জনগণ ও হুমায়ূনের বাদশাহ নামদার by মাসুদ মজুমদার
ক.
নন্দিত কথাসাহিত্যিক মরহুম হুমায়ূন আহমেদের জীবনের শেষ উপন্যাসটি ইতিহাস
আশ্রয়ী। অসাধারণ চরিত্র চিত্রনশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ স্বভাবে হেয়ালিনির্ভর,
বিশ্বাসে নিয়তিবাদী। সাধারণত লেখকসত্তা যার যার লেখনীতে ফুটে ওঠে। হুমায়ূন
ব্যতিক্রম নন। লেখকের আরো উপন্যাস রয়েছে, যা ইতিহাসের বৃন্ত থেকে বিচ্ছিন্ন
নয়। অন্তত জননী ও জোৎস্নার গল্প ও দেয়ালকে ইতিহাস আশ্রয়ী বলা সঙ্গত। যদিও
দেয়াল উপন্যাসটির চরিত্র হরণ করা হয়েছে। এই নিন্দনীয় ও অপকর্মটি করা হয়েছে
এই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়; যারা এই অপকর্মে জড়িত ছিলেন তারা মুখোশ পরা
কালোমুখের মানুষ। হুমায়ূনের নিজস্ব কথ্য ঢঙে হাত দেয়ার মতো জ্ঞান-গরিমা
তাদের কারো ছিল না। সাহিত্যের স্বকীয়তা ও চরিত্র হরণ অপরাধ। ইতিহাস তাদের
ক্ষমা করবে না।
বাদশাহ নামদার মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের জীবনালেখ্য। এই ঐতিহাসিক চরিত্রের মাঝে হুমায়ূন নিজের মিল খোঁজার চেষ্টা করছেন। তাই বলে তিনি ইতিহাস লিখেননি, লিখেছেন কথাসাহিত্য। তাতে ইতিহাসনির্ভরতা আছে কিন্তু কর্মটি ইতিহাস গবেষণা নয়, সাহিত্যকর্ম। এর সাথে ইতিহাসের চরিত্র খুঁজে লাভ নেই। উপন্যাসের নায়ক খোঁজাই ভালো। প্রসঙ্গটি টানার কারণ আজকের দিনে আমাদের চেনা-জানা রাজনীতিবিদদের শ্রেণী চরিত্র বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ দুই পক্ষের রাজনীতিবিদেরা জনগণের সামনে খোলামেলা উপস্থাপিত হচ্ছেন না। কিন্তু তারাই দেশ-জাতি ও জনগণের নিয়তি ঠিক করে দিচ্ছেন। বিশেষত শেখ হাসিনা নীতিনির্ধারক হিসেবে জাতির দণ্ডমুণ্ডের মালিক হয়ে উঠেছেন। জবাবদিহিতা ও তার সরকারের দায়বদ্ধতা ইতিহাসের মানদণ্ডে যদি দেখা যেত, তাহলে তাকে কার সাথে তুলনা করা যায় তা বোঝা যেত। একই সাথে এই সময়ের খালেদা জিয়া ও এরশাদের চরিত্র চিত্রণের জন্যও হুমায়ূন আহমেদের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করছি। হুমায়ূন তার বাদশাহ নামদার উপন্যাসটি শেষ করেছেন এভাবেÑ ‘রাজা যায় রাজা আসে। প্রজাও যায়, নতুন প্রজা আসে। কিছুই টিকে থাকে না। ুধার্ত সময় সব কিছু গিলে ফেলে।’
হুমায়ূন আহমেদ বাবর পুত্র ও আকবরের পিতা সম্রাট হুমায়ুনের যে চরিত্রটি উপন্যাসে সৃষ্টি করেছেনÑ সেটাই হবে এ জনপদের মানুষের কাছে পরিচিত মুঘল সম্রাট হুমায়ুন। যেমনটি ইতিহাসের নবাব সিরাজউদ্দৌলার চেয়ে খান আতার অসাধারণ সৃষ্টি সিনেমার সিরাজউদ্দৌলাহ বড় হয়ে উঠেছেন। আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা, জয়-পুতুলের মা, ডক্টর ওয়াজেদের