ই-বুক এবং কাগজের বই by ফজলুল হক সৈকত
বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তির প্রয়োগে আধুনিক জীবন-ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে ব্যাপক
পরিবর্তনের হাওয়া। মানুষের আচার-আচরণ, অনুশীলন এবং চিন্তা-প্রকাশে এসেছে
নতুনত্ব; পাঠাভ্যাসে প্রবেশ করেছে ভিন্নতর ভঙ্গি। কলকারখানায় প্রযুক্তির
প্রয়োগে মানুষের কায়িক পরিশ্রমের জায়গা দখল করেছে মেশিন, রোবট প্রভৃতি।
যন্ত্র যখন উৎপাদনে সরাসরি প্রচুর কাজ করছে, স্বাভাবিক-ভাবেই বহু মানুষ তখন
বেকার হয়ে পড়ছে। তাই আধুনিক ছাপাখানায় নানান বিবর্তন পরিলক্ষিত হলেও
প্রকাশনাশিল্পের শ্রমিকদের জায়গা দিনে দিনে সংকীর্ণ করে দিচ্ছে ই-বুক বা
ইলেকট্রনিক বুক। কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং ইন্টারনেট সুবিধার কারণে বাজারে
এসেছে ই-বুক পদ্ধতি। যেন হাতের ওপরে রাখা কম্পিউটারের ভেতরে ঢুকে গেছে
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি। কেউ কেউ মনে করছেন, ই-বুক সনাতন পদ্ধতিতে
প্রকাশিত ও প্রচলিত কাগজের বই-এর বাজারকে ধ্বংস করছে নীরবে। অনেকের ধারণা
ই-বুক হাতের নাগালের মধ্যে থাকায় অগ্রসর পাঠক কাজগের বই পড়া কমিয়ে দিচ্ছে;
কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারেই পড়া ছেড়ে দিচ্ছে। তবে এর বিপরীত মেরুর কথাও
রয়েছে। এমন অনেকে আছেন, যারা ই-বুক পড়লেও কাগজে ছাপা বই-এর গন্ধ থেকে দূরে
সরে যাননি। হাতের আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় পাতা উল্টে উল্টে বই পড়ার আনন্দ থেকে
তারা নিজেকে কিছুতেই বঞ্চিত করতে চান না।
এখনও পৃথিবীর প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে রয়েছে। দেশে-দেশে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনও চালু হয়নি ডিজিটাল ক্লাসরুম। বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর দেশে তো ডিজিটাল ক্লাসরুম এখনও স্বপ্নের মতো ব্যাপার। মেগাসিটিতে হাতেগোনা কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ক্লাসরুম, মাল্টিমিডিয়া বা অনলাইন সুবিধার আওতায় এলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর কাছে আজও এগুলো অপরিচিত শব্দ। আবার সাধারণ পাঠক কিংবা ভোক্তাসমাজ বিপুলভাবে ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় আছে, তাও নয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ই-বুক একটি ধারণা মাত্র। তবে, দিনে দিনে তার প্রসার, পরিচিতি ও প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা ই-বুক ধারণাকে শক্তভাবে সমর্থন করেন, তারা বলছেন ওয়েবে বই পড়লে কাগজ কম খরচ হবে। আর যেহেতু কাগজ উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে গাছ-কাঠ প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তাই কাগজের বই না পড়লে বৃক্ষনিধন কমে আসবে।
