গণঅধিকার ছাড়া রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা কিংবা জাতীয়তাবাদ দুটিই স্রেফ ধাপ্পা by ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
'Then professor, You are against your country!
- There is no country colonel! Only rivers, mountains and people!'
●
আশির দশকে একটি ইংরেজি ছবি দেখেছিলাম। 'Escape to Athena'। ফ্যাসিস্ট কবলিত ইতালির পটভূমিতে নির্মিত এ ছবির কাহিনীটি গড়ে উঠেছে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটকে ঘিরে। পুরনো একটি দুর্গের পাশে খনন কার্য চালিয়ে আবিষ্কৃত হয়েছে মহামূল্যবান সব ঐতিহাসিক নিদর্শন। গড়ে উঠেছে একটা ছোটখাটো জাদুঘর। জাদুঘরের কিউরেটর একজন নিবেদিতপ্রাণ ইতালীয় প্রত্নতাত্ত্বিক।
মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট বাহিনী আর তার মুরব্বি জার্মান নাৎসি বাহিনী এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করছে। ওই দুর্গে তারা বহু অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট লোকজনকে ধরে এনে আটকে রেখেছে। আর সেই সঙ্গে একের পর এক মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী পাচার হয়ে যাচ্ছে জার্মানিতে। ইতালীয় ও জার্মান জেনারেলরা মিলেমিশেই কারবারটা চালাচ্ছে। প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক চোখের সামনে এসব দেখছেন। কিন্তু তিনি ঝুটঝামেলায় যেতে চান না। ফ্যাসিজমবিরোধী বিদ্রোহীরা তাদের বন্দি সহযোগীদের মুক্ত করার জন্য মাঝে মধ্যে হামলা চালায়। প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপকের কাছ থেকে তারা কোনো সহায়তা পায় না। তিনি নিজের কাজের ভেতরেই নিমগ্ন। বিদ্রোহীরা তার এ কাপুরুষতায় ক্ষুব্ধ।
কিন্তু একদিন এ নির্বিরোধ মানুষটিও বেঁকে বসলেন। যোগ দিলেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে, যারা বন্দি শিবির থেকে তাদের সহকর্মীদের মুক্ত করতে অস্ত্র ধরেছে। তিনি তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
আর তখনই ইতালীয় সেনাপতির সঙ্গে তার এ সংলাপ।
শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক দেশদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন- এ বিসদৃশ ঘটনায় যেন চমকে উঠেছেন ইতালীয় বাহিনীর অধিনায়ক। অধ্যাপককে ডেকে ভর্ৎসনার সুরে বললেন,
- 'Then Professor, You are against your country!' (তাহলে প্রফেসর সাহেব, আপনি নিজের দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন!)
এতদিনের নির্বিরোধ প্রত্নতাত্ত্বিক শান্তস্বরে জবাব দিলেন,
- 'There is no country Colonel! Only rivers, mountains and people!'
(দেশ কোথায় কর্নেল সাহেব। আছে কেবল কিছু নদী, কিছু পাহাড় এবং কিছু মানুষ)
সুঅভিনেতা ডেভিড নিভেনের অপূর্ব বাচনভঙ্গিতে উচ্চারিত সংলাপটি সেই অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের দেয়াল থেকে দেয়ালে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। ফ্যাসিস্ট কবলিত ইতালির অবয়বে যেন সেদিনের সেনাশাসক কবলিত বাংলাদেশকেই দেখতে থাকলাম।
●
বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।
কিন্তু এ কোন বাংলাদেশ?
যে দেশে প্রাণ খুলে কথা বলা যায় না, যে দেশে বন্দুকই রাজা, খলনায়করাই মঞ্চের পাদপ্রদীপ দখল করে আছে, সে দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি যদি কেউ আনুগত্য অনুভব না করে, তবে কি তাকে দেশদ্রোহী বলা যাবে?