স্ত্রী, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে যদি হুমায়ূন আহামেদ উপন্যাস চরিত্রে তুলে আনতেন, তাহলে সেই চরিত্র কেমন হতো। তিনি কি একগুঁয়েমিনির্ভর দৃঢ়চেতা একজন নারী চরিত্র হয়ে উঠে আসতেন। তার শাসনকাল কিভাবে দেখা হতো! তার তাহাজ্জুদ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত প্রাধান্য পেত, না ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম থেকে শুরু করে সালাহউদ্দিন গুম হওয়া পর্যন্ত কাহিনীগুলো প্রাধান্য পেত। বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় নেয়ার জন্য তিনি কি নিষ্ঠুর হিসেবে উপস্থাপিত হতেন না একজন মমতাময়ী মাও সংবেদনশীল শাসক হিসেবে উঠে আসতেন। গণতন্ত্রের নিজস্ব ব্যাখ্যাদাতার জন্য হুমায়ূন কি শেখ হাসিনাকে আব্রাহাম লিঙ্কনের পাশে স্থান দিতেন। হুমায়ূন পরপারে। জবাব দেয়ার দায় যেহেতু কারো নেই, তখন খালেদা জিয়া কিংবা অন্য কারো প্রসঙ্গ তুলেই বা কী লাভ।
হুমায়ূন আহমেদ ব্যতিক্রমী চরিত্র সৃষ্টির জাদুকর। বর্ণাঢ্য মানুষকে তিনি নাই করে উপস্থাপন করতে জানতেন। আবার সাধারণকে অসাধারণ করার নৈপুণ্যও তার আয়ত্তে ছিল। আমাদের সমাজে এ ধরনের মানুষ এখন নেই বললেও চলে। হেয়ালি ঢঙে অকপট সত্যটি বলে ফেলা কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটি সহজেই করতে পারতেন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন শেষজীবনে সাহিত্যের খাতিরে পারস্য সাহিত্য নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। ফার্সি শের বা কবিতা তাকে বেশ আকৃষ্ট করেছিল। তাদের প্রবাদ-প্রবচনগুলোও বেশ আয়ত্ত করেছিলেন। একটা ফার্সি নীতিকথা তিনি প্রায় তুলে ধরতেন এভাবেÑ ‘আমরা বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করি অভিজ্ঞতার জন্য। যুবকদের সমীহ করি তারুণ্যের জন্য। আর শিশুদের স্নেহ-মমতায় আগলে রাখি শিশুসুলভ আচরণের জন্য’। আজকের সমাজে বয়োজ্যেষ্ঠরা জিজ্ঞাসিত হন কার খালু, কেয়া হনুবলে। এই কাতারে দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ পড়ে যাচ্ছেন। রাজনীতিবিদের মধ্যে ভিন্নমতাবলম্বীরা বাদ পড়ছেন না।
যুবকের তারুণ্য ব্যবহার হচ্ছে বাজিকর হিসেবে। তাদের জন্য টেন্ডারবাজির রাস্তাটা খোলা। চাঁদাবাজি তাদের পেশা। মাস্তানি তাদের স্বভাব। এরাই সোনার ছেলে। তরুণদের মধ্যে ভিন্নমতের হলে নিয়তি লাশ হয়ে যাওয়া। পায়ে গুলি খাওয়া। জেলে মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হওয়া। নয়তো গুম হয়ে যাওয়া। আর শিশুরা লাশ হয়ে যাচ্ছে নষ্ট রাজনীতির জন্য। সিলেটের স্কুলছাত্র সাঈদের ব্যাপারে আমাদের জবাব কী! ত্বকি কেন নেই। বাসে ট্রাভেল ব্যাগে শিশুর লাশ কেন?