তবে, হয়তো একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক বই ঠিকই ইলেকট্রোনিক ফরমেটে উৎপাদন করা যাবে, কিন্তু বিপুল বই থেকে যাবে কাগজে ছাপা আকারে। প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্নও দেখা দিবে সাধারণ ভোক্তার মনে। ই-বুক সমৃদ্ধ এই আধুনিক বিশ্বে কি লাইব্রেরির কোনো প্রয়োজন আছে?- যে-কোনো গ্রন্থাগারিক কিংবা কোনো সাধারণ পাঠকের কাছে এইটি একটি অতি প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসা। একটা সময় ছিল যখন বড় বড় শহরের পথের ধারে বিপুল আকারের বইয়ের দোকান দেখা যেত, কিংবা রাস্তার মোড়ে চোখে পড়তো বইয়ের বিজ্ঞাপন অথবা পোস্টার। এখন হয়তো প্রকাশকরা খুঁজছেন বেশি লাভের প্রকাশনার খাত। যে-কোনো ধরনের ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন চ্যালেঞ্জের পথ ধরে অগ্রসর হয়। প্রকাশনাশিল্পের দীর্ঘদিনের পথ-পরিক্রমার ক্ষেত্রেও এই কথাটি সত্য। পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে সমগ্র পৃথিবীতে গত কয়েক শতকে পাবলিকেশন সেক্টর নানান প্রতিবন্ধকতার পথ পারি দিয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে যদি আমরা এই প্রশ্ন করি যে, আমাদের লাইব্রেরিগুলোর কি প্রয়োজনীয় ইলেকট্রোনিক বই ক্রয় করার আর্থিক সামর্থ্য আছে? কিংবা আমাদের প্রয়োজন ও প্রত্যাশা অনুযায়ী কি গ্রন্থাগারগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে দক্ষ ও যোগ্য কর্মচারী রয়েছে? প্রতিটি লাইব্রেরিতে কি প্রচুর পরিমাণে জায়গা রয়েছে? সবগুলো লাইব্রেরি কি উপযুক্ত জায়গায় স্থাপিত? আমাদের সকল প্রতিষ্ঠানে, বিদ্যালয়ে, স্বাস্থ্য কিংবা রিসার্চ সেন্টারে অথবা সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে কি প্রয়োজন মতো সব বই আমাদের প্রকাশক বন্ধুরা সরবরাহ করতে পারছেন?
২০১১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লজ অ্যাঞ্জেলস-এ অনুষ্ঠিত টাইম ফেস্টিভ্যালে বুক প্যানেল সেশনের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় যে, মাত্র কয়েক বছরে ই-বুক রিডারের সংখ্যা অবিশ্বাস্যরকমভাবে বেড়েছে। প্যানেল মনে করছে, সহজলভ্যতা ও অপেক্ষাকৃত কম মূল্য ই-বুক-এর বাজার সম্প্রসারণের মূল কারণ। সাম্প্রতিকালের অন্য একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, গত বিশ বছরে কাগজে ছাপা বইয়ের দোকানের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। কম্পিউটার প্রযুক্তি, ইন্টারনেট এবং টেলিভিশনের ফরমেট পরিবর্তন হওয়ার ফলে যেমন কমেছে সিনেমা হল, তেমনি কমছে বইয়ের দোকানও। লোকেরা এখন ঘরে বসে সিনেমা দেখে এবং কম্পিউটারের স্ক্রিনে বই পড়ে। আর আধুনিক ও নগরবাসী ক্রেতার জন্য বাজারে