সংঘাতের রাজনীতি অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে by রণেশ মৈত্র
সিপিডির পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান
একটি সংবাদপত্রকে বলেছেন, প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে
বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলছিল। সংঘাতময় রাজনীতির কবলে পড়ে দেশের সেই
অর্থনীতি এখন বেসামাল। এ অবস্থায় দেশী বিনিয়োগ থমকে গেছে, বিদেশী বিনিয়োগ
অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অস্থির রাজনীতির এ ধরনের একটি চিত্রই দেশের সর্বনাশ
ডেকে আনতে পারে। তিনি বলেন, রাজনীতির এ ধারা জাতীয় আকাক্সক্ষার প্রতিফলন
ঘটার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
আমরা দেখেছি, হরতাল-অবরোধে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে যায়। কল-কারখানায় সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উৎপাদনে টান পড়ে। জোড়াতালি দিয়ে কিছু উৎপাদন করা গেলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে শিপমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয়। বিকল্প হিসেবে আকাশপথের কথা হয়তোবা ভাবা যায়; কিন্তু তাতে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায় বহু গুণ। দেশের ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর এক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতিদিন হরতাল-অবরোধে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। তবে অবরোধকালীন চিত্র হরতালের চেয়েও ভয়াবহ। ফলে অবরোধে প্রতিদিনকার ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, অবরোধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ ক্ষতি হয়। হরতাল-অবরোধজনিত ক্ষতি নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি একটা হিসাব প্রাক্কলন করেছে। সিপিডির মতে, হরতাল-অবরোধে ধ্বংসাÍক কর্মকাণ্ডে মূলধনজনিত বিনিয়োগ (ক্যাপিটাল স্টক) এক শতাংশ কমে গেলে জিডিপি কমে যাবে .০৯ শতাংশ, রফতানি ২.৫ শতাংশ, কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে ০.৯ শতাংশ। সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অবরোধে বড় ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থার সংকট। এটা দীর্ঘমেয়াদি হলে অর্থনৈতিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ রফতানি আদেশ বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে গেছে। একদিনের অবরোধে পোশাক খাতে ক্ষতির পরিমাণ ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা। সংগঠনের সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ্ আজিম বলেন, পরিবহন বন্ধ থাকায় পণ্যসামগ্রী বন্দরে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। যথাসময়ে শিপমেন্ট না হওয়ায় রফতানি করতে গেলে ব্যয় বেড়ে যায় দশ গুণ।
সম্প্রতি রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একদিনের অবরোধে ৪০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় ব্যাহত হয়। অবরোধের কারণে চালানগুলো সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। রাজস্ব আদায়ের দিক থেকে সবচেয়ে বড় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার পণ্যের চালান খালাস হয়। রাজস্ব বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করেন, এ ধরনের সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি চলতে থাকলে রাজস্ব আদায় আগামীতে আরও বেশি ঝুঁকিতে পড়বে। এনবিআর সূত্র জানায়, হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোলে আটকে থাকে ৪০০টি, ঢাকা কাস্টম হাউসে ৬০০ থেকে ৭০০ ও কমলাপুর আইসিডিতে ৫০-৬০টি চালান। হরতালজনিত কারণে মালপত্র খালাস না হওয়ায় সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দেয়। পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার হচ্ছে দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার। ওই বাজারের ৪০টি ব্যবসায়ী সংগঠনের হিসাবে প্রতিদিন সেখানে ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। কিন্তু অবরোধের কারণে লেনদেন বন্ধ থাকে। অবরোধের কারণে বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা আসতে পারেন না, পণ্যও ঢাকার বাইরে যেতে পারে না। ফলে অবরোধে ঢাকা শহরের প্রায় ৪০টি মার্কেট বন্ধ থাকে।
খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের বৃহত্তর এই পাইকারি বাজারটিতে প্রতিদিন চাল, ডাল, লবণ, মশলাসহ প্রায় সব ধরনের মুদিপণ্য বিক্রি হয়। এখানে গড়ে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়ে থাকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে। কিন্তু অবরোধের সময় বাজারটি প্রায় বন্ধই থাকে। এখানে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার টন চাল, ৪০০ থেকে ৫০০ টন পেঁয়াজ, ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার ডাল, ৬ থেকে ৭ লাখ টাকার মশলা বিক্রি হয়। কিন্তু অবরোধের কারণে তার শতকরা ১০ ভাগও বিক্রি হয় না।
আমদানি-রফতানির প্রায় ৮০ শতাংশই হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। প্রতিদিন এ বন্দর দিয়ে গড়ে ২০০০ কনটেইনার পণ্য আমদানি-রফতানি হয়। কিন্তু অবরোধে এর পরিমাণ অনেক কমে যায়। ফলে কনটেইনার জটের সৃষ্টি হয়। অনেক ব্যবসায়ীর নির্ধারিত সিডিউল বাতিল হয়ে যায়। সময়মতো পণ্য খালাস করা ও পণ্য জাহাজীকরণে বিঘ্ন ঘটায় ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ গুনতে হয়।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি বলেছে, তাদের হিসাবে ঢাকা শহরে দোকান প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩ লাখ এবং সারা দেশে ২৫ লাখ। অবরোধের দিনগুলোতে এই দোকানগুলোর প্রায় সবই বন্ধ থাকে। তাতে প্রতিদিনের ক্ষতি দাঁড়ায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
বাসের একজন কন্ডাক্টর জানান, একদিন ডিউটি করলে তিনি ৫০০ টাকা পান; কিন্তু যখন অবরোধ-হরতাল থাকে তখন বাস বন্ধ রাখতে হয় বলে এ সময় রোজগার বন্ধ থাকে। এ ছাড়া খেটে খাওয়া মানুষগুলোই সাধারণত অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত-আহত হচ্ছেন। ফলে তাদের পরিবার-পরিজনরা থাকছে অনাহারে-অর্ধাহারে। সারা দেশে রিকশাচালকদের কমপক্ষে ৬০ ভাগই বসে থাকতে বাধ্য হন যাত্রীর অভাবে। সবজি বাজারে-ফলের বাজারেও পড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া। দাম বেড়ে যায় পরিবহন সংকটে। কিন্তু তৃণমূলে উৎপাদক কৃষকরা একই কারণে হন ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ তাদের পণ্যের ক্রেতা না থাকায় পরিবহন সংকটে তা কোথাও পাঠাতে না পারায় উৎপাদন খরচেরও অনেক কম দামে কৃষিপণ্য বিক্রি করে দিতে বাধ্য হতে হয়।
এভাবে দেখা যায়, শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি মানুষ হরতাল-অবরোধে মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পতিত হন।
ব্যবসা-বাণিজ্যে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হওয়ায় ব্যাংকিং সেক্টরেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়ে যায় মাত্রাতিরিক্তভাবে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যায়- অগ্রগতির সব আশাও দুমড়ে-মুচড়ে একাকার হয়ে যায়। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে যেভাবে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে, তাতে এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির ধকল কাটিয়ে অর্থনীতির অবরুদ্ধ চাকাকে কতদিনে সচল করা যাবে তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, এ ধরনের হরতাল-অবরোধে যেভাবে যানবাহন পোড়ানো হয়, নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে ছাই করে দেয়া হয়, তাতে মনে হয় আমাদের হাজার বছরের লালিত, বিকশিত সভ্যতা যেন গণবিরোধী অপরাজনীতির দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। এ থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে- বাঁচাতে হবে সভ্যতাকে।
যে দাবিতে এ আন্দোলন সেই দাবি পূরণের ষোল আনা এখতিয়ার হল সরকারের- জনগণের আদৌ নয়। সেই জনগণকে পুড়িয়ে মারা, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করা, তার যাতায়াত-চলাচলের সব পথ বন্ধ করে দেয়ার নাম আর যাই হোক রাজনীতি হতে পারে না- গণতান্ত্রিক আন্দোলনও হতে পারে না। অন্যদিকে আন্দোলন-সংগ্রাম-সহিংসতা বন্ধের নামে সরকার যা করে চলেছে তাও শিষ্টাচার-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি রক্ষা বা সহিংসতা দমন আদৌ নয়। একের পর এক বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার, তাদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা করা কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ নয়, বরং এগুলো দ্বারা বিরোধী দলের উগ্রবাদী অংশকে উসকে দেয়া হচ্ছে। সরকারের জন্য সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম পদ্ধতি হতে পারে বিরোধী দলের মূল দাবি নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসা। সবার অংশগ্রহণে একটি অর্থবহ জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে বিদ্যমান সংকট অচিরেই কেটে যাবে।