●
১৯৭১ সালের এক ভোরে যখন আগরতলায় বসে শুনলাম, আগের রাতে ভৈরবের ব্রিজ ডিনামাইটে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে তখন আমাদের মনে কী প্রচণ্ড আনন্দ। একবারও মনে হয়নি এ ব্রিজ আমাদেরই জাতীয় সম্পদ। ওটা আবার গড়তে অনেক মূল্য দিতে হবে।
তখনও ওই ছবিটা আমার দেখা হয়নি। কিন্তু বোধহয় আমাদের তখনকার মানসিক অবস্থাটাও ছিল ওই অধ্যাপকের মতোই। কোথায় দেশ? কার দেশ?
দেশের ভেতরে একের পর এক রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, পাওয়ার হাউস ধ্বংস হচ্ছে, আর আমরা শত্র“ হননের সাফল্যে আত্মহারা হচ্ছি। যে রাষ্ট্রযন্ত্র কেবলই উৎপীড়নের, কেবলই শোষণের, কেবলই শৃংখলের- সেই রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি আনুগত্য আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই নয়। সেদিন পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রযন্ত্রটি আমাদের দুশমন ছিল- আর এসব রাস্তাঘাট-ব্রিজ-কালভার্ট-পাওয়ার হাউস ছিল ওই রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তির জোগানদার। তাই এগুলোকে ধ্বংস করে শত্র“ রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে আমরা কাবু করতে চেয়েছি।
●
কেবল বিদেশী শাসকের হাতেই নয়, স্বদেশবাসীর হাতেও রাষ্ট্রযন্ত্র রীতিমতো গণবিরোধী হয়ে উঠতে পারে।
১৯৭৫-এ একদলীয় স্বৈরশাসন এসেছিল সংসদীয় গণতন্ত্রের সিঁড়ি বেয়ে। যেদিন সংসদের ওই সিদ্ধান্ত পাস হয়ে গেল, ওসমানী সাহেব আর ব্যারিস্টার মইনুল ছাড়া আর সব গণপ্রতিনিধি সেই গণবিরোধী পদক্ষেপে দুহাত তুলে সমর্থন জানালেন, সেদিন নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়েছিল। আমি তখন জাতীয় লীগের সদস্য। ১৯৭০ সালে আমরা হাজার হাজার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী নিয়ে দলটি গড়েছিলাম। আমাদের চোখে ছিল স্বাধীন স্বদেশের স্বপ্ন। আতাউর রহমান খান ছিলেন ওই দলের সভাপতি। ৭৩-এর সংসদে তিনি আমাদের একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধি। কিন্তু বাকশাল প্রতিষ্ঠার কদিনের মধ্যেই তিনি আমাদের হতচকিত করে বাকশালে যোগ দিয়ে বসলেন। আমি আমার রাজনৈতিক জীবনে অনেকবার বেশ বড়সড় আঘাত সয়েছি। এ ছিল তন্মধ্যে সবচেয়ে বেদনাদায়ক। নিজেকে এবারে কেবল অসহায় নয়, একাও মনে হতে লাগল।
এ কোন বাংলাদেশ? এ দেশেরই কি স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা? এ স্বৈরতন্ত্র দেখার জন্যই কি জীবনের সুন্দরতম দিনগুলো কারাগারে-আত্মগোপনে-রাজপথে হারিয়ে এসেছি? কোথায় চলেছি আমরা? কোথায়?
আমার মনটা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেই সচরাচর লিখতে বসি। সেদিনও কিছু লিখেছিলাম। ইত্তেফাকের সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে ওটা দিয়েছিলাম ছাপাতে। সে লেখায় সরাসরি আক্রমণ কিছুই ছিল না। ওই পরিবেশে কতটা লেখা যায়, ছাপা যায়, সে মাত্রাজ্ঞান আমার ছিল। যতদূর মনে পড়ে, ওই লেখায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যে কথাটা তুলে ধরতে চেয়েছিলাম তা ছিল : সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে এক দল গড়ার এ পদক্ষেপে আওয়ামী লীগের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে পড়বে, বিভিন্ন মতের বারোয়াড়ি লোকজন নিয়ে বিকল্প কিছুই গড়ে উঠবে না। পরিণামে সরকারের এক দলের ভেতরেই মাথাচাড়া দেবে বহু দল। আসলে এক দল মানে কোনো দলই নয়। এতে আমও যাবে, ছালাও যাবে। ইত্যাদি।
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আমাকে কথা দিয়েছিলেন লেখাটা ছাপবেন। কিন্তু ছাপেননি। কয়েকদিন পর জিজ্ঞাসা করতেই তার স্বভাবসুলভ উচ্চহাসি দিয়ে বললেন,
ওটা ছাপিনি, কিন্তু যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছি।
বললাম, মানে?
