অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া, অবরুদ্ধ গণতন্ত্র by মহিউদ্দিন খান মোহন
ভোটারবিহীন
নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সরকার ও দেশের প্রধান বিরোধী দলের
কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা
এখনো অব্যাহত আছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্র রক্ষা
দিবস’ এবং বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তুতি নিয়েছিল।
ওইদিন রাজধানী ঢাকায় বড় ধরনের সমাবেশ করার পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। এ জন্য
নয়াপল্টন, সোহরাওয়ার্দীর উদ্যান অথবা মতিঝিল শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার
অনুমতি চেয়ে দলটি ডিএমপির কাছে আবেদন জানিয়েছিল। অন্যদিকে রাজধানীর ১৬টি
পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ পালনের ঘোষণা দিয়েছিল আওয়ামী
লীগ। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কালো পতাকা হাতে ওই সমাবেশে যোগ
দেয়ার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্ত ও
পদক্ষেপের কারণে সে সমাবেশ অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে
সরকার যেসব পদক্ষেপ নেয়, তাতে ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বরের চিত্রই আবার দেখা
গেল। সে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। শুধু স্থানটা ভিন্ন। সেবার বেগম জিয়াকে
অবরুদ্ধ করা হয়েছিল তাঁর বাসভবনে। এবার করা হয়েছে তাঁর কার্যালয়ে। সে একই
কায়দা, একই পদ্ধতি। অগণিত পুলিশ-র্যাব-গোয়েন্দার প্রাচীর, বালু-ইট-সুরকি
ভর্তি ট্রাক দিয়ে রাস্তা বন্ধ। এবার বাড়তি সংযোজন প্রধান গেইটে তালা মারা।
এসবই নাকি করা হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার জন্য। প্রশ্ন উঠেছে- কী
এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো যে, বেগম খালেদা জিয়া এতোটাই নিরাপত্তাহীন হয়ে
পড়লেন, যে কারণে অসংখ্য পুলিশ আর দুই ডজন ট্রাক দিয়ে তার অফিসকে ঘিরে রাখা
হলো! সরকার প্রধান এবং তার একাধিক মন্ত্রী মিডিয়াকে বললেন যে, খালেদা
জিয়াকে অবরুদ্ধ করা হয়নি তিনি ইচ্ছা করলে বাসায় যেতে পারেন। অথচ তার অফিস
থেকে বের হওয়ার সব পথই রয়েছে বন্ধ। বিবেকবান মানুষেরা বিস্ময় ভরা কণ্ঠে
প্রশ্ন করছেন- সরকার প্রধান এবং তার স্যাঙ্গাতরা কী দেশবাসীকে
অন্ধ-বোবা-কালা বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ভেবে বসে আছেন ? টিভি চ্যানেলগুলোতে
সরাসরি দেখানো হচ্ছিল বেগম জিয়া অবরুদ্ধ। অথচ তারা বললেন তাকে অবরুদ্ধ করা
হয়নি। এটাকে যদি নির্জলা মিথ্যাচার বলা হয়, তাহলেও বোধকরি কম বলা হবে।
সরকারের আরেক মন্ত্রী এ বিষয়ে এমন এক তথ্য দিলেন যে, দেশবাসী বিস্ময়ে বিমূঢ়
হয়ে গেল। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া
ওইদিন দলীয় এক সমাবেশে বললেন, ‘বালু ভর্তি ট্রাকগুলো সরকার নেয়নি। বেগম
জিয়া তার অফিস সংস্কারের জন্য নিজেই ইট-বালু ভর্তি ট্রাক এনেছেন।’ সরকারের
কর্তাব্যক্তিরা দেশের মানুষকে কী ভাবেন এটাই এখন একটা প্রশ্ন হয়ে
দাঁড়িয়েছে। তারা কি সবাইকে বুদ্ধিহীন বা নাবালক ভাবছেন, নাকি তারা নিজেরাই
বিবেক-বুদ্ধি সব খুঁইয়ে উন্মাদ হয়ে গেছেন? ৫ জানুয়ারি বিএনপির কর্মসূচিকে