রণেশ মৈত্র : প্রবীণ সাংবাদিক
আমরা দেখেছি, হরতাল-অবরোধে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে যায়। কল-কারখানায় সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উৎপাদনে টান পড়ে। জোড়াতালি দিয়ে কিছু উৎপাদন করা গেলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে শিপমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয়। বিকল্প হিসেবে আকাশপথের কথা হয়তোবা ভাবা যায়; কিন্তু তাতে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায় বহু গুণ। দেশের ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর এক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতিদিন হরতাল-অবরোধে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। তবে অবরোধকালীন চিত্র হরতালের চেয়েও ভয়াবহ। ফলে অবরোধে প্রতিদিনকার ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, অবরোধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ ক্ষতি হয়। হরতাল-অবরোধজনিত ক্ষতি নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি একটা হিসাব প্রাক্কলন করেছে। সিপিডির মতে, হরতাল-অবরোধে ধ্বংসাÍক কর্মকাণ্ডে মূলধনজনিত বিনিয়োগ (ক্যাপিটাল স্টক) এক শতাংশ কমে গেলে জিডিপি কমে যাবে .০৯ শতাংশ, রফতানি ২.৫ শতাংশ, কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে ০.৯ শতাংশ। সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অবরোধে বড় ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থার সংকট। এটা দীর্ঘমেয়াদি হলে অর্থনৈতিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ রফতানি আদেশ বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে গেছে। একদিনের অবরোধে পোশাক খাতে ক্ষতির পরিমাণ ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা। সংগঠনের সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ্ আজিম বলেন, পরিবহন বন্ধ থাকায় পণ্যসামগ্রী বন্দরে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। যথাসময়ে শিপমেন্ট না হওয়ায় রফতানি করতে গেলে ব্যয় বেড়ে যায় দশ গুণ।
সম্প্রতি রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একদিনের অবরোধে ৪০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় ব্যাহত হয়। অবরোধের কারণে চালানগুলো সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। রাজস্ব আদায়ের দিক থেকে সবচেয়ে বড় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার পণ্যের চালান খালাস হয়। রাজস্ব বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করেন, এ ধরনের সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি চলতে থাকলে রাজস্ব আদায় আগামীতে আরও বেশি ঝুঁকিতে পড়বে। এনবিআর সূত্র জানায়, হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোলে আটকে থাকে ৪০০টি, ঢাকা কাস্টম হাউসে ৬০০ থেকে ৭০০ ও কমলাপুর আইসিডিতে ৫০-৬০টি চালান। হরতালজনিত কারণে মালপত্র খালাস না হওয়ায় সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দেয়। পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার হচ্ছে দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার। ওই বাজারের ৪০টি ব্যবসায়ী সংগঠনের হিসাবে প্রতিদিন সেখানে ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। কিন্তু অবরোধের কারণে লেনদেন বন্ধ থাকে। অবরোধের কারণে বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা আসতে পারেন না, পণ্যও ঢাকার বাইরে যেতে পারে না। ফলে অবরোধে ঢাকা শহরের প্রায় ৪০টি মার্কেট বন্ধ থাকে।
খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের বৃহত্তর এই পাইকারি বাজারটিতে প্রতিদিন চাল, ডাল, লবণ, মশলাসহ প্রায় সব ধরনের মুদিপণ্য বিক্রি হয়। এখানে গড়ে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়ে থাকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে। কিন্তু অবরোধের সময় বাজারটি প্রায় বন্ধই থাকে। এখানে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার টন চাল, ৪০০ থেকে ৫০০ টন পেঁয়াজ, ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার ডাল, ৬ থেকে ৭ লাখ টাকার মশলা বিক্রি হয়। কিন্তু অবরোধের কারণে তার শতকরা ১০ ভাগও বিক্রি হয় না।