- মানে যার উদ্দেশ্যে লিখেছেন তাকে শুনিয়েছি।
- বলো কী? উনি কী বললেন?
- ঠোঁটে পাইপ চেপে কেবল বললেন- হুম।
লেখাটা কোথাও কোনো ডাস্টবিনে পচে গলে মাটি হয়ে গেছে।
১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি, সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর সারা দেশে সে কী অদ্ভুত প্রতিযোগিতা। কে কার আগে সরকারি দল বাকশালে নাম লেখাবে। আমাদের সংবাদপত্র জগতের মধ্যমণিগণ, বিদগ্ধ অধ্যাপক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরা কাতারবন্দি হয়ে বাকশাল অফিসে গিয়ে দীক্ষা নিতে থাকলেন।
ছাত্রজীবনের সহকর্মীরা কেউ পাশে নেই। জাতীয় লীগ নামে যে দলটি খাড়া করার জন্য নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বেশ কবছর কাজ করেছি- আতাউর রহমান খান সাহেবের বাকশালে যোগদানের মধ্য দিয়ে সেই দলটিও বিলুপ্ত। কয়েকটি সরকারি কাগজ ছাড়া সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষণার কালাকানুনে দেশবাংলার অফিসেও তালা ঝুলছে। সেই দুঃসহ দিনগুলোতে ইতালীয় অধ্যাপকের মতো অমন সুন্দর করে কথাটা বলতে পারিনি। কিন্তু মনের ভেতরের অব্যক্ত যন্ত্রণার সুরটি ছিল একেবারেই অভিন্ন।
এই কি আমার স্বদেশ? আমি কি এই দেশের?
●
১৯৭৫-এর ২৪ জানুয়ারির পর ১৫ আগস্ট, তারপর ৭ নভেম্বর। পুরো বছরটাই যেন নাটকের বছর। ভয়ংকর সব পালাবদলের নাটক।
এসব নাটকের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে একটু একটু করে আবার যখন দরজা-জানালা খুলতে শুরু করেছে, সেই খোলা দরজা-জানালা দিয়ে কিছুটা বাতাস ঢুকছে রুদ্ধ গুহায়- তখনই এলো ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ।
একনায়ক এবারে আর মুখোশ পরে নয়, একেবারে সমূর্তিতে হাজির। অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সারা দেশ। অবশেষে ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান। জনতার বিজয়।
৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক, এ অভ্যুত্থান ঘটেছে জনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ-দুঃখ-বেদনার সশব্দ বিস্ফোরণে। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্বের আন্দোলনে নয়। জনতার মিছিলে নেতাদের নেমে আসতে হয়েছে। ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটে না।
কিন্তু ইতিহাসে এমন ঘটনা যখনই ঘটেছে- ফরাসি বিপ্লবের মতো, রাশিয়ার দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনের মতো তার সমাপ্তিটা প্রায়শ প্রবাহিত হয়েছে ভিন্নখাতে। অন্য কোথাও চলে গেছে ঘটনা প্রবাহের ফসল। আর জনতাকে ফিরে যেতে হয়েছে তার পুরনো অবস্থানে। হাতুড়ি, শাবল কিংবা লাঙ্গলের পেছনে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম হল না।
●
৮৩র পাঁচ-দফার ভিত্তিতে গোটা ৮০র দশক একনায়কের বিরুদ্ধে লড়েছে জাতি। ৯০-এর পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পালাক্রমিক শাসন-অপশাসনের ২৩ বছর। মাঝখানে দুই বছরের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সবমিলিয়ে ২৫ বছরের গণতান্ত্রিক শাসনের শেষে আজকের বাংলাদেশে নিত্যদিন কী দৃশ্য দেখছি?
