বই, বইমেলা ও আমরা by ধীরাজ কুমার নাথ
অবাধে
বিচরণ করা এবং পছন্দমতো বই কেনার মধ্য দিয়ে ফেব্রুয়ারিব্যাপী চলছে অমর
একুশে বইমেলা। এসবের মধ্যেই উৎসারিত হবে পাঠক মহলে ব্যাপক জ্ঞানের চর্চা,
প্রকাশকদের দারুণ ব্যস্ততা এবং লেখকদের হৃদয়জুড়ে উৎকণ্ঠা। এ মেলা সময়ের
পরিক্রমায় বিশ্বব্যাপী বিপুলসংখ্যক লেখক এবং প্রকাশকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে
বর্তমানে আন্তর্জাতিক মেলায় রূপলাভ করেছে। এ আমাদের অহংকার।
পৃথিবীর অনেক দেশেই বইমেলার আয়োজন করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বইমেলার আবেদন ভিন্ন। এখানে মিশে আছে প্রাণের স্পন্দন, মনের আকুতি এবং হৃদয়ের অভিব্যক্তি। অমর একুশে গ্রন্থমেলার মাঝে উদ্ভাসিত হয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক ভাবনার পরিচয়, বাংলার ঐতিহ্য। বইয়ের বাইরেও ভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং চরম আত্মত্যাগের কাহিনী মিশে আছে এ মেলার সঙ্গে। শুধু মায়ের মুখের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আত্মোৎসর্গ করা নয়, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার সূচনা হয়েছে এমনি এক অনুভূতিকে লালন করে এবং তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে। প্রতি বছর বইমেলা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ‘আ মরি বাংলা ভাষা, তোমার বোলে, তোমার কোলে, কত শান্তি ভালোবাসা।’
বর্ধমান হাউসের আঙিনায় খোলা মাঠে বটবৃক্ষের নিচে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাটের মাদুর ছড়িয়ে পুথিঘরের প্রকাশিত মাত্র ৩২টি বই নিয়ে এ বইমেলার সূচনা করেছিলেন প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহা এবং তিনিই হচ্ছেন বইমেলার অগ্রদূত। তার বই পড়ার এ আন্দোলন চলতে থাকে ১৯৭৬ সাল অবধি সহজ-সরল প্রদর্শনী হিসেবে। তিনি ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার দিয়েছিলেন, ‘বই পড়ুন, বই কিনুন, বই প্রিয়জনকে উপহার দিন।’ ‘বই কিনে কেউ দেওলিয়া হয় না’, তার এ আবেদনমূলক পোস্টার মানুষের হৃদয়কে তখন স্পর্শ করেছিল। সত্যিই তখন বিয়েশাদিতে বই উপহার দেয়ার রীতি প্রচলিত হয় দারুণভাবে। বর্তমানে বই উপহার দেয়ার প্রচলন অনেক হ্রাস পেয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
১৯৭৬ সালে আরও কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এ বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বইমেলাকে অনেক আকর্ষণীয় করে তোলে। তবে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী এ মেলার সঙ্গে বাংলা একাডেমিকে সংযুক্ত করে এ মেলার নতুন মাত্রা দেন। ১৯৮৪ সালে এ বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।
বর্তমানে এ হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় মেলা, যেখানে অংশ নেয় দেশী-বিদেশী অনেক সাহিত্যিক, কবি এবং জ্ঞানের ভুবনে বিচরণকারী অনেক প্রাজ্ঞজন। এবার যেমন এসেছে অনেক বিদেশী কবি ও সাহিত্যিক, যারা ১ ফেব্রুয়ারিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীর হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি করেছেন। বাংলায় কবিতা পড়ে এবং বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে এক আবেগের সূচনা করেছেন। মনে হয়েছে, সত্যিই আমরা পেরেছি আমাদের ২১ ফেব্রয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। আমরা গর্বিত, প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ, আবেগে উদ্বেলিত। মনে হয় আমরা আবারও মাইকেলের ভাষায় বলি, ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন, তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি, পরধনে লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ, পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষনে আচরি।’
