আমাদের আমজনতা কোথায়? by কাজল ঘোষ
চমকটা
উপমহাদেশের। টেনশনটা রাজনীতিবিদদের। ঘুণেধরা এই সমাজকে পরিবর্তনে কিভাবে
এগিয়ে আসতে পারেন এক সাধারণ মানুষ। যে কিনা মানুষের মনোভাব বুঝে রাজনীতিকে
এগিয়ে নেবেন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে সাধারণের জন্যই কাজ করবেন। পারিবারিক
উত্তরাধিকারের বুলি না আউড়ে লড়াইটা চালাবেন সবরকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
গতবছরের ফেব্রুয়ারিতে যখন প্রথম দফায় ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতিবিরোধী লোকপাল
বিল পাস করাতে পারেননি তখনই সরে দাঁড়ান। মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় এমন
সিদ্ধান্ত সবাইকে অবাক করেছিল। অনেকে পাগলও ঠাওরে ছিলেন এই বলে, ক্ষমতার
বাইরে থেকে অনেক কিছু বলা যায়। কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকা সত্যিই দুষ্কর।
এটাই ঠিক। যারা গন্ধ-পচা-দূষিত রাজনীতির প্রবাহে গা না ভাসাবেন তাদের
এভাবেই বিদায় নিতে হবে। কিন্তু না। কেজরিওয়াল তা প্রমাণ করেছেন। মাঠ
ছাড়েননি। বরং শক্ত হাতে পা বাড়িয়েছেন। মানুষকে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে
আরও শক্ত অবস্থান নিয়ে ফিরে এসেছেন। দিল্লির এই চমক বিশ্বজুড়ে আলোচনায়।
মোদির চমকের সম্মোহনী শক্তি কোনভাবেই কাবু করতে পারেনি আমজনতাকে। তাইতো
সত্তর আসনের সাতষট্টিটি বাগিয়ে নিয়েছে কেজরিওয়ালের ঝাড়–। সব ঝঞ্ঝাট ঝেঁটিয়ে
পরিষ্কার করে দেয়ার যে আওয়াজ তা উপলদ্ধিতে নিয়ে দিল্লির ভোটাররা আমূল
বদলেছেন নিজেদের। না হলে যেখানে ভোটাররা বরাবরই কংগ্রেস বা বিজেপিকে
জয়মাল্য উপহার দিয়েছে সেখানে তারাই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। সত্যিকার জনতার
প্রতিনিধিকে কাছে টেনে নিয়েছেন। কোন চমক বা বুজরুকির কাছে নিজেদের সমর্পণ
করেননি। দিল্লির মানুষ একাট্টা হয়ে বিশ্বাস করেছে কেজরিওয়ালকে। ৪৯ দিন নয়,
তারা পাঁচবছরই চায় কেজরিওয়ালকে। দিল্লির শাসন ব্যবস্থায় প্রথম দফায় জয়ী হয়ে
লোকসভা নির্বাচনে দেশজুড়ে প্রার্থী দিলে ভরাডুবি ঘটে আমজনতা পার্টির। ভুল
সুধরে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলেন। ক্ষমা চাইলেন ভোটারদের কাছে কেজরিওয়াল।
বললেন, আমার এই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আমি ক্ষমা চাইছি। এবার আমি শুধুই
দিল্লির মানুষের জন্যই লড়বো। কথা রেখেছেন, একজন সাধারণ মানুষের মতোই রাজ্য
পরিচালনা করবেন। তাইতো শপথ নিয়েছেন লাখো ভোটারকে সঙ্গে নিয়ে রামলীলার
উন্মুক্ত ময়দানে। প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ওয়াদা করেছেন প্রকাশ্যে। আগেও ফিরিয়ে
দিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। এবারও তার নড়চড় হবে না। ভিআইপি কালচারের
বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার কেজরিওয়াল। বিপুল বিজয়ের পরপরই বলেছেন, কংগ্রেস ও
বিজেপি হেরেছে অহঙ্কারের কারণে। একই মনোভাব নিলে, পাঁচ বছর পরে মানুষ
আমাদেরও একই শিক্ষা দেবেন। তাই অহঙ্কার নয়, হাতজোড় করে সেবা করতে হবে
মানুষের। I promise to be janatas chief minister and end corruption and
VIP culture. I am an ordinary man; I want to remain an ordinary man.
