টেকসই সমাধানে চাই ‘জাতীয় সনদ’ by বদিউল আলম মজুমদার
জাতি
হিসেবে আমরা দুটি গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন। প্রথম সমস্যাটি হলো ব্যাপক
বোমাবাজি, সহিংসতা ও বিচারবহির্ভূত হত্যা। ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪২ দিনের
অবরোধে বোমা হামলাসহ সহিংসতায় ৮৯ জন নিরপরাধ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে
(পেট্রলবোমা ও আগুনে ৫২ জন) এবং সহস্রাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছে। এর মধ্যে
ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন ১৯ জন। এ সময় ১ হাজার ১২৭টি যানবাহনে আগুন দেওয়া
হয় ও ভাঙচুর চালানো হয় এবং ১৩ দফায় নাশকতা চালানো হয় রেলে (প্রথম আলো,
১৬ ফেব্রুয়ারি)। যারা পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করে, তারা ঘৃণিত অপরাধী
এবং তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে জরুরি
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান।
দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো রাজনৈতিক। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কর্মসূচি পালনে বিধিনিষেধ আরোপ ও তাদের দমন-পীড়ন এবং গণমাধ্যমের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক সমস্যার মূল কারণ। আর বিতর্কিত নির্বাচনের পেছনের কারণ হলো সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী, যা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। আর রাজনীতির ভাষা হলো সংলাপ ও সমঝোতা। আমরা আশা করি যে বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে যত দ্রুত সম্ভব স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সংলাপের আয়োজন করা হবে, যার মাধ্যমে কতগুলো বিষয়ে জাতীয় মতৈক্য গড়ে উঠবে, একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণীত ও স্বাক্ষরিত হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে।
আমরা মনে করি যে বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যার টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে মোটাদাগে তিনটি ক্ষেত্রে জাতীয় মতৈক্য সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন। সম্ভাব্য মতৈক্যের ক্ষেত্রসমূহ হতে পারে: ক. নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা; খ. নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচনী আইনের সংস্কার; এবং গ. নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের করণীয়।
নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা
সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহে দলতন্ত্রের ভয়াবহ প্রভাব বিস্তারের কারণে অতীতের মতো ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোও যে কারচুপি ও কারসাজিমুক্ত হবে না, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাই ভবিষ্যতের নির্বাচন যাতে দলীয় প্রভাবমুক্ত, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক হতে পারে, সেই লক্ষ্যে এই মুহূর্তেই নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে একটি সমঝোতা হওয়া জরুরি। আর সংশ্লিষ্ট সবার মতৈক্যের ভিত্তিতে গঠিত নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব হবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের (যেমন, ৯০ দিনের) মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা, যাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত হতে পারে। আর শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত না হলে দেশে কোনো দিন শান্তি আসবে না।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচনী আইনের সংস্কার
সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের এবং কমিশনের সদস্যরা যোগ্য ও নিরপেক্ষ না হলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশা করা দুরাশা মাত্র। তাই সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন আবশ্যক। এ লক্ষ্যে অবশ্য কমিশনে নিয়োগদান–সম্পর্কিত একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে, যে ব্যাপারে সুস্পষ্ট সাংবিধানিক (অনুচ্ছেদ ১১৮) বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘হুদা কমিশন’-এর রেখে যাওয়া আইনের একটি খসড়া কাজে লাগানো যেতে পারে। কমিশন পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে একটি অনুসন্ধান কমিটির সহায়তা নিতে হবে, যে কমিটি স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগদানের জন্য সুপারিশ করবে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কমিশনে নিয়োগ প্রদান করবেন।
সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য শুধু নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা ও নির্বাচন কমিশনের দক্ষতাই যথেষ্ট নয়, এর জন্য নির্বাচনকালীন আইনকানুন ও বিধিবিধানও যথার্থ হতে হবে। বিদ্যমান আইনি কাঠামো বহুলাংশে গ্রহণযোগ্য হলেও এগুলোতে কিছু সংস্কার আনতে হবে এবং নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে মোটাদাগের কিছু সংস্কারের ব্যাপারেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আরপিওতে ‘না ভোটের’ এবং দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের সুস্পষ্ট বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া নির্বাচনী ব্যয়ে লাগাম টানার লক্ষ্যেও আইনি সংস্কারের প্রয়োজন হবে।
আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনকে কলুষমুক্ত করতে হলে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার মানদণ্ড আরও কঠোর করতে হবে। এটি বাস্তবায়নের জন্য অবশ্য প্রয়োজন হবে যুদ্ধাপরাধী, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ও অসৎ ব্যক্তিদের মনোনয়ন না দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার। এ ছাড়া হলফনামার মাধ্যমে প্রার্থীদের প্রদত্ত তথ্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক পদ্ধতিগতভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে হবে।
নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের করণীয়
নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার ও একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারলেও আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজমান অসহিষ্ণুতা ও হানাহানি তথা অচলাবস্থার সমস্যা দূরীভূত হবে না। এর জন্য প্রয়োজন হবে নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের করণীয় সস্পর্কে একটি মতৈক্য সৃষ্টি। আর তা করতে পারলেই আমরা সমস্যার টেকসই সমাধান আশা করতে পারি।
