অবশেষে দখলমুক্ত হল একটি মন্দির by ড. জিতেন্দ্র নাথ সরকার
১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী শহরের ঘোড়ামারা এলাকার একটি মন্দির জনৈক দখলদারের কবল থেকে মুক্তি পায় মাত্র কদিন আগে। ৩ ফেব্রুয়ারি মহাসমারোহে শুরু হয় সদ্য অবমুক্ত হওয়া মন্দির প্রাঙ্গণে পূজা-উৎসব এবং ৬ ফেব্র“য়ারি দিনব্যাপী পূজার্চনা, প্রসাদ বিতরণ ও সুদীর্ঘ আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে স্থানীয় হিন্দুদের প্রাণের আনন্দমেলা।
বোয়ালিয়া থানার একেবারে দোরগোড়ায় স্থাপিত এ মন্দিরটি ১৯৭১ সালে জনৈক দুর্বৃত্ত হঠাৎ দখল করে নেয়। তদানীন্তন প্রশাসন ছিল নীরব! স্থানীয় হিন্দুরা দুরু দুরু অন্তরে প্রতিবাদ হয়তো করেছিল; কিন্তু লাভ হয়নি তাতে। পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দুরা এমন ঘটনাকে নিয়তির পরিহাস মনে করেই ছাইয়ে-ঢাকা আগুনের মতো অন্তর্দাহ সহ্য করে এসেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে দীর্ঘ ৪৩ বছর আগে। তবু এতদিনেও দখলমুক্ত হয়নি পাঁচু মণ্ডল প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি। বহু কষ্টে চেপে-রাখা এবং বহুকালের জমাটবাঁধা হতাশা একটা দীর্ঘশ্বাসের মধ্য দিয়ে অবশেষে কেটে গেল- যেন এক দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটল।
এবার আসা যাক আলোচনা সভা প্রসঙ্গে। বড় বড় বক্তা, বিদ্বান-সুধীজন ও সম্মানিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আলোচনা সভার শোভা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছিলেন। তন্মধ্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী, সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, সাবেক ট্রাস্টি বাবু অনিল কুমার সরকার, বর্তমান ট্রাস্টি বাবু তপন সেন, খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-হিন্দু ঐক্য-পরিষদের সভাপতি প্রফেসর নিমচন্দ্র ভৌমিক, প্রফেসর ড. সুজিৎ সরকারসহ অনেক গুণীজন জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করেন। সুধী-সজ্জন শ্রোতাদের ভিড়ে মন্দির প্রাঙ্গণে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। বাঁধভাঙা মনের উচ্ছ্বসিত এ আনন্দের তুলনা হয় না।
অবমুক্ত হল বাংলাদেশের একটি মন্দির। এটি ছাড়াও রাজশাহী শহরের বিভিন্ন স্থানে অনেক প্রাচীন মন্দির-চূড়া তাদের গ্রীবা উচিয়ে জীর্ণ অস্তিত্বের ঘোষণা করছে- এখনও বেদখলে সেসব। তাদের মধ্যে শিরোইল মঠ পুকুর এলাকার শিবমন্দির, রামচন্দ্রপুর মন্দির, সপুরা সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিজ এলাকার পরিত্যক্ত কয়েকটি মন্দির অবমুক্তির প্রত্যাশায় যেন এখনও তাকিয়ে আছে আকাশে। দেশের অন্যত্রও এমন আরও কিছু মন্দির আছে।
এখনও তো বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হয়নি। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে কেন ফিরিয়ে দেয়া হয় না প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত এসব দেবালয়? তাছাড়া দেবত্তর-সম্পত্তিসহ অসংখ্য শ্মশান বেদখলে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রণীত শত্র“ সম্পত্তি আইন নানা সময়ে নানা নামে অশুভ আগ্রাসনের হাতিয়াররূপে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ সরকার এসব ক্ষেত্রে কখনও উদাসীন, কখনও নীরব ভূমিকা পালন করে আসছে।
পাকিস্তান সরকারের শত্রু সম্পত্তি আইন হিন্দুদের ভূমিহীন কৃষকে পরিণত করেছে। প্রকল্প আর উন্নয়নের নামে বেছে বেছে হিন্দু-সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে থেকে দেশব্যাপী শত শত হিন্দুর বাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যেন কিছুই করার নেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের।
