গোবিন্দ হালদার আর নেই by পরিতোষ পাল
মুক্তিযুদ্ধের
প্রেরণা সৃষ্টিকারী অসংখ্য গানের রচয়িতা কবি ও সুরকার গোবিন্দ হালদার (৮৫)
আর নেই। দীর্ঘ রোগে ভোগার পর তিনি গতকাল সকাল ১১টায় কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগ করেন। কলকাতার মানিকতলায় জিতেন্দ্র নারায়ণ রায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন
গোবিন্দ হালদার। তিনি একমাত্র কন্যা ও স্ত্রীকে রেখে গেছেন। এদিনই নীমতলা
শ্মশানে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের
সর্বজন প্রশংসিত গীতিকার ও সুরকার গোবিন্দ হালদার দীর্ঘদিন ধরে কিডনি,
চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ
করি’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘লেফট রাইট
লেফট রাইট’, ‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘চলো বীর সৈনিক’
প্রভৃতি গানের রচয়িতা গোবিন্দ হালদারকে শেষ জীবনে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে
কাটাতে হয়েছে। একসময় তিনি আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন। গত মাসে হাসপাতালে
তিনি ভর্তি রয়েছেন জানতে পেরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে
ফোন করে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার কথা জানিয়েছিলেন। এর আগেও বাংলাদেশ
সরকার তাকে ১৫ লাখ রুপি সহায়তা দিয়েছিল। গত মাসে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ
কলকাতা সফরে হাসপাতালে গিয়ে তাকে দেখে এসেছিলেন। ওই সময় প্রেসিডেন্ট
গোবিন্দ হালদারকে বলেন, আপনি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধে আপনার বড় ভূমিকা ছিল। আপনার অনেক গান মুক্তিযোদ্ধাদের
অনুপ্রাণিত করেছে। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি
হিসেবে ২০১২ সালে বরেণ্য এ গীতিকারকে ‘মুক্তিযোদ্ধা মৈত্রী সম্মাননা’ দিয়ে
সম্মানিত করে। গোবিন্দ হালদারের জন্ম ১৯৩০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি,
পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয়। একসময় বনগাঁ থেকে চাকরি সূত্রে কলকাতায় চলে এসেছিলেন
তিনি। অসামান্য কবিমনের এ মানুষটি মুক্তিযুদ্ধের সময় আপন মনেই আবেগের বশে
লিখেছিলেন বেশ কিছু কবিতা ও গান। জয় বাংলার গান হিসেবে চিহ্নিত সেই
গানগুলোই তাকে পরিণত করেছিল একজন বিপ্লবী গীতিকার হিসেবে। তার সেই গান
যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা হয়ে উঠেছিল। কলকাতার বুকে স্থাপিত
গোপন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গোবিন্দ হালদারের সেই
কালজয়ী গানগুলো সে সময় মানুষকে যেমন আলোড়িত করেছিল, তেমনি আজও মানুষকে মনে
করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা। মুক্তিযুদ্ধের অমর এ গীতিকারকে
স্বাধীন বাংলা বেতারের পরিচালক কামাল লোহানী খুঁজে পেয়েছিলেন তার বন্ধু
কামাল আহমেদের মাধ্যমে। সেদিনের তরুণ গোবিন্দ ৩০টি গান লেখা ‘জয় বাংলার
গান’ নামে দুটি খাতা তুলে দিয়েছিলেন কামাল লোহানীর হাতে। বাকিটা ইতিহাস।
তবে গোবিন্দ হালদারের একসময় আফসোস করেছেন এই বলে, বাংলাদেশ বেতারে তার
কালজয়ী গানগুলো প্রচারিত হলেও সেগুলোতে তাকে স্বীকৃতি দেয়া হয় নি। ১৯৭২
সালে এ অভিযোগ নিয়ে তিনি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। সে সময় বেতার কর্তৃপক্ষের
সঙ্গে তার একটি চুক্তিও হয়েছিল যে, তার গানের সঙ্গে তার নামও প্রচার করা
হবে। পরে সেই চুক্তি অনুযায়ী তার নাম গানের সঙ্গে প্রচার করা হলেও তিনি এ
গান প্রচার বাবদ কোন রয়্যালটি পান নি কোন দিন। এদিকে গোবিন্দ হালদারের
মৃত্যুতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ
করেছেন। তিনি গোবিন্দ হালদারের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার
শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্য, ভক্ত ও গুণগ্রাহীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
অন্যদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য
চয়ন ইসলাম এবং কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আওলাদ হোসেন রুহুল
গোবিন্দ হালদারের পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাতে হাসপাতালে যান।
No comments