অনেকরকম পাগলামিই কেজরিওয়ালকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। একের পর এক
দৃষ্টান্তমূলক কার্যপ্রক্রিয়ায় আজকের কেজরিওয়াল। ক্লাসে বরাবর ভাল ফলের
অধিকারী মানুষটি অধিত বিদ্যায় নিজেকে আটকে রাখেননি। মেকানিক্যাল
ইঞ্জিনিয়ারিং শেষে যোগ দেন টাটা স্টিলের ডিজাইন বিভাগে সহকারী ব্যবস্থাপক
পদে। পরিবর্তন স্পৃহায় অল্পদিনেই নিজের দপ্তর পরিবর্তনে দর কষাকষি শুরু
করলেন কর্তৃপক্ষের কাছে। চাইলেন সোশ্যাল অফিসারের পদ। প্রত্যাখ্যাত হয়ে
কাজের আশায় ঘুরতে থাকেন নানা জায়গায়। কিছুদিন মাদার তেরেসার সঙ্গে
মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের জন্য কাজ করেন। সেখান থেকে রামকৃষ্ণ মিশনে। পরে
আইসিএস দিয়ে যোগ দেন রাজস্ব ক্যাডারে। ১৯৯২ সালে এই বিভাগে যোগ দিয়ে পরে
২০০৬ সালে চাকরি ছাড়েন অতিরিক্ত কর কমিশনার হিসেবে। চাকরিতে থাকা অবস্থাতেই
লড়াই শুরু করেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কর দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ যেন
হয়রানির শিকার না হন সে জন্য বন্ধুদের নিয়ে বিনামূল্যে মানুষের করসেবা দেয়া
শুরু করেন। সে সময় ট্যাক্স অফিসে ‘ইনকামট্যাক্স অফিসে ঘুষ দেবেন না’
ব্যানার টাঙিয়ে চারপাশে আলোচনার ঝড় তোলেন। দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে পেয়েছেন
এশিয়ার নোবেল খ্যাত র্যামন ম্যাগ সাইসাই পুরস্কার। এরপরের ইতিহাসতো অজানা
নয়। কোন মানুষের ইচ্ছাশক্তি এবং লক্ষ্য স্থির থাকলে কতদূর এগিয়ে যাওয়া যায়
তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত অরবিন্দ কেজরিওয়াল। কেজরিওয়ালের এই নাটকীয় উত্থানের
ঝড়ো হাওয়া আমাদের এখানেও আলোচনায়। বাংলাদেশের বর্তমান উদ্বেগজনক
পরিস্থিতিতে এখানের আমজনতা কোথায় মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন অনেকেই। পাশের
দেশ ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এত বেশি শক্তিশালী যেখানে একজন অরবিন্দ
কেজরিওয়ালের জন্ম হওয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের এখানে শক্তিশালী কোন
প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নেই যেখানে সাধারণ মানুষের ইচ্ছাশক্তি সংঘবব্ধ হয়ে
লড়াই করবে দেশের অনৈতিকতা, অসততা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিক
পরিস্থিতি আলোচনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। বড় দু’দলের অনড় অবস্থানের ফলে
জিম্মি সাধারণ মানুষ। গত পঁয়তাল্লিশ দিনে প্রায় নব্বই জনের ওপর মানুষের
মৃত্যু হয়েছে পেট্রলবোমার আগুনে। অসংখ্য মানুষ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের
বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছেন দগ্ধ যন্ত্রণায়। গণতন্ত্রের নামে মানুষ মৃত্যুর
মিছিলে আছে এখানে দশকের পর দশক। কতো মায়ের বুক খালি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
গণতন্ত্রের সুফল ভোগ করেছে ক্ষমতায় থাকা দলগুলোই। আর ক্ষমতায় থাকা আর
ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াইয়ে নানা কলায় সাধারণ মানুষের হা-পিত্যেশ উঠেছে বারবার।
তবু কি মানুষ এই পৈশাচিক আর বীভৎসতার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। জনগণের
অধিকারের নামে দলগুলোর ক্যাডাররাই ভাগিয়ে নিয়েছে সাধারণের সবকিছু। ক্ষমতায়
থাকার নামে লুটের মাল গিলেছে রাজনীতিকরাই। আর গরিব মানুষ তিলে তিলে নিঃস্ব
থেকে আরও নিঃস্ব হচ্ছে। অবরোধ-হরতালে দিনমজুর, শ্রমজীবী মানুষ ও কৃষকের
মাথায় হাত। তাদের হয় ভিক্ষা করতে হবে, না হলে বাঁচার তাগিদে অসৎ কোন পন্থা
বেছে নিতে হবে। অতি সম্প্রতি অক্সফাম প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, বিশ্বের
অর্ধেক মানুষের সম্পদ ১% মানুষের হাতে। আর ৮০ শতাংশ মানুষের কাছে মাত্র ৫
দশমিক ৫ ভাগ সম্পদ। এই সম্পদ ভাগিয়ে নেয়ার দৌড়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের
অবদান নিঃসন্দেহে কম না। যদিও অভিযুক্তরা দুদকের কাছ থেকে গণহারে
দায়মুক্তির সার্টিফিকেট অর্জন করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একের পর এক
বন্দুকযুদ্ধের জন্ম দিচ্ছে। একই গল্প আমরা বছরের পর বছর শুনছি। লিমনের মতো
নিরীহ মানুষ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাছে অসহায়। পেট্রলবোমার আগুনে মানুষ পুড়ে
মরছে এটাই কেবল সত্য। কিন্তু কারা মারছে এর কোন হদিস আজ পর্যন্ত করা যায়নি।
একটি ঘটনারও দৃষ্টান্ত শাস্তি কেউ পায়নি। সরকার বলছে বিরোধীদের আন্দোলন
থেকে মারা হচ্ছে। বিরোধী পক্ষ বলছে সরকারি এজেন্টরাই এ কাজ করে তাদের ওপর
দায় চাপাচ্ছে। কিন্তু আমজনতার অবস্থান কোথায়? তাদের আর কতকাল বার্ন ইউনিটে
দগ্ধ যন্ত্রণা নিয়ে কাল কাটাতে হবে? উদ্বেগ-আতঙ্কে দিন গুজরান করতে হবে?
দুনিয়ার কোথাও এই নির্মমতার ঘটনা দিনের পর দিন চলতে দিতো না। কিন্তু আমাদের
এখানে সাধারণ মানুষ এখনও রাস্তায় নামে না। হাতাশায় গুমরে মরছে কোটি কোটি
মানুষ। যারা রুখে দাঁড়ালে এই দেশটায় বদলে যেতো। হটকারি রাজনীতির কবর বহু
আগেই রচনা হতো।
No comments