অভিবাসন একটি চলমান বাস্তবতা by একেএম শাহনাওয়াজ
সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী
প্রবাসীদের জন্য আনন্দ বার্তা যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রায়
অর্ধকোটি অভিবাসীকে তার দেশে বৈধভাবে থাকার অনুমতি দিচ্ছেন। এ সিদ্ধান্তে
রিপাবলিকানরা তীব্র আপত্তি তুললেও অবৈধভাবে বসবাস করা যুক্তরাষ্ট্র
প্রবাসীরা একটি বড় সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ পেয়েছেন। কারণ সাম্প্র্রতিক
সময়ে একটি সিদ্ধান্তের কথা প্রচারিত হয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে
বসবাসকারীদের যার যার দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এতে অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি
মানবিক সংকটও দেখা দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত বিধি অনুযায়ী
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার বিধান রয়েছে। জন্মসূত্রে নাগরিকের বাবা, মা,
ভাই, বোনকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে যদি নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়, তবে এ
পরিবারের জন্য তা হবে মানবিক বিপর্যয়। আবার সব ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি
দেয়া মানুষদের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের বিষয়টি আছেই।
তবে মানতে হবে রিপাবলিকানদের প্রতিক্রিয়া অনেকটাই রাজনৈতিক বিরুদ্ধাচরণ। কারণ ইতিহাসের আদিকাল থেকেই অভিবাসন প্রক্রিয়া একটি চলমান বাস্তবতা। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক বাস্তবতায় অভিবাসন প্রক্রিয়া পরিত্যাজ্য হওয়ার সুযোগ কম।
উনিশ শতকের শুরুতে আমেরিকায় পশ্চিমে সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া চলেছিল জোরেশোরে। পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ একর জমির ওপর দখলদারিত্ব বজায় রাখার জন্য, বিশেষ করে ইউরোপের নানা অঞ্চলের মানুষ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। নতুন নতুন খামারের পত্তন হয়। এভাবে আজকের আমেরিকানদের উৎস খুঁজলে অধিকাংশকে এ অভিবাসীদের বংশধর হিসেবেই শনাক্ত করা যাবে।
অভিবাসী কোথায় নেই? অস্ট্রেলিয়ায় খুঁজলে অল্পসংখ্যক আদিবাসী ছাড়া বেশিরভাগই অভিবাসী। সৃষ্টির শুরুতে যখন মানুষের বন্য দশা ছিল তখন স্বাভাবিকভাবেই সে ছিল যাযাবর। ক্ষুণ্নিবৃত্তির জন্য বন থেকে বনে ঘুরে বেড়াতে হতো। তারপর বর্বর দশায় উদ্ভাবন ঘটায়
কৃষির। কৃষির প্রয়োজনে স্থায়ী আবাস গড়তে হয় নদীর তীরে উর্বর মাটির আশ্রয়ে। এখানেও অভিবাসন ঘটে। রুক্ষ অঞ্চলের মানুষ জীবন বাঁচাতে আর জীবন সাজাতে নদীর তীরে এসে নতুন বসতি গড়ে।
ইতিহাসের সূত্র ধরে আদি থেকে বর্তমানে দাঁড়ালে ভারতবর্ষে এবং বাংলায় অভিবাসন কি কম হয়েছে? এখন তো জাতিসংঘের এক অদ্ভুত ব্যাখ্যায় স্থূল সুবিধা পাওয়ার আকাক্সক্ষায় আমাদের দেশের নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সবাই আদিবাসী হতে চায়। এটি কী আত্মপ্রবঞ্চনা নয়! এদেশে আমরা অধিকাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিবাসী। সেই আদি অস্ট্রিক বা অস্ট্রলয়েডগোষ্ঠী অর্থাৎ কোল, মুণ্ডা, সাঁওতাল ছাড়া আদি সূত্রে এ মাটির সন্তান আর কেউ নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সম্প্রদায় সুলতানি যুগের শেষে পনের-ষোল শতকে এবং এরপর মোগল যুগে অভিবাসিত হয়ে বসতি গড়েছিল আমাদের এ ভূখণ্ডে। গারো-হাজং সম্প্রদায় নাগাল্যান্ড, মেঘালয় থেকে অভিবাসিত হয়ে বসতি গড়েছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে। উনিশ শতকে মনিপুরীরা সিলেট অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। এসব হচ্ছে বাস্তবতা। এসবের জন্য কোনো সম্প্র্রদায়ের নিন্দিত বা নন্দিত হওয়ার কারণ নেই। নিন্দিত হতে হয় তখনই যখন অভিবাসী হয়ে আসা কোনো সম্প্র্রদায় নিজেকে সেই মাটির আদিসন্তান বলে পরিচয় দেয়। সুবিধাবাদী সংজ্ঞায় নিজেদের আদিবাসী অর্থাৎ aborigines বলতে চায়। এভাবেই কোনো সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছায় নিজ উৎসকে অস্বীকার করার নজির খুব বেশি নেই।