একদিকে তথাকথিত হরতাল-অবরোধে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস, পেট্রলবোমার আগুনে ছাই হয়ে যাচ্ছে বাস-ট্রাক-মোটরগাড়ি-সিএনজি, অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষ শিশু-বৃদ্ধ-নারী নির্বিশেষে। ঝলসে যাওয়া শরীর নিয়ে বার্ন ইউনিটে কিংবা পঙ্গু হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে সাধারণ মানুষ। দুপক্ষের ক্ষমতার যুদ্ধে যাদের অধিকাংশের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
কে বা কারা এ নারকীয় বর্বরতা চালাচ্ছে তা কেউ জানে না- কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। অপরদিকে সরকার পক্ষের লক্ষ্যহীন প্রতিরোধ এবং নিরন্তর হুংকার। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। কোথায় চলেছে দেশ? এ একটি মাত্র প্রশ্ন সবার মুখে।
পাকিস্তানের শেষ দিনগুলোতে ছিল এমন দৃশ্য। সেটা তো ছিল ভাঙনের সময়। পরস্পরকে হননের সময়।
একাত্তরে আমরা ভেঙেছি একটি দানব রাষ্ট্র। আজকের ভাঙন-হননের লক্ষ্য কী? এখন কি আমরা লাখো প্রাণের মূল্যে অর্জিত এ জাতিকেই দ্বিধাবিভক্ত করার ব্রত নিয়েছি? স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের কল্পিত, আরোপিত ও আত্মবিনাশী বিভাজনে?
আজকের এ যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে কি সেই ইতালীয় অধ্যাপকের ভাষায় বলতে হবে-
-দেশ কোথায়? জাতি কোথায়? চারদিকে দেখছি কেবল যুদ্ধরত আওয়ামী লীগ-বিএনপি- দুই নেত্রী, পেট্রলবোমা, আর ১৬ কোটি অসহায় দিশাহীন মানুষ!
●●
ক্ষমা প্রার্থনা :
২৯ জানুয়ারি যুগান্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে শীর্ষক কলামে একটি মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনে একটি জেলা ছিলর স্থলে চট্টগ্রাম জেলার অধীনে একটি মহকুমা হয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম কোনো স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ছিল না, চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনে ছিল, একথা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। এ গুরুতর ভুলের জন্য পাঠকদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
shapshin@gtlbd.com
- There is no country colonel! Only rivers, mountains and people!'
●
আশির দশকে একটি ইংরেজি ছবি দেখেছিলাম। 'Escape to Athena'। ফ্যাসিস্ট কবলিত ইতালির পটভূমিতে নির্মিত এ ছবির কাহিনীটি গড়ে উঠেছে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটকে ঘিরে। পুরনো একটি দুর্গের পাশে খনন কার্য চালিয়ে আবিষ্কৃত হয়েছে মহামূল্যবান সব ঐতিহাসিক নিদর্শন। গড়ে উঠেছে একটা ছোটখাটো জাদুঘর। জাদুঘরের কিউরেটর একজন নিবেদিতপ্রাণ ইতালীয় প্রত্নতাত্ত্বিক।
মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট বাহিনী আর তার মুরব্বি জার্মান নাৎসি বাহিনী এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করছে। ওই দুর্গে তারা বহু অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট লোকজনকে ধরে এনে আটকে রেখেছে। আর সেই সঙ্গে একের পর এক মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী পাচার হয়ে যাচ্ছে জার্মানিতে। ইতালীয় ও জার্মান জেনারেলরা মিলেমিশেই কারবারটা চালাচ্ছে। প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক চোখের সামনে এসব দেখছেন। কিন্তু তিনি ঝুটঝামেলায় যেতে চান না। ফ্যাসিজমবিরোধী বিদ্রোহীরা তাদের বন্দি সহযোগীদের মুক্ত করার জন্য মাঝে মধ্যে হামলা চালায়। প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপকের কাছ থেকে তারা কোনো সহায়তা পায় না। তিনি নিজের কাজের ভেতরেই নিমগ্ন। বিদ্রোহীরা তার এ কাপুরুষতায় ক্ষুব্ধ।
কিন্তু একদিন এ নির্বিরোধ মানুষটিও বেঁকে বসলেন। যোগ দিলেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে, যারা বন্দি শিবির থেকে তাদের সহকর্মীদের মুক্ত করতে অস্ত্র ধরেছে। তিনি তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
আর তখনই ইতালীয় সেনাপতির সঙ্গে তার এ সংলাপ।
শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক দেশদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন- এ বিসদৃশ ঘটনায় যেন চমকে উঠেছেন ইতালীয় বাহিনীর অধিনায়ক। অধ্যাপককে ডেকে ভর্ৎসনার সুরে বললেন,
- 'Then Professor, You are against your country!' (তাহলে প্রফেসর সাহেব, আপনি নিজের দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন!)