বইয়ের প্রভাব মানুষের সামাজিক জীবনে, রাষ্ট্র পরিচালনায়, অর্থনৈতিক অঙ্গনে, শিল্প ও সাহিত্যে বিশাল প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। এমন কিছু বইয়ের কথা বলতে হয় যা বিশ্ব বিবেককে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছে এবং মানুষের ভাবনায় নতুন জগতের সূচনা করেছে। এসব বই একাধারে দর্শন, অপরদিকে দিকনির্দেশক। লিও টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ফিলজার দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’, প্লেটোর ‘দ্য রিপাবলিক’, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, ম্যাকিয়াভেলির ‘দি প্রিন্স’, কার্ল মার্কসের ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’, ডারউইনের ‘অরিজিন অব স্পেসিস’ অথবা প্রাচীন গ্রিক নাটক সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ ইত্যাদি অনেক গ্রন্থ সমগ্র বিশ্বে বংশানুক্রমে পঠিত হয়ে আসছে এবং অনেক যত্নসহকারে রক্ষিত হচ্ছে। একই বই বারবার পড়ছে মানুষ এবং সংরক্ষণ করছে অতিশয় যত্নসহকারে। এছাড়াও বাৎসায়নের ‘কামশাস্ত্র’ অথবা ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশান অব ড্রিমস’ জীবন রহস্যের অঙ্গনে অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। এসব অসামান্য ও ঐতিহাসিক বই বিশ্বে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে আলোচনার বিষয় হিসেবে শত শত বছর বিরাজ করবে।
এখানেই প্রশ্ন আসে বই-এর গুণগত মান সম্পর্কে ভাবনা। প্রতি বছর আমাদের বইমেলা উপলক্ষে অনেক বই প্রকাশিত হয়। বেশকিছু বই প্রকাশিত হয় লেখকের তাগিদে, প্রকাশকের ক্ষেত্রে প্রকাশশিল্প বা তার বাণিজ্যকে সংরক্ষণের প্রয়োজনে। অনেক বইয়ের গুণগত মান দুর্বল, ভাষাগত বিভ্রান্তিতে ভরা। আকর্ষণীয় কভার; কিন্তু ভেতরে যা আছে তা তথ্যসমৃদ্ধ নয় অথবা বলা যায় তাড়াহুড়ো করে প্রকাশের ফলে ভুল শব্দ ও বাক্যবিন্যাস থেকে গেছে। আবার অনেক উপন্যাস প্রকাশিত হয় যাকে উপন্যাসের সংজ্ঞায় আখ্যায়িত করা কঠিন হয়ে ওঠে। তবে এমনটি হতেই পারে, কারণ আমাদের দেশে মূলত অধিকাংশ বই প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে এবং একুশের বইমেলায় তার মোড়ক উন্মোচন হবে বলে।
তবে দুঃখজনক হচ্ছে, কিছু নামকরা বই থেকে পাইরেসি করে শুধু কাহিনী নয়, অনেক সময় শব্দ চয়নও ধার করা হয় যা মাঝে-মধ্যে ধরা পড়ে গিয়ে প্রকাশককে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দেয়। এক্ষেত্রে প্রকাশককে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে।
বইমেলাকে কেন্দ্র করে কবি-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিকরা ব্যস্ত সময় কাটান। জ্ঞানের ভুবনে বিচরণ করে অনেক উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে। এভাবে তারা শিল্প ও সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখতে আগ্রহী হয়ে উঠছে, যা তাদের সুস্থ মানস গঠনে সহায়ক হচ্ছে। একটা বিষয় লক্ষণীয়। বাংলাদেশে যারা প্রকাশনার জগতে নিয়োজিত অথবা এ বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা অনেকেই বড় ধরনের পুঁজি বা বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে এ ব্যবসায় আসেনি। তাদের অনেকে কোনো রকমে তাদের প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রুফ রিডার, বুক বাঁধাইকারী, কাগজ বিক্রেতা এবং অন্যান্য কর্মী এ শিল্পের ওপর নির্ভর করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করছে। সরকার বিভিন্ন সময়ে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা দিয়ে থাকে অথবা ভালো সুযোগ দেয় তাদের ব্যবসার বিকাশের লক্ষ্যে। কিন্তু প্রকাশনা শিল্পে সরকারের এমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। এই শিল্প প্রধানত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমন একটি শিল্পকে উৎসাহ প্রদান করা জাতির জন্য মঙ্গলজনক।
শুধ প্রকাশকদের স্বার্থ নয়, লেখকদের মূল্যবান গ্রন্থাদির স্বত্ব যাতে লংঘন না হয়, চৌর্যবৃত্তি যেন প্রতিভাকে অথবা প্রকাশনাকে নিরুসাহিত করতে না পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রয়োজনে বর্তমান আইনের সংশোধন করে এ সংক্রান্ত কঠোর আইন প্রণয়নের কথা ভাবতে হবে। অপরাধীকে শাস্তিদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। অনেক বই প্রকাশ করে বইপড়াকে উৎসাহিত করতে হবে।
বর্তমানে ইন্টারনেটের প্রভাবের ফলে মুদ্রণ শিল্পে ভাটা পড়ছে, লাইব্রেরিতে বই পড়ার আগ্রহ হ্রাস পেয়েছে; কিন্তু তারপরও মুদ্রিত গ্রন্থের চাহিদা কমেনি। বইপড়ার আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। গুণগত মানসম্পন্ন বই প্রকাশে অধিকতর যত্নবান হতে পারলে আমাদের বইমেলা আরও বেশি আকর্ষণীয় হবে।
