রাজনৈতিক সহিংসতা: দগ্ধ মানুষের কথা
বাংলাদেশে
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গেলে এখন চোখে পড়বে পায়ে,
শরীরে, মুখমণ্ডলে সাদা ব্যান্ডেজে মোড়া বহু রোগী। এক একটি মানুষ যেন এক
একটি জীবন্ত মমি। গত ১২ দিনের রাজনৈতিক হানাহানির মধ্যে রাস্তায় বা
গাড়িতে অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছেন তারা। গত ১২ দিনে প্রতিদিনই বাংলাদেশের
বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যানবাহনে অগ্নিসংযোগের খবর এসেছে। আজও রাজধানী ঢাকার
পুরনো অংশে দুটি যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এসব ঘটনায় দগ্ধ
অনেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের অনেকের
অবস্থাই গুরুতর। নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে যারা সজ্ঞানে আছেন মাঝে মধ্যেই
তাদের যন্ত্রনাকাতর চীৎকার শোনা যায়ে। দগ্ধদের কজন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা
নিচ্ছেন রাজশাহীর আবু বক্কর সিদ্দিক। পেশায় ট্রাকচালক। গত বৃহস্পতিবার
সন্ধ্যায় একটি খাদ্যপন্যবোঝাই ট্রাক নিয়ে উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকায় আসছিলেন
তিনি। পথে সিরাজগঞ্জে হামলার শিকার হয় তার চলন্ত ট্রাকটি। “সন্ধ্যা সাড়ে
সাতটা। আমার ট্রাক চলছে। হঠাৎ দেখলাম পাশে জঙ্গলের মধ্যে থেকে একদল ছেলে
এসে একটি আগুন বোমা ছুড়ে মারল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকে এবং আমার গায়ে আগুন
ধরে গেল। আমি ট্রাক নামিয়ে দিলাম পাশের রাস্তায়। ট্রাক উল্টে গেল। আমার
গায়ে সব শীতের পোশাকে আগুন ধরে গেল। আমি উপরের জ্যাকেট খুলতে পারলাম।
ততক্ষণে আমার মাথার মাফলারে আগুন ধরে গেছে।” সিদ্দিকের শরীরের শতকরা নব্বই
ভাগই আগুনে পুড়ে গেছে। তিনি তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে পরিবার। সন্তানেরা স্কুলে পড়ে। তিনি যেদিন
বার্ন ইউনিটে এসেছেন, সেদিনই তার পাশের বিছানার রোগী আবুল কালাম আজাদের
মৃত্যু হয়েছে। পেশায় তিনি ছিলেন একজন ব্যক্তিগত গাড়িচালক। কয়েকদিন আগেই
মগবাজার এলাকায় তার গাড়িটিতে অগ্নিসংযোগ করার পর তিনি দগ্ধ হয়েছিলেন।
দুরপাল্লার বাসে পেট্রোল বোমায় পুড়ে গেছেন স্বপ্না বেগম (ডানে) এবং
মিনারা নিবিড় পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের পাশেই পোস্ট অপারেটিভ বা অস্ত্রোপচার
পরবর্তী কক্ষে রয়েছেন স্বপ্না বেগম। অস্ত্রোপচারের পড় তিনি আশঙ্কামুক্ত।
মুখের ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে। দগদগে ঘা সেখানে। চোখ খুলতে পারছেন না।
গাড়িচালক স্বামীর রোজগারে ঢাকায় সংসার চালানো কষ্ট, তাই বাসাবাড়িতে কাজ
করতেন স্বপ্না। মেয়ে আর জামাইকে নিয়ে বাবার বাড়ী কুড়িগ্রামের
ভূরুঙ্গামারীতে বেড়িয়ে বাসে করে ঢাকায় ফিরছিলেন তিনি। এ সময়ে চলন্ত
বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে দুষ্কৃতিকারীরা। বার্ন ইউনিটে রাজনৈতিক
সহিংসতার কারণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে যে এগারোজন মানুষ এখন চিকিৎসাধীন আছেন তাদের
সবারই কমবেশি একই রকম গল্প। 'সারা শরীরে মরিচের জ্বালা' ঢাকার কমলাপুরে
একটি লেগুনায় অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দগ্ধ মোহাম্মদ সেলিম বলছিলেন, "“সারা
গায়ে মরিচের মত জ্বলে।এখন আর চিৎকার করার শক্তিও পাই না। আপনার সঙ্গে কথা
বলছি, কিন্তু সারা শরীরে বেদনা’। দগ্ধ সেলিমের পাশে বসে ছিলেন উৎকণ্ঠিত তার
মা রহিমা বেগম। এক মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে লেগুনাটি কিনে
দিয়েছিলেন সেলিমকে। প্রতি সপ্তাহে ঋণের কিস্তি দিতে হয়। গত রবিবারের
হামলায় তার লেগুনাটি ভস্মীভূত হয়ে গেছে। সেলিম যখন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন
ইউনিটে চিকিৎসাধীন, তখন গত সপ্তাহেই কিস্তির জন্য তাদের বাড়িতে এসে
কয়েকবার ঘুরে গেছেন মহাজন।
No comments