চাই দলনিরপেক্ষ বিবেকের প্রতিধ্বনি by মাহমুদুল বাসার
সব হৃদয়বিদারক ঘটনার সঙ্গে আমরা একমত হতে
পারি না। কারণ রাজনৈতিক চেতনা আমাদের এক চোখ কেড়ে নিয়েছে। শিশু জিহাদের
বেলায় আমরা দুই চোখ মেলে দিতে পেরেছি বলে সবাই কেঁদেছি, আক্ষেপ করেছি,
সরকারি প্রশাসনযন্ত্র ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছি।
এমনকি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ কামনাও করেছি। আমরা এমনই একটা দেশে
বসবাস করছি যে, হৃদয়বিদারক ঘটনা মোটে থামতে চায় না। যেদিন ২০ দল হরতাল
পালন করল, সেদিন দুজন অসহায় নারী বর্বরোচিত হামলার শিকার হয়েছেন। কাকতালীয়
হলেও দুজনেরই নামই শামসুন্নাহার। কী অপরাধ ছিল এ দুই মহিলার? দুজনই
শিক্ষিকা। দুষ্কৃতকারীদের হামলায় একজন নিহত হয়েছেন, অন্যজন মৃত্যুর সঙ্গে
লড়ছেন।
মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষিকা শামসুন্নাহার বেগম ঝর্ণা নোয়াখালীতে হরতালকারীদের ছোড়া ইটের আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আর দুই সন্তানের জননী আরেক শামসুন্নাহার রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়ায় সিএনজিতে দুষ্কৃতকারীদের দেয়া আগুনে দুই সন্তানসহ এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। কাজীপাড়ার শামসুন্নাহারের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে অয়ন আর কলেজ পড়ুয়া মেয়ে আনিকা মায়ের সঙ্গেই সিএনজির আগুনে দগ্ধ।
কোনো মৃত্যুই আনন্দদায়ক নয়, হৃদয়বিদারক। কিন্তু সব হৃদয়বিদারক ঘটনার সঙ্গে আমরা সমানভাবে জিহাদের ঘটনার মতো আবেগপ্রবণ ও ক্ষুব্ধ হতে পারি না, কারণ আমাদের চোখ একটা। এই যে পথচারী দুই নারী এবং দুজন শিক্ষিকা অযৌক্তিক হরতালের কারণে হামলার শিকার হলেন, তাদের জন্য জিহাদের মতো মানুষের প্রাণ কেঁদে উঠল না। কারও পদত্যাগ দাবি করা হল না, দুর্বৃত্তদের শাস্তি দাবি করা হল না, বিন্দুমাত্র ক্ষোভ প্রকাশ করা হল না। কেন? ওই দুই শিক্ষিকার প্রাণের মূল্য নেই? তবুও তো জিহাদ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল, ওকে বাঁচানোটা মানুষের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু হরতাল সমর্থনকারী দুর্বৃত্তরা স্বহস্তে এক নারী শিক্ষিকাকে হত্যা করেছে, অন্যজনকে আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে। বর্বরতা জিহাদের মৃত্যুর চেয়ে স্বহস্তে নারী হত্যার ঘটনায় বেশি। তাদের জন্য আমাদের হৃদয় উদ্বেলিত হল না কেন? রাজনৈতিক কারণে? এমন নারকীয় হত্যার বিরুদ্ধে নিন্দা বা ক্ষোভ জানালে এক পক্ষের লাভ আর অন্য পক্ষের লোকসান- এ কারণে আমাদের বিবেক সাড়া দিল না? যে সমাজে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবতার চর্চা হয় না, সে সমাজে নিরাপত্তা চাইলেই পাওয়া যায় না। মানবতার ব্যাপারটা সব সময় নির্দলীয়। অন্তত মানবতাকে দলীয়করণ অথবা শ্রেণীকরণ না করলে আমরা লাভবান হব বেশি।
একজন বামপন্থী লেখককে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর কথা ছেড়ে দিন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাতে যেসব নারী, শিশু ও অন্তঃস্বত্ত্বা রমণীকে হত্যা করা হল, সে সম্পর্কে কোনোদিন একটা প্রতিবাদী লেখা আপনার কলম থেকে বের হয়নি। তিনি উত্তরে বললেন, ব্যাপারটা রাজনৈতিক। তাছাড়া আমি তো আওয়ামী লীগ করি না।
এজন্যই বলছিলাম, সব হৃদয়বিদারক ঘটনা আমাদের বিবেককে সংবেদনশীল করে না। বিবেককেও আমরা দলীয়করণ করে ফেলেছি! এ কারণে বিবেকবর্জিত সমাজ দিন দিন দানবের মতো শক্তিশালী হচ্ছে। অপরাধ, নৃশংসতা, বর্বরতা কারও না কারও কাছে প্রশ্রয় পাচ্ছে, নীরব সমর্থন পাচ্ছে।
