে সিটি মেয়র আটক থাকায় এ মাসের প্রথম দিকে নগরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন ভাতা তুলতেও বিপাকে পড়েন। এ অবস্থায় আর্থিক ক্ষমতা ও যাবতীয় ক্ষমতা প্রদানসহ সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আদেশে ৪৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুর রহমান কিরণকে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এর কয়েকদিন আগে আইনি লড়াইয়ে আসাদুর রহমান কিরণের বৈধতা পায় প্যানেল মেয়রের পদ। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসাবে তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। গাজীপুরা এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফজলুল হক চৌধুরী মেয়রের আগেই আটক হয়েছেন পুলিশের হাতে। নির্বাচিত মেয়র ছাড়াও কাউন্সিলররা উন্নয়ন কাজের পাশাপাশি নাগরিক সনদ, ওয়ারিশ সনদ প্রদান, জন্ম সনদে সুপারিশ ও সেবামূলক কাজ করতেন। এ ছাড়াও জনগণের ছোটখাটো বিরোধ মিটানোর পাশাপাশি নানা এখতিয়ারের মধ্যে থাকা নানা ধরনের সালিশও করতেন। ফলে বাধ্য হয়ে থানায় বা আদালতে ছুটতে হচ্ছে তাদের।
মো. আমির হোসেন, হবিগঞ্জ থেকে জানান, হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ জি কে গউছ কারাগারে থাকায় পৌরসভার উন্নয়ন কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। পৌরবাসী বঞ্চিত হচ্ছে নাগরিক সেবা থেকে। গত ৩রা ডিসেম্বর সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলার তৃতীয় দফা সম্পূরক চার্জশিটে মেয়র গউছসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এরপর ২৮শে ডিসেম্বর জি কে গউছ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়। ৬ই জানুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. খলিলুর রহমান স্বাক্ষরিত একপত্রে জি কে গউছকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পাশাপাশি মেয়রের দায়িত্ব দেয়া হয় প্যানেল মেয়র মহিলা কাউন্সিলর পেয়ারা বেগমকে। এ ছাড়া ৯ জন পুরুষ কাউন্সিলরের মধ্যে ৩ জন রয়েছেন বিএনপি সমর্থিত। এর মধ্যে পুলিশের দায়েরি মামলায় কাউন্সিলর বিএনপি নেতা মাহবুবুল হক হেলাল বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন এবং অপর কাউন্সিলর বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মজনু একাধিক মামলায় জামিনে রয়েছেন। এদিকে নির্বাচিত মেয়র জি কে গউছকে বরখাস্তের পর থেকে হবিগঞ্জ পৌরসভার স্বাভাবিক উন্নয়ন কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা জানান, পৌরসভার উন্নয়নে মেয়র গউছ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। চলমান উন্নয়নমূলক কাজ মেয়র নিজে তদারকি করতেন। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে এসব সেবামূলক কার্যক্রম থেকে পৌরবাসী বঞ্চিত হচ্ছেন।
রাশিদুল ইসলাম, খুলনা থেকে জানান, রাজনৈতিক মামলা ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) কার্যক্রম চালাতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছেন মেয়র মনিরুজ্জামান মনি। গত ২০শে জানুয়ারি চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যান তিনি। প্রায় দেড় মাস খুলনার বাইরে থাকায় কেসিসির সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। খুলনায় এলেও তার বাসভবনে থেকেই অফিসের ফাইলপত্র স্বাক্ষর করছেন। তবে গত ৭ই মার্চ থেকে নগরভবনে এসে তার দপ্তরে বসে কাজ করছেন। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ফাইল ছাড়াতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক হয়রানি ও নিরাপত্তার কারণে বাইরে সভা-সমাবেশ বা সেমিনারে তাকে আগের মতো দেখা যাচ্ছে না। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার একাধিকবার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অনুমতি না দেয়ায় তিনি যেতে পারেননি বলে মেয়রের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়।