এতদিনের নির্বিরোধ প্রত্নতাত্ত্বিক শান্তস্বরে জবাব দিলেন,
- 'There is no country Colonel! Only rivers, mountains and people!'
(দেশ কোথায় কর্নেল সাহেব। আছে কেবল কিছু নদী, কিছু পাহাড় এবং কিছু মানুষ)
সুঅভিনেতা ডেভিড নিভেনের অপূর্ব বাচনভঙ্গিতে উচ্চারিত সংলাপটি সেই অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের দেয়াল থেকে দেয়ালে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। ফ্যাসিস্ট কবলিত ইতালির অবয়বে যেন সেদিনের সেনাশাসক কবলিত বাংলাদেশকেই দেখতে থাকলাম।
●
বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।
কিন্তু এ কোন বাংলাদেশ?
যে দেশে প্রাণ খুলে কথা বলা যায় না, যে দেশে বন্দুকই রাজা, খলনায়করাই মঞ্চের পাদপ্রদীপ দখল করে আছে, সে দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি যদি কেউ আনুগত্য অনুভব না করে, তবে কি তাকে দেশদ্রোহী বলা যাবে?
●
১৯৭১ সালের এক ভোরে যখন আগরতলায় বসে শুনলাম, আগের রাতে ভৈরবের ব্রিজ ডিনামাইটে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে তখন আমাদের মনে কী প্রচণ্ড আনন্দ। একবারও মনে হয়নি এ ব্রিজ আমাদেরই জাতীয় সম্পদ। ওটা আবার গড়তে অনেক মূল্য দিতে হবে।
তখনও ওই ছবিটা আমার দেখা হয়নি। কিন্তু বোধহয় আমাদের তখনকার মানসিক অবস্থাটাও ছিল ওই অধ্যাপকের মতোই। কোথায় দেশ? কার দেশ?
দেশের ভেতরে একের পর এক রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, পাওয়ার হাউস ধ্বংস হচ্ছে, আর আমরা শত্র“ হননের সাফল্যে আত্মহারা হচ্ছি। যে রাষ্ট্রযন্ত্র কেবলই উৎপীড়নের, কেবলই শোষণের, কেবলই শৃংখলের- সেই রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি আনুগত্য আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই নয়। সেদিন পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রযন্ত্রটি আমাদের দুশমন ছিল- আর এসব রাস্তাঘাট-ব্রিজ-কালভার্ট-পাওয়ার হাউস ছিল ওই রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তির জোগানদার। তাই এগুলোকে ধ্বংস করে শত্র“ রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে আমরা কাবু করতে চেয়েছি।
●
কেবল বিদেশী শাসকের হাতেই নয়, স্বদেশবাসীর হাতেও রাষ্ট্রযন্ত্র রীতিমতো গণবিরোধী হয়ে উঠতে পারে।
১৯৭৫-এ একদলীয় স্বৈরশাসন এসেছিল সংসদীয় গণতন্ত্রের সিঁড়ি বেয়ে। যেদিন সংসদের ওই সিদ্ধান্ত পাস হয়ে গেল, ওসমানী সাহেব আর ব্যারিস্টার মইনুল ছাড়া আর সব গণপ্রতিনিধি সেই গণবিরোধী পদক্ষেপে দুহাত তুলে সমর্থন জানালেন, সেদিন নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়েছিল। আমি তখন জাতীয় লীগের সদস্য। ১৯৭০ সালে আমরা হাজার হাজার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী নিয়ে দলটি গড়েছিলাম। আমাদের চোখে ছিল স্বাধীন স্বদেশের স্বপ্ন। আতাউর রহমান খান ছিলেন ওই দলের সভাপতি। ৭৩-এর সংসদে তিনি আমাদের একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধি। কিন্তু বাকশাল প্রতিষ্ঠার কদিনের মধ্যেই তিনি আমাদের হতচকিত করে বাকশালে যোগ দিয়ে বসলেন। আমি আমার রাজনৈতিক জীবনে অনেকবার বেশ বড়সড় আঘাত সয়েছি। এ ছিল তন্মধ্যে সবচেয়ে বেদনাদায়ক। নিজেকে এবারে কেবল অসহায় নয়, একাও মনে হতে লাগল।
এ কোন বাংলাদেশ? এ দেশেরই কি স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা? এ স্বৈরতন্ত্র দেখার জন্যই কি জীবনের সুন্দরতম দিনগুলো কারাগারে-আত্মগোপনে-রাজপথে হারিয়ে এসেছি? কোথায় চলেছি আমরা? কোথায়?