বা দোকানে গিয়ে কাগজের বই কেনার চেয়ে অনলাইনে বই ক্রয় করাটা সহজ। পাঠকের কাছে বই পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ই-বুক প্রকাশকরাও পাচ্ছেন বাড়তি সুবিধা। আর প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে প্রডাকশন ফরমেটে পবির্তন আনতে পারছে ই-বুক প্রকাশকরা। যেটা কাগজে ছাপার বই প্রকাশকদের পক্ষে বেশ কঠিন ব্যাপার। তবে ই-বুক ধারণা ও পদ্ধতিটি নতুন হওয়ায় এখনও এখানে বিরাজ করছে বহু রকম সমস্যা। আর এই সমস্যাকে বাজারে নিজেদের অনুকূলে প্রচারণা হিসেবে নানানভাবে কাজে লাগাতে পারছে কাগজে ছাপা বইয়ের প্রকাশকবন্ধুরা।
লাইব্রেরি সব সময় টেকস্টকে গুরুত্ব দেয়। একটা সময় ছিল যখন আমাদের পুরনো বই খুঁজতে বাজারে যেতে হতো এবং অনেক খোঁজাখুঁজির পর হয়তো একটা ময়লাধরা ছেঁড়া-ফাটা-কাটা পুরাতন বই আমরা হাতে পেতাম। কিন্তু আজকের বিশ্বে, যখন ই-বুক ছড়িয়ে পড়েছে প্রযুক্তি বিস্তারের পথ ধরে, তখন মুহূর্তের মধ্যে আমরা ই-বুক ফরমেটে পুরনো বই (নতুনের মতোই) ডাউনলোড করতে পারছি আমাদের ডেক্সটপ, ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনে। ই-বুক কাউকে ধার দেওয়া চলে না, বিক্রিও করা যায় না। অবশ্য বন্ধুর লাইব্রেরি কিংবা পাড়ার পাঠাগারে তাকে সাজানো বইয়ের মতোও এটি নয়। আর তাই, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত নাগরিক কিংবা ওই ধরনের পরিবারের শিশুদের পক্ষে ই-বুক পড়াটা কঠিন ব্যাপার। তবে তারা অনায়াসে পাশের গণগ্রন্থাগারে গিয়ে অথবা কারো কাছ থেকে বই নিয়ে বা রাস্তা থেকে কাগজের বইয়ের ছেঁড়া পাতা কুড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু ই-বুক তো যেখানে-সেখানে সকলের নাগালের মধ্যে নেই! প্রসঙ্গত আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে, যিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন লগ কেবিনে এবং বেড়ে উঠেছিলেন প্রবল দারিদ্র্যের ভেতর দিয়ে, স্বশিক্ষিত এই লোকটি সামান্য সঞ্চয়ের বই থেকে জীবনের অনেক পাঠ নিয়েছিলেন। তাঁর সামনে ই-বুকের বিরাট ভুবন খোলা ছিল না। আমাদের দেশের জ্ঞানতাপস ঈশ্বরচন্দ বিদ্যাসাগরের কথাও আমরা মনে করতে পারি।- এঁদের জ্ঞানপিপাসা মিটিয়েছিল কাগজে ছাপা বই! অবশ্য বলা যেতে পারে- লিংকন বা বিদ্যাসাগরের যুগ এটা নয়। দিকে দিকে চলছে এখন বসন্ত ও বিদ্রোহ। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ওপর ভর করে পৃথিবী এখন দারুণ গতিতে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। বদলে যাচ্ছে পড়াশোনার মাধ্যম ও উপাদান। একুশ শতকের এই প্রবণতার প্রবাহে আমাদেরকে ‘ডিজিটাল ডিভাইস’ গ্রহণ করতে হচ্ছে একরকম নিরুপায় হয়ে। উপকার যে আমরা পাচ্ছি না, তা নয়। তবে সনাতনী গন্ধ মন থেকে মুছে ফেলতে খানিকটা সময় লাগছে, এই আর কি!
প্রখ্যাত লেখক জন পিনকিন, কিছুকাল আগে, ই-বুক বাণিজ্যের মডেল সম্বন্ধে একপ্রকারে হতাশাই ব্যক্ত করেছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন: ‘একজন লেখক হিসেবে পরিবারকে ফুলটাইম সাপোর্ট দিতে গেলে আমাকে আমার পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।’ তাঁর এই মন্তব্যের পথ ধরে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ডিজিটাল বিপ্লব কেবল ট্র্যাডিশনাল ছাপাখানার মডেলকে বিপন্ন করছে তা না, নতুন লেখকরা এখন প্রকাশকদের নজরে আসতে পারছে না। কাজেই তারা জনগণের লেখক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। ই-বুকের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের লেখক সম্প্রদায় কেবল একটা বিশেষ শ্রেণির লেখক হয়ে উঠছেন। ই-বুকের দাম কাগজে ছাপা বইয়ের চেয়ে কম হওয়ায় প্রকাশকরা লাভ করছে সামান্য। বড় বড় পাইকারি বিক্রেতারাও কিছু নির্দিষ্ট ধরনের বই ক্রয় করছে। ফলে বইয়ের বাণিজ্যটা হয়ে পড়ছে একঅর্থে সীমাবদ্ধ। ই-বুক অর্থনীতি বর্তমান প্রজন্মের লেখকদের জন্য কিছুটা ব্যথা ও ক্লান্তি বয়ে আনছে। বেস্ট সেলার বই থেকে একজন লেখক যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে পারতেন, এখন তার অর্ধেকও তিনি পাচ্ছেন না। ২০১২ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বে বিগত ২ বছরের তুলনায় ই-বুক থেকে আয়ের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে কাগজে ছাপা বইয়ের বাজারকে অতিক্রম করতে পারে ডিজিটাল বিপ্লব ও ই-বুক কনসেপ্ট।
এখনও পৃথিবীর প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে রয়েছে। দেশে-দেশে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনও চালু হয়নি ডিজিটাল ক্লাসরুম। বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর দেশে তো ডিজিটাল ক্লাসরুম এখনও স্বপ্নের মতো ব্যাপার। মেগাসিটিতে হাতেগোনা কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ক্লাসরুম, মাল্টিমিডিয়া বা অনলাইন সুবিধার আওতায় এলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর কাছে আজও এগুলো অপরিচিত শব্দ। আবার সাধারণ পাঠক কিংবা ভোক্তাসমাজ বিপুলভাবে ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় আছে, তাও নয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ই-বুক একটি ধারণা মাত্র। তবে, দিনে দিনে তার প্রসার, পরিচিতি ও প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা ই-বুক ধারণাকে শক্তভাবে সমর্থন করেন, তারা বলছেন ওয়েবে বই পড়লে কাগজ কম খরচ হবে। আর যেহেতু কাগজ উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে গাছ-কাঠ প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তাই কাগজের বই না পড়লে বৃক্ষনিধন কমে আসবে।
তবে, হয়তো একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক বই ঠিকই ইলেকট্রোনিক ফরমেটে উৎপাদন করা যাবে, কিন্তু বিপুল বই থেকে যাবে কাগজে ছাপা আকারে। প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্নও দেখা দিবে সাধারণ ভোক্তার মনে। ই-বুক সমৃদ্ধ এই আধুনিক বিশ্বে কি লাইব্রেরির কোনো প্রয়োজন আছে?- যে-কোনো গ্রন্থাগারিক কিংবা কোনো সাধারণ পাঠকের কাছে এইটি একটি অতি প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসা। একটা সময় ছিল যখন বড় বড় শহরের পথের ধারে বিপুল আকারের বইয়ের দোকান দেখা যেত, কিংবা রাস্তার মোড়ে চোখে পড়তো বইয়ের বিজ্ঞাপন অথবা পোস্টার। এখন হয়তো প্রকাশকরা খুঁজছেন বেশি লাভের প্রকাশনার খাত। যে-কোনো ধরনের ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন চ্যালেঞ্জের পথ ধরে অগ্রসর হয়। প্রকাশনাশিল্পের দীর্ঘদিনের পথ-পরিক্রমার ক্ষেত্রেও এই কথাটি সত্য। পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে সমগ্র পৃথিবীতে গত কয়েক শতকে পাবলিকেশন সেক্টর নানান প্রতিবন্ধকতার পথ পারি দিয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে যদি আমরা এই প্রশ্ন করি যে, আমাদের লাইব্রেরিগুলোর কি প্রয়োজনীয় ইলেকট্রোনিক বই ক্রয় করার আর্থিক সামর্থ্য আছে? কিংবা আমাদের প্রয়োজন ও প্রত্যাশা অনুযায়ী কি গ্রন্থাগারগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে দক্ষ ও যোগ্য কর্মচারী রয়েছে? প্রতিটি লাইব্রেরিতে কি প্রচুর পরিমাণে জায়গা রয়েছে? সবগুলো লাইব্রেরি কি উপযুক্ত জায়গায় স্থাপিত? আমাদের সকল প্রতিষ্ঠানে, বিদ্যালয়ে, স্বাস্থ্য কিংবা রিসার্চ সেন্টারে অথবা সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে কি প্রয়োজন মতো সব বই আমাদের প্রকাশক বন্ধুরা সরবরাহ করতে পারছেন?
