উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ -দু’নেত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ডেনিশ মন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকা
সফররত ডেনমার্কের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহায়তা মন্ত্রী মগেন্স জেনসেন। গতকাল
সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এবং রাতে গুলশানে বিএনপি
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার বৈঠক হয়। খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে
রাত সোয়া আটটা থেকে পৌনে নয়টা পর্যন্ত আধা ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক অনুষ্ঠিত
হয়।
এদিকে দুপুরের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে ডেনিশ মন্ত্রী বলেন, প্রগতির পরবর্তী ধাপে পৌঁছতে হলে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। পাশাপাশি উৎপাদন খাতে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শুধু বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য নয়, বাংলাদেশের মানুষের জন্যও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া উন্নয়নের জন্যও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মত দেন তিনি। ডেনিশ মন্ত্রী বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, আমি মনে করি, যে রাজনৈতিক অস্থিরতা এখানে দেখা যাচ্ছে তার সমাধান সম্ভব। বিনিয়োগকারীরা ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায়’ সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় উল্লেখ করে তিনি বলেন ‘রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা’ না থাকলে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে উত্তরণের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বিনিয়োগ প্রসঙ্গে ডেনিশ মন্ত্রী বলেন, শুধু তৈরী পোশাক খাতেই নয়, বরং অন্য সম্ভাবনাময় খাতগুলোতেও বিনিয়োগ করতে হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে জেনসেন বলেন, উন্নয়নশীল একটি সমাজের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সভা-সমাবেশের স্বাধীনতার বিষয়ে পূর্ণ গণতন্ত্র থাকার সর্বজনীন জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। এছাড়াও তিনি বলেন, এনজিওগুলোর কাজ করার স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। ওয়েস্টিন হোটেলে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনের সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ডেনিশ রাষ্ট্রদূত হ্যান ফুগল এসকজার।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক: এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রেস সচিব একেএম শামীম চৌধুরী সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডেনমার্ক ও সে দেশের জনগণ বাংলাদেশের মহান বন্ধু। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ডেনমার্কের জনগণের দেয়া মূল্যবান নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থনের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। শেখ হাসিনা ডেনমার্ক-বাংলাদেশ স্ট্যাটেজিক সেক্টর কো-অপারেশন সফলভাবে চালু হওয়ায় ডেনিশ মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। শেখ হাসিনা দৃঢ় আস্থা ব্যক্ত করেন, কোপেনহেগেন নগরীতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন চালু হওয়ার পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও প্রসারিত ও গভীর হবে। প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, মুখ্য সচিব মো. আবুল কালাম আজাদ, ডেনমার্কে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ এ মুহিত এসময় উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে বৈঠক: বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ সফররত ডেনিশ মন্ত্রী মগেন্স জেনসেনের বৈঠকে আলোচনায় ছিল বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল জানান, বৈঠকে বাংলাদেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আলোচনার এক পর্যায়ে রাজনৈতিক বিষয়ে কথা হয়। ডেনিশ মন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করা উচিত বলে মত দেন। এ সময় তিনি বিএনপিকে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আলাপ-আলোচনায় জোর দেয়ার কথা বলেন। ডেনিশ মন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ দরকার। অন্যথায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। এ সময় বিএনপির তরফে ডেনিশ মন্ত্রীকে জানানো হয়, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ বের করার ব্যাপারে বিএনপি ইতিবাচক। সংলাপের জন্য বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০দলের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু সরকার সংলাপের ব্যাপারে অব্যাহতভাবেই নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আসছে।