কোমল-কঠিন স্বভাবের হুমায়ুন বাদশাহ হুমায়ুনকেও তাই ভেবেছেন। তিনি যদি আমাদের বর্তমান সরকারপ্রধানের বৈশিষ্ট্য ও স্বভাবকে কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতেন, তাহলে মৃত্যুর দীর্ঘ মিছিলের বিষয়টি কিভাবে তুলে আনতেন। নিমতলীতে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কান্না থেকে শুরু করে বার্ন ইউনিটের জন্য কান্না কিভাবে হুমায়ুন চিত্রিত করতেন।
হরতাল-অবরোধের মাত্র ৭১ দিনের যে চিত্রটি ‘যুগান্তর’ ছেপেছে, তাতে বিচারবহির্ভূত নানা উপায়ে ৬৩ জন লাশের মিছিলে যোগ হয়েছে। ৬৬ জন নিহত হয়েছে নাশকতায়। প্রতিপক্ষের হামলায় সরকারপক্ষের নিহত ২৫ জন। গুম ৩৬ জন, নিখোঁজ ১৮ জন ও পঙ্গু ৫০ জন। মামলা হয়েছে এক হাজার ৪০০, গ্রেফতার ১৬ হাজার। গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রাক্কালে এবং বিগত ছয়-সাত মাসে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেয়া ও হামলা-মামলার চিত্র এখানে নেই। তা ছাড়া বিরোধী দলের হিসাব আরো অনেক বেশি। সরকারপ্রধান সব মৃত্যুকে কান্নার আওতায় আনেননি। হুমায়ুন এর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কি হেয়ালি দেখাতেন, না নিয়তির ওপর ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর হুকুম বলে শেষ করতেন।
বাদশাহ নামদার হুমায়ুন আহমেদ শুধু তার গরজে লেখেননি। একজন শাসকের উত্থান-পতন, চড়াই-উতরাই, সুদিন-দুর্দিন তুলে এনে আমাদের জন্য একটি উপমা উপস্থাপন করেছেন। নাটকীয় সংলাপধর্মী উপন্যাসটি নাট্যরূপ দেয়া সম্ভব। কোমল-কঠিন, নিষ্ঠুর ও নিপীড়ক সব শাসকের জন্য এ বইটির মধ্যে একটি শিক্ষণীয় বার্তা রয়েছে। সাহিত্যে এর মূল্যায়ন না-ই বা হলো। শাসক চেনার একটা পথ তো হুমায়ুন জনগণকে দেখালেন।
খ. ক্ষমতা, অর্থের প্রাচুর্য এবং গর্ভধারিণী মায়ের স্ফীত শরীর লুকানো যায় না। যার ক্ষমতা আছে তিনি আচার-আচরণ, চাল-চলন এবং অঙ্গভঙ্গি দিয়েই সেটা জানান দেবেন। বিত্তশালী কিছু সংযত মানুষের ঠাঁটবাট কম থাকে। অন্যরা মনের অজান্তেই কেয়া হনু বা কেউকেটা হয়ে ওঠেন। সাথে থাকা লাইসেন্সধারী অস্ত্রের গরম তাপ ছড়ায়। সেটা আশপাশের মানুষ টের পাবেই। এ জন্য নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, কক্সবাজার কিংবা মিরপুর যেতে হয় না। এই তাপ ও ক্ষমতার দাপট অনুগতরা পাবে বেশি। অর্থের প্রাচুর্য লুকিয়ে রাখা যায় না। কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ ঘটবেই। পোশাক-আশাকে তো বটেই, জীবনযাত্রায় এবং জীবনমানে তার প্রতিফলন কেউ লুকাতে পারেন না। স্ফীত মেদ ভুঁড়ির মতোই গর্ভধারিণী মায়ের শারীরিক গঠন পাল্টে যায়, সেটাও লুকানো যায় না, এটা খোদায়ী নিয়ম। প্রকৃতিসিদ্ধ ব্যাপার।