গত ২৩ জানুয়ারি ঢাকায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এক মহাসমাবেশ হওয়ার কথা থাকলেও চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে তা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ওই সমাবেশের দিন ধার্য হয়েছে ১৩ মার্চ। কী সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে জানা নেই কারও। শুধু ভোটাধিকার আছে বলেই এ দেশে সংখ্যালঘু মানুষ নাগরিকত্বের দাবিদার। কিন্তু এ ভোটাধিকারের কারণেই তাদের ওপর জুলুম ও নির্যাতন নেমে আসে। বারবার তাদের জানমালের নিরাপত্তা পড়ে হুমকির মুখে। অথচ নাগরিকের কাছে খেয়ে-পরে নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার অপেক্ষাকৃত অধিক মৌলিক। ভোটাধিকার রাজনৈতিক অধিকার, যা এদেশের সংখ্যালঘু নাগরিকের কাছে এক বিড়ম্বনা মাত্র। ধর্মের অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত; কিন্তু তা উপেক্ষিত বা অনুগৃহীত। এদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘু ধর্মের কারণে; জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত শক্তি হিসেবে নয়। জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও ১৯৭১ সালে তারা ছিল সংখ্যালঘু এবং ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক হয়েও এখনও তারা সংখ্যালঘু। একটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হয়েও এ পরিচয় তাদের ঘুচবে না। ফলে উপেক্ষিত তারা সামাজিক জীবনে এবং বঞ্চিত রাজনৈতিক অধিকারে। যে একটি মাত্র রাজনৈতিক সংগঠন তাদের অন্তর্ভুক্তির দ্বার খোলা রেখেছে, সে দলেও তাদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ সীমিত। সংখ্যালঘু নাগরিকদের ভোটে তাদের দলটি ক্ষমতায় যেতে চায় এবং যায়ও। কিন্তু নির্বাচনে ভোটার সংখ্যার অনুপাতে তাদের মনোনয়ন দিলে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অসন্তোষের কারণ ঘটতে পারে; ফলে নিজ দলের ভোটারদের সমর্থন হারানোর ভয় আছে দলটির। এ বাস্তবতা প্রমাণিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন নির্বাচনে। তাই এটা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট যে, দেশের একটি দলও প্রকৃত গণতান্ত্রিক নয়। সংখ্যালঘুরা তা বোঝে এবং বুঝেসুঝেই মন্দের ভালো একটি দলকে বেছে নেয় এবং সমর্থন করে। যে দলের রাজনৈতিক আদর্শ দলের চরিত্রে প্রতিফলিত হয়নি; প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি সব দলনেতা তাদের অনুসারীদের- কী লাভ সংখ্যালঘুদের এরূপ দলকে সমর্থন করার? বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে সংখ্যালঘু নাগরিকরা দেখে আসছে তাদের দল তাদের নিরাপত্তা দিতে পারে না; পারেনি কখনও। উপরন্তু অন্য দলগুলোর কাছে তারা শত্র“ হয়ে গেছে। ফলে নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘু মানুষ বারবার হয় নির্যাতনের শিকার। ব্যক্তিগতভাবে সমর্থিত দলের কিছু নেতা তাদের বিপদে পাশে এসে দাঁড়ালেও দলগতভাবে তারা এগিয়ে আসেনি কখনও। বরং দলের কিছু সুবিধাবাদী ভণ্ড-রক্ষক বিপদে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এরূপ ঘটনা ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও ঘটেছে বলে পত্রপত্রিকায় জানা গেছে।
অতএব ১৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মহাসভায় খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংসদে প্রত্যেক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির সংখ্যা হবে তাদের নিজ নিজ জনসংখ্যার ভিত্তিতে। একটি দেশ গণতান্ত্রিক কিনা তা নির্ভর করে সে দেশে গঠিত এবং সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতান্ত্রিক মতাদর্শের ওপর। গণতান্ত্রিক সংবিধানের অনুকূলে ঢেলে সাজাতে হবে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র।
যা হোক, রাজশাহীর প্রাচীন মন্দিরটি দখলমুক্ত করার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের প্রশাসনিক পদক্ষেপ এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা সরকারের এ আন্তরিকতার জন্য কৃতজ্ঞতা ও সাধুবাদ জানাই। তবে মাত্র একটি মন্দির দখলমুক্ত হলেও হিন্দুমন দখলমুক্ত হতে এখনও বাকি- ভয়-ভীতি, আশংকা ও অবিশ্বাস হিন্দুমনে দখলদারিত্বের যে ভিত রচনা করেছে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া কি এতই সহজ! পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে মন্দির, শ্মশান আর দেবত্তর সম্পত্তি দখলে নেয়ার ধারাবাহিক মহোৎসব দেখেছে তারা; অধিকন্তু প্রশাসনিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠতে দেখেনি কোনোদিন। অদ্যাবধি মন্দির ভাংচুর এবং হিন্দু বাড়িতে হামলার মতো সহিংস ঘটনা হিন্দুরা দেখছে খুব কাছ থেকে। দেখছে, এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিচার হয়নি কোনোদিন, এখনও হয় না। সরকারকে দেখেছে এবং দেখছে নীরব! হিন্দুদের মনের মন্দির দখলমুক্ত হবে কী করে? দু-তিনটি প্রজন্ম এভাবেই কেটে গেছে হিন্দু সমাজের। তারা চায় একটা স্থায়ী নির্ভরযোগ্য সমাধান, একটি নিরাপদ বাসস্থান।