আমার মনটা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেই সচরাচর লিখতে বসি। সেদিনও কিছু লিখেছিলাম। ইত্তেফাকের সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে ওটা দিয়েছিলাম ছাপাতে। সে লেখায় সরাসরি আক্রমণ কিছুই ছিল না। ওই পরিবেশে কতটা লেখা যায়, ছাপা যায়, সে মাত্রাজ্ঞান আমার ছিল। যতদূর মনে পড়ে, ওই লেখায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যে কথাটা তুলে ধরতে চেয়েছিলাম তা ছিল : সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে এক দল গড়ার এ পদক্ষেপে আওয়ামী লীগের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে পড়বে, বিভিন্ন মতের বারোয়াড়ি লোকজন নিয়ে বিকল্প কিছুই গড়ে উঠবে না। পরিণামে সরকারের এক দলের ভেতরেই মাথাচাড়া দেবে বহু দল। আসলে এক দল মানে কোনো দলই নয়। এতে আমও যাবে, ছালাও যাবে। ইত্যাদি।
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আমাকে কথা দিয়েছিলেন লেখাটা ছাপবেন। কিন্তু ছাপেননি। কয়েকদিন পর জিজ্ঞাসা করতেই তার স্বভাবসুলভ উচ্চহাসি দিয়ে বললেন,
ওটা ছাপিনি, কিন্তু যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছি।
বললাম, মানে?
- মানে যার উদ্দেশ্যে লিখেছেন তাকে শুনিয়েছি।
- বলো কী? উনি কী বললেন?
- ঠোঁটে পাইপ চেপে কেবল বললেন- হুম।
লেখাটা কোথাও কোনো ডাস্টবিনে পচে গলে মাটি হয়ে গেছে।
১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি, সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর সারা দেশে সে কী অদ্ভুত প্রতিযোগিতা। কে কার আগে সরকারি দল বাকশালে নাম লেখাবে। আমাদের সংবাদপত্র জগতের মধ্যমণিগণ, বিদগ্ধ অধ্যাপক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরা কাতারবন্দি হয়ে বাকশাল অফিসে গিয়ে দীক্ষা নিতে থাকলেন।
ছাত্রজীবনের সহকর্মীরা কেউ পাশে নেই। জাতীয় লীগ নামে যে দলটি খাড়া করার জন্য নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বেশ কবছর কাজ করেছি- আতাউর রহমান খান সাহেবের বাকশালে যোগদানের মধ্য দিয়ে সেই দলটিও বিলুপ্ত। কয়েকটি সরকারি কাগজ ছাড়া সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষণার কালাকানুনে দেশবাংলার অফিসেও তালা ঝুলছে। সেই দুঃসহ দিনগুলোতে ইতালীয় অধ্যাপকের মতো অমন সুন্দর করে কথাটা বলতে পারিনি। কিন্তু মনের ভেতরের অব্যক্ত যন্ত্রণার সুরটি ছিল একেবারেই অভিন্ন।
এই কি আমার স্বদেশ? আমি কি এই দেশের?