গর্ভধারণ নিয়ে একটি মজার গল্প চালু আছে। প্রকৃতিপূজারী একদল মহিলা তাদের ঈশ্বরের কাছে একবার নিয়ম পরিবর্তনের জন্য সাহায্য বা বর চাইলেনÑ অন্তর ও বহির্মুখী কাজ সামাল দিয়ে তাদের আবার সন্তান ধারণ করার ঝামেলা পোহাতে হয়। প্রসব বেদনার তীব্র ব্যথাও তাদের সহ্য করতে হয়। তাদের সমাজের পুরুষেরা কোনো দায় নেয় না। ঈশ্বর যেন অন্তত একটি দায় পুরুষের ওপর দিয়ে দেন। প্রসব বেদনার তীব্রতাটা অন্তত তাদের স্বামীদের ওপর বর্তান। ঈশ্বর তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বর বা চাওয়াটা দিয়ে দিলেন। ক’দিন পর এক দম্পতির ক্ষেত্রে দেখা গেল সন্তানসম্ভবা নারীর প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, কিন্তু স্বামীর ব্যথা উঠছে না। কিছুক্ষণ পর জানা গেল, বাগানমালি অসহ্য ব্যথায় বার বার কঁকিয়ে উঠছে। এক সময় সন্তান প্রসব হলো, বাগানমালির পেটের ব্যথাও তাৎক্ষণিক বন্ধ হয়ে গেল। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে প্রকৃতিপূজারী নারীরা আবার তাদের ঈশ্বরের কাছে আগের নিয়ম ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানাল। কিছুটা উদ্ভট কিন্তু শিক্ষণীয় গল্পটি মেম-ড্রাইভার পর্যন্ত রসিয়ে রসিয়ে বলার নজির রয়েছে। এতে শিক্ষাটা হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত ধারণা ও প্রকৃতির নিয়ম পাল্টানোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্পষ্ট। আজ প্রকৃতির নিয়ম পাল্টে দেয়ার অন্ত নেই। আমাদের চিরায়ত মূল্যবোধগুলোও উপড়ে ফেলা হচ্ছে। তাতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জীবনকে দোজখ বানিয়ে দিচ্ছে। আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি না।
আমরা এই গল্প এখানে বিনা কারণে তুলে আনিনি। আমাদের রাজনীতিতে জনগণের কষ্ট ও ব্যথা লুকানোর শেষ নেই। একের ব্যথা ও কষ্ট অন্যের ওপর চাপানোরও সীমা নেই। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম পাল্টে দেয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। ক্ষমতার তীব্র দহন এবং অসংযত ভাষায় নাগরিকেরা দিশেহারা। রাজনীতির অসুস্থ পরিবেশের কারণে সবাই ক্ষতবিক্ষত। নাগরিকদের রক্তক্ষরণ কেউ দেখছে না। শাসকেরা ক্ষমতার জোর লুকাতে চাচ্ছেন। কিন্তু লুকানো যাচ্ছে না। ভুল আর বাড়াবাড়ির স্তূপ তারাই সৃষ্টি করছেন। গণতন্ত্রের ভাষা পাল্টে গেছে। বধ হয়ে গেছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির চিরায়ত মূল্যবোধগুলো। কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তোয়াক্কা মন্ত্রীরাও করছেন না। মন্ত্রীরা যখন কথা বলেন, তখন একই সাথে ক্ষমতার দাপট এবং অর্থ-বিত্তের কারণে গা গরমের উষ্ণতা পাওয়া যায়। অথচ তারাও জানেন ক্ষমতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পাওয়া জমিদারি নয়। যেকোনো সময় এর পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে। খোদায়ী বিধান হচ্ছে, যারা বিশ্বাসী তাদের রোগ-শোক, জ্বরাগ্রস্ততা ও বিপদ-আপদ দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। তাদের ওপর দুর্বিনীত ও জালেম শাসক বসিয়ে দিয়ে অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়। যারা ধৈর্য ধরে বুদ্ধিমানের মতো তারাই শুধু এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এবং তারা সফলও হয়। যারা ধৈর্য হারায় তাদের দুই কূল হারানোর অবস্থা সৃষ্টি হয়। দুঃশাসনের হোতারা বাড়াবাড়ির শেষসীমানায় না পৌঁছা পর্যন্ত তাদের কোমরের রশি মুখের লাগাম খোলা থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শাসক-শাসিতের যে দূরত্ব সেটা বোঝানোর মতো অবস্থাও কারো কারো নেই। পুরো জাতি বিব্রত। এই বিব্রতকর পরিস্থিতির হোতা রাজনীতিবিদেরা। বিশেষত সরকার। জনগণ আর নিতে পারছে না। এবার জনগণকে মুক্তি দিন।
বাদশাহ নামদার মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের জীবনালেখ্য। এই ঐতিহাসিক চরিত্রের মাঝে হুমায়ূন নিজের মিল খোঁজার চেষ্টা করছেন। তাই বলে তিনি ইতিহাস লিখেননি, লিখেছেন কথাসাহিত্য। তাতে ইতিহাসনির্ভরতা আছে কিন্তু কর্মটি ইতিহাস গবেষণা নয়, সাহিত্যকর্ম। এর সাথে ইতিহাসের চরিত্র খুঁজে লাভ নেই। উপন্যাসের নায়ক খোঁজাই ভালো। প্রসঙ্গটি টানার কারণ আজকের দিনে আমাদের চেনা-জানা রাজনীতিবিদদের শ্রেণী চরিত্র বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ দুই পক্ষের রাজনীতিবিদেরা জনগণের সামনে খোলামেলা উপস্থাপিত হচ্ছেন না। কিন্তু তারাই দেশ-জাতি ও জনগণের নিয়তি ঠিক করে দিচ্ছেন। বিশেষত শেখ হাসিনা নীতিনির্ধারক হিসেবে জাতির দণ্ডমুণ্ডের মালিক হয়ে উঠেছেন। জবাবদিহিতা ও তার সরকারের দায়বদ্ধতা ইতিহাসের মানদণ্ডে যদি দেখা যেত, তাহলে তাকে কার সাথে তুলনা করা যায় তা বোঝা যেত। একই সাথে এই সময়ের খালেদা জিয়া ও এরশাদের চরিত্র চিত্রণের জন্যও হুমায়ূন আহমেদের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করছি। হুমায়ূন তার বাদশাহ নামদার উপন্যাসটি শেষ করেছেন এভাবেÑ ‘রাজা যায় রাজা আসে। প্রজাও যায়, নতুন প্রজা আসে। কিছুই টিকে থাকে না। ুধার্ত সময় সব কিছু গিলে ফেলে।’
হুমায়ূন আহমেদ বাবর পুত্র ও আকবরের পিতা সম্রাট হুমায়ুনের যে চরিত্রটি উপন্যাসে সৃষ্টি করেছেনÑ সেটাই হবে এ জনপদের মানুষের কাছে পরিচিত মুঘল সম্রাট হুমায়ুন। যেমনটি ইতিহাসের নবাব সিরাজউদ্দৌলার চেয়ে খান আতার অসাধারণ সৃষ্টি সিনেমার সিরাজউদ্দৌলাহ বড় হয়ে উঠেছেন। আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা, জয়-পুতুলের মা, ডক্টর ওয়াজেদের স্ত্রী, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে যদি হুমায়ূন আহামেদ উপন্যাস চরিত্রে তুলে আনতেন, তাহলে সেই চরিত্র কেমন হতো। তিনি কি একগুঁয়েমিনির্ভর দৃঢ়চেতা একজন নারী চরিত্র হয়ে উঠে আসতেন। তার শাসনকাল কিভাবে দেখা হতো! তার তাহাজ্জুদ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত প্রাধান্য পেত, না ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম থেকে শুরু করে সালাহউদ্দিন গুম হওয়া পর্যন্ত কাহিনীগুলো প্রাধান্য পেত। বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় নেয়ার জন্য তিনি কি নিষ্ঠুর হিসেবে উপস্থাপিত হতেন না একজন মমতাময়ী মাও সংবেদনশীল শাসক হিসেবে উঠে আসতেন। গণতন্ত্রের নিজস্ব ব্যাখ্যাদাতার জন্য হুমায়ূন কি শেখ হাসিনাকে আব্রাহাম লিঙ্কনের পাশে স্থান দিতেন। হুমায়ূন পরপারে। জবাব দেয়ার দায় যেহেতু কারো নেই, তখন খালেদা জিয়া কিংবা অন্য কারো প্রসঙ্গ তুলেই বা কী লাভ।