গত বছরের নৃশংসতম ঘটনার একটি ছিল ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামকে পুড়িয়ে হত্যা। বর্বরোচিত এ ঘটনায় দেশবাসী হতবাক হয়। ব্যথিত হয় জাতির বিবেক। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের রক্ত মুছতে না মুছতেই ২০ মে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ একরামূল হক একরামকে পুড়িয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওইদিন বেলা সোয়া ১১টায় আগে থেকে ওঁৎপেতে থাকা সশস্ত্র ক্যাডাররা ফেনী পরশুরাম সড়কের বিলাসী সিনেমা হলের সামনে অবস্থান নিয়ে রাস্তার ওপর ট্রলি দিয়ে একরামের গাড়ি গতিরোধ করার চেষ্টা করে। একে একে দুটি বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হলেও তৃতীয় বাধায় গাড়ির গতি কমে যায়। এ সময় হামলাকারীরা তার গাড়ি লক্ষ করে গুলি করলে একরাম গুলিবিদ্ধ হয়, এরপর সন্ত্রাসীরা গানপাউডার দিয়ে গাড়িটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। একরাম গাড়ির সামনে বসা থাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে চালকের সিটে লুটিয়ে পড়েন। এতে চালক মামুন দরজা খুলে পালিয়ে যেতে চাইলে হামলাকারীরা তার ওপর আক্রমণ করে তাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। মুহূর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখায় গাড়ি ভস্মীভূত হয়ে যায়। পুড়ে কয়লা হয়ে যান একরাম।
এমন একটি বর্বর ঘটনায় কোনো ক্ষোভ কিংবা প্রতিবাদ সম্মিলিতভাবে জানানো হয়েছিল বলে পত্রিকায় খবর দেখিনি। কারণ ব্যক্তিটি রাজনৈতিক। এ ব্যক্তিকে উপলক্ষ করে বর্বরোচিত নির্দয়তার প্রতিবাদ করলে লাভ-লোকসানের হিসাবটা সামনে আসে। এভাবেই আমরা আমাদের বিবেককে দলীয়করণ করেছি। ঐক্যের আহ্বান জানানো যত সহজ ঐক্যবদ্ধ হওয়া তত সহজ নয়। পথে অনেক বাধা।
বঙ্গবিবেক আবুল ফজল মানবতন্ত্রের ওপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিলেন সঙ্গত কারণে। আমাদের মানবতাবোধ ও বিবেক যদি দলনিরপেক্ষ হতো, তাহলে যে কোনো হৃদয়বিদারক ঘটনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘৃণা জানাতে পারতাম।
মাহমুদুল বাসার : প্রাবন্ধিক, গবেষক
মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষিকা শামসুন্নাহার বেগম ঝর্ণা নোয়াখালীতে হরতালকারীদের ছোড়া ইটের আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আর দুই সন্তানের জননী আরেক শামসুন্নাহার রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়ায় সিএনজিতে দুষ্কৃতকারীদের দেয়া আগুনে দুই সন্তানসহ এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। কাজীপাড়ার শামসুন্নাহারের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে অয়ন আর কলেজ পড়ুয়া মেয়ে আনিকা মায়ের সঙ্গেই সিএনজির আগুনে দগ্ধ।
কোনো মৃত্যুই আনন্দদায়ক নয়, হৃদয়বিদারক। কিন্তু সব হৃদয়বিদারক ঘটনার সঙ্গে আমরা সমানভাবে জিহাদের ঘটনার মতো আবেগপ্রবণ ও ক্ষুব্ধ হতে পারি না, কারণ আমাদের চোখ একটা। এই যে পথচারী দুই নারী এবং দুজন শিক্ষিকা অযৌক্তিক হরতালের কারণে হামলার শিকার হলেন, তাদের জন্য জিহাদের মতো মানুষের প্রাণ কেঁদে উঠল না। কারও পদত্যাগ দাবি করা হল না, দুর্বৃত্তদের শাস্তি দাবি করা হল না, বিন্দুমাত্র ক্ষোভ প্রকাশ করা হল না। কেন? ওই দুই শিক্ষিকার প্রাণের মূল্য নেই? তবুও তো জিহাদ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল, ওকে বাঁচানোটা মানুষের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু হরতাল সমর্থনকারী দুর্বৃত্তরা স্বহস্তে