সমালোচনা উন্নয়নের অংশ: সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে ‘সরকারের সমালোচনার’ বিষয়ে মগেন্স বলেন, সমালোচনা উন্নয়নের একটি অংশ। কারণ যখন কেউ সার্বক্ষণিক আপনার কাজের সমালোচনা করবে, তখন আপনি আরও ভাল কাজ করার চেষ্টা করবেন। ফলে সমালোচনা জরুরি। এটি সর্বজনীন। এটি উন্নয়নশীল সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মানবাধিকার নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মানবাধিকার নিশ্চিত করা উন্নয়নের মৌলিক শর্ত। আমরা বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করবো। বাংলাদেশকে একটি উন্নয়শীল অর্থনীতির দেশ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, তবে এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বর্তমানে টেঙটাইল উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তন হচ্ছে। আপনারা ভাল কর্মপরিবেশ পাচ্ছেন, যা ভাল ব্যবসা দিচ্ছে। এটি ভাল ব্যবসার জন্য বিনিয়োগ। তৈরী পোশাক শিল্পের মানোন্নয়নে ক্রেতা, বিক্রেতা এবং সরকার একসঙ্গে কাজ করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমরা গর্বিত। তবে পুরো বাংলাদেশে সত্যিকারের স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে শ্রমিক অধিকার এবং কর্মপরিবেশের ওপর আরও জোর দিতে হবে। তৈরী পোশাকশিল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন এ শিল্পে ভাল কিছু হচ্ছে। স্বল্প সময়ে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে ডেনমার্ক তা অনুধাবন করে। তবে এখনও কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা শর্ত পূরণ করছে না। ফলে এখনও আরও কিছু করতে হবে। ডেনমার্কের শ্রমিকদের পরিস্থিতি নিয়ে অভিজ্ঞতায় তিনি বলেন, যদিও ডেনমার্কে এখন শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে, তারপরও দুর্ঘটনার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়। ফলে এক্ষেত্রে থেমে থাকার কোন সুযোগ নেই। বিষয়টিতে সার্বক্ষণিক কাজ করে যাওয়া জরুরি। বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতাকে বিস্ময়কর বলে তিনি বলেন, ডেনমার্কের দেয়া উন্নয়ন সহযোগিতা দরিদ্রদের মাঝে পৌঁছাচ্ছে দেখে ভাল লেগেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৬০টির মতো ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠান ব্যবসা পরিচালনা করছে। যা আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে সকালে হোটেল ওয়েস্টিনে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ নিয়ে ঢাকাস্থ ডেনিশ দূতাবাস এবং ডেনিশ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশ- ফ্রেমিং দ্য ফিউচার: এ হাই লেভেল কনফারেন্স অন আরএমজি অ্যান্ড বিয়ন্ড’ শীর্ষক কনফারেন্সের উদ্বোধন করেন ডেনিশ মন্ত্রী। কনফারেন্সে প্রধান অতিথি হিসেবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বক্তব্য রাখেন। এছাড়া ডেনিশ ও বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা এবং ডেনিশ ও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এনজিও, লেবার অর্গানাইজেশন এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও ডেনমার্কের মধ্যে ‘ওয়ার্কিং ইনভায়রনমেন্ট-অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ’ শীর্ষক একটি দ্বিপক্ষীয় সম্মতিপত্র সই হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং ডেনমার্কের পক্ষ থেকে ডেনিশ কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী সম্মতি পত্রে স্বাক্ষর করে। এর মাধ্যমে কর্মপরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে ডেনিশ কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং ডেনিশ কর্মস্থল-পরিবেশ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে। যেখানে বিশেষ করে পেশাগত নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে। অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় ডেনিশ মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ রানা প্লাজার দুর্ঘটনাকে পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ সরকার, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও তৈরী পোশাক খাতের সমন্বয়ে নতুন মাননিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন হয়েছে। পারস্পরিক সমঝোতার এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। যা বিশ্বের কোথাও আগে দেখা যায়নি। এ অবস্থায় বলা যায়, বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই ভবিষ্যতের রূপরেখা বাস্তবায়ন করছে। তবে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতে এখনও সামাজিক সংলাপের প্রয়োজন রয়েছে। যা দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে। শুধু তৈরী পোশাকশিল্পই নয়, অন্যান্য শিল্পেও বিনিয়োগ করে পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে।
ডেনিশ মন্ত্রীকে রওশন- পরিস্থিতি অচিরেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে: এদিকে ডেনিশ মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে দেশের বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতি অচিরেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ। গতকাল সন্ধ্যায় তার বাসভবনে ডেনমার্কের বাণিজ্য ও উন্নয়ন মন্ত্রী মগেন্স জেনসেন সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যান। সাক্ষাতে ডেনিশ মন্ত্রীর জিজ্ঞাসার জবাবে বিরোধী দলীয় নেতা দেশের বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ মন্ত্রীকে আরও বলেন, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই ডেনমার্কের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ডেনমার্কের সহযোগিতা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করে বিরোধী নেতা। বলেন, বিশেষ করে কৃষি, বাণিজ্য, পরিবহন, মৎস্য ও গ্রামীণ উন্নয়নে ডেনমার্ক আরও ভূমিকা রাখতে পারে। জবাবে ডেনিশ মন্ত্রী এসব বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বলেন, এ উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। বিরোধী দলীয় নেতা ডেনমার্কের বাণিজ্য মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের রেডিমেড গার্মেন্টস ডেনমার্কে রফতানির মাধ্যমে আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া ড্যানিডাসহ বিভিন্ন ড্যানিশ প্রতিষ্ঠান এ দেশে কাজ করে দেশের জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার ফলে বেকারত্ব দূরীকরণে ডেনমার্ক বিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী এমপি, বিরোধী দলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব ফখরুল ইমাম এমপি, নূর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী এমপি, ডেনমার্কের স্টেট সেক্রেটারি মি. মার্টিন বি হারমান, বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত হান ফুগোল ইস্কেজার প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে দুপুরের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে ডেনিশ মন্ত্রী বলেন, প্রগতির পরবর্তী ধাপে পৌঁছতে হলে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। পাশাপাশি উৎপাদন খাতে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শুধু বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য নয়, বাংলাদেশের মানুষের জন্যও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া উন্নয়নের জন্যও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মত দেন তিনি। ডেনিশ মন্ত্রী বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, আমি মনে করি, যে রাজনৈতিক অস্থিরতা এখানে দেখা যাচ্ছে তার সমাধান সম্ভব। বিনিয়োগকারীরা ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায়’ সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় উল্লেখ করে তিনি বলেন ‘রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা’ না থাকলে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে উত্তরণের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বিনিয়োগ প্রসঙ্গে ডেনিশ মন্ত্রী বলেন, শুধু তৈরী পোশাক খাতেই নয়, বরং অন্য সম্ভাবনাময় খাতগুলোতেও বিনিয়োগ করতে হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে জেনসেন বলেন, উন্নয়নশীল একটি সমাজের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সভা-সমাবেশের স্বাধীনতার বিষয়ে পূর্ণ গণতন্ত্র থাকার সর্বজনীন জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। এছাড়াও তিনি বলেন, এনজিওগুলোর কাজ করার স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। ওয়েস্টিন হোটেলে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনের সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ডেনিশ রাষ্ট্রদূত হ্যান ফুগল এসকজার।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক: এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রেস সচিব একেএম শামীম চৌধুরী সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডেনমার্ক ও সে দেশের জনগণ বাংলাদেশের মহান বন্ধু। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ডেনমার্কের জনগণের দেয়া মূল্যবান নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থনের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। শেখ হাসিনা ডেনমার্ক-বাংলাদেশ স্ট্যাটেজিক সেক্টর কো-অপারেশন সফলভাবে চালু হওয়ায় ডেনিশ মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। শেখ হাসিনা দৃঢ় আস্থা ব্যক্ত করেন, কোপেনহেগেন নগরীতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন চালু হওয়ার পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও প্রসারিত ও গভীর হবে। প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, মুখ্য সচিব মো. আবুল কালাম আজাদ, ডেনমার্কে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ এ মুহিত এসময় উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে বৈঠক: বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ সফররত ডেনিশ মন্ত্রী মগেন্স জেনসেনের বৈঠকে আলোচনায় ছিল বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল জানান, বৈঠকে বাংলাদেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আলোচনার এক পর্যায়ে রাজনৈতিক বিষয়ে কথা হয়। ডেনিশ মন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করা উচিত বলে মত দেন। এ সময় তিনি বিএনপিকে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আলাপ-আলোচনায় জোর দেয়ার কথা বলেন। ডেনিশ মন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ দরকার। অন্যথায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। এ সময় বিএনপির তরফে ডেনিশ মন্ত্রীকে জানানো হয়, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ বের করার ব্যাপারে বিএনপি ইতিবাচক। সংলাপের জন্য বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০দলের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু সরকার সংলাপের ব্যাপারে অব্যাহতভাবেই নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আসছে।
সমালোচনা উন্নয়নের অংশ: সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে ‘সরকারের সমালোচনার’ বিষয়ে মগেন্স বলেন, সমালোচনা উন্নয়নের একটি অংশ। কারণ যখন কেউ সার্বক্ষণিক আপনার কাজের সমালোচনা করবে, তখন আপনি আরও ভাল কাজ করার চেষ্টা করবেন। ফলে সমালোচনা জরুরি। এটি সর্বজনীন। এটি উন্নয়নশীল সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মানবাধিকার নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মানবাধিকার নিশ্চিত করা উন্নয়নের মৌলিক শর্ত। আমরা বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করবো। বাংলাদেশকে একটি উন্নয়শীল অর্থনীতির দেশ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, তবে এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বর্তমানে টেঙটাইল উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তন হচ্ছে। আপনারা ভাল কর্মপরিবেশ পাচ্ছেন, যা ভাল ব্যবসা দিচ্ছে। এটি ভাল ব্যবসার জন্য বিনিয়োগ। তৈরী পোশাক শিল্পের মানোন্নয়নে ক্রেতা, বিক্রেতা এবং সরকার একসঙ্গে কাজ করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমরা গর্বিত। তবে পুরো বাংলাদেশে সত্যিকারের