স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে। এরপর আবার অহেতুক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ চাপানো হল। ইতিহাস মূর্খতা নিয়ে যে ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হল তার মূলে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের তাৎপর্যতে বুঝতে না পারা বা না চাওয়া। ধারণা দেয়া হল বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। তাই এ মাটিতে বসত করা- যারা বাংলা ভাষাভাষী নন (অর্থাৎ ভিনভাষী অভিবাসী) তারা এভাবে বাঙালিত্ব চাপিয়ে দেয়াটাকে অন্যায় বিবেচনা করল এবং ক্ষুব্ধ হল। কিন্তু ইতিহাস কি তা বলে? যখন বাংলা ভাষা এর নির্দিষ্ট অবয়ব নিয়ে দাঁড়ায়নি তখনও বাংলা ভূখণ্ডের অধিবাসী বলে এ অঞ্চলের মানুষ বাঙালি নামে পরিচিত ছিলেন। চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায় এসেছিলেন। সিলেট হয়ে সোনারগাঁ ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। ইবনে বতুতা বাংলার মানুষকে বাঙালি বলেছেন। এর এক দশক পর দিল্লির মুসলমান শাসকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাকে স্বাধীন করেন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ। পুরো বাংলার স্বাধীন সুলতান হওয়ার পর দিল্লির ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারণী ইলিয়াস শাহের নাম উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, সুলতান ইলিয়াস শাহ সুলতান-ই-বাঙালিয়ান অর্থাৎ ইলিয়াস শাহ বাঙালির সুলতান। এতে স্পষ্ট হয় তখন বাংলা ভূখণ্ডের মানুষ বাঙালি নামে পরিচিত ছিল। সারকথা হল স্থানীয় ও অভিবাসী সব মানুষকে স্বাভাবিক নিয়মেই আত্তীকরণ করে ফেলেছিল বাংলার মটি। এভাবে সবাই হয়েছিল গর্বিত বাঙালি।
২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য হয়ে যখন আর্যরা ভারতে প্রবেশ করে, তখন কতদিন তাদের আক্রমণকারী অভিবাসী হিসেবে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পেরেছে ভারতবাসী? একসময় তাদের আত্তীকরণ হয়ে যায়। ভারতীয় অভিধায়ই অভিহিত হয় তারা। এ সূত্রে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও হয় রূপান্তর। আর্য ধর্মগ্রন্থ বেদ ভারতীয় সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে। এ সূত্রেই সনাতন ধর্ম তথা হিন্দু ধর্ম তার নিজস্ব কাঠামোটি পেয়ে যায়। সাত শতক থেকে আরব বাণিজ্য তরী ভারতের পশ্চিম উপকূলে নোঙর করে। শতাধিক বছর ধরে বাণিজ্য সম্প্র্রসারণ করে পশ্চিম উপকূল থেকে দক্ষিণ উপকূল পর্যন্ত। এক পর্যায়ে ভারত মহাসাগর হয়ে ঢুকে পড়ে বঙ্গোপসাগরে। অতিক্রম করে চলে আসে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। এভাবে যে আরব অভিবাসন প্রক্রিয়া চলছিল তাকে কি রুখে দেয়া সম্ভব হয়েছিল, না সে চেষ্টা কেউ করেছে? সুলতানি শাসন পর্বে তুর্কি পাঠান বংশোদ্ভূত মানুষের অভিবাসন হয় ভারতে। মোগল রক্তধারা আসে গজনী, সমরখন্দ, বুখারা ও কাবুল হয়ে। তারাও মিশে গিয়েছিল ভারতীয় জীবনধারায়। মোগল যুগে ইরান থেকে বড় ধরনের অভিবাসন ঘটে ভারতে ও বাংলায়। এসব অভিবাসন ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি সংমিশ্রণ এবং সেই সূত্রে সমন্বয়ের ইতিবাচক প্রবাহের সৃষ্টি করে।
আমাদের বাংলা ভূখণ্ডে অভিবাসন চলেছে দীর্ঘকাল ধরে। আদিবাসী মুণ্ডা সাঁওতালদের সঙ্গে একসময় মিশ্রণ ঘটে আর্য রক্তধারা। উত্তর ভারতের মৌর্য ও গুপ্ত বংশীয় রাজাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ফলে সামরিক এবং বাণিজ্যিক কারণে উত্তর ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীর অভিবাসন ঘটে বাংলায়। অন্তত নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম সমুদ্র উপকূলে সীমিতভাবে হলেও বাণিজ্যিক এবং বৈবাহিক সূত্রে আরব অভিবাসন ঘটে। আট শতক থেকে পাল রাজাদের শাসন যুগে সেনাবাহিনীতে চাকরির সূত্রে ভারতের নানা অঞ্চলের মানুষের অভিবাসন ঘটে বাংলায়। এ পথ ধরেই এগারো শতকে পাল শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক থেকে আসা সেন বংশের ব্রাহ্মণ রাজারা বাংলার রাজক্ষমতা দখল করে। তের শতকের সূচনায় রাজক্ষমতায় মুসলমানদের অনুপ্রবেশের আগ পর্যন্ত বাংলায় দক্ষিণ ভারতীয় অভিবাসন অব্যাহত থাকে।
বাংলায় মুসলমান শাসন অব্যাহত ছিল আঠার শতকের মাঝপর্ব পর্যন্ত। এ দীর্ঘ কালপরিসরে তুর্কি, আরব, আবিসিনