প্রধানমন্ত্রীর দেশপ্রেমের কঠিন পরীক্ষা by সিরাজুর রহমান
কখনো
সুখী কখনো মন্দভাগ্য দেশটা নিয়ে আমাদের অতিমাত্রায় ভালোবাসা সমস্যার একটা
কারণ। পারিবারিক সম্পত্তি বিক্রি করে, আদম পাচারকারীর কাছে সর্বস্ব খুইয়ে,
সাগরে ডুবে একাধিক কোটি বাংলাদেশী এখন পাঁচটি মহাদেশের প্রায় একশোটি দেশে
নিজেদের স্থাপন করেছে। অমানুষিক কঠোর পরিশ্রম করে দরিদ্র দেশটিতে কিছু অর্থ
পাঠাবে- সে লক্ষ্যে। দেশে এখন ফাল্গুনের শেষ। নববর্ষের আয়োজন এখনো শুরু
হয়নি সবখানে। কিন্তু যুক্তরাজ্যে, মহাদেশীয় ইউরোপে, আমেরিকা-ক্যানাডার বহু
স্থানে ঘটা করে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান করার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। আমরা
যখন প্রথম প্রবাসে আসি সংখ্যায় খুবই সীমিত ছিলাম। দু-চারজন বন্ধুকে ভাড়াকরা
বাসায় ডেকে গল্প-গুজারি করে এবং ডালভাত খেয়ে নববর্ষ করেছি। হয়তো কখনো কেউ
একটা-দু’টা গান গেয়েছেন কিংবা কবিতা আবৃত্তি করেছেন। আমি স্বয়ং বিশেষ একটা
সুবিধার স্থানে ছিলাম বিবিসির চাকরি উপলক্ষে। পাওয়া গেলে দেশের কোনো
শিল্পীকে ডেকে কিংবা বিবিসির লাইব্রেরি থেকে দু’চারখানি গ্রামোফোন রেকর্ড
বাজিয়ে বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠন প্রচার করতাম।
উচ্চশিক্ষার জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে যারা আসতেন তাদের মধ্যে অনেক প্রতিভাধর ছিলেন। দুই কবি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান আর আবু হেনা মোস্তাফা কামালকে দিয়ে বেশ কিছু গান আমি লিখিয়েছি। সুরও দিয়েছেন তারা এবং কোনো কোনো প্রবাসীকে শিখিয়ে-পড়িয়ে সেসব গান গাওয়ানো হয়েছে, প্রায়ই স্টুডিওর বাইরে কোনো স্কুল হল কিংবা ইয়ুথ সেন্টারে। প্রবাসী বাংলাভাষীরা দূর-দূরান্ত থেকে শুনতে এসেছেন। আবু হেনার লেখা একটা গানের দুটো পঙ্ক্তি ছিল, ‘কবে আমি চোখ মেলেছি স্বপ্নভরা গ্রামে, ছড়িয়ে আবির মেঘে মেঘে সন্ধ্যা যেথা নামে।’ আজো কোনো সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে আবির-ছটা দেখলেই গানটা আমার কানে বাজতে থাকে।
বলছিলাম প্রবাসে বাংলা নববর্ষ, শহীদ দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি পালনের কথা। দেশে এ জাতীয় অনুষ্ঠানে মাঝে মধ্যে হাতাহাতি হয়। দেশের সে ঐতিহ্য বিদেশে বাকি থাকবে কেন? একেক সময় মনে হয় ভালোবাসার আতিশয্য থেকে হয়তো আমরা দেশের বহু ক্ষতি করছি, দেশের হানাহানি আমরা বিদেশেও নিয়ে এসেছি। লন্ডনে আমাদের পাড়ায় মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের কোনো দেশের এক তরুণ দম্পতি এসেছে। ভারি মিষ্টি দু’টি ছোট্ট মেয়ে ওদের। কোলে এলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বড় মেয়ের তিন বছর বয়সে ছোটটির জন্ম হয়। মায়ের ভালোবাসার জন্য কিছুটা ঈর্ষা হবে- সেটা স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের সমস্যা দাঁড়াল। তিন বছরের মেয়েটির ধারণা হলো নবজাতকটি তার সন্তান। সব সময় তাকে সে দখল করে রাখছিল। এমনকি দুধ খাওয়াতে মায়ের কোলে দিতেও না-রাজ ছিল সে। ভাগ্য ভালো, শিগগিরই সমস্যাটার সুসমাধান হয়ে গেছে। এখন ওরা দু’টিতে মিলে যখন খেলা করে দেখে আনন্দ হয়।
এমন দৃষ্টান্ত হয়তো দেশেও আপনারা দেখে থাকবেন। অপরিণত স্নেহের বাড়াবাড়ি হয়তো এ সমস্যার কিছু কারণ। বাংলাদেশে এখন কিছু জটিল সমস্যা-সঙ্কট চলছে। অনিয়মিতভাবে ক্ষমতা দখল করে রাখা, র্যাব ও পুলিশকে রাজনৈতিক পেশিশক্তি হিসেবে ব্যবহার করা, অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে আইন-আদালতকে দলীয় হাতিয়ারে পরিণত করা ইত্যাদি হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কটের কিছু আলামত। বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য প্রহসনের নির্বাচন সূত্রে বহাল এবং সরকার বলছে খালেদা জিয়া এবং বিএনপি গদি লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে বলেই সমস্যার জন্ম। কিন্তু পৃথিবীর সব প্রত্যন্ত পর্যন্ত এখন জানে যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। ক্ষমতা তারা পেয়েছিল এবং সে ক্ষমতা যাতে হাতছাড়া না হয় তার জন্য সব কিছু তারা করেছে আর করছে।
বর্তমান সঙ্কট যেভাবে শুরুজামায়াতে ইসলামীর গায়ে তখন গন্ধ ছিল না। তাদের দলে নিয়ে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালুর জন্য লাগাতার হরতাল আর অবরোধ চালু করেছিল। দেশের সব মানুষ ভুলে যায়নি সে ইতিহাস। রেল লাইন উপড়ে ফেলা হয়েছিল, বন্দর আর সড়ক অবরোধ করে অর্থনীতিকে স্থবির করে দেয়া হয়েছিল, বহু লোক মারা গিয়েছিল সে আন্দোলনে। আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির তফাৎ এখানে যে বিএনপির রাজনীতি কখনোই আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মতো নিষ্ঠুর হয় না, তাদের আন্দোলন মানবিকতার সীমা ছাড়িয়ে যায় না। তাদের যখন বলা হলো যে সংবিধান ও নির্বাচন পদ্ধতি দেশের মানুষের জন্য, তারা সংলাপে রাজি হলো, চটজলদি সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু করা হলো। ২০০৮ সালের মাস্টারপ্ল্যান নির্বাচনে জয়ের পর আওয়ামী লীগের লক্ষ্যে পরিবর্তন হয়। ভবিষ্যতে নির্বাচন করে ক্ষমতা লাভের চেষ্টার পরিবর্তে তারা বাকশালী পন্থায় স্থায়ীভাবে গদি দখল করে রাখার জন্য তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি উল্টে ফেলার পরিকল্পনা নেয়। প্রশাসন, পুলিশ ও র্যাব আর বিচারিক ব্যবস্থার দলীয়করণ করে তারা প্রতিবাদ ও প্রতিকার অসম্ভব করে তোলে। তারপর একদলীয় সংসদে সংবিধানের খোল-নলচে পাল্টে দিয়ে ন্যায্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব করে তোলে। একই সাথে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের সময় থেকে আজো পর্যন্ত বিএনপিসহ কোনো বিরোধী দলকে অবাধে সভা-সমাবেশ করে নিজেদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়া হয়নি। বরঞ্চ গুম, হত্যা, নির্যাতন, ভুয়া মামলায় গ্রেফতার, ভীতি প্রদর্শন এবং আইনি ও পুলিশি শক্তি ব্যবহার করে বিরোধীপক্ষের রাজনীতি করা অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। পাশাপাশি মিডিয়ারও কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে।
বলতে গেলে গোটা ২০১৩ সালজুড়েই জাতিসঙ্ঘ থেকে শুরু করে সব বন্ধু রাষ্ট্র, সাহায্যদাতা দেশ ও সংস্থা সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সবার গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকার ও বিরোধী জোটকে চাপ দিতে থাকে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল পাশের দেশ ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকার। স্বাভাবিক দ্বিপক্ষীয় ও কূটনৈতিক পন্থায় নয়, বরং গোপন ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তির মাধ্যমে সে সরকার বাংলাদেশ নামের দেশটাকে আরো একটি সিকিমে পরিণত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বভাবতই আওয়ামী লীগ সরকারকে গদিতে বহাল রাখার প্রয়োজন ছিল তাদের।
বিনিময়ে বিনা ভোটে নির্বাচন এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে কংগ্রেসশাসিত ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে গুরুতর হস্তক্ষেপ করেছে। শেখ হাসিনাকে সে আশ্বাস দিতে ভারতের সম্প্রতি পদচ্যূত পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায়ও এসেছিলেন। ভারতের অন্যায় পরামর্শ ও উসকানিতে বলীয়ান হয়ে সরকার ভোটারবিহীন নির্বাচনের পথ ধরে। দেশের ও বিদেশের মানুষকে প্রতারিত করার লক্ষ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর গণভবনে ঘোষণা করেন, ‘৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন হবে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। সমঝোতা হলে সংসদ ভেঙে আবার নির্বাচন দেয়া হবে।’ তখনকার চেয়ে কত ভিন্ন আওয়ামী লীগ প্রধানের বর্তমান অবস্থান! সরকার ও আওয়ামী লীগ এখন বলছে, ২০১৯ সালের আগে আর কোনো নির্বাচন হবে না। সে বক্তব্যের পক্ষে নিত্যনতুন ফাঁকা যুক্তি ও অজুহাত সৃষ্টি করে চলেছে তারা।
জাতির প্রতি অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা
আওয়ামী লীগ নেতারা এখন শেখ হাসিনার ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বরের প্রতিশ্রুতি গিলে খাবার চেষ্টা করছেন। মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতারা উল্টো বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ তুলছেন। লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ গত ১৪ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন যে, সমঝোতা-সংলাপ কিছু হবে না। তিনি আরো বলেছেন, ‘আগামীতেও একইভাবে নির্বাচন হবে।’ একইভাবে বলতে তিনি অবশ্যই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির তামাশার কথা বলেছেন। বলছেন কি না জানি না। পাঠকদের অবগতির জন্য স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন, সে নির্বাচনের তারিখের এক সপ্তাহ আগেই ঘোষণা করা হয় আওয়ামী লীগ বিনা নির্বাচনে ১৫৪টি আসন পেয়ে সংসদে গরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। আর ৫ জানুয়ারি কী হয়েছে? সে দিন ২০ দলের জোট ও সরকারবিরোধী অন্য গোষ্ঠীগুলো নির্বাচন বর্জন করেছে, বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোটার যাননি, শতাধিক ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং বিরোধী দলগুলোর কর্মী ও সমর্থকদের ওপর আওয়ামী লীগ ক্যাডার ও পুলিশের আক্রমণে ২১ জন লোক নিহত হন। সৈয়দ আশরাফেরা এ ধরনের নির্বাচন করেই ভবিষ্যতেও গদি দখল করে রাখতে চান। দেশ ও মানুষের প্রতি কতখানি ঘৃণা ও অবজ্ঞা থাকলে এ ধরনের নির্লজ্জ কথা বলা যায় সহজেই ধারণা করে নেয়া যায়।
মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপি, বিশেষ করে জনসাধারণের ভোটে তিনবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে যেসব ভাষায় গালিগালাজ করছেন রাজপথের গুণ্ডাপাণ্ডাদের মুখেও সচরাচর তেমন ভাষা আশা করা যায় না। মনে হতে পারে যে, প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহারের লক্ষ্যে নিত্যনতুন গালিগালাজ খুঁজে পেতে এরা রীতিমতো গবেষণা করছেন। বিন লাদেন ও আল জাওয়াহিরির সাথেও খালেদার তুলনা দেয়া হয়েছে। তবে যত দূর জানি এখনো তাকে তৈমুর লং কিংবা চেঙ্গিস খান বলা হয়নি।
আওয়ামী নেতাদের গালিগালাজ কেন তুঙ্গে উঠেছে মন্ত্রীপাড়ায় ঘুরে এলেই তার কারণ বোঝা যাবে। শুনেছি মন্ত্রীদের অনেকেরই বউ-বাচ্চা বাংলাদেশে নেই। পুলিশ-র্যাবের যেসব বড় কর্তা আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো কথা বলছেন এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করছেন, তাদেরও কেউ কেউ পরিবার-পরিজনদের বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন বলে শুনেছি। আজকের মন্ত্রীদের কে কী করেছেন, কে কী বলেছেন তার রোজনামচা তৈরি হচ্ছে। আজ যারা গুম হচ্ছেন, খুন হচ্ছেন, তাদের পুত্র-কন্যা, নাতি-নাতনী প্রমুখ বংশধর ১০০ বছর পরও আজকের মন্ত্রীদের মনে রাখবে। মানবতাবিরোধী অপরাধে তাদের কিংবা তাদের বংশধরদের বিচার হবে। মন্ত্রীরা পরিবার-পরিজন বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন সে ভয়ে। তারাও বুঝে গেছেন গায়ের জোরে গদি আর বেশি দিন আঁকড়ে থাকা যাবে না। গদি যে দিন হাতছাড়া হবে, ক্রুদ্ধ জনতা সে দিনই প্রতিশোধ নিতে ছুটে যাবে, সামুদ্রিক সুনামির মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে এই সরকারের আর শাসক দলের নেতাদের ওপর। এ কারণেই তারা বুঝে গেছেন দেশের মানুষ তাদের দুশমন। দেশের মানুষকে তারা ‘খরচের খাতায় লিখে ফেলেছেন’। সে জন্যই মানুষ সম্বন্ধে গালিগালাজ আর অশ্রদ্ধার ভাষা ব্যবহারকে তারা আর ভয় করছেন না।
অভাব সরকারের অনুকূল প্রতিক্রিয়ার
অথচ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ আর মহাদেশে বাংলাদেশ ও এ দেশের মানুষের আরো একটা পরিচয় আছে। বাংলাদেশীদের ঘটা করে বিভিন্ন উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। আমি নিজে সেসব অনুষ্ঠানে সেসব দেশের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের উপস্থিতি ও অংশ নেয়ার দৃষ্টান্ত দেখেছি। আমেরিকা, ক্যানাডা এবং ইউরোপের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যান। খুব সম্ভবত দু-চারজন বাংলাদেশী অধ্যাপকের দেখা পাবেন। ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিকে কম্পিউটার প্রযুক্তির স্নায়ুকেন্দ্র বলা হয়। বহু বাংলাদেশী প্রকৌশলী সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছেন। অস্ট্রেলিয়ায় বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রকৌশলী ও প্রাযুক্তিক পদে কাজ করছেন বাংলাদেশীরা। আমি সঠিক জানি এ কারণে যে, তাদের অনেকে প্রায়ই ইন্টারনেটে কিংবা টেলিফোনে আমার সাথে যোগাযোগ রাখেন। কিছু দিন আগে লন্ডনে সমুদ্রসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অস্ট্রেলীয় প্রতিনিধিদলের নেতা হয়ে এসেছিলেন এক অস্ট্রেলীয় বাংলাদেশী। লন্ডনে আমাদের বাড়িতে এসে আমার সাথে দেখা করে গেছেন। সম্প্রতি আমি অসুস্থ হয়েছিলাম। আমার আরোগ্য কামনা করে কয়েক ডজন পাঠক ই-মেইল পাঠিয়েছেন কয়েকটি দেশ থেকে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশে বর্তমানে যা হচ্ছে তাতে তারা কী রকম মর্মাহত, তাদের ই-মেইলগুলোতে তার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত পড়েছি।
বাংলাদেশে আজ যা হচ্ছে, মন্ত্রীরা যে ভাষায় কথা বলেন সেসব খবর চুইয়ে চুইয়ে হলেও বিদেশে পৌঁছছে এখন। স্বভাবতই লজ্জায় সেসব দেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের মাথা হেঁট হচ্ছে। কোনো প্রয়োজন ছিল না তার; এবং এতকাল একটা সভ্য, ভদ্র এবং সংস্কৃতিশীল দেশ বলেই বাংলাদেশের পরিচয় ছিল। ধীমান, প্রাজ্ঞ এবং শুভবুদ্ধির মানুষের অভাব বাংলাদেশে এখনো ঘটেনি। বিগত কয়েক দিনে দেশের সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের উপায় নির্দেশ করে তাদের কারো কারো বক্তব্য আমি পড়েছি। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এবং আরো কেউ কেউ সঙ্কটের সূচনা থেকে জাতিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে এসেছেন। এমাজউদ্দিন আহমদ সে দিন বলেছেন, বাংলাদেশ যাতে মোগল সাম্রাজ্যের মতো অন্তর্বিরোধ ও হানাহানির কারণে ভেতর থেকে খসে না পড়ে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশের সব মানুষ তার হুঁশিয়ারি মনে রাখলে ভালো করবে।
রাজনীতিকেরা অনেক কথা বলেছেন সঙ্কট সম্বন্ধে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের কাজ করে চলেছে। গোড়া থেকেই শিক্ষাব্রতী, সমাজকর্মী ও সাংবাদিকসহ পেশাজীবীরা সমাধানের বিভিন্ন পথনির্দেশ দিয়েছেন। সুশীলসমাজ, সুজন, সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. বি চৌধুরী এবং শেখ মুজিবের আইন উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশের মূল সংবিধানের প্রণেতা ড. কামাল হোসেন প্রমুখ সবাই ভীত ও আতঙ্কিত দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ‘উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ’ নামে নতুন একটা গোষ্ঠী সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আকুল আবেদন নিয়ে এগিয়ে এসেছে। সবাই মোটামুটি যা বলছেন তার সারকথা এ রকম : সংলাপের মাধ্যম ছাড়া সমস্যার সমাধানের অর্থাৎ বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখার আর কোনো উপায় নেই এবং যেহেতু সরকারের কিছু হঠকারী কাজ ও গোঁয়ার্তুমি সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য দায়ী সেহেতু সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। সমাধান সন্ধানী মননশীল মহল আরো লক্ষ করেছেন যে, জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রায় সব বন্ধু ও সাহায্যদাতা দেশ ও সংস্থাই সংলাপের যেসব প্রস্তাব দিয়েছে খালেদা জিয়া ও বিএনপি সাগ্রহে তাতে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। অন্য দিকে সরকারের দিক থেকে হয় নীরব নিশ্চুপ থাকা হয়েছে, নয়তো তারা সেসব প্রস্তাব রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান
করেছে।
স্বেচ্ছায় একঘরে হবে বাংলাদেশ?
যেকানো দেশ, এমনকি বিশ্বসমাজে প্রায় একঘরে উত্তর কোরিয়াও আন্তর্জাতিক সমাজের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক এবং সব দেশই অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রক, কূটনৈতিক সার্ভিস এবং সেসব দেশে ব্যয়বহুল দূতাবাস স্থাপন করে থাকে। প্রত্যেকটি দেশ বিপুল অর্থ ব্যয় করে দূতাবাস ও কূটনীতিকদের বাবদ। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। অন্য দিকে বর্তমান সঙ্কটকে ঘিরে সরকারের কিছু কাজকর্ম থেকে মনে হতে পারে যে, বাকি বিশ্বের সাথে অ-সদ্ভাব সৃষ্টি করার জন্যই সরকার উঠেপড়ে লেগেছে।
প্রধানমন্ত্রী নিজে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের কোনো কোনো দূত এবং একাধিক মার্কিন কূটনীতিক ও কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সিনিয়র মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সহকারী মার্কিন মন্ত্রী নিশা দেসাই বিসওয়ালকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে ‘বাসার চাকর’ বলেছেন। তাতেও ভারতের জামাই সৈয়দ আশরাফের দাম্ভিকতার তৃপ্তি হয়নি। গত সপ্তাহের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের ‘তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী’ বলে হেনস্তা করেছেন। অথচ সারা বিশ্ব জানে যে, বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতেরা সমবেত এবং পৃথক পৃথকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের অবসান করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। কিছু কিছু সুফলও দেখা যাচ্ছে তার। খালেদা জিয়া আন্দোলন করার ও কর্মসূচি দেয়ার সময় সর্বদা দেশের মানুষের দুঃখকষ্টের কথা ভাবেন। সে জন্যই বহু উপদেষ্টার উপদেশ অমান্য করেও তিনি কিস্তিতে কিস্তিতে ‘সহনশীল’ কর্মসূচি দিয়ে থাকেন। বিশেষ লক্ষণীয় যে এখনো তিনি সিভিল ডিসওবিডিয়েন্সের (অসহযোগ ও আইন অমান্য করার) কর্মসূচি দেননি; এবং বিদেশী কূটনীতিকেরাসহ অনেকেই লক্ষ করেছেন খালেদা জিয়া তার ১৩ মার্চের সংবাদ সম্মেলনে এমন
কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন যে সরকারের দিকে শুভবুদ্ধির উদ্রেক হলে তিনি আপসমুখী হতে রাজি আছেন। এ সম্মেলনে তিনি সরকারকে টেনে ফেলার কথা বলেননি, ভাসুরের নামের মতো অগ্রহণযোগ্য ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের কথাও উচ্চারণ করেননি। তিনি বলেছেন ‘আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতির’ কথা, তিনি দাবি করেছেন সবার গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণে অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে সংলাপের আয়োজন করার। প্রায় সোয়া দুই মাসের রক্তক্ষরা আন্দোলনের পরও এর চেয়ে যুক্তিবহ অবস্থান আর কী হতে পারে?
অন্য দিকে কোনো কোনো কারণে মনে হতে পারে যে সরকারপক্ষ স্থির মস্তিষ্কে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। তথাকথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে জামায়াতের এবং দুই-একজন বিএনপি নেতার বিচারের সময় শাহবাগে একটা উচ্ছৃঙ্খল জনতা রক্তপিপাসু নরমাংস-ভোগী পিশাচের মতো ‘ফাঁসি ফাঁসি’ বলে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিল। জানা গেছে, তাদের বিরিয়ানি ও ফলের রস সরবরাহ করা হয়েছে সরকারের ভেতর থেকেই। বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর আচরণ থেকে মনে হতে পারে যে মন্ত্রিসভাও এখন শাহবাগী দঙ্গলে পরিণত হয়েছে। খালেদা জিয়ার গ্রেফতার দাবি করে এত দিন বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর মুখে ফেনা উঠছিল। এখন কয়েকজন খালেদা জিয়ার ফাঁসির দাবিতে অবিরাম স্লোগান দিতে শুরু করেছেন। এই মন্ত্রীরা অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন। কথায় বলে ‘সাত চক্রে ভগবান ভূত।’ এতগুলো মন্ত্রীর হুজুগ আর চাপের মুখে শেখ হাসিনা কি সুস্থ ও স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারছেন? খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার কিংবা তাকে ফাঁসি দেয়া হলে দেশের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত যে আগুন জ্বলবে ভেবে দেখার স্বাধীনতা শেখ হাসিনার আছে কি? আমার সন্দেহ
হয়।
(লন্ডন, ১৭.০৩.১৫)
serajurrahman34@gmail.com
উচ্চশিক্ষার জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে যারা আসতেন তাদের মধ্যে অনেক প্রতিভাধর ছিলেন। দুই কবি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান আর আবু হেনা মোস্তাফা কামালকে দিয়ে বেশ কিছু গান আমি লিখিয়েছি। সুরও দিয়েছেন তারা এবং কোনো কোনো প্রবাসীকে শিখিয়ে-পড়িয়ে সেসব গান গাওয়ানো হয়েছে, প্রায়ই স্টুডিওর বাইরে কোনো স্কুল হল কিংবা ইয়ুথ সেন্টারে। প্রবাসী বাংলাভাষীরা দূর-দূরান্ত থেকে শুনতে এসেছেন। আবু হেনার লেখা একটা গানের দুটো পঙ্ক্তি ছিল, ‘কবে আমি চোখ মেলেছি স্বপ্নভরা গ্রামে, ছড়িয়ে আবির মেঘে মেঘে সন্ধ্যা যেথা নামে।’ আজো কোনো সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে আবির-ছটা দেখলেই গানটা আমার কানে বাজতে থাকে।
বলছিলাম প্রবাসে বাংলা নববর্ষ, শহীদ দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি পালনের কথা। দেশে এ জাতীয় অনুষ্ঠানে মাঝে মধ্যে হাতাহাতি হয়। দেশের সে ঐতিহ্য বিদেশে বাকি থাকবে কেন? একেক সময় মনে হয় ভালোবাসার আতিশয্য থেকে হয়তো আমরা দেশের বহু ক্ষতি করছি, দেশের হানাহানি আমরা বিদেশেও নিয়ে এসেছি। লন্ডনে আমাদের পাড়ায় মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের কোনো দেশের এক তরুণ দম্পতি এসেছে। ভারি মিষ্টি দু’টি ছোট্ট মেয়ে ওদের। কোলে এলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বড় মেয়ের তিন বছর বয়সে ছোটটির জন্ম হয়। মায়ের ভালোবাসার জন্য কিছুটা ঈর্ষা হবে- সেটা স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের সমস্যা দাঁড়াল। তিন বছরের মেয়েটির ধারণা হলো নবজাতকটি তার সন্তান। সব সময় তাকে সে দখল করে রাখছিল। এমনকি দুধ খাওয়াতে মায়ের কোলে দিতেও না-রাজ ছিল সে। ভাগ্য ভালো, শিগগিরই সমস্যাটার সুসমাধান হয়ে গেছে। এখন ওরা দু’টিতে মিলে যখন খেলা করে দেখে আনন্দ হয়।
এমন দৃষ্টান্ত হয়তো দেশেও আপনারা দেখে থাকবেন। অপরিণত স্নেহের বাড়াবাড়ি হয়তো এ সমস্যার কিছু কারণ। বাংলাদেশে এখন কিছু জটিল সমস্যা-সঙ্কট চলছে। অনিয়মিতভাবে ক্ষমতা দখল করে রাখা, র্যাব ও পুলিশকে রাজনৈতিক পেশিশক্তি হিসেবে ব্যবহার করা, অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে আইন-আদালতকে দলীয় হাতিয়ারে পরিণত করা ইত্যাদি হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কটের কিছু আলামত। বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য প্রহসনের নির্বাচন সূত্রে বহাল এবং সরকার বলছে খালেদা জিয়া এবং বিএনপি গদি লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে বলেই সমস্যার জন্ম। কিন্তু পৃথিবীর সব প্রত্যন্ত পর্যন্ত এখন জানে যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। ক্ষমতা তারা পেয়েছিল এবং সে ক্ষমতা যাতে হাতছাড়া না হয় তার জন্য সব কিছু তারা করেছে আর করছে।
বর্তমান সঙ্কট যেভাবে শুরুজামায়াতে ইসলামীর গায়ে তখন গন্ধ ছিল না। তাদের দলে নিয়ে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালুর জন্য লাগাতার হরতাল আর অবরোধ চালু করেছিল। দেশের সব মানুষ ভুলে যায়নি সে ইতিহাস। রেল লাইন উপড়ে ফেলা হয়েছিল, বন্দর আর সড়ক অবরোধ করে অর্থনীতিকে স্থবির করে দেয়া হয়েছিল, বহু লোক মারা গিয়েছিল সে আন্দোলনে। আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির তফাৎ এখানে যে বিএনপির রাজনীতি কখনোই আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মতো নিষ্ঠুর হয় না, তাদের আন্দোলন মানবিকতার সীমা ছাড়িয়ে যায় না। তাদের যখন বলা হলো যে সংবিধান ও নির্বাচন পদ্ধতি দেশের মানুষের জন্য, তারা সংলাপে রাজি হলো, চটজলদি সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু করা হলো। ২০০৮ সালের মাস্টারপ্ল্যান নির্বাচনে জয়ের পর আওয়ামী লীগের লক্ষ্যে পরিবর্তন হয়। ভবিষ্যতে নির্বাচন করে ক্ষমতা লাভের চেষ্টার পরিবর্তে তারা বাকশালী পন্থায় স্থায়ীভাবে গদি দখল করে রাখার জন্য তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি উল্টে ফেলার পরিকল্পনা নেয়। প্রশাসন, পুলিশ ও র্যাব আর বিচারিক ব্যবস্থার দলীয়করণ করে তারা প্রতিবাদ ও প্রতিকার অসম্ভব করে তোলে। তারপর একদলীয় সংসদে সংবিধানের খোল-নলচে পাল্টে দিয়ে ন্যায্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব করে তোলে। একই সাথে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের সময় থেকে আজো পর্যন্ত বিএনপিসহ কোনো বিরোধী দলকে অবাধে সভা-সমাবেশ করে নিজেদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়া হয়নি। বরঞ্চ গুম, হত্যা, নির্যাতন, ভুয়া মামলায় গ্রেফতার, ভীতি প্রদর্শন এবং আইনি ও পুলিশি শক্তি ব্যবহার করে বিরোধীপক্ষের রাজনীতি করা অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। পাশাপাশি মিডিয়ারও কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে।
বলতে গেলে গোটা ২০১৩ সালজুড়েই জাতিসঙ্ঘ থেকে শুরু করে সব বন্ধু রাষ্ট্র, সাহায্যদাতা দেশ ও সংস্থা সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সবার গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকার ও বিরোধী জোটকে চাপ দিতে থাকে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল পাশের দেশ ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকার। স্বাভাবিক দ্বিপক্ষীয় ও কূটনৈতিক পন্থায় নয়, বরং গোপন ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তির মাধ্যমে সে সরকার বাংলাদেশ নামের দেশটাকে আরো একটি সিকিমে পরিণত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বভাবতই আওয়ামী লীগ সরকারকে গদিতে বহাল রাখার প্রয়োজন ছিল তাদের।
বিনিময়ে বিনা ভোটে নির্বাচন এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে কংগ্রেসশাসিত ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে গুরুতর হস্তক্ষেপ করেছে। শেখ হাসিনাকে সে আশ্বাস দিতে ভারতের সম্প্রতি পদচ্যূত পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায়ও এসেছিলেন। ভারতের অন্যায় পরামর্শ ও উসকানিতে বলীয়ান হয়ে সরকার ভোটারবিহীন নির্বাচনের পথ ধরে। দেশের ও বিদেশের মানুষকে প্রতারিত করার লক্ষ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর গণভবনে ঘোষণা করেন, ‘৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন হবে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। সমঝোতা হলে সংসদ ভেঙে আবার নির্বাচন দেয়া হবে।’ তখনকার চেয়ে কত ভিন্ন আওয়ামী লীগ প্রধানের বর্তমান অবস্থান! সরকার ও আওয়ামী লীগ এখন বলছে, ২০১৯ সালের আগে আর কোনো নির্বাচন হবে না। সে বক্তব্যের পক্ষে নিত্যনতুন ফাঁকা যুক্তি ও অজুহাত সৃষ্টি করে চলেছে তারা।
জাতির প্রতি অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা
আওয়ামী লীগ নেতারা এখন শেখ হাসিনার ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বরের প্রতিশ্রুতি গিলে খাবার চেষ্টা করছেন। মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতারা উল্টো বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ তুলছেন। লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ গত ১৪ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন যে, সমঝোতা-সংলাপ কিছু হবে না। তিনি আরো বলেছেন, ‘আগামীতেও একইভাবে নির্বাচন হবে।’ একইভাবে বলতে তিনি অবশ্যই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির তামাশার কথা বলেছেন। বলছেন কি না জানি না। পাঠকদের অবগতির জন্য স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন, সে নির্বাচনের তারিখের এক সপ্তাহ আগেই ঘোষণা করা হয় আওয়ামী লীগ বিনা নির্বাচনে ১৫৪টি আসন পেয়ে সংসদে গরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। আর ৫ জানুয়ারি কী হয়েছে? সে দিন ২০ দলের জোট ও সরকারবিরোধী অন্য গোষ্ঠীগুলো নির্বাচন বর্জন করেছে, বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোটার যাননি, শতাধিক ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং বিরোধী দলগুলোর কর্মী ও সমর্থকদের ওপর আওয়ামী লীগ ক্যাডার ও পুলিশের আক্রমণে ২১ জন লোক নিহত হন। সৈয়দ আশরাফেরা এ ধরনের নির্বাচন করেই ভবিষ্যতেও গদি দখল করে রাখতে চান। দেশ ও মানুষের প্রতি কতখানি ঘৃণা ও অবজ্ঞা থাকলে এ ধরনের নির্লজ্জ কথা বলা যায় সহজেই ধারণা করে নেয়া যায়।
মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপি, বিশেষ করে জনসাধারণের ভোটে তিনবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে যেসব ভাষায় গালিগালাজ করছেন রাজপথের গুণ্ডাপাণ্ডাদের মুখেও সচরাচর তেমন ভাষা আশা করা যায় না। মনে হতে পারে যে, প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহারের লক্ষ্যে নিত্যনতুন গালিগালাজ খুঁজে পেতে এরা রীতিমতো গবেষণা করছেন। বিন লাদেন ও আল জাওয়াহিরির সাথেও খালেদার তুলনা দেয়া হয়েছে। তবে যত দূর জানি এখনো তাকে তৈমুর লং কিংবা চেঙ্গিস খান বলা হয়নি।
আওয়ামী নেতাদের গালিগালাজ কেন তুঙ্গে উঠেছে মন্ত্রীপাড়ায় ঘুরে এলেই তার কারণ বোঝা যাবে। শুনেছি মন্ত্রীদের অনেকেরই বউ-বাচ্চা বাংলাদেশে নেই। পুলিশ-র্যাবের যেসব বড় কর্তা আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো কথা বলছেন এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করছেন, তাদেরও কেউ কেউ পরিবার-পরিজনদের বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন বলে শুনেছি। আজকের মন্ত্রীদের কে কী করেছেন, কে কী বলেছেন তার রোজনামচা তৈরি হচ্ছে। আজ যারা গুম হচ্ছেন, খুন হচ্ছেন, তাদের পুত্র-কন্যা, নাতি-নাতনী প্রমুখ বংশধর ১০০ বছর পরও আজকের মন্ত্রীদের মনে রাখবে। মানবতাবিরোধী অপরাধে তাদের কিংবা তাদের বংশধরদের বিচার হবে। মন্ত্রীরা পরিবার-পরিজন বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন সে ভয়ে। তারাও বুঝে গেছেন গায়ের জোরে গদি আর বেশি দিন আঁকড়ে থাকা যাবে না। গদি যে দিন হাতছাড়া হবে, ক্রুদ্ধ জনতা সে দিনই প্রতিশোধ নিতে ছুটে যাবে, সামুদ্রিক সুনামির মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে এই সরকারের আর শাসক দলের নেতাদের ওপর। এ কারণেই তারা বুঝে গেছেন দেশের মানুষ তাদের দুশমন। দেশের মানুষকে তারা ‘খরচের খাতায় লিখে ফেলেছেন’। সে জন্যই মানুষ সম্বন্ধে গালিগালাজ আর অশ্রদ্ধার ভাষা ব্যবহারকে তারা আর ভয় করছেন না।
অভাব সরকারের অনুকূল প্রতিক্রিয়ার
অথচ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ আর মহাদেশে বাংলাদেশ ও এ দেশের মানুষের আরো একটা পরিচয় আছে। বাংলাদেশীদের ঘটা করে বিভিন্ন উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। আমি নিজে সেসব অনুষ্ঠানে সেসব দেশের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের উপস্থিতি ও অংশ নেয়ার দৃষ্টান্ত দেখেছি। আমেরিকা, ক্যানাডা এবং ইউরোপের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যান। খুব সম্ভবত দু-চারজন বাংলাদেশী অধ্যাপকের দেখা পাবেন। ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিকে কম্পিউটার প্রযুক্তির স্নায়ুকেন্দ্র বলা হয়। বহু বাংলাদেশী প্রকৌশলী সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছেন। অস্ট্রেলিয়ায় বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রকৌশলী ও প্রাযুক্তিক পদে কাজ করছেন বাংলাদেশীরা। আমি সঠিক জানি এ কারণে যে, তাদের অনেকে প্রায়ই ইন্টারনেটে কিংবা টেলিফোনে আমার সাথে যোগাযোগ রাখেন। কিছু দিন আগে লন্ডনে সমুদ্রসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অস্ট্রেলীয় প্রতিনিধিদলের নেতা হয়ে এসেছিলেন এক অস্ট্রেলীয় বাংলাদেশী। লন্ডনে আমাদের বাড়িতে এসে আমার সাথে দেখা করে গেছেন। সম্প্রতি আমি অসুস্থ হয়েছিলাম। আমার আরোগ্য কামনা করে কয়েক ডজন পাঠক ই-মেইল পাঠিয়েছেন কয়েকটি দেশ থেকে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশে বর্তমানে যা হচ্ছে তাতে তারা কী রকম মর্মাহত, তাদের ই-মেইলগুলোতে তার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত পড়েছি।
বাংলাদেশে আজ যা হচ্ছে, মন্ত্রীরা যে ভাষায় কথা বলেন সেসব খবর চুইয়ে চুইয়ে হলেও বিদেশে পৌঁছছে এখন। স্বভাবতই লজ্জায় সেসব দেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের মাথা হেঁট হচ্ছে। কোনো প্রয়োজন ছিল না তার; এবং এতকাল একটা সভ্য, ভদ্র এবং সংস্কৃতিশীল দেশ বলেই বাংলাদেশের পরিচয় ছিল। ধীমান, প্রাজ্ঞ এবং শুভবুদ্ধির মানুষের অভাব বাংলাদেশে এখনো ঘটেনি। বিগত কয়েক দিনে দেশের সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের উপায় নির্দেশ করে তাদের কারো কারো বক্তব্য আমি পড়েছি। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এবং আরো কেউ কেউ সঙ্কটের সূচনা থেকে জাতিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে এসেছেন। এমাজউদ্দিন আহমদ সে দিন বলেছেন, বাংলাদেশ যাতে মোগল সাম্রাজ্যের মতো অন্তর্বিরোধ ও হানাহানির কারণে ভেতর থেকে খসে না পড়ে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশের সব মানুষ তার হুঁশিয়ারি মনে রাখলে ভালো করবে।
রাজনীতিকেরা অনেক কথা বলেছেন সঙ্কট সম্বন্ধে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের কাজ করে চলেছে। গোড়া থেকেই শিক্ষাব্রতী, সমাজকর্মী ও সাংবাদিকসহ পেশাজীবীরা সমাধানের বিভিন্ন পথনির্দেশ দিয়েছেন। সুশীলসমাজ, সুজন, সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. বি চৌধুরী এবং শেখ মুজিবের আইন উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশের মূল সংবিধানের প্রণেতা ড. কামাল হোসেন প্রমুখ সবাই ভীত ও আতঙ্কিত দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ‘উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ’ নামে নতুন একটা গোষ্ঠী সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আকুল আবেদন নিয়ে এগিয়ে এসেছে। সবাই মোটামুটি যা বলছেন তার সারকথা এ রকম : সংলাপের মাধ্যম ছাড়া সমস্যার সমাধানের অর্থাৎ বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখার আর কোনো উপায় নেই এবং যেহেতু সরকারের কিছু হঠকারী কাজ ও গোঁয়ার্তুমি সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য দায়ী সেহেতু সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। সমাধান সন্ধানী মননশীল মহল আরো লক্ষ করেছেন যে, জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রায় সব বন্ধু ও সাহায্যদাতা দেশ ও সংস্থাই সংলাপের যেসব প্রস্তাব দিয়েছে খালেদা জিয়া ও বিএনপি সাগ্রহে তাতে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। অন্য দিকে সরকারের দিক থেকে হয় নীরব নিশ্চুপ থাকা হয়েছে, নয়তো তারা সেসব প্রস্তাব রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান
করেছে।
স্বেচ্ছায় একঘরে হবে বাংলাদেশ?