হুমায়ূন আহমেদ ব্যতিক্রমী চরিত্র সৃষ্টির জাদুকর। বর্ণাঢ্য মানুষকে তিনি নাই করে উপস্থাপন করতে জানতেন। আবার সাধারণকে অসাধারণ করার নৈপুণ্যও তার আয়ত্তে ছিল। আমাদের সমাজে এ ধরনের মানুষ এখন নেই বললেও চলে। হেয়ালি ঢঙে অকপট সত্যটি বলে ফেলা কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটি সহজেই করতে পারতেন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন শেষজীবনে সাহিত্যের খাতিরে পারস্য সাহিত্য নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। ফার্সি শের বা কবিতা তাকে বেশ আকৃষ্ট করেছিল। তাদের প্রবাদ-প্রবচনগুলোও বেশ আয়ত্ত করেছিলেন। একটা ফার্সি নীতিকথা তিনি প্রায় তুলে ধরতেন এভাবেÑ ‘আমরা বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করি অভিজ্ঞতার জন্য। যুবকদের সমীহ করি তারুণ্যের জন্য। আর শিশুদের স্নেহ-মমতায় আগলে রাখি শিশুসুলভ আচরণের জন্য’। আজকের সমাজে বয়োজ্যেষ্ঠরা জিজ্ঞাসিত হন কার খালু, কেয়া হনুবলে। এই কাতারে দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ পড়ে যাচ্ছেন। রাজনীতিবিদের মধ্যে ভিন্নমতাবলম্বীরা বাদ পড়ছেন না।
যুবকের তারুণ্য ব্যবহার হচ্ছে বাজিকর হিসেবে। তাদের জন্য টেন্ডারবাজির রাস্তাটা খোলা। চাঁদাবাজি তাদের পেশা। মাস্তানি তাদের স্বভাব। এরাই সোনার ছেলে। তরুণদের মধ্যে ভিন্নমতের হলে নিয়তি লাশ হয়ে যাওয়া। পায়ে গুলি খাওয়া। জেলে মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হওয়া। নয়তো গুম হয়ে যাওয়া। আর শিশুরা লাশ হয়ে যাচ্ছে নষ্ট রাজনীতির জন্য। সিলেটের স্কুলছাত্র সাঈদের ব্যাপারে আমাদের জবাব কী! ত্বকি কেন নেই। বাসে ট্রাভেল ব্যাগে শিশুর লাশ কেন?
কোমল-কঠিন স্বভাবের হুমায়ুন বাদশাহ হুমায়ুনকেও তাই ভেবেছেন। তিনি যদি আমাদের বর্তমান সরকারপ্রধানের বৈশিষ্ট্য ও স্বভাবকে কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতেন, তাহলে মৃত্যুর দীর্ঘ মিছিলের বিষয়টি কিভাবে তুলে আনতেন। নিমতলীতে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কান্না থেকে শুরু করে বার্ন ইউনিটের জন্য কান্না কিভাবে হুমায়ুন চিত্রিত করতেন।
হরতাল-অবরোধের মাত্র ৭১ দিনের যে চিত্রটি ‘যুগান্তর’ ছেপেছে, তাতে বিচারবহির্ভূত নানা উপায়ে ৬৩ জন লাশের মিছিলে যোগ হয়েছে। ৬৬ জন নিহত হয়েছে নাশকতায়। প্রতিপক্ষের হামলায় সরকারপক্ষের নিহত ২৫ জন। গুম ৩৬ জন, নিখোঁজ ১৮ জন ও পঙ্গু ৫০ জন। মামলা হয়েছে এক হাজার ৪০০, গ্রেফতার ১৬ হাজার। গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রাক্কালে এবং বিগত ছয়-সাত মাসে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেয়া ও হামলা-মামলার চিত্র এখানে নেই। তা ছাড়া বিরোধী দলের হিসাব আরো অনেক বেশি। সরকারপ্রধান সব মৃত্যুকে কান্নার আওতায় আনেননি। হুমায়ুন এর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কি হেয়ালি দেখাতেন, না নিয়তির ওপর ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর হুকুম বলে শেষ করতেন।