স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে শ্রমিক অধিকার এবং কর্মপরিবেশের ওপর আরও জোর দিতে হবে। তৈরী পোশাকশিল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন এ শিল্পে ভাল কিছু হচ্ছে। স্বল্প সময়ে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে ডেনমার্ক তা অনুধাবন করে। তবে এখনও কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা শর্ত পূরণ করছে না। ফলে এখনও আরও কিছু করতে হবে। ডেনমার্কের শ্রমিকদের পরিস্থিতি নিয়ে অভিজ্ঞতায় তিনি বলেন, যদিও ডেনমার্কে এখন শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে, তারপরও দুর্ঘটনার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়। ফলে এক্ষেত্রে থেমে থাকার কোন সুযোগ নেই। বিষয়টিতে সার্বক্ষণিক কাজ করে যাওয়া জরুরি। বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতাকে বিস্ময়কর বলে তিনি বলেন, ডেনমার্কের দেয়া উন্নয়ন সহযোগিতা দরিদ্রদের মাঝে পৌঁছাচ্ছে দেখে ভাল লেগেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৬০টির মতো ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠান ব্যবসা পরিচালনা করছে। যা আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে সকালে হোটেল ওয়েস্টিনে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ নিয়ে ঢাকাস্থ ডেনিশ দূতাবাস এবং ডেনিশ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশ- ফ্রেমিং দ্য ফিউচার: এ হাই লেভেল কনফারেন্স অন আরএমজি অ্যান্ড বিয়ন্ড’ শীর্ষক কনফারেন্সের উদ্বোধন করেন ডেনিশ মন্ত্রী। কনফারেন্সে প্রধান অতিথি হিসেবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বক্তব্য রাখেন। এছাড়া ডেনিশ ও বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা এবং ডেনিশ ও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এনজিও, লেবার অর্গানাইজেশন এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও ডেনমার্কের মধ্যে ‘ওয়ার্কিং ইনভায়রনমেন্ট-অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ’ শীর্ষক একটি দ্বিপক্ষীয় সম্মতিপত্র সই হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং ডেনমার্কের পক্ষ থেকে ডেনিশ কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী সম্মতি পত্রে স্বাক্ষর করে। এর মাধ্যমে কর্মপরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে ডেনিশ কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং ডেনিশ কর্মস্থল-পরিবেশ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে। যেখানে বিশেষ করে পেশাগত নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে। অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় ডেনিশ মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ রানা প্লাজার দুর্ঘটনাকে পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ সরকার, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও তৈরী পোশাক খাতের সমন্বয়ে নতুন মাননিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন হয়েছে। পারস্পরিক সমঝোতার এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। যা বিশ্বের কোথাও আগে দেখা যায়নি। এ অবস্থায় বলা যায়, বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই ভবিষ্যতের রূপরেখা বাস্তবায়ন করছে। তবে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতে এখনও সামাজিক সংলাপের প্রয়োজন রয়েছে। যা দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে। শুধু তৈরী পোশাকশিল্পই নয়, অন্যান্য শিল্পেও বিনিয়োগ করে পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে।
ডেনিশ মন্ত্রীকে রওশন- পরিস্থিতি অচিরেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে: এদিকে ডেনিশ মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে দেশের বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতি অচিরেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ। গতকাল সন্ধ্যায় তার বাসভবনে ডেনমার্কের বাণিজ্য ও উন্নয়ন মন্ত্রী মগেন্স জেনসেন সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যান। সাক্ষাতে ডেনিশ মন্ত্রীর জিজ্ঞাসার জবাবে বিরোধী দলীয় নেতা দেশের বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ মন্ত্রীকে আরও বলেন, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই ডেনমার্কের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ডেনমার্কের সহযোগিতা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করে বিরোধী নেতা। বলেন, বিশেষ করে কৃষি, বাণিজ্য, পরিবহন, মৎস্য ও গ্রামীণ উন্নয়নে ডেনমার্ক আরও ভূমিকা রাখতে পারে। জবাবে ডেনিশ মন্ত্রী এসব বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বলেন, এ উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। বিরোধী দলীয় নেতা ডেনমার্কের বাণিজ্য মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের রেডিমেড গার্মেন্টস ডেনমার্কে রফতানির মাধ্যমে আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া ড্যানিডাসহ বিভিন্ন ড্যানিশ প্রতিষ্ঠান এ দেশে কাজ করে দেশের জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার ফলে বেকারত্ব দূরীকরণে ডেনমার্ক বিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী এমপি, বিরোধী দলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব ফখরুল ইমাম এমপি, নূর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী এমপি, ডেনমার্কের স্টেট সেক্রেটারি মি. মার্টিন বি হারমান, বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত হান ফুগোল ইস্কেজার প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
No comments