যেকানো দেশ, এমনকি বিশ্বসমাজে প্রায় একঘরে উত্তর কোরিয়াও আন্তর্জাতিক সমাজের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক এবং সব দেশই অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রক, কূটনৈতিক সার্ভিস এবং সেসব দেশে ব্যয়বহুল দূতাবাস স্থাপন করে থাকে। প্রত্যেকটি দেশ বিপুল অর্থ ব্যয় করে দূতাবাস ও কূটনীতিকদের বাবদ। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। অন্য দিকে বর্তমান সঙ্কটকে ঘিরে সরকারের কিছু কাজকর্ম থেকে মনে হতে পারে যে, বাকি বিশ্বের সাথে অ-সদ্ভাব সৃষ্টি করার জন্যই সরকার উঠেপড়ে লেগেছে।
প্রধানমন্ত্রী নিজে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের কোনো কোনো দূত এবং একাধিক মার্কিন কূটনীতিক ও কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সিনিয়র মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সহকারী মার্কিন মন্ত্রী নিশা দেসাই বিসওয়ালকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে ‘বাসার চাকর’ বলেছেন। তাতেও ভারতের জামাই সৈয়দ আশরাফের দাম্ভিকতার তৃপ্তি হয়নি। গত সপ্তাহের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের ‘তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী’ বলে হেনস্তা করেছেন। অথচ সারা বিশ্ব জানে যে, বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতেরা সমবেত এবং পৃথক পৃথকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের অবসান করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। কিছু কিছু সুফলও দেখা যাচ্ছে তার। খালেদা জিয়া আন্দোলন করার ও কর্মসূচি দেয়ার সময় সর্বদা দেশের মানুষের দুঃখকষ্টের কথা ভাবেন। সে জন্যই বহু উপদেষ্টার উপদেশ অমান্য করেও তিনি কিস্তিতে কিস্তিতে ‘সহনশীল’ কর্মসূচি দিয়ে থাকেন। বিশেষ লক্ষণীয় যে এখনো তিনি সিভিল ডিসওবিডিয়েন্সের (অসহযোগ ও আইন অমান্য করার) কর্মসূচি দেননি; এবং বিদেশী কূটনীতিকেরাসহ অনেকেই লক্ষ করেছেন খালেদা জিয়া তার ১৩ মার্চের সংবাদ সম্মেলনে এমন
কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন যে সরকারের দিকে শুভবুদ্ধির উদ্রেক হলে তিনি আপসমুখী হতে রাজি আছেন। এ সম্মেলনে তিনি সরকারকে টেনে ফেলার কথা বলেননি, ভাসুরের নামের মতো অগ্রহণযোগ্য ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের কথাও উচ্চারণ করেননি। তিনি বলেছেন ‘আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতির’ কথা, তিনি দাবি করেছেন সবার গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণে অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে সংলাপের আয়োজন করার। প্রায় সোয়া দুই মাসের রক্তক্ষরা আন্দোলনের পরও এর চেয়ে যুক্তিবহ অবস্থান আর কী হতে পারে?
অন্য দিকে কোনো কোনো কারণে মনে হতে পারে যে সরকারপক্ষ স্থির মস্তিষ্কে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। তথাকথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে জামায়াতের এবং দুই-একজন বিএনপি নেতার বিচারের সময় শাহবাগে একটা উচ্ছৃঙ্খল জনতা রক্তপিপাসু নরমাংস-ভোগী পিশাচের মতো ‘ফাঁসি ফাঁসি’ বলে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিল। জানা গেছে, তাদের বিরিয়ানি ও ফলের রস সরবরাহ করা হয়েছে সরকারের ভেতর থেকেই। বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর আচরণ থেকে মনে হতে পারে যে মন্ত্রিসভাও এখন শাহবাগী দঙ্গলে পরিণত হয়েছে। খালেদা জিয়ার গ্রেফতার দাবি করে এত দিন বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর মুখে ফেনা উঠছিল। এখন কয়েকজন খালেদা জিয়ার ফাঁসির দাবিতে অবিরাম স্লোগান দিতে শুরু করেছেন। এই মন্ত্রীরা অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন। কথায় বলে ‘সাত চক্রে ভগবান ভূত।’ এতগুলো মন্ত্রীর হুজুগ আর চাপের মুখে শেখ হাসিনা কি সুস্থ ও স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারছেন? খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার কিংবা তাকে ফাঁসি দেয়া হলে দেশের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত যে আগুন জ্বলবে ভেবে দেখার স্বাধীনতা শেখ হাসিনার আছে কি? আমার সন্দেহ
হয়।
(লন্ডন, ১৭.০৩.১৫)
serajurrahman34@gmail.com
No comments