বাদশাহ নামদার হুমায়ুন আহমেদ শুধু তার গরজে লেখেননি। একজন শাসকের উত্থান-পতন, চড়াই-উতরাই, সুদিন-দুর্দিন তুলে এনে আমাদের জন্য একটি উপমা উপস্থাপন করেছেন। নাটকীয় সংলাপধর্মী উপন্যাসটি নাট্যরূপ দেয়া সম্ভব। কোমল-কঠিন, নিষ্ঠুর ও নিপীড়ক সব শাসকের জন্য এ বইটির মধ্যে একটি শিক্ষণীয় বার্তা রয়েছে। সাহিত্যে এর মূল্যায়ন না-ই বা হলো। শাসক চেনার একটা পথ তো হুমায়ুন জনগণকে দেখালেন।
খ. ক্ষমতা, অর্থের প্রাচুর্য এবং গর্ভধারিণী মায়ের স্ফীত শরীর লুকানো যায় না। যার ক্ষমতা আছে তিনি আচার-আচরণ, চাল-চলন এবং অঙ্গভঙ্গি দিয়েই সেটা জানান দেবেন। বিত্তশালী কিছু সংযত মানুষের ঠাঁটবাট কম থাকে। অন্যরা মনের অজান্তেই কেয়া হনু বা কেউকেটা হয়ে ওঠেন। সাথে থাকা লাইসেন্সধারী অস্ত্রের গরম তাপ ছড়ায়। সেটা আশপাশের মানুষ টের পাবেই। এ জন্য নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, কক্সবাজার কিংবা মিরপুর যেতে হয় না। এই তাপ ও ক্ষমতার দাপট অনুগতরা পাবে বেশি। অর্থের প্রাচুর্য লুকিয়ে রাখা যায় না। কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ ঘটবেই। পোশাক-আশাকে তো বটেই, জীবনযাত্রায় এবং জীবনমানে তার প্রতিফলন কেউ লুকাতে পারেন না। স্ফীত মেদ ভুঁড়ির মতোই গর্ভধারিণী মায়ের শারীরিক গঠন পাল্টে যায়, সেটাও লুকানো যায় না, এটা খোদায়ী নিয়ম। প্রকৃতিসিদ্ধ ব্যাপার।
গর্ভধারণ নিয়ে একটি মজার গল্প চালু আছে। প্রকৃতিপূজারী একদল মহিলা তাদের ঈশ্বরের কাছে একবার নিয়ম পরিবর্তনের জন্য সাহায্য বা বর চাইলেনÑ অন্তর ও বহির্মুখী কাজ সামাল দিয়ে তাদের আবার সন্তান ধারণ করার ঝামেলা পোহাতে হয়। প্রসব বেদনার তীব্র ব্যথাও তাদের সহ্য করতে হয়। তাদের সমাজের পুরুষেরা কোনো দায় নেয় না। ঈশ্বর যেন অন্তত একটি দায় পুরুষের ওপর দিয়ে দেন। প্রসব বেদনার তীব্রতাটা অন্তত তাদের স্বামীদের ওপর বর্তান। ঈশ্বর তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বর বা চাওয়াটা দিয়ে দিলেন। ক’দিন পর এক দম্পতির ক্ষেত্রে দেখা গেল সন্তানসম্ভবা নারীর প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, কিন্তু স্বামীর ব্যথা উঠছে না। কিছুক্ষণ পর জানা গেল, বাগানমালি অসহ্য ব্যথায় বার বার কঁকিয়ে উঠছে। এক সময় সন্তান প্রসব হলো, বাগানমালির পেটের ব্যথাও তাৎক্ষণিক বন্ধ হয়ে গেল। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে প্রকৃতিপূজারী নারীরা আবার তাদের ঈশ্বরের কাছে আগের নিয়ম ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানাল। কিছুটা উদ্ভট কিন্তু শিক্ষণীয় গল্পটি মেম-ড্রাইভার পর্যন্ত রসিয়ে রসিয়ে বলার নজির রয়েছে। এতে শিক্ষাটা হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত ধারণা ও প্রকৃতির নিয়ম পাল্টানোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্পষ্ট। আজ প্রকৃতির নিয়ম পাল্টে দেয়ার অন্ত নেই। আমাদের চিরায়ত মূল্যবোধগুলোও উপড়ে ফেলা হচ্ছে। তাতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জীবনকে দোজখ বানিয়ে দিচ্ছে। আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি না।
