ভেঙে পড়ছে স্বাস্থ্যসেবা by সালমান ফরিদ
চলমান
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অবরোধে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে
স্বাস্থ্যসেবায়। পুরো দেশের সঙ্গে যেন অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে চিকিৎসাসেবাও।
আওতামুক্ত থাকার পরও নিরাপত্তার অভাব ও পথে পথে প্রতিবন্ধকতা থাকায় চেম্বার
কিংবা হাসপাতালমুখী হতে পারছেন না অনেকে। আবার বেরুলে পড়তে হচ্ছে নানা
দুর্ভোগ-প্রতিবন্ধকতায়। এ কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে রোগীদের জীবন। তারা চরম
ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালেও কাঙিক্ষত চিকিৎসাসেবাও পাচ্ছেন না। বিশেষ
করে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হৃদরোগ, কিডনি রোগ অথবা ক্যানসারে আক্রান্ত
রোগীরা সময়মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে না পারায় নানা রকম জটিলতার মুখে পড়ার
উপক্রম হচ্ছে। গতকাল থেকে অবরোধ শুরু হলেও চার দিন ধরে কার্যত ঢাকার সঙ্গে
সারা দেশ বিচ্ছিন্ন। ফলে জরুরি বা উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে আসতে
পারছেন না কেউ। আবার কেউ কেউ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন
না। ফিরতে চাইলেও আতঙ্কে আছেন রাস্তায় কোন অঘটন হয় কিনা। এমনকি চরম
অনিশ্চয়তায় গ্রাম থেকে পাশের শহরেও যেতে পারছেন না রোগী-অভিভাবকরা। অসুস্থ
হওয়ার পর জরুরি সময়ে যানবাহন না পাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না
অনেকে। ঢাকার কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় রোগীর সংখ্যা
কম দেখা গেছে। বর্তমানে যারা সেবা নিতে আসছেন তাদের প্রায় সবাই ঢাকা ও তার
আশপাশ এলাকার। গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল
বিশ্ববিদ্যালয়-বিএসএমএমইউ হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে
রোগী স্বল্পতার চিত্র দেখা গেছে। এগুলোতে বাইরে থেকে খুব কম রোগীই সেবা
নিতে এসেছিলেন। যারা এসেছেন তাদের সংখ্যা হাতেগোনা। রোগীদের একটি বড় অংশ
তাদের আশপাশের ফার্মেসি থেকে বিক্রেতাদের পরামর্শ নিয়ে ওষুধপত্র কিনে নিজের
মতো করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফলে রোগ সারার পরিবর্তে তাদের জীবন হুমকির
সম্মুখীন হচ্ছে। এদিকে গতকাল বিকালে ও সন্ধ্যায় চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত
চেম্বারে কম ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। আগেভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সময় নিয়েও
ঢাকার বাইরে থেকে আসতে পারেননি রোগীরা। পূর্বনির্ধারিত তারিখ বাতিল করতে
হয়েছে। দ্বিতীয়বার কখন সিরিয়াল পাবেন, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। সিরিয়াল পেলেও
ততদিন কতটা সুস্থ থাকবেন, সেই ভাবনা আরও অসুস্থ করে দিচ্ছে জটিল রোগীদের।
অন্যদিকে রাস্তায় যাতায়াতের সময় নিরাপত্তাহীনতার কারণে হাসপাতাল ও
চেম্বারের চিকিৎসকরা ডিউটি শিডিউল বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা
গেছে, স্যার সলিমুল্লাহ মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন অন্তত
৮০০ রোগী ভর্তি থাকেন। কিন্তু গতকাল দুপুর পর্যন্ত গত দুই দিনে সেখানে
ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬০০ পার হয়নি। জরুরি বিভাগের ভর্তি শাখা জানিয়েছে, অন্য
সময় প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ রোগী ভর্তি হন। কিন্তু এখন ৫০ জনও ছাড়াচ্ছে না।
তবে এদের প্রায় সবাই আশপাশের এলাকার। ঢাকার বাইরের রোগী নেই বললেই চলে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন অন্তত ৬,০০০ রোগী
সেবা নেন। তাই ভিড় থাকে প্রচুর। কিন্তু এখন কোন ভিড় নেই। টিকিট কাউন্টার
থেকে জানানো হয়, প্রতিদিন ৫০০-এর বেশি রোগী হচ্ছে না। অথচ অন্য স্বাভাবিক
সময়ে প্রতিদিন দুই হাজারেরও বেশি টিকিট বিক্রি হতো। এখানকার ওয়ার্ডে সিট
পেতে অন্য সময় দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হলেও এখন অনেক সিট খালি থাকছে।
রাজধানীর অন্যান্য সরকারি হাসপাতালেও রোগীর উপস্থিতি কম। কিন্তু তা
সত্ত্বেও কাঙিক্ষত চিকিৎসাসেবা অনেক জায়গায় মিলছে না। ভুক্তভোগী রোগী ও
তাদের স্বজনরা জানান, অবরোধের দোহাই দিয়ে ডাক্তার-নার্সরা অনুপস্থিত থাকায়
মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছেড়ে
গেছেন চট্টগ্রামের মিরেরসরাই-এর হতদরিদ্র আমিনুল। তার অভিভাবকরা চিন্তিত।
কিভাবে তাকে নিয়ে যাবেন বাড়ি পর্যন্ত! এ নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। বড় ভাই সাইদুল
ইসলাম আফসোস করে বলেন, অসুস্থতা নিয়ে অশান্তিতে ছিলাম। রোগীকে সুস্থ করে
তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে যেয়ে এখন আরেক অশান্তির মধ্যে পড়লাম। আমাদের আর
শান্তি হলো না কোথাও। এদিকে এ সুযোগে বাড়তি পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে
অ্যাম্বুলেন্সগুলোও। ভাড়া নিচ্ছে দ্বিগুণ-তিন গুণ। অনেকে রোগী নিয়ে ঢাকায়
এসে বিপাকে পড়েছেন। গ্রামে যেতে পারছেন না। রিলিজ হয়ে গেলেও যানবাহন না
ছাড়ায় তারা ঢাকা ছাড়তে পারছেন না। বসে অপেক্ষা করছেন বাস টার্মিনালগুলোতে।
সিট না পেয়েও অনেকে আবার ট্রেনে করে গন্তব্যে রওনা দিয়েছেন। এদিকে এ অবস্থা
আরও কয়েক দিন চলতে থাকলে স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে বলে
মনে করছেন সংশ্লিরা। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে দেখা দিতে পারে অক্সিজেনসহ
অন্য উপকরণ ও ওষুধপত্রের সঙ্কট। অতীতের হরতাল-অবরোধে হাসপাতালে প্রয়োজনীয়
সামগ্রীর সরবরাহ ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কার্বন-ডাই অক্সাইড
লিক্যুইড ও সিলিন্ডার সরবরাহ না থাকায় ঢাকার বেশির ভাগ হাসপাতালে
ল্যাপারোস্কপি অপারেশন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের
বাইরে থেকেই কিনতে হয়েছিল গজ-ব্যান্ডেজ থেকে শুরু করে সুই-সিরিঞ্জ পর্যন্ত।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ধারণা, অবরোধ চলমান থাকলে এবারও হয়তো সেই পরিস্থিতি
আবার সৃষ্টি হতে পারে।
No comments