পরবর্তী সরকারের সম্ভাব্য করণীয় বিষয়সমূহ হতে পারে: (১) যুদ্ধাপরাধের বিচার দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন ও রায় কার্যকর করা; (২) জাতীয় সংসদকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, যাতে সংসদ যথাযথভাবে সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে; (৩) রাজনৈতিক দলের সংস্কারের মাধ্যমে দলগুলোকে গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ করা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সব স্তরে দলতন্ত্রের অবসান ঘটানো; (৪) রাজনৈতিক দলসমূহের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন বিলুপ্ত করা; (৫) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত ও উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য একটি আইন প্রণয়ন এবং বিচার বিভাগের সত্যিকার পৃথক্করণের মাধ্যমে নিম্ন আদালতের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; (৬) আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগদানের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা; (৭) দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালের মতো দুর্নীতিবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে একটি সর্বব্যাপী দুর্নীতি দমন অভিযান পরিচালনা করা, বিদেশে পাচার করা কালোটাকা ফেরত আনার এবং ন্যায়পাল নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া; (৮) একটি সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়ন, পুলিশ আইনের আধুনিকায়ন এবং সরকারি কর্মকমিশনে সংস্কারের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা, পেশাদারত্ব ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা; (৯) প্রশাসনিক ও আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে একটি বলিষ্ঠ কর্মসূচি গ্রহণ, অন্তত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ন্যূনতম ৫০ শতাংশ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যয় এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে স্থানীয় সাংসদদের অযাচিত হস্তক্ষেপ তথা এমপিতন্ত্র ও দলতন্ত্রের অবসান করা; (১০) সরকারি ও বেসরকারি সব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং নাগরিক সমাজের কাজের পরিধি যাতে সংকুচিত না হয়, সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া; (১১) গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সংখ্যালঘুসহ সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখা; (১২) প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে ‘পলিটিক্যাল ফাইন্যান্স’ বা রাজনীতির অর্থায়ন–প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা, যাতে নির্বাচনী ব্যয় ও রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের ওপর লাগাম টানা সম্ভব হয়; (১৩) একটি নতুন ‘সামাজিক চুক্তি’তে উপনীত হওয়া, যাতে সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সম্পদে তাদের ন্যায্য হিস্যা পেতে পারে এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা; এবং (১৪) সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা, যে কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে পরবর্তী সরকার উদ্যোগ নেবে।
জাতির বৃহত্তর স্বার্থে রাজনীতিবিদদের দায়িত্বশীল আচরণ করার উদাহরণ আমাদের রয়েছে। যেমন, ১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ‘তিন জোটের রূপরেখা’ প্রণয়ন করেছিল, যার ভিত্তিতে ১৯৯১ সালে একটি সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন ঘটেছিল। আশা করি, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে ও কার্যকর করতে এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সম্মানিত রাজনীতিবিদেরা আবারও সংলাপ ও সমঝোতার লক্ষ্যে এগিয়ে আসবেন।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো রাজনৈতিক। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কর্মসূচি পালনে বিধিনিষেধ আরোপ ও তাদের দমন-পীড়ন এবং গণমাধ্যমের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক সমস্যার মূল কারণ। আর বিতর্কিত নির্বাচনের পেছনের কারণ হলো সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী, যা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। আর রাজনীতির ভাষা হলো সংলাপ ও সমঝোতা। আমরা আশা করি যে বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে যত দ্রুত সম্ভব স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সংলাপের আয়োজন করা হবে, যার মাধ্যমে কতগুলো বিষয়ে জাতীয় মতৈক্য গড়ে উঠবে, একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণীত ও স্বাক্ষরিত হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে।
আমরা মনে করি যে বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যার টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে মোটাদাগে তিনটি ক্ষেত্রে জাতীয় মতৈক্য সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন। সম্ভাব্য মতৈক্যের ক্ষেত্রসমূহ হতে পারে: ক. নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা; খ. নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচনী আইনের সংস্কার; এবং গ. নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের করণীয়।
নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা
সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহে দলতন্ত্রের ভয়াবহ প্রভাব বিস্তারের কারণে অতীতের মতো ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোও যে কারচুপি ও কারসাজিমুক্ত হবে না, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাই ভবিষ্যতের নির্বাচন যাতে দলীয় প্রভাবমুক্ত, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক হতে পারে, সেই লক্ষ্যে এই মুহূর্তেই নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে একটি সমঝোতা হওয়া জরুরি। আর সংশ্লিষ্ট সবার মতৈক্যের ভিত্তিতে গঠিত নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব হবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের (যেমন, ৯০ দিনের) মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা, যাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত হতে পারে। আর শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত না হলে দেশে কোনো দিন শান্তি আসবে না।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচনী আইনের সংস্কার
সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের এবং কমিশনের সদস্যরা যোগ্য ও নিরপেক্ষ না হলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশা করা দুরাশা মাত্র। তাই সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন আবশ্যক। এ লক্ষ্যে অবশ্য কমিশনে নিয়োগদান–সম্পর্কিত একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে, যে ব্যাপারে সুস্পষ্ট সাংবিধানিক (অনুচ্ছেদ ১১৮) বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘হুদা কমিশন’-এর রেখে যাওয়া আইনের একটি খসড়া কাজে লাগানো যেতে পারে। কমিশন পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে একটি অনুসন্ধান কমিটির সহায়তা নিতে হবে, যে কমিটি স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগদানের জন্য সুপারিশ করবে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কমিশনে নিয়োগ প্রদান করবেন।
সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য শুধু নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা ও নির্বাচন কমিশনের দক্ষতাই যথেষ্ট নয়, এর জন্য নির্বাচনকালীন আইনকানুন ও বিধিবিধানও যথার্থ হতে হবে। বিদ্যমান আইনি কাঠামো বহুলাংশে গ্রহণযোগ্য হলেও এগুলোতে কিছু সংস্কার আনতে হবে এবং নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে মোটাদাগের কিছু সংস্কারের ব্যাপারেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আরপিওতে ‘না ভোটের’ এবং দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের সুস্পষ্ট বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া নির্বাচনী ব্যয়ে লাগাম টানার লক্ষ্যেও আইনি সংস্কারের প্রয়োজন হবে।
আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনকে কলুষমুক্ত করতে হলে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার মানদণ্ড আরও কঠোর করতে হবে। এটি বাস্তবায়নের জন্য অবশ্য প্রয়োজন হবে যুদ্ধাপরাধী, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ও অসৎ ব্যক্তিদের মনোনয়ন না দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার। এ ছাড়া হলফনামার মাধ্যমে প্রার্থীদের প্রদত্ত তথ্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক পদ্ধতিগতভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে হবে।
নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের করণীয়
নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার ও একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারলেও আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজমান অসহিষ্ণুতা ও হানাহানি তথা অচলাবস্থার সমস্যা দূরীভূত হবে না। এর জন্য প্রয়োজন হবে নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের করণীয় সস্পর্কে একটি মতৈক্য সৃষ্টি। আর তা করতে পারলেই আমরা সমস্যার টেকসই সমাধান আশা করতে পারি।
পরবর্তী সরকারের সম্ভাব্য করণীয় বিষয়সমূহ হতে পারে: (১) যুদ্ধাপরাধের বিচার দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন ও রায় কার্যকর করা; (২) জাতীয় সংসদকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, যাতে সংসদ যথাযথভাবে সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে; (৩) রাজনৈতিক দলের সংস্কারের মাধ্যমে দলগুলোকে গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ করা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সব স্তরে দলতন্ত্রের অবসান ঘটানো; (৪) রাজনৈতিক দলসমূহের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন বিলুপ্ত করা; (৫) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত ও উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য একটি আইন প্রণয়ন এবং বিচার বিভাগের সত্যিকার পৃথক্করণের মাধ্যমে নিম্ন আদালতের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; (৬) আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগদানের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা; (৭) দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালের মতো দুর্নীতিবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে একটি সর্বব্যাপী দুর্নীতি দমন অভিযান পরিচালনা করা, বিদেশে পাচার করা কালোটাকা ফেরত আনার এবং ন্যায়পাল নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া; (৮) একটি সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়ন, পুলিশ আইনের আধুনিকায়ন এবং সরকারি কর্মকমিশনে সংস্কারের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা, পেশাদারত্ব ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা; (৯) প্রশাসনিক ও আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে একটি বলিষ্ঠ কর্মসূচি গ্রহণ, অন্তত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ন্যূনতম ৫০ শতাংশ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যয় এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে স্থানীয় সাংসদদের অযাচিত হস্তক্ষেপ তথা এমপিতন্ত্র ও দলতন্ত্রের অবসান করা; (১০) সরকারি ও বেসরকারি সব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং নাগরিক সমাজের কাজের পরিধি যাতে সংকুচিত না হয়, সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া; (১১) গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সংখ্যালঘুসহ সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখা; (১২) প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে ‘পলিটিক্যাল ফাইন্যান্স’ বা রাজনীতির অর্থায়ন–প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা, যাতে নির্বাচনী ব্যয় ও রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের ওপর লাগাম টানা সম্ভব হয়; (১৩) একটি নতুন ‘সামাজিক চুক্তি’তে উপনীত হওয়া, যাতে সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সম্পদে তাদের ন্যায্য হিস্যা পেতে পারে এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা; এবং (১৪) সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা, যে কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে পরবর্তী সরকার উদ্যোগ নেবে।
জাতির বৃহত্তর স্বার্থে রাজনীতিবিদদের দায়িত্বশীল আচরণ করার উদাহরণ আমাদের রয়েছে। যেমন, ১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ‘তিন জোটের রূপরেখা’ প্রণয়ন করেছিল, যার ভিত্তিতে ১৯৯১ সালে একটি সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন ঘটেছিল। আশা করি, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে ও কার্যকর করতে এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সম্মানিত রাজনীতিবিদেরা আবারও সংলাপ ও সমঝোতার লক্ষ্যে এগিয়ে আসবেন।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments