পুড়ছে স্বপ্ন আর সম্ভাবনা- হরতাল–অবরোধে ১৩ দিনে বার্ন ইউনিটে মোট ভর্তি ২৫ by শেখ সাবিহা আলম
(৫ জানুয়ারির পর অবরোধ ও হরতাল চলাকালে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে দগ্ধ রোগীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে l ছবি: প্রথম আলো) ওঁদের
কেউ সংসারের বাড়তি খরচ জোগাতে নিজেই সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায়
নেমেছিলেন, কেউ কেউ গোটা পরিবারের আয়ের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু অবরোধের
আগুনে পুড়ে তাঁদের ঠিকানা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট।
গতকাল শনিবার বার্ন ইউনিটে দেখা যায়, কারও মুখে, কারও হাতে, কারও প্রায়
সমস্ত শরীরে পোড়া ক্ষত। আগুনে কেবল তাঁদের শরীরই পোড়েনি, পুড়ছে স্বপ্ন
আর সম্ভাবনা। বার্ন ইউনিটে ৫ জানুয়ারি থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত
হরতাল-অবরোধে দেওয়া পেট্রলবোমা ও আগুনে পুড়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৫ জন। এর
মধ্যে বর্তমানে ভর্তি আছেন ১০ জন, আর মারা গেছেন দুজন। তাঁরা হলেন আবুল
কালাম হাওলাদার ও মো. সিদ্দিক।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অবৈতনিক উপদেষ্টা সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেছেন, ভর্তি রোগীদের কেউ শঙ্কামুক্ত নন। তাঁদের বেশির ভাগ শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। শ্বাসনালি পুড়ে গেলে ফুলে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হয়। কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হলেও অনেকে আর বাঁচে না। শরীরের অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও পুড়ে গেছে এঁদের।
বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, হরতাল-অবরোধের আগুনে পোড়া মানুষের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসকদের আলাদা একটি দল গঠন করা হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে পুড়ে যাওয়া মানুষকে ১০-১৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বজনেরা বলছেন, সরকার সাহায্য করছে বটে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।
গতকাল শনিবার বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, এখন সবচেয়ে সংকটময় অবস্থায় আছেন মো. সেলিম। তাঁর শরীরের ৩৬ শতাংশ পুড়ে গেছে। পেশায় হিউম্যান হলার (লেগুনা) চালক। ১৫ বছর ধরে লেগুনা চালান। ১১ জানুয়ারি মুগদা থেকে মতিঝিলে যাচ্ছিলেন। এ সময় পেট্রলবোমার আগুনে তাঁর মুখ, বুক, হাত-পা, পিঠ সব পুড়ে গেছে। সেলিমের ভাই মো. সবুজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যের গাড়ি আর চালাইব না কইরা কিস্তিতে লেগুনাটা কিনছিল। সপ্তাহে কিস্তির টাকা দিতেই হইব। এ মাসে খরচা বাড়ছে ভাইস্তারে স্কুলে ভর্তির জন্য। টানাটানিতে পইড়া গেছিল। এখন জান যায়।’
ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের সামনে পুড়েছেন মো. সিদ্দিক। তাঁর তিন সন্তান। দুই ছেলে, এক মেয়ে। নতুন বছরের শুরুতে মেয়েকে ভর্তি করাতে হবে, স্কুলের পোশাক বানাতে হবে, ঋণ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কিনেছেন। এত চাপ সামলাতে সিদ্দিককে গাড়ি নিয়ে নামতে হয়েছিল। সিদ্দিকের স্ত্রী শরীফা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, গাড়ি পোড়া আর মানুষ পোড়া কি এক হইল? গাড়ির তো জান নাই, মানুষের তো জান আছে।’ তাঁর স্বামীর মাথা, গোটা মুখ, কান, গলা, দুই হাত পুড়ে গেছে। পুড়েছে শ্বাসতন্ত্রসহ শরীরের ১৭ শতাংশ। গাড়িতে যাত্রী ছিলেন না। দুর্বৃত্তরা ফাঁকা গাড়িতেই আগুন দিয়েছে। ঘটনাটি ঘটে ৫ জানুয়ারি।
শরীফা জানালেন, সমিতি থেকে টাকা উঠিয়ে অটোরিকশা কিনেছিলেন সিদ্দিক। মাত্র ৩০ হাজার টাকা শোধ হয়েছে।
সিদ্দিক পুড়েছেন, কবে সুস্থ হবেন জানা নেই। এ সংসারটা কীভাবে চলবে, তাও জানেন না তাঁর স্ত্রী।
পুড়ে যাওয়া ট্রাকচালক পিয়ার আহমেদের অবস্থা আরও করুণ। তাঁর স্ত্রী বলছিলেন, ‘মানুষটা তো বুড়া হই গ্যাছে। কিন্তু কী করব? হাওলাদ করি ছেলেরে দুবাই ফাটাইচিল। এক বছর পর ছেলে ফিরি আসছে। হাওলাদ ফুরা দিই দিতে ফারি নাই।’
১১ জানুয়ারি পিয়ার আহমেদ ট্রাক নিয়ে ঢাকার দিকে আসছিলেন। লাকসামে তাঁর চোখে টর্চ লাইটের আলো ফেলে ছেলের বয়সী ছেলেরা গাড়ি থামিয়ে আগুন দেয়। বিস্ময়ে হতবাক পিয়ার। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পান না। পিয়ারের পুড়েছে শরীরের ১৫ শতাংশ।
১০ জানুয়ারি পুড়েছেন রিকশাচালক অমূল্য চন্দ্র বর্মণ। এক মাস চার দিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন পঞ্চগড় থেকে। বাড়িতে কাজ নেই। তিন ছেলে স্কুলে পড়ে। টাকা জমিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন। বাড়ি পৌঁছানোর আগেই লোকজন ধরাধরি করে পৌঁছে দিয়ে গেছেন বার্ন ইউনিটে।
১৩ জানুয়ারি কুড়িগ্রামে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে বগুড়ায় বাসে পেট্রলবোমা মারে দুর্বৃত্তরা। তখন রাত একটা। স্বপ্না বেগমের পুরো মুখ পুড়ে যায়। এখন একটু ভালোর দিকে। তিনি ঢাকায় একটি বাসায় কাজ করেন। স্বামী মো. বাদশাকে মুঠোফোনে ছবি তুলে দেখাতে বলেছিলেন। নিজের মুখচ্ছবি দেখে হা-হুতাশ করছেন।
স্বপ্নার পাশেই রংপুরের মিঠাপুকুরে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ মিনারা বেগম ভর্তি আছেন। মিনারার সঙ্গে বার্ন ইউনিটে আসার পথেই একজন মারা যান। সেই ঘটনা মনে করিয়ে স্বামী সান্ত্বনা দেন স্বপ্নাকে, ‘প্রাণে তো বেঁচে গেছ। কত লোকে তো মরে যায়। তোমার তো শুধু মুখটা।’
মো. বাদশা বলেন, ‘মানুষ পুড়লে কি সমস্যার সমাধান হবে? হলে কবে? শুধু একজন অন্যজনের ওপর দোষ চাপায়। আমরা তো আর পারতেছি না। শক্তি থাকতে হবে তো।’
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অবৈতনিক উপদেষ্টা সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেছেন, ভর্তি রোগীদের কেউ শঙ্কামুক্ত নন। তাঁদের বেশির ভাগ শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। শ্বাসনালি পুড়ে গেলে ফুলে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হয়। কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হলেও অনেকে আর বাঁচে না। শরীরের অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও পুড়ে গেছে এঁদের।
বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, হরতাল-অবরোধের আগুনে পোড়া মানুষের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসকদের আলাদা একটি দল গঠন করা হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে পুড়ে যাওয়া মানুষকে ১০-১৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বজনেরা বলছেন, সরকার সাহায্য করছে বটে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।