এক নারী শিক্ষিকাকে হত্যা করেছে, অন্যজনকে আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে। বর্বরতা জিহাদের মৃত্যুর চেয়ে স্বহস্তে নারী হত্যার ঘটনায় বেশি। তাদের জন্য আমাদের হৃদয় উদ্বেলিত হল না কেন? রাজনৈতিক কারণে? এমন নারকীয় হত্যার বিরুদ্ধে নিন্দা বা ক্ষোভ জানালে এক পক্ষের লাভ আর অন্য পক্ষের লোকসান- এ কারণে আমাদের বিবেক সাড়া দিল না? যে সমাজে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবতার চর্চা হয় না, সে সমাজে নিরাপত্তা চাইলেই পাওয়া যায় না। মানবতার ব্যাপারটা সব সময় নির্দলীয়। অন্তত মানবতাকে দলীয়করণ অথবা শ্রেণীকরণ না করলে আমরা লাভবান হব বেশি।
একজন বামপন্থী লেখককে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর কথা ছেড়ে দিন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাতে যেসব নারী, শিশু ও অন্তঃস্বত্ত্বা রমণীকে হত্যা করা হল, সে সম্পর্কে কোনোদিন একটা প্রতিবাদী লেখা আপনার কলম থেকে বের হয়নি। তিনি উত্তরে বললেন, ব্যাপারটা রাজনৈতিক। তাছাড়া আমি তো আওয়ামী লীগ করি না।
এজন্যই বলছিলাম, সব হৃদয়বিদারক ঘটনা আমাদের বিবেককে সংবেদনশীল করে না। বিবেককেও আমরা দলীয়করণ করে ফেলেছি! এ কারণে বিবেকবর্জিত সমাজ দিন দিন দানবের মতো শক্তিশালী হচ্ছে। অপরাধ, নৃশংসতা, বর্বরতা কারও না কারও কাছে প্রশ্রয় পাচ্ছে, নীরব সমর্থন পাচ্ছে।
গত বছরের নৃশংসতম ঘটনার একটি ছিল ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামকে পুড়িয়ে হত্যা। বর্বরোচিত এ ঘটনায় দেশবাসী হতবাক হয়। ব্যথিত হয় জাতির বিবেক। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের রক্ত মুছতে না মুছতেই ২০ মে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ একরামূল হক একরামকে পুড়িয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওইদিন বেলা সোয়া ১১টায় আগে থেকে ওঁৎপেতে থাকা সশস্ত্র ক্যাডাররা ফেনী পরশুরাম সড়কের বিলাসী সিনেমা হলের সামনে অবস্থান নিয়ে রাস্তার ওপর ট্রলি দিয়ে একরামের গাড়ি গতিরোধ করার চেষ্টা করে। একে একে দুটি বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হলেও তৃতীয় বাধায় গাড়ির গতি কমে যায়। এ সময় হামলাকারীরা তার গাড়ি লক্ষ করে গুলি করলে একরাম গুলিবিদ্ধ হয়, এরপর সন্ত্রাসীরা গানপাউডার দিয়ে গাড়িটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। একরাম গাড়ির সামনে বসা থাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে চালকের সিটে লুটিয়ে পড়েন। এতে চালক মামুন দরজা খুলে পালিয়ে যেতে চাইলে হামলাকারীরা তার ওপর আক্রমণ করে তাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। মুহূর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখায় গাড়ি ভস্মীভূত হয়ে যায়। পুড়ে কয়লা হয়ে যান একরাম।
এমন একটি বর্বর ঘটনায় কোনো ক্ষোভ কিংবা প্রতিবাদ সম্মিলিতভাবে জানানো হয়েছিল বলে পত্রিকায় খবর দেখিনি। কারণ ব্যক্তিটি রাজনৈতিক। এ ব্যক্তিকে উপলক্ষ করে বর্বরোচিত নির্দয়তার প্রতিবাদ করলে লাভ-লোকসানের হিসাবটা সামনে আসে। এভাবেই আমরা আমাদের বিবেককে দলীয়করণ করেছি। ঐক্যের আহ্বান জানানো যত সহজ ঐক্যবদ্ধ হওয়া তত সহজ নয়। পথে অনেক বাধা।
বঙ্গবিবেক আবুল ফজল মানবতন্ত্রের ওপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিলেন সঙ্গত কারণে। আমাদের মানবতাবোধ ও বিবেক যদি দলনিরপেক্ষ হতো, তাহলে যে কোনো হৃদয়বিদারক ঘটনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘৃণা জানাতে পারতাম।
মাহমুদুল বাসার : প্রাবন্ধিক, গবেষক
No comments