আমদানি-রফতানির প্রায় ৮০ শতাংশই হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। প্রতিদিন এ বন্দর দিয়ে গড়ে ২০০০ কনটেইনার পণ্য আমদানি-রফতানি হয়। কিন্তু অবরোধে এর পরিমাণ অনেক কমে যায়। ফলে কনটেইনার জটের সৃষ্টি হয়। অনেক ব্যবসায়ীর নির্ধারিত সিডিউল বাতিল হয়ে যায়। সময়মতো পণ্য খালাস করা ও পণ্য জাহাজীকরণে বিঘ্ন ঘটায় ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ গুনতে হয়।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি বলেছে, তাদের হিসাবে ঢাকা শহরে দোকান প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩ লাখ এবং সারা দেশে ২৫ লাখ। অবরোধের দিনগুলোতে এই দোকানগুলোর প্রায় সবই বন্ধ থাকে। তাতে প্রতিদিনের ক্ষতি দাঁড়ায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
বাসের একজন কন্ডাক্টর জানান, একদিন ডিউটি করলে তিনি ৫০০ টাকা পান; কিন্তু যখন অবরোধ-হরতাল থাকে তখন বাস বন্ধ রাখতে হয় বলে এ সময় রোজগার বন্ধ থাকে। এ ছাড়া খেটে খাওয়া মানুষগুলোই সাধারণত অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত-আহত হচ্ছেন। ফলে তাদের পরিবার-পরিজনরা থাকছে অনাহারে-অর্ধাহারে। সারা দেশে রিকশাচালকদের কমপক্ষে ৬০ ভাগই বসে থাকতে বাধ্য হন যাত্রীর অভাবে। সবজি বাজারে-ফলের বাজারেও পড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া। দাম বেড়ে যায় পরিবহন সংকটে। কিন্তু তৃণমূলে উৎপাদক কৃষকরা একই কারণে হন ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ তাদের পণ্যের ক্রেতা না থাকায় পরিবহন সংকটে তা কোথাও পাঠাতে না পারায় উৎপাদন খরচেরও অনেক কম দামে কৃষিপণ্য বিক্রি করে দিতে বাধ্য হতে হয়।
এভাবে দেখা যায়, শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি মানুষ হরতাল-অবরোধে মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পতিত হন।
ব্যবসা-বাণিজ্যে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হওয়ায় ব্যাংকিং সেক্টরেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়ে যায় মাত্রাতিরিক্তভাবে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যায়- অগ্রগতির সব আশাও দুমড়ে-মুচড়ে একাকার হয়ে যায়। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে যেভাবে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে, তাতে এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির ধকল কাটিয়ে অর্থনীতির অবরুদ্ধ চাকাকে কতদিনে সচল করা যাবে তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, এ ধরনের হরতাল-অবরোধে যেভাবে যানবাহন পোড়ানো হয়, নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে ছাই করে দেয়া হয়, তাতে মনে হয় আমাদের হাজার বছরের লালিত, বিকশিত সভ্যতা যেন গণবিরোধী অপরাজনীতির দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। এ থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে- বাঁচাতে হবে সভ্যতাকে।
যে দাবিতে এ আন্দোলন সেই দাবি পূরণের ষোল আনা এখতিয়ার হল সরকারের- জনগণের আদৌ নয়। সেই জনগণকে পুড়িয়ে মারা, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করা, তার যাতায়াত-চলাচলের সব পথ বন্ধ করে দেয়ার নাম আর যাই হোক রাজনীতি হতে পারে না- গণতান্ত্রিক আন্দোলনও হতে পারে না। অন্যদিকে আন্দোলন-সংগ্রাম-সহিংসতা বন্ধের নামে সরকার যা করে চলেছে তাও শিষ্টাচার-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি রক্ষা বা সহিংসতা দমন আদৌ নয়। একের পর এক বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার, তাদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা করা কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ নয়, বরং এগুলো দ্বারা বিরোধী দলের উগ্রবাদী অংশকে উসকে দেয়া হচ্ছে। সরকারের জন্য সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম পদ্ধতি হতে পারে বিরোধী দলের মূল দাবি নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসা। সবার অংশগ্রহণে একটি অর্থবহ জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে বিদ্যমান সংকট অচিরেই কেটে যাবে।
রণেশ মৈত্র : প্রবীণ সাংবাদিক
No comments