২০১১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লজ অ্যাঞ্জেলস-এ অনুষ্ঠিত টাইম ফেস্টিভ্যালে বুক প্যানেল সেশনের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় যে, মাত্র কয়েক বছরে ই-বুক রিডারের সংখ্যা অবিশ্বাস্যরকমভাবে বেড়েছে। প্যানেল মনে করছে, সহজলভ্যতা ও অপেক্ষাকৃত কম মূল্য ই-বুক-এর বাজার সম্প্রসারণের মূল কারণ। সাম্প্রতিকালের অন্য একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, গত বিশ বছরে কাগজে ছাপা বইয়ের দোকানের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। কম্পিউটার প্রযুক্তি, ইন্টারনেট এবং টেলিভিশনের ফরমেট পরিবর্তন হওয়ার ফলে যেমন কমেছে সিনেমা হল, তেমনি কমছে বইয়ের দোকানও। লোকেরা এখন ঘরে বসে সিনেমা দেখে এবং কম্পিউটারের স্ক্রিনে বই পড়ে। আর আধুনিক ও নগরবাসী ক্রেতার জন্য বাজারে বা দোকানে গিয়ে কাগজের বই কেনার চেয়ে অনলাইনে বই ক্রয় করাটা সহজ। পাঠকের কাছে বই পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ই-বুক প্রকাশকরাও পাচ্ছেন বাড়তি সুবিধা। আর প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে প্রডাকশন ফরমেটে পবির্তন আনতে পারছে ই-বুক প্রকাশকরা। যেটা কাগজে ছাপার বই প্রকাশকদের পক্ষে বেশ কঠিন ব্যাপার। তবে ই-বুক ধারণা ও পদ্ধতিটি নতুন হওয়ায় এখনও এখানে বিরাজ করছে বহু রকম সমস্যা। আর এই সমস্যাকে বাজারে নিজেদের অনুকূলে প্রচারণা হিসেবে নানানভাবে কাজে লাগাতে পারছে কাগজে ছাপা বইয়ের প্রকাশকবন্ধুরা।
লাইব্রেরি সব সময় টেকস্টকে গুরুত্ব দেয়। একটা সময় ছিল যখন আমাদের পুরনো বই খুঁজতে বাজারে যেতে হতো এবং অনেক খোঁজাখুঁজির পর হয়তো একটা ময়লাধরা ছেঁড়া-ফাটা-কাটা পুরাতন বই আমরা হাতে পেতাম। কিন্তু আজকের বিশ্বে, যখন ই-বুক ছড়িয়ে পড়েছে প্রযুক্তি বিস্তারের পথ ধরে, তখন মুহূর্তের মধ্যে আমরা ই-বুক ফরমেটে পুরনো বই (নতুনের মতোই) ডাউনলোড করতে পারছি আমাদের ডেক্সটপ, ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনে। ই-বুক কাউকে ধার দেওয়া চলে না, বিক্রিও করা যায় না। অবশ্য বন্ধুর লাইব্রেরি কিংবা পাড়ার পাঠাগারে তাকে সাজানো বইয়ের মতোও এটি নয়। আর তাই, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত নাগরিক কিংবা ওই ধরনের পরিবারের শিশুদের পক্ষে ই-বুক পড়াটা কঠিন ব্যাপার। তবে তারা অনায়াসে পাশের গণগ্রন্থাগারে গিয়ে অথবা কারো কাছ থেকে বই নিয়ে বা রাস্তা থেকে কাগজের বইয়ের ছেঁড়া পাতা কুড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু ই-বুক তো যেখানে-সেখানে সকলের নাগালের মধ্যে নেই! প্রসঙ্গত আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে, যিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন লগ কেবিনে এবং বেড়ে উঠেছিলেন প্রবল দারিদ্র্যের ভেতর দিয়ে, স্বশিক্ষিত এই লোকটি সামান্য সঞ্চয়ের বই থেকে জীবনের অনেক পাঠ নিয়েছিলেন। তাঁর সামনে ই-বুকের বিরাট ভুবন খোলা ছিল না। আমাদের দেশের জ্ঞানতাপস ঈশ্বরচন্দ বিদ্যাসাগরের কথাও আমরা মনে করতে পারি।- এঁদের জ্ঞানপিপাসা মিটিয়েছিল কাগজে ছাপা বই! অবশ্য বলা যেতে পারে- লিংকন বা বিদ্যাসাগরের যুগ এটা নয়। দিকে দিকে চলছে এখন বসন্ত ও বিদ্রোহ। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ওপর ভর করে পৃথিবী এখন দারুণ গতিতে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। বদলে যাচ্ছে পড়াশোনার মাধ্যম ও উপাদান। একুশ শতকের এই প্রবণতার প্রবাহে আমাদেরকে ‘ডিজিটাল ডিভাইস’ গ্রহণ করতে হচ্ছে একরকম নিরুপায় হয়ে। উপকার যে আমরা পাচ্ছি না, তা নয়। তবে সনাতনী গন্ধ মন থেকে মুছে ফেলতে খানিকটা সময় লাগছে, এই আর কি!
প্রখ্যাত লেখক জন পিনকিন, কিছুকাল আগে, ই-বুক বাণিজ্যের মডেল সম্বন্ধে একপ্রকারে হতাশাই ব্যক্ত করেছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন: ‘একজন লেখক হিসেবে পরিবারকে ফুলটাইম সাপোর্ট দিতে গেলে আমাকে আমার পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।’ তাঁর এই মন্তব্যের পথ ধরে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ডিজিটাল বিপ্লব কেবল ট্র্যাডিশনাল ছাপাখানার মডেলকে বিপন্ন করছে তা না, নতুন লেখকরা এখন প্রকাশকদের নজরে আসতে পারছে না। কাজেই তারা জনগণের লেখক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। ই-বুকের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের লেখক সম্প্রদায় কেবল একটা বিশেষ শ্রেণির লেখক হয়ে উঠছেন। ই-বুকের দাম কাগজে ছাপা বইয়ের চেয়ে কম হওয়ায় প্রকাশকরা লাভ করছে সামান্য। বড় বড় পাইকারি বিক্রেতারাও কিছু নির্দিষ্ট ধরনের বই ক্রয় করছে। ফলে বইয়ের বাণিজ্যটা হয়ে পড়ছে একঅর্থে সীমাবদ্ধ। ই-বুক অর্থনীতি বর্তমান প্রজন্মের লেখকদের জন্য কিছুটা ব্যথা ও ক্লান্তি বয়ে আনছে। বেস্ট সেলার বই থেকে একজন লেখক যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে পারতেন, এখন তার অর্ধেকও তিনি পাচ্ছেন না। ২০১২ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বে বিগত ২ বছরের তুলনায় ই-বুক থেকে আয়ের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে কাগজে ছাপা বইয়ের বাজারকে অতিক্রম করতে পারে ডিজিটাল বিপ্লব ও ই-বুক কনসেপ্ট।
No comments