ড. জিতেন্দ্র নাথ সরকার : প্রফেসর (পিআরএল), দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বোয়ালিয়া থানার একেবারে দোরগোড়ায় স্থাপিত এ মন্দিরটি ১৯৭১ সালে জনৈক দুর্বৃত্ত হঠাৎ দখল করে নেয়। তদানীন্তন প্রশাসন ছিল নীরব! স্থানীয় হিন্দুরা দুরু দুরু অন্তরে প্রতিবাদ হয়তো করেছিল; কিন্তু লাভ হয়নি তাতে। পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দুরা এমন ঘটনাকে নিয়তির পরিহাস মনে করেই ছাইয়ে-ঢাকা আগুনের মতো অন্তর্দাহ সহ্য করে এসেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে দীর্ঘ ৪৩ বছর আগে। তবু এতদিনেও দখলমুক্ত হয়নি পাঁচু মণ্ডল প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি। বহু কষ্টে চেপে-রাখা এবং বহুকালের জমাটবাঁধা হতাশা একটা দীর্ঘশ্বাসের মধ্য দিয়ে অবশেষে কেটে গেল- যেন এক দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটল।
এবার আসা যাক আলোচনা সভা প্রসঙ্গে। বড় বড় বক্তা, বিদ্বান-সুধীজন ও সম্মানিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আলোচনা সভার শোভা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছিলেন। তন্মধ্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী, সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, সাবেক ট্রাস্টি বাবু অনিল কুমার সরকার, বর্তমান ট্রাস্টি বাবু তপন সেন, খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-হিন্দু ঐক্য-পরিষদের সভাপতি প্রফেসর নিমচন্দ্র ভৌমিক, প্রফেসর ড. সুজিৎ সরকারসহ অনেক গুণীজন জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করেন। সুধী-সজ্জন শ্রোতাদের ভিড়ে মন্দির প্রাঙ্গণে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। বাঁধভাঙা মনের উচ্ছ্বসিত এ আনন্দের তুলনা হয় না।
অবমুক্ত হল বাংলাদেশের একটি মন্দির। এটি ছাড়াও রাজশাহী শহরের বিভিন্ন স্থানে অনেক প্রাচীন মন্দির-চূড়া তাদের গ্রীবা উচিয়ে জীর্ণ অস্তিত্বের ঘোষণা করছে- এখনও বেদখলে সেসব। তাদের মধ্যে শিরোইল মঠ পুকুর এলাকার শিবমন্দির, রামচন্দ্রপুর মন্দির, সপুরা সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিজ এলাকার পরিত্যক্ত কয়েকটি মন্দির অবমুক্তির প্রত্যাশায় যেন এখনও তাকিয়ে আছে আকাশে। দেশের অন্যত্রও এমন আরও কিছু মন্দির আছে।
এখনও তো বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হয়নি। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে কেন ফিরিয়ে দেয়া হয় না প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত এসব দেবালয়? তাছাড়া দেবত্তর-সম্পত্তিসহ অসংখ্য শ্মশান বেদখলে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রণীত শত্র“ সম্পত্তি আইন নানা সময়ে নানা নামে অশুভ আগ্রাসনের হাতিয়াররূপে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ সরকার এসব ক্ষেত্রে কখনও উদাসীন, কখনও নীরব ভূমিকা পালন করে আসছে।
পাকিস্তান সরকারের শত্রু সম্পত্তি আইন হিন্দুদের ভূমিহীন কৃষকে পরিণত করেছে। প্রকল্প আর উন্নয়নের নামে বেছে বেছে হিন্দু-সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে থেকে দেশব্যাপী শত শত হিন্দুর বাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যেন কিছুই করার নেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের।
গত ২৩ জানুয়ারি ঢাকায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এক মহাসমাবেশ হওয়ার কথা থাকলেও চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে তা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ওই সমাবেশের দিন ধার্য হয়েছে ১৩ মার্চ। কী সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে জানা নেই কারও। শুধু ভোটাধিকার আছে বলেই এ দেশে সংখ্যালঘু মানুষ নাগরিকত্বের দাবিদার। কিন্তু এ ভোটাধিকারের কারণেই তাদের ওপর জুলুম ও নির্যাতন নেমে আসে। বারবার তাদের জানমালের নিরাপত্তা পড়ে হুমকির মুখে। অথচ নাগরিকের কাছে খেয়ে-পরে নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার অপেক্ষাকৃত অধিক মৌলিক। ভোটাধিকার রাজনৈতিক অধিকার, যা এদেশের সংখ্যালঘু নাগরিকের কাছে এক বিড়ম্বনা মাত্র। ধর্মের অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত; কিন্তু তা উপেক্ষিত বা অনুগৃহীত। এদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘু ধর্মের কারণে; জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত শক্তি হিসেবে নয়। জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও ১৯৭১ সালে তারা ছিল সংখ্যালঘু এবং ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক হয়েও এখনও তারা সংখ্যালঘু। একটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হয়েও এ পরিচয় তাদের ঘুচবে না। ফলে উপেক্ষিত তারা সামাজিক জীবনে এবং বঞ্চিত রাজনৈতিক অধিকারে। যে একটি মাত্র রাজনৈতিক সংগঠন তাদের অন্তর্ভুক্তির দ্বার খোলা রেখেছে, সে দলেও তাদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ সীমিত। সংখ্যালঘু নাগরিকদের ভোটে তাদের দলটি ক্ষমতায় যেতে চায় এবং যায়ও। কিন্তু নির্বাচনে ভোটার সংখ্যার অনুপাতে তাদের মনোনয়ন দিলে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অসন্তোষের কারণ ঘটতে পারে; ফলে নিজ দলের ভোটারদের সমর্থন হারানোর ভয় আছে দলটির। এ বাস্তবতা প্রমাণিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন নির্বাচনে। তাই এটা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট যে, দেশের একটি দলও প্রকৃত গণতান্ত্রিক নয়। সংখ্যালঘুরা তা বোঝে এবং বুঝেসুঝেই মন্দের ভালো একটি দলকে বেছে নেয় এবং সমর্থন করে। যে দলের রাজনৈতিক আদর্শ দলের চরিত্রে প্রতিফলিত হয়নি; প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি সব দলনেতা তাদের অনুসারীদের- কী লাভ সংখ্যালঘুদের এরূপ দলকে সমর্থন করার? বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে সংখ্যালঘু নাগরিকরা দেখে আসছে তাদের দল তাদের নিরাপত্তা দিতে পারে না; পারেনি কখনও। উপরন্তু অন্য দলগুলোর কাছে তারা শত্র“ হয়ে গেছে। ফলে নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘু মানুষ বারবার হয় নির্যাতনের শিকার। ব্যক্তিগতভাবে সমর্থিত দলের কিছু নেতা তাদের বিপদে পাশে এসে দাঁড়ালেও দলগতভাবে তারা এগিয়ে আসেনি কখনও। বরং দলের কিছু সুবিধাবাদী ভণ্ড-রক্ষক বিপদে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এরূপ ঘটনা ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও ঘটেছে বলে পত্রপত্রিকায় জানা গেছে।
অতএব ১৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মহাসভায় খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংসদে প্রত্যেক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির সংখ্যা হবে তাদের নিজ নিজ জনসংখ্যার ভিত্তিতে। একটি দেশ গণতান্ত্রিক কিনা তা নির্ভর করে সে দেশে গঠিত এবং সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতান্ত্রিক মতাদর্শের ওপর। গণতান্ত্রিক সংবিধানের অনুকূলে ঢেলে সাজাতে হবে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র।
যা হোক, রাজশাহীর প্রাচীন মন্দিরটি দখলমুক্ত করার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের প্রশাসনিক পদক্ষেপ এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা সরকারের এ আন্তরিকতার জন্য কৃতজ্ঞতা ও সাধুবাদ জানাই। তবে মাত্র একটি মন্দির দখলমুক্ত হলেও হিন্দুমন দখলমুক্ত হতে এখনও বাকি- ভয়-ভীতি, আশংকা ও অবিশ্বাস হিন্দুমনে দখলদারিত্বের যে ভিত রচনা করেছে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া কি এতই সহজ! পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে মন্দির, শ্মশান আর দেবত্তর সম্পত্তি দখলে নেয়ার ধারাবাহিক মহোৎসব দেখেছে তারা; অধিকন্তু প্রশাসনিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠতে দেখেনি কোনোদিন। অদ্যাবধি মন্দির ভাংচুর এবং হিন্দু বাড়িতে হামলার মতো সহিংস ঘটনা হিন্দুরা দেখছে খুব কাছ থেকে। দেখছে, এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিচার হয়নি কোনোদিন, এখনও হয় না। সরকারকে দেখেছে এবং দেখছে নীরব! হিন্দুদের মনের মন্দির দখলমুক্ত হবে কী করে? দু-তিনটি প্রজন্ম এভাবেই কেটে গেছে হিন্দু সমাজের। তারা চায় একটা স্থায়ী নির্ভরযোগ্য সমাধান, একটি নিরাপদ বাসস্থান।
ড. জিতেন্দ্র নাথ সরকার : প্রফেসর (পিআরএল), দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
No comments