কেন্দ্র করে সরকার যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো তা কারো কাছেই সমর্থনযোগ্য মনে
হয়নি। এটা যে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির চরম লঙ্ঘন সেটাও সবাই এক বাক্যে
বলছেন। ওইদিন বিএনপি ঢাকায় একটা বড় সমাবেশ করতে চেয়েছিল। এটা দল হিসেবে
বিএনপির অধিকার। এ অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই। সরকার
পক্ষ ওইদিন ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ পালনের কথা বলেছিল। অথচ তাদের
কর্মকাণ্ডই যে গণতন্ত্রের শরীরে তীক্ষ্ম ছুরিকাঘাত তুল্য সেটা ভেবে দেখার
সময় বোধকরি তারা পাননি। একটি সরকার কতোটা অসহিষ্ণু হলে এরকম স্বৈরতান্ত্রিক
আচরণ করতে পারে সেটা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সরকারের আচরণে এটা
মনে হওয়া স্বাভাবিক এবং সঙ্গত যে, তাদের পায়ের তলার মাটি শক্ত নেই। তারা এক
ধরনের ভীতির মধ্যে আছে। বিএনপি তথা বেগম খালেদা জিয়া একটি সমাবেশ করলেই
তাদের পতন হবে-এমন ধারণা বোধকরি তাদের মগজে বাসা বেঁধে আছে। আর সেজন্যই
যেখানে বেগম জিয়া সভা করতে যাবেন সেখানেই বাধা দেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়,
সরকার বিরোধী কোনো কর্মসূচিই বিরোধী দলকে পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। একটি
সরকার তখনই এ ধরনের আচরণ করে, যখন তাদের নিজেদের ওপর আস্থা হ্রাস পায়,
জনসমর্থনে প্রবল ভাটার সৃষ্টি হয়। সরকার পক্ষ এটা ঠিকই উপলব্ধি করতে সক্ষম
হয়েছে যে, তারা বস্তুত, একটি আগ্নেয়গিরির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। জনক্ষোভের সে
আগ্নেয়াগিরি যে কোন সময় জ্বলন্ত লাভা উদগীরণ করে তাদের সাজানো বাগান
ভষ্মীভূত করে দিতে পারে। আর সে আশঙ্কা থেকেই তারা সর্বশক্তি দিয়ে
জনবিস্ফোরণের আগ্নেয়গিরিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছে। সচেতন মহলে
আরেকটি প্রশ্ন এখন বেশ জোরে সোরেই উচ্চারিত হচ্ছে। বিশেষ করে লীগ সরকারের
অপশাসনকে অতীষ্ঠ মানুষ এ প্রশ্নটি প্রতিনিয়ত তুলছেন। প্রশ্নটি হলো-বর্তমান
সরকারের মতো জনপ্রিয়তাহীন এমন একটি সরকারকে বিএনপি কেন হটাতে পারছে না।
জনসমর্থনহীন সরকার যে শুধুমাত্র দলীয় গুন্ডা বাহিনী এবং প্রশাসনের জোরে
টিকে আছে সেটা সবাই জানেন। বিপুল জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিএনপি কেন
রাজনীতির মাঠ দখলে নিতে পারছে না- এ প্রশ্নের জবাব কেউ খুঁজে পাচ্ছেন না।
সবাই ধারণা করেছিলেন যে, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার হয়তো
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মাঠে থাকবেন। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য
করা গেল যে, বিএনপি নেতারা অতীতের মতোই লাপাত্তা হয়ে গেলেন। দু’একজনকে
দু’এক ঝলক দেখা গেলেও পরে আর তাদের টিকিটিরও হদিস পায়নি কেউ। কোথায় তারা
রাজপথে নেমে কর্মীদের নেতৃত্ব দেবেন, তা না, তারা চলে গেলেন অজ্ঞাতবাসে, আর
তাদের মোবাইল ফোনের সুইচ গেল অফ হয়ে। অথচ এসব নেতাই সভামঞ্চে বেগম খালেদা
জিয়ার সামনে, কিংবা প্রেস ক্লাবের হল রুমে এক ধাক্কায় সরকারের পতন ঘটানোর
দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে থাকেন। কেউ কেউ প্রয়োজনে ‘বুকের তাজা রক্ত’ ঢেলে