ধীরাজ কুমার নাথ : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, সাবেক সচিব
dknath888@gmail.com
পৃথিবীর অনেক দেশেই বইমেলার আয়োজন করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বইমেলার আবেদন ভিন্ন। এখানে মিশে আছে প্রাণের স্পন্দন, মনের আকুতি এবং হৃদয়ের অভিব্যক্তি। অমর একুশে গ্রন্থমেলার মাঝে উদ্ভাসিত হয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক ভাবনার পরিচয়, বাংলার ঐতিহ্য। বইয়ের বাইরেও ভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং চরম আত্মত্যাগের কাহিনী মিশে আছে এ মেলার সঙ্গে। শুধু মায়ের মুখের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আত্মোৎসর্গ করা নয়, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার সূচনা হয়েছে এমনি এক অনুভূতিকে লালন করে এবং তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে। প্রতি বছর বইমেলা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ‘আ মরি বাংলা ভাষা, তোমার বোলে, তোমার কোলে, কত শান্তি ভালোবাসা।’
বর্ধমান হাউসের আঙিনায় খোলা মাঠে বটবৃক্ষের নিচে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাটের মাদুর ছড়িয়ে পুথিঘরের প্রকাশিত মাত্র ৩২টি বই নিয়ে এ বইমেলার সূচনা করেছিলেন প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহা এবং তিনিই হচ্ছেন বইমেলার অগ্রদূত। তার বই পড়ার এ আন্দোলন চলতে থাকে ১৯৭৬ সাল অবধি সহজ-সরল প্রদর্শনী হিসেবে। তিনি ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার দিয়েছিলেন, ‘বই পড়ুন, বই কিনুন, বই প্রিয়জনকে উপহার দিন।’ ‘বই কিনে কেউ দেওলিয়া হয় না’, তার এ আবেদনমূলক পোস্টার মানুষের হৃদয়কে তখন স্পর্শ করেছিল। সত্যিই তখন বিয়েশাদিতে বই উপহার দেয়ার রীতি প্রচলিত হয় দারুণভাবে। বর্তমানে বই উপহার দেয়ার প্রচলন অনেক হ্রাস পেয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
১৯৭৬ সালে আরও কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এ বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বইমেলাকে অনেক আকর্ষণীয় করে তোলে। তবে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী এ মেলার সঙ্গে বাংলা একাডেমিকে সংযুক্ত করে এ মেলার নতুন মাত্রা দেন। ১৯৮৪ সালে এ বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।
বর্তমানে এ হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় মেলা, যেখানে অংশ নেয় দেশী-বিদেশী অনেক সাহিত্যিক, কবি এবং জ্ঞানের ভুবনে বিচরণকারী অনেক প্রাজ্ঞজন। এবার যেমন এসেছে অনেক বিদেশী কবি ও সাহিত্যিক, যারা ১ ফেব্রুয়ারিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীর হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি করেছেন। বাংলায় কবিতা পড়ে এবং বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে এক আবেগের সূচনা করেছেন। মনে হয়েছে, সত্যিই আমরা পেরেছি আমাদের ২১ ফেব্রয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। আমরা গর্বিত, প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ, আবেগে উদ্বেলিত। মনে হয় আমরা আবারও মাইকেলের ভাষায় বলি, ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন, তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি, পরধনে লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ, পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষনে আচরি।’
বইয়ের প্রভাব মানুষের সামাজিক জীবনে, রাষ্ট্র পরিচালনায়, অর্থনৈতিক অঙ্গনে, শিল্প ও সাহিত্যে বিশাল প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। এমন কিছু বইয়ের কথা বলতে হয় যা বিশ্ব বিবেককে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছে এবং মানুষের ভাবনায় নতুন জগতের সূচনা করেছে। এসব বই একাধারে দর্শন, অপরদিকে দিকনির্দেশক। লিও টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ফিলজার দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’, প্লেটোর ‘দ্য রিপাবলিক’, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, ম্যাকিয়াভেলির ‘দি প্রিন্স’, কার্ল মার্কসের ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’, ডারউইনের ‘অরিজিন অব স্পেসিস’ অথবা প্রাচীন গ্রিক নাটক সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ ইত্যাদি অনেক গ্রন্থ সমগ্র বিশ্বে বংশানুক্রমে পঠিত হয়ে আসছে এবং অনেক যত্নসহকারে রক্ষিত হচ্ছে। একই বই বারবার পড়ছে মানুষ এবং সংরক্ষণ করছে অতিশয় যত্নসহকারে। এছাড়াও বাৎসায়নের ‘কামশাস্ত্র’ অথবা ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশান অব ড্রিমস’ জীবন রহস্যের অঙ্গনে অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। এসব অসামান্য ও ঐতিহাসিক বই বিশ্বে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে আলোচনার বিষয় হিসেবে শত শত বছর বিরাজ করবে।
এখানেই প্রশ্ন আসে বই-এর গুণগত মান সম্পর্কে ভাবনা। প্রতি বছর আমাদের বইমেলা উপলক্ষে অনেক বই প্রকাশিত হয়। বেশকিছু বই প্রকাশিত হয় লেখকের তাগিদে, প্রকাশকের ক্ষেত্রে প্রকাশশিল্প বা তার বাণিজ্যকে সংরক্ষণের প্রয়োজনে। অনেক বইয়ের গুণগত মান দুর্বল, ভাষাগত বিভ্রান্তিতে ভরা। আকর্ষণীয় কভার; কিন্তু ভেতরে যা আছে তা তথ্যসমৃদ্ধ নয় অথবা বলা যায় তাড়াহুড়ো করে প্রকাশের ফলে ভুল শব্দ ও বাক্যবিন্যাস থেকে গেছে। আবার অনেক উপন্যাস প্রকাশিত হয় যাকে উপন্যাসের সংজ্ঞায় আখ্যায়িত করা কঠিন হয়ে ওঠে। তবে এমনটি হতেই পারে, কারণ আমাদের দেশে মূলত অধিকাংশ বই প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে এবং একুশের বইমেলায় তার মোড়ক উন্মোচন হবে বলে।
তবে দুঃখজনক হচ্ছে, কিছু নামকরা বই থেকে পাইরেসি করে শুধু কাহিনী নয়, অনেক সময় শব্দ চয়নও ধার করা হয় যা মাঝে-মধ্যে ধরা পড়ে গিয়ে প্রকাশককে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দেয়। এক্ষেত্রে প্রকাশককে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে।
বইমেলাকে কেন্দ্র করে কবি-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিকরা ব্যস্ত সময় কাটান। জ্ঞানের ভুবনে বিচরণ করে অনেক উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে। এভাবে তারা শিল্প ও সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখতে আগ্রহী হয়ে উঠছে, যা তাদের সুস্থ মানস গঠনে সহায়ক হচ্ছে। একটা বিষয় লক্ষণীয়। বাংলাদেশে যারা প্রকাশনার জগতে নিয়োজিত অথবা এ বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা অনেকেই বড় ধরনের পুঁজি বা বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে এ ব্যবসায় আসেনি। তাদের অনেকে কোনো রকমে তাদের প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রুফ রিডার, বুক বাঁধাইকারী, কাগজ বিক্রেতা এবং অন্যান্য কর্মী এ শিল্পের ওপর নির্ভর করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করছে। সরকার বিভিন্ন সময়ে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা দিয়ে থাকে অথবা ভালো সুযোগ দেয় তাদের ব্যবসার বিকাশের লক্ষ্যে। কিন্তু প্রকাশনা শিল্পে সরকারের এমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। এই শিল্প প্রধানত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমন একটি শিল্পকে উৎসাহ প্রদান করা জাতির জন্য মঙ্গলজনক।
শুধ প্রকাশকদের স্বার্থ নয়, লেখকদের মূল্যবান গ্রন্থাদির স্বত্ব যাতে লংঘন না হয়, চৌর্যবৃত্তি যেন প্রতিভাকে অথবা প্রকাশনাকে নিরুসাহিত করতে না পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রয়োজনে বর্তমান আইনের সংশোধন করে এ সংক্রান্ত কঠোর আইন প্রণয়নের কথা ভাবতে হবে। অপরাধীকে শাস্তিদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। অনেক বই প্রকাশ করে বইপড়াকে উৎসাহিত করতে হবে।
বর্তমানে ইন্টারনেটের প্রভাবের ফলে মুদ্রণ শিল্পে ভাটা পড়ছে, লাইব্রেরিতে বই পড়ার আগ্রহ হ্রাস পেয়েছে; কিন্তু তারপরও মুদ্রিত গ্রন্থের চাহিদা কমেনি। বইপড়ার আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। গুণগত মানসম্পন্ন বই প্রকাশে অধিকতর যত্নবান হতে পারলে আমাদের বইমেলা আরও বেশি আকর্ষণীয় হবে।
ধীরাজ কুমার নাথ : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, সাবেক সচিব
dknath888@gmail.com
No comments