চৌধুরী মুমতাজ আহমদ/ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে জানান, ‘অভিভাবকহীন’ সিলেট সিটি করপোরেশনে দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। গত তিন মাসে নাগরিক সেবা নিম্নগামী। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উন্নয়ন কাজ। রাজস্ব আদায়ের হারও কমে আসছে। একই সঙ্গে সিলেট নগরীর ফুটপাত ও রক্ষণাবেক্ষণ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। এতে দিন দিন বাড়ছে নাগরিক দুর্ভোগ। কোথাও কোথাও দুর্ভোগের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আসছে বর্ষা মওসুমেও জলাবদ্ধতা নিয়ে আগে থেকেই দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে। তবে সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান প্রশাসনিক কর্মকর্তারা অচলাবস্থা দূর করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কাউন্সিলররা বলছেন, নির্বাচিত মেয়র ছাড়া কোনভাবেই নাগরিক স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলার তৃতীয় দফা সম্পূরক চার্জশিটে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর প্রায় দেড় মাস আড়ালে ছিলেন তিনি। ওই মামলায় গত ৩০শে ডিসেম্বর হবিগঞ্জের বিচারিক আদালতে হাজির হলে তাকে জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়। আটকের পর অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে সিলেট সিটি করপোরেশন। ভারপ্রাপ্ত মেয়র নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। ভারপ্রাপ্ত মেয়র-১ রেজাউল হাসান কয়েছ লোদি ও ভারপ্রাপ্ত মেয়র-২ অ্যাডভোকেট সালেহ আহমদের পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েন কাউন্সিলররা। সর্বশেষ এ বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। ওদিকে, ভারপ্রাপ্ত মেয়র-৩ অ্যাডভোকেট রোকশানা বেগম শাহনাজ দায়িত্ব পাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের আবেদন জানিয়েও কোন কাজ হয়নি। ফলে সিলেট সিটি করপোরেশন ভারপ্রাপ্ত মেয়রও খুঁজে পায়নি। সঙ্কট কাটাতে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবিবের হাতে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সিলেট নগরীকে বদলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। শপথ নিয়ে সিলেট নগরীর উন্নয়ন কাজে হাত দেন। কাউন্সিলররা জানিয়েছেন, মেয়র আরিফ সিটির উন্নয়নের জন্য মাস্টার প্ল্যানসহ নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা করেন। একই সঙ্গে তিনি নগরীর অন্যতম সমস্যা জলাবদ্ধতা দূর করতে ছড়া-খাল উদ্ধার শুরু করেন। বেশ কয়েকটি ছড়ায় মেয়র কোটি কোটি টাকার উদ্ধার অভিযান চালিয়েছিলেন। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ছড়া উদ্ধার অভিযান শেষ হওয়ার কথা ছিল। নগরীর অন্যতম সমস্যা ছিল ফুটপাত দখল। মেয়র আরিফ ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে অভিযান শুরু করেন। টানা কয়েক দিন তিনি অভিযান চালিয়ে ফুটপাথকে দখলমুক্ত করেন। আর যানজট দূর করতে রিকশার লেন স্থাপন করেছিলেন। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব গার্ডও নিয়োগ দেয়া হয়েছিল রাস্তায়। কিন্তু মেয়র না থাকায় এখন সিলেটের ফুটপাথ হকারদের দখলে। লেনের খুঁটি চুরি হচ্ছে। রাস্তা এতটাই দখল হয়ে গেছে চলতি হরতাল-অবরোধে স্বল্প সংখ্যক যানবাহনে যানজট দেখা দেয় সিলেটে। বর্তমানে ফুটপাথ সমস্যাটি আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। নগরীর জিন্দাবাজার থেকে বন্দরবাজার, সুমরা পয়েন্ট, ওসমানী শিশুপার্ক পর্যন্ত এলাকা পুরোটাই চলে গেছে হকারদের দখলে। এদিকে, মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জেলে