আমরা এই গল্প এখানে বিনা কারণে তুলে আনিনি। আমাদের রাজনীতিতে জনগণের কষ্ট ও ব্যথা লুকানোর শেষ নেই। একের ব্যথা ও কষ্ট অন্যের ওপর চাপানোরও সীমা নেই। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম পাল্টে দেয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। ক্ষমতার তীব্র দহন এবং অসংযত ভাষায় নাগরিকেরা দিশেহারা। রাজনীতির অসুস্থ পরিবেশের কারণে সবাই ক্ষতবিক্ষত। নাগরিকদের রক্তক্ষরণ কেউ দেখছে না। শাসকেরা ক্ষমতার জোর লুকাতে চাচ্ছেন। কিন্তু লুকানো যাচ্ছে না। ভুল আর বাড়াবাড়ির স্তূপ তারাই সৃষ্টি করছেন। গণতন্ত্রের ভাষা পাল্টে গেছে। বধ হয়ে গেছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির চিরায়ত মূল্যবোধগুলো। কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তোয়াক্কা মন্ত্রীরাও করছেন না। মন্ত্রীরা যখন কথা বলেন, তখন একই সাথে ক্ষমতার দাপট এবং অর্থ-বিত্তের কারণে গা গরমের উষ্ণতা পাওয়া যায়। অথচ তারাও জানেন ক্ষমতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পাওয়া জমিদারি নয়। যেকোনো সময় এর পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে। খোদায়ী বিধান হচ্ছে, যারা বিশ্বাসী তাদের রোগ-শোক, জ্বরাগ্রস্ততা ও বিপদ-আপদ দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। তাদের ওপর দুর্বিনীত ও জালেম শাসক বসিয়ে দিয়ে অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়। যারা ধৈর্য ধরে বুদ্ধিমানের মতো তারাই শুধু এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এবং তারা সফলও হয়। যারা ধৈর্য হারায় তাদের দুই কূল হারানোর অবস্থা সৃষ্টি হয়। দুঃশাসনের হোতারা বাড়াবাড়ির শেষসীমানায় না পৌঁছা পর্যন্ত তাদের কোমরের রশি মুখের লাগাম খোলা থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শাসক-শাসিতের যে দূরত্ব সেটা বোঝানোর মতো অবস্থাও কারো কারো নেই। পুরো জাতি বিব্রত। এই বিব্রতকর পরিস্থিতির হোতা রাজনীতিবিদেরা। বিশেষত সরকার। জনগণ আর নিতে পারছে না। এবার জনগণকে মুক্তি দিন।
নয়া দিগন্তের ডেপুটি এডিটর মাসুদ মজুমদার |
এখন জোর দেখানোর অর্থ ক্ষমতার বরফ গলিয়ে ফেলা, যে চাপ
সৃষ্টি করা হচ্ছে সেটা হয়তো বিরোধী দলের বার্গেনিং ক্ষমতা কমিয়ে আনার কিংবা
নিঃশেষ করার জন্যই করা হচ্ছে। এর ফল ইতিবাচক না হয়ে ষোল আনা নেতিবাচক
হওয়ার পথে। কেউ নিয়তি ও প্রকৃতির নিয়ম ঠেকাতে পারবেন না। কোনো শাসক
পারেননি, ভবিষ্যতেও কেউ পারবেন না। সময়ের বিবেচনায় সবাই গুরুত্বপূর্ণ, কেউ
অপরিহার্য নন।
No comments