সংকটে সংলাপ by কেএম এনায়েত হোসেন
কথায়
বলে ‘যা নেই মহাভারতে, তা নেই ভারতে’, অর্থাৎ মহাভারতে যে বিষয়ের উল্লেখ
নেই, তার অস্তিত্ব এ উপমহাদেশেই ছিল না। এ লেখার শিরোনাম ‘সংকটে সংলাপ’ও
তেমনি অবিচ্ছেদ্যভাবে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। এর অর্থ দু’ভাবে করা যায়- এক.
সংকটে পড়লে সংলাপ প্রয়োজন; দুই. সংলাপ নিজেই সংকটাপন্ন। কোন অর্থটি নিতে
হবে, সে ভার সহৃদয় পাঠকের ওপর ছেড়ে দিলাম। বিএনপি ৫ জানুয়ারি থেকে
লাগাতার অবরোধ-হরতাল পালন করছে। তাদের ভাষায় এটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের
আন্দোলন। বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্র হচ্ছে প্রায় সর্বজন
স্বীকৃত একটি শাসন ব্যবস্থা। এর সমর্থনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন
ব্রিটেনের জাঁদরেল প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র খুবই নিকৃষ্ট মানের
শাসন ব্যবস্থা, তবে এর চেয়ে ভালো আর কোনো ব্যবস্থাও দেখা যায় না।’ অতএব
গণতন্ত্রই সর্বোত্তম। এহেন গণতন্ত্র যদি খাদে পড়ে যায়, তাহলে তা উদ্ধারের
চেষ্টা একটি মহতী উদ্যোগ বটে! আর সেই মহৎ কর্মটি সাধনের জন্য বিএনপি নিরীহ
অসহায় মানুষের প্রাণ বধ করাকেই একমাত্র ধন্বন্তরি ওষুধ বলে গণ্য করছে। এ
ক’দিনের আন্দোলনে আমরা মাতৃগর্ভের শিশুসহ যুবা, বৃদ্ধ সব মিলিয়ে ৮০ জনেরও
অধিক স্বজনকে দাফন করেছি। অসংখ্য নারী-পুরুষকে বার্ন ইউনিটে যমরাজের সঙ্গে
জীবন-মরণ লড়াইয়ে লিপ্ত থাকতে দেখছি। দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপের
বাইরে চলে গেছে। দীর্ঘ ফিরিস্তি প্রদান অনাবশ্যক। কারণ এ আন্দোলনের তাপ
লাগেনি- এমন মানুষের খোঁজ মেলা ভার।
এ সুযোগে কতিপয় সুশীল ব্যক্তি মধ্যরাতের টকশোর অতিরিক্ত আরও একটি কাজ নিজ দায়িত্বে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। স্বয়ম্বর সভার আদলে নিজেদের জাতির মুরব্বি এবং বিবেকের আসনে অধিষ্ঠিত করে সংলাপ নামক সোনার হরিণটিকে কব্জা করতে গলদঘর্ম হয়ে পড়েছেন। এ কর্মকাণ্ডে তাদের সফলতাও বেশ সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তারা ইতিমধ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং আন্দোলনের নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে পত্র প্রেরণ করে প্রাথমিক সাফল্য প্রমাণ করেছেন! রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংলাপ আয়োজনের অনুরোধ পাঠানোর যৌক্তিকতা বোঝা যায়। কিন্তু খালেদা জিয়ার কাছে অনুরোধ পাঠানোর ক্লেশ স্বীকার না করলেও হয়তো চলত। কারণ তিনি তো সংলাপের সিঁড়িতে পা রেখে অনতিবিলম্বে ক্ষমতা আরোহণের জন্য এক পায়ে খাঁড়া হয়েই আছেন; নির্বিকার চিত্তে অগ্নি দেবতার সেবা করেই চলেছেন, যার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ আর তাদের যাতায়াতের বাহন। সংলাপের জন্য সুশীল ব্যক্তিবর্গের এই যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দৌড়ঝাঁপ- এর মধ্যে প্রাণের স্পন্দন, আবেগ এবং প্রচুর কর্মযোগের প্রমাণ মেলে। জাতির জন্য এটা বেশ আশাপ্রদ। অন্তত বোঝা যায়- এ জাতি এখনও মরে যায়নি। সময়ের ডাকে বিদ্যুৎগতিতে সাড়া দিতে প্রস্তুত! কিন্তু গোল বেধে যায়, যখন সমস্যার মূল কারণ বা গভীরে না গিয়ে সমস্যার খোলসটি নিয়ে অতিরিক্ত হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। হতে পারে তা আগ্রহাতিয্যের কারণে, কিংবা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের তরে। সে যাক গে, তর্কশাস্ত্রের একটি সাধারণ সূত্র হচ্ছে- where there is a smoke, there is a fire. অর্থাৎ যেখানে ধোঁয়া আছে, সেখানে অবশ্যই আগুন থাকবে। ধোঁয়া নিবারণ করতে হলে আগুন নেভাতে হবে, এটাই সত্য এবং বাস্তবতার দাবি। কিন্তু সে আগুন খুঁজতে গেলে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা মাঠে মারা যায় ভেবে তারা ধোঁয়া নিয়েই প্রলয়কাণ্ড ঘটানোটাকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে আদা-জল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষমতার চৌহদ্দি থেকে ছিটকে পড়ার দায় কেবল বিএনপিরই। সাধারণ মানুষের নয়। সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক ধারায় থাকতে হলে বিএনপিকে অবশ্যই পরবর্তী নির্বাচনের আগের সময়টুকু জনগণের সঙ্গে থাকতে হবে। আমাদের সুশীল সমাজ নিরতিশয় শ্রদ্ধার পাত্র বটে। বিশ্বাস করতে খুবই ভালো লাগবে, আমাদের মান্যবর সুশীল সমাজ বিএনপিকে মাসাধিককাল ধরে চালিয়ে আসা নারকীয়তা থেকে বিরত রাখার উদ্যোগ গ্রহণে জোর তৎপরতা শুরু করবেন এবং সংলাপ-সংলাপ করে বিএনপির অসময়োচিত, অযৌক্তিক, সর্বোপরি অসাংবিধানিক দাবিকে সমর্থন ও উৎসাহিত করা থেকে বিরত থাকবেন। যদি অধমের এ অনুরোধ আপনাদের বিরক্তির কারণ ঘটিয়ে থাকে, তা হলে শেষ আর একটি কথা বলে আমার বক্তব্যের ইতি টানব। বিগত এক মাস ধরে সারা দেশে পেট্রলবোমাবাজি করে কারা সাধারণ অসহায় মানুষদের পুড়িয়ে মারছে, তা যখন আপনারা বুঝতে পারছেন না বলে জোরালো ভাষায় তা এখনই বন্ধ করার আওয়াজটিও তুলতে পারছেন না, তখন সংলাপ-সংলাপ করে গলদঘর্ম হয়ে ছোটাছুটি করার কাজটিও আপাতত না বোঝার তালিকায় রেখে দিন। তাতে অন্তত সুশীল কথাটির অর্থ কিঞ্চিৎ হলেও সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে। অন্যথায় দহন-পীড়িত মানুষ আপনাদের অন্য কিছু ভাবলে, তাদের কি খুব একটা দোষ দেয়া যাবে?