দেয়ার প্রতিজ্ঞাও করে থাকেন। আকাশে উত্তোলিত তাদের হাত এবং মুখের
অভিব্যক্তি দেখে সবাই ভাবেন- এবার আন্দোলন চুড়ান্ত পরিণতি লাভ না করার কোনো
কারণ নেই। ৫ জানুয়ারির আগেও অমন বজ্র নির্ঘোষ বিএনপির অনেক নেতাকে বর্ষণ
করতে দেখা গেছে। কিন্তু হা হতোষ্মি! যখন লগ্ন ঘনিয়ে এলো দেখা- কোথাও কেউ
নেই। অন্যদিকে একাই লড়াই করে গেলেন বেগম খালেদা জিয়া। কালোপতাকা হাতে তিনি
গাড়িতে উঠেছিলেন বের হওয়ার জন্য। তাঁর সঙ্গে ছিল আটকে পড়া কিছু মহিলা
নেত্রী আর অফিসের কর্মচারী। একজন নেতাকেও দেখা গেল না একটা মিছিল নিয়ে
‘প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে’ মুক্ত করতে গুলশান অভিমুখে যেতে। কেন এমন বেহাল দশা
বিএনপি নেতৃত্বের এ প্রশ্ন আজ সবার মনে। এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এখানে
প্রাসঙ্গিক নয়। তবে এটুকু বলা যায় যে, দলটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে এমন
সব ব্যক্তিদের বসানো হয়েছে, যাদের কাছে দলের চেয়ে নিজের জীবন-সম্পদ অনেক
বেশি প্রিয়। যারা ‘সব ঝামেলা নেত্রী সামলাবেন’ নীতি অবলম্বন করে বসে আছে।
বেগম খালেদা জিয়া গত সোমবার (৫ জানুয়ারি) বিকালে গণমাধ্যম কর্মীদের মাধ্যমে
অনির্দিষ্টকাল অবরোধের ডাক দিয়েছেন। বলেছেন পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া
পর্যন্ত অবরোধ অব্যাহত থাকবে। তাঁর এ ঘোষণার কয়েক ঘন্টা পরই তাঁর অফিসের
সামনে থেকে ইট-বালুর ট্রাকগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে
টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা। ফলে বেগম জিয়ার ডাকা অবরোধ কতদিন অব্যাহত রাখা
সম্ভব হবে সে প্রশ্নও রয়েছে। আবার একবার অবরোধ তুলে নিলে পরবর্তীতে আবার সে
কর্মসূচি শুরু করা কতোটা সহজ বা সম্ভব হবে সেটাও ভেবে দেখতে হবে। এ
অবস্থায় এটা বলা চলে যে, বিএনপি তাদের আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে বেশ জটিল
পরিস্থিতিতেই পড়বে। তবে, ৫ জানুয়ারি উপলক্ষে বিএনপির কর্মসূচিকে বানচাল
করতে সরকার যেসব উদ্যোগ-আয়োজন করেছিল, তা যেকোনো বিচারে নিন্দনীয়,
অগ্রহণীয়। তারা দলটির কর্মসূচি ঠেকাতে বেগম জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রেখে এটা
আবারো সবাইকে জানিয়ে দিল যে, সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও
আওয়ামী লীগের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। একই সঙ্গে তারা এটাও বুঝিয়ে দিল
যে, রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য তারা আরো অনেক নিচে নামতে পারে। রাজনৈতিক সচেতন
মহল মনে করেন, সরকার শুধু একজন বেগম খালেদা জিয়াকেই অবরুদ্ধ করেনি, অবরুদ্ধ
করেছে গোটা দেশকে, গণতন্ত্রকে। কিন্তু এভাবে কী শেষ রক্ষা হবে ? বেগম
জিয়ার অফিসের গেইটে তালা মেরে হয়তো কিছু সময় বা দিনের জন্য তাকে আটকে রাখা
যেতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্রের মুখে খুব বেশিদিন তালা লাগিয়ে রাখা যায় না। এ
সত্যটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যতো তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে তাদের জন্য ততোই
মঙ্গল। মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক
No comments