গতকাল শনিবার বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, এখন সবচেয়ে সংকটময় অবস্থায় আছেন মো. সেলিম। তাঁর শরীরের ৩৬ শতাংশ পুড়ে গেছে। পেশায় হিউম্যান হলার (লেগুনা) চালক। ১৫ বছর ধরে লেগুনা চালান। ১১ জানুয়ারি মুগদা থেকে মতিঝিলে যাচ্ছিলেন। এ সময় পেট্রলবোমার আগুনে তাঁর মুখ, বুক, হাত-পা, পিঠ সব পুড়ে গেছে। সেলিমের ভাই মো. সবুজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যের গাড়ি আর চালাইব না কইরা কিস্তিতে লেগুনাটা কিনছিল। সপ্তাহে কিস্তির টাকা দিতেই হইব। এ মাসে খরচা বাড়ছে ভাইস্তারে স্কুলে ভর্তির জন্য। টানাটানিতে পইড়া গেছিল। এখন জান যায়।’
ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের সামনে পুড়েছেন মো. সিদ্দিক। তাঁর তিন সন্তান। দুই ছেলে, এক মেয়ে। নতুন বছরের শুরুতে মেয়েকে ভর্তি করাতে হবে, স্কুলের পোশাক বানাতে হবে, ঋণ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কিনেছেন। এত চাপ সামলাতে সিদ্দিককে গাড়ি নিয়ে নামতে হয়েছিল। সিদ্দিকের স্ত্রী শরীফা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, গাড়ি পোড়া আর মানুষ পোড়া কি এক হইল? গাড়ির তো জান নাই, মানুষের তো জান আছে।’ তাঁর স্বামীর মাথা, গোটা মুখ, কান, গলা, দুই হাত পুড়ে গেছে। পুড়েছে শ্বাসতন্ত্রসহ শরীরের ১৭ শতাংশ। গাড়িতে যাত্রী ছিলেন না। দুর্বৃত্তরা ফাঁকা গাড়িতেই আগুন দিয়েছে। ঘটনাটি ঘটে ৫ জানুয়ারি।
শরীফা জানালেন, সমিতি থেকে টাকা উঠিয়ে অটোরিকশা কিনেছিলেন সিদ্দিক। মাত্র ৩০ হাজার টাকা শোধ হয়েছে।
সিদ্দিক পুড়েছেন, কবে সুস্থ হবেন জানা নেই। এ সংসারটা কীভাবে চলবে, তাও জানেন না তাঁর স্ত্রী।
পুড়ে যাওয়া ট্রাকচালক পিয়ার আহমেদের অবস্থা আরও করুণ। তাঁর স্ত্রী বলছিলেন, ‘মানুষটা তো বুড়া হই গ্যাছে। কিন্তু কী করব? হাওলাদ করি ছেলেরে দুবাই ফাটাইচিল। এক বছর পর ছেলে ফিরি আসছে। হাওলাদ ফুরা দিই দিতে ফারি নাই।’
১১ জানুয়ারি পিয়ার আহমেদ ট্রাক নিয়ে ঢাকার দিকে আসছিলেন। লাকসামে তাঁর চোখে টর্চ লাইটের আলো ফেলে ছেলের বয়সী ছেলেরা গাড়ি থামিয়ে আগুন দেয়। বিস্ময়ে হতবাক পিয়ার। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পান না। পিয়ারের পুড়েছে শরীরের ১৫ শতাংশ।
১০ জানুয়ারি পুড়েছেন রিকশাচালক অমূল্য চন্দ্র বর্মণ। এক মাস চার দিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন পঞ্চগড় থেকে। বাড়িতে কাজ নেই। তিন ছেলে স্কুলে পড়ে। টাকা জমিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন। বাড়ি পৌঁছানোর আগেই লোকজন ধরাধরি করে পৌঁছে দিয়ে গেছেন বার্ন ইউনিটে।
১৩ জানুয়ারি কুড়িগ্রামে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে বগুড়ায় বাসে পেট্রলবোমা মারে দুর্বৃত্তরা। তখন রাত একটা। স্বপ্না বেগমের পুরো মুখ পুড়ে যায়। এখন একটু ভালোর দিকে। তিনি ঢাকায় একটি বাসায় কাজ করেন। স্বামী মো. বাদশাকে মুঠোফোনে ছবি তুলে দেখাতে বলেছিলেন। নিজের মুখচ্ছবি দেখে হা-হুতাশ করছেন।
স্বপ্নার পাশেই রংপুরের মিঠাপুকুরে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ মিনারা বেগম ভর্তি আছেন। মিনারার সঙ্গে বার্ন ইউনিটে আসার পথেই একজন মারা যান। সেই ঘটনা মনে করিয়ে স্বামী সান্ত্বনা দেন স্বপ্নাকে, ‘প্রাণে তো বেঁচে গেছ। কত লোকে তো মরে যায়। তোমার তো শুধু মুখটা।’
মো. বাদশা বলেন, ‘মানুষ পুড়লে কি সমস্যার সমাধান হবে? হলে কবে? শুধু একজন অন্যজনের ওপর দোষ চাপায়। আমরা তো আর পারতেছি না। শক্তি থাকতে হবে তো।’
No comments