কেএম এনায়েত হোসেন
পশ্চিম ধানমণ্ডি, ঢাকা
advocate.enayet@gmail.com
এ সুযোগে কতিপয় সুশীল ব্যক্তি মধ্যরাতের টকশোর অতিরিক্ত আরও একটি কাজ নিজ দায়িত্বে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। স্বয়ম্বর সভার আদলে নিজেদের জাতির মুরব্বি এবং বিবেকের আসনে অধিষ্ঠিত করে সংলাপ নামক সোনার হরিণটিকে কব্জা করতে গলদঘর্ম হয়ে পড়েছেন। এ কর্মকাণ্ডে তাদের সফলতাও বেশ সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তারা ইতিমধ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং আন্দোলনের নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে পত্র প্রেরণ করে প্রাথমিক সাফল্য প্রমাণ করেছেন! রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংলাপ আয়োজনের অনুরোধ পাঠানোর যৌক্তিকতা বোঝা যায়। কিন্তু খালেদা জিয়ার কাছে অনুরোধ পাঠানোর ক্লেশ স্বীকার না করলেও হয়তো চলত। কারণ তিনি তো সংলাপের সিঁড়িতে পা রেখে অনতিবিলম্বে ক্ষমতা আরোহণের জন্য এক পায়ে খাঁড়া হয়েই আছেন; নির্বিকার চিত্তে অগ্নি দেবতার সেবা করেই চলেছেন, যার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ আর তাদের যাতায়াতের বাহন। সংলাপের জন্য সুশীল ব্যক্তিবর্গের এই যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দৌড়ঝাঁপ- এর মধ্যে প্রাণের স্পন্দন, আবেগ এবং প্রচুর কর্মযোগের প্রমাণ মেলে। জাতির জন্য এটা বেশ আশাপ্রদ। অন্তত বোঝা যায়- এ জাতি এখনও মরে যায়নি। সময়ের ডাকে বিদ্যুৎগতিতে সাড়া দিতে প্রস্তুত! কিন্তু গোল বেধে যায়, যখন সমস্যার মূল কারণ বা গভীরে না গিয়ে সমস্যার খোলসটি নিয়ে অতিরিক্ত হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। হতে পারে তা আগ্রহাতিয্যের কারণে, কিংবা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের তরে। সে যাক গে, তর্কশাস্ত্রের একটি সাধারণ সূত্র হচ্ছে- where there is a smoke, there is a fire. অর্থাৎ যেখানে ধোঁয়া আছে, সেখানে অবশ্যই আগুন থাকবে। ধোঁয়া নিবারণ করতে হলে আগুন নেভাতে হবে, এটাই সত্য এবং বাস্তবতার দাবি। কিন্তু সে আগুন খুঁজতে গেলে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা মাঠে মারা যায় ভেবে তারা ধোঁয়া নিয়েই প্রলয়কাণ্ড ঘটানোটাকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে আদা-জল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষমতার চৌহদ্দি থেকে ছিটকে পড়ার দায় কেবল বিএনপিরই। সাধারণ মানুষের নয়। সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক ধারায় থাকতে হলে বিএনপিকে অবশ্যই পরবর্তী নির্বাচনের আগের সময়টুকু জনগণের সঙ্গে থাকতে হবে। আমাদের সুশীল সমাজ নিরতিশয় শ্রদ্ধার পাত্র বটে। বিশ্বাস করতে খুবই ভালো লাগবে, আমাদের মান্যবর সুশীল সমাজ বিএনপিকে মাসাধিককাল ধরে চালিয়ে আসা নারকীয়তা থেকে বিরত রাখার উদ্যোগ গ্রহণে জোর তৎপরতা শুরু করবেন এবং সংলাপ-সংলাপ করে বিএনপির অসময়োচিত, অযৌক্তিক, সর্বোপরি অসাংবিধানিক দাবিকে সমর্থন ও উৎসাহিত করা থেকে বিরত থাকবেন। যদি অধমের এ অনুরোধ আপনাদের বিরক্তির কারণ ঘটিয়ে থাকে, তা হলে শেষ আর একটি কথা বলে আমার বক্তব্যের ইতি টানব। বিগত এক মাস ধরে সারা দেশে পেট্রলবোমাবাজি করে কারা সাধারণ অসহায় মানুষদের পুড়িয়ে মারছে, তা যখন আপনারা বুঝতে পারছেন না বলে জোরালো ভাষায় তা এখনই বন্ধ করার আওয়াজটিও তুলতে পারছেন না, তখন সংলাপ-সংলাপ করে গলদঘর্ম হয়ে ছোটাছুটি করার কাজটিও আপাতত না বোঝার তালিকায় রেখে দিন। তাতে অন্তত সুশীল কথাটির অর্থ কিঞ্চিৎ হলেও সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে। অন্যথায় দহন-পীড়িত মানুষ আপনাদের অন্য কিছু ভাবলে, তাদের কি খুব একটা দোষ দেয়া যাবে?
কেএম এনায়েত হোসেন
পশ্চিম ধানমণ্ডি, ঢাকা
advocate.enayet@gmail.com
No comments