যাওয়ার পর সিলেট সিটি করপোরেশনের আর্থিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এতে করে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বন্ধসহ উন্নয়ন কাজ থেমে গিয়েছিল। পরে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেয়ায় কিছুটা গতি পায়। সিলেট সিটির ভারপ্রাপ্ত মেয়র-২ অ্যাডভোকেট সালেহ আহমদ মানবজমিনকে বলেন, নির্বাচিত মেয়র না থাকার কারণে প্রায় অচল সিলেট সিটি করপোরেশন। উন্নয়ন কাজ থেমে গেছে। এতে করে সিলেটবাসীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ের মাত্রাও কমে গেছে। প্যানেল মেয়র-১ রেজাউল হাসান কয়েছ লোদি জানিয়েছেন, সিলেট সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত মেয়র ও প্রশাসনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মেয়র জনপ্রতিনিধি। তিনি জনগণের সুখ-দুঃখ বুঝবেন। সেটি হয়তো প্রশাসন দ্বারা বুঝা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, মেয়র উন্নয়ন কাজে যে গতি আনতে পারবেন সেটি প্রশাসন দিয়ে সম্ভব নয়। একই বক্তব্য সিলেট সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র-৩ অ্যাডভোকেট রোকশানা বেগম শাহনাজের। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন জনপ্রতিনিধি দিয়ে চলবে। এটাই নিয়ম। মেয়র না থাকলে প্যানেল মেয়ররা আছেন। প্যানেল মেয়ররাও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কাজে গতি আনাসহ করপোরেশন সচল করতে প্যানেল মেয়রের হাতে ক্ষমতা দেয়ার দাবি জানান তিনি।
আসলাম-উদ-দৌলা, রাজশাহী থেকে জানান, গত তিন মাস ধরে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। নাগরিক সেবা বঞ্চিত হচ্ছে পদে পদে। উন্নয়ন কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০১৩ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর রাজশাহী সিটির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। এরপর সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় একে একে ১৬টি মামলা। গত ৫ই জানুয়ারির পর বিএনপি জোটের টানা হরতাল-অবরোধে যানবাহনে পেট্রলবোমা হামলার ঘটনার তিনটি মামলায় হুকুমের আসামি করা হয় মেয়র বুলবুলকে। এরপরই গ্রেপ্তার এড়াতে কৌশলী অবস্থানে চলে যান তিনি। এ ছাড়া কারাগারে প্যানেল মেয়রসহ দুই কাউন্সিলর। নাশকতার একাধিক মামলায় আত্মগোপনে বিএনপি-জাময়াতপন্থি আরও ২৬ কাউন্সিলর। সূত্র জানায়, মেয়র বুলবুলসহ সিটি করপোরেশনের ৩৭ কাউন্সিলের মধ্যে ২৮ জনই গা-ঢাকা দিয়েছেন। মাসিক সাধারণ সভা করা হচ্ছে না। কার্যক্রম না থাকায় করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ঝিমিয়ে পড়েছে। তবে জরুরি কাজে মাঝেমধ্যে মোবাইল ফোনে মেয়র পরামর্শ দিচ্ছেন বলেও সূত্র দাবি করে। এদিকে সিটি করপোরেশনের কোন প্রকল্পই এখন আর আলোর মুখ দেখছে না। অনেক আগে উদ্যোগ নেয়া হলেও নগরীর পদ্মা তীরবর্তী লালন শাহ পার্ক, রিক্রেশন পার্ক ও ল্যান্ড স্কাইপিং, পাঠানপাড়া শেড, পেপার স্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন প্রকল্প শুরুই করতে পারেনি তারা। অন্যদিকে শালবাগান মার্কেট, নওদাপাড়া মার্কেট, ভদ্রা মার্কেট, লক্ষ্মীপুর ক্লিনিক, বর্ণালী সিনেমা হলের পেছনের ট্রেনিং সেন্টার, আরডিএ মার্কেটের পাশে দোকানঘর নির্মাণকাজগুলো দরপত্র হওয়ার পরও বাতিল হয়েছে। থমকে রয়েছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের কাজও। ড্রেনের পানি উপচে পড়ে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। নগরজুড়ে বেড়েছে মশার অত্যাচার। মশা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ছিটানোর নেই কোন উদ্যোগ। গরমের শুরুতেই মশার আক্রমণে অতিষ্ঠ নগরবাসী। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে নগরজুড়ে বেড়েছে বে-ওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যাও। রাতে কুকুরের উৎপাতে সাধারণ মানুষ রাস্তা দিয়ে চলতে পারে না। ওদিকে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেমে থাকার পাশাপাশি বর্তমানে রাজস্ব আদায়েও গতি কমে গেছে। রাজস্ব আয় থেকেই কর্মচারীদের আংশিক বেতন পরিশোধ করা হয়। বর্তমানে নিয়মিত ৪৮২ জন ও মাস্টার রোলের দুই হাজার ১৬৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এদিকে মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারি বরাদ্দ ব্যাপকহারে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আগে যেখানে প্রতিবছর ২৫-৩০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ পাওয়া যেত। এখন সেই বরাদ্দ নেমে দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি টাকায়। প্যানেল মেয়র-৩ নূর নাহার বেগম সাময়িক অসুবিধার কথা স্বীকার করে বলেন, সমস্যা কাটিয়ে উঠতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তবে রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম মানবজমিনকে বলেন, মেয়র না থাকলে কোন সিদ্ধান্ত স্বাভাবিকভাবে নেয়া যায় না। সেই সঙ্গে অধিকাংশ স্থায়ী কমিটির সভাপতিসহ সদস্যরাও আত্মগোপনে থাকায় করপোরেশনের কর্মকাণ্ড বলা যায় থমকে আছে। এদিকে মেয়র বুলবুলকে বরখাস্তের সুপারিশ করে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি)।
ইকবাল আহমদ সরকার, গাজীপুর থেকে জানান, নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নানসহ ২৫ জন কাউন্সিলর কারাগারে কিংবা গা-ঢাকা দিয়েছেন। এতে নাগরিক সেবায় বিঘ্ন ঘটছে। নগরবাসী নানা ধরনের সেবা ও উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে ভারপ্রাপ্ত মেয়র ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরণ বলছেন, মেয়র না থাকায় কিছুদিন সিটির সেবা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন ঘটলেও এখন সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে। বরং মেয়র থাকাকালীন যে ধরনের কার্যক্রম হয়েছে তার চেয়ে এখন অনেক বেশি গতিশীল হয়েছে নগরের কার্যক্রমে। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে গাজীপুর সিটির প্রথম নির্বাচনে মেয়র, ৫৭ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ১৯ জন নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্ব নেয়ার মাত্র সোয়া বছরের মাথায় জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, সিটি মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নানের নামে গাড়ি ভাঙচুর, নাশকতায় উসকানির অভিযোগে ৪টি মামলা হয়। এরপর গত মাসে গ্রেপ্তার হন তিনি। মামলা ও আইনি প্রক্রিয়ার কারণে মেয়র পদ থেকে অধ্যাপক এমএ মান্নানকে বরখাস্ত করা হতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন অনেকেই। বিএনপির এই মেয়র ছাড়াও সিটি করপোরেশনের গাজীপুর, টঙ্গী, পূবাইল, শালনা, কাশিমপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের কমপক্ষে ২৫ জন বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত কাউন্সিলরদের নামেও নাশকতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা রয়েছে। মামলার তালিকায় শিরিন চাকলাদার ও রীনা হালিম নামের দুজন নারী কাউন্সিলরের নামেও মামলা রয়েছে। কাউন্সিলররা জানান, নগরের পূবাইল এলাকার একটি নাশকতার ঘটনায়ই মামলা হয়েছে নগরের ১৯ জন বিএনপিপন্থি কাউন্সিলরের নামে। নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলররা না থাকায় নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে নগরবাসীর। নগর পরিষদের কার্যক্রমে অনেকটা স্থবির হয়ে যায়। কারাগারে সিটি মেয়র আটক থাকায় এ মাসের প্রথম দিকে নগরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন ভাতা তুলতেও বিপাকে পড়েন। এ অবস্থায় আর্থিক ক্ষমতা ও যাবতীয় ক্ষমতা প্রদানসহ সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আদেশে ৪৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুর রহমান কিরণকে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এর কয়েকদিন আগে আইনি লড়াইয়ে আসাদুর রহমান কিরণের বৈধতা পায় প্যানেল মেয়রের পদ। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসাবে তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। গাজীপুরা এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফজলুল হক চৌধুরী মেয়রের আগেই আটক হয়েছেন পুলিশের হাতে। নির্বাচিত মেয়র ছাড়াও কাউন্সিলররা উন্নয়ন কাজের পাশাপাশি নাগরিক সনদ, ওয়ারিশ সনদ প্রদান, জন্ম সনদে সুপারিশ ও সেবামূলক কাজ করতেন। এ ছাড়াও জনগণের ছোটখাটো বিরোধ মিটানোর পাশাপাশি নানা এখতিয়ারের মধ্যে থাকা নানা ধরনের সালিশও করতেন। ফলে বাধ্য হয়ে থানায় বা আদালতে ছুটতে হচ্ছে তাদের।
মো. আমির হোসেন, হবিগঞ্জ থেকে জানান, হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ জি কে গউছ কারাগারে থাকায় পৌরসভার উন্নয়ন কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। পৌরবাসী বঞ্চিত হচ্ছে নাগরিক সেবা থেকে। গত ৩রা ডিসেম্বর সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলার তৃতীয় দফা সম্পূরক চার্জশিটে মেয়র গউছসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এরপর ২৮শে ডিসেম্বর জি কে গউছ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়। ৬ই জানুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. খলিলুর রহমান স্বাক্ষরিত একপত্রে জি কে গউছকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পাশাপাশি মেয়রের দায়িত্ব দেয়া হয় প্যানেল মেয়র মহিলা কাউন্সিলর পেয়ারা বেগমকে। এ ছাড়া ৯ জন পুরুষ কাউন্সিলরের মধ্যে ৩ জন রয়েছেন বিএনপি সমর্থিত। এর মধ্যে পুলিশের দায়েরি মামলায় কাউন্সিলর বিএনপি নেতা মাহবুবুল হক হেলাল বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন এবং অপর কাউন্সিলর বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মজনু একাধিক মামলায় জামিনে রয়েছেন। এদিকে নির্বাচিত মেয়র জি কে গউছকে বরখাস্তের পর থেকে হবিগঞ্জ পৌরসভার স্বাভাবিক উন্নয়ন কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা জানান, পৌরসভার উন্নয়নে মেয়র গউছ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। চলমান উন্নয়নমূলক কাজ মেয়র নিজে তদারকি করতেন। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে এসব সেবামূলক কার্যক্রম থেকে পৌরবাসী বঞ্চিত হচ্ছেন।
রাশিদুল ইসলাম, খুলনা থেকে জানান, রাজনৈতিক মামলা ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) কার্যক্রম চালাতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছেন মেয়র মনিরুজ্জামান মনি। গত ২০শে জানুয়ারি চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যান তিনি। প্রায় দেড় মাস খুলনার বাইরে থাকায় কেসিসির সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। খুলনায় এলেও তার বাসভবনে থেকেই অফিসের ফাইলপত্র স্বাক্ষর করছেন। তবে গত ৭ই মার্চ থেকে নগরভবনে এসে তার দপ্তরে বসে কাজ করছেন। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ফাইল ছাড়াতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক হয়রানি ও নিরাপত্তার কারণে বাইরে সভা-সমাবেশ বা সেমিনারে তাকে আগের মতো দেখা যাচ্ছে না। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার একাধিকবার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অনুমতি না দেয়ায় তিনি যেতে পারেননি বলে মেয়রের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়।
No comments