●
১৯৭৫-এর ২৪ জানুয়ারির পর ১৫ আগস্ট, তারপর ৭ নভেম্বর। পুরো বছরটাই যেন নাটকের বছর। ভয়ংকর সব পালাবদলের নাটক।
এসব নাটকের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে একটু একটু করে আবার যখন দরজা-জানালা খুলতে শুরু করেছে, সেই খোলা দরজা-জানালা দিয়ে কিছুটা বাতাস ঢুকছে রুদ্ধ গুহায়- তখনই এলো ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ।
একনায়ক এবারে আর মুখোশ পরে নয়, একেবারে সমূর্তিতে হাজির। অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সারা দেশ। অবশেষে ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান। জনতার বিজয়।
৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক, এ অভ্যুত্থান ঘটেছে জনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ-দুঃখ-বেদনার সশব্দ বিস্ফোরণে। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্বের আন্দোলনে নয়। জনতার মিছিলে নেতাদের নেমে আসতে হয়েছে। ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটে না।
কিন্তু ইতিহাসে এমন ঘটনা যখনই ঘটেছে- ফরাসি বিপ্লবের মতো, রাশিয়ার দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনের মতো তার সমাপ্তিটা প্রায়শ প্রবাহিত হয়েছে ভিন্নখাতে। অন্য কোথাও চলে গেছে ঘটনা প্রবাহের ফসল। আর জনতাকে ফিরে যেতে হয়েছে তার পুরনো অবস্থানে। হাতুড়ি, শাবল কিংবা লাঙ্গলের পেছনে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম হল না।
●
৮৩র পাঁচ-দফার ভিত্তিতে গোটা ৮০র দশক একনায়কের বিরুদ্ধে লড়েছে জাতি। ৯০-এর পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পালাক্রমিক শাসন-অপশাসনের ২৩ বছর। মাঝখানে দুই বছরের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সবমিলিয়ে ২৫ বছরের গণতান্ত্রিক শাসনের শেষে আজকের বাংলাদেশে নিত্যদিন কী দৃশ্য দেখছি?
একদিকে তথাকথিত হরতাল-অবরোধে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস, পেট্রলবোমার আগুনে ছাই হয়ে যাচ্ছে বাস-ট্রাক-মোটরগাড়ি-সিএনজি, অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষ শিশু-বৃদ্ধ-নারী নির্বিশেষে। ঝলসে যাওয়া শরীর নিয়ে বার্ন ইউনিটে কিংবা পঙ্গু হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে সাধারণ মানুষ। দুপক্ষের ক্ষমতার যুদ্ধে যাদের অধিকাংশের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
কে বা কারা এ নারকীয় বর্বরতা চালাচ্ছে তা কেউ জানে না- কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। অপরদিকে সরকার পক্ষের লক্ষ্যহীন প্রতিরোধ এবং নিরন্তর হুংকার। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। কোথায় চলেছে দেশ? এ একটি মাত্র প্রশ্ন সবার মুখে।
পাকিস্তানের শেষ দিনগুলোতে ছিল এমন দৃশ্য। সেটা তো ছিল ভাঙনের সময়। পরস্পরকে হননের সময়।
একাত্তরে আমরা ভেঙেছি একটি দানব রাষ্ট্র। আজকের ভাঙন-হননের লক্ষ্য কী? এখন কি আমরা লাখো প্রাণের মূল্যে অর্জিত এ জাতিকেই দ্বিধাবিভক্ত করার ব্রত নিয়েছি? স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের কল্পিত, আরোপিত ও আত্মবিনাশী বিভাজনে?
আজকের এ যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে কি সেই ইতালীয় অধ্যাপকের ভাষায় বলতে হবে-
-দেশ কোথায়? জাতি কোথায়? চারদিকে দেখছি কেবল যুদ্ধরত আওয়ামী লীগ-বিএনপি- দুই নেত্রী, পেট্রলবোমা, আর ১৬ কোটি অসহায় দিশাহীন মানুষ!
●●
ক্ষমা প্রার্থনা :
২৯ জানুয়ারি যুগান্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে শীর্ষক কলামে একটি মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনে একটি জেলা ছিলর স্থলে চট্টগ্রাম জেলার অধীনে একটি মহকুমা হয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম কোনো স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ছিল না, চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনে ছিল, একথা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। এ গুরুতর ভুলের জন্য পাঠকদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
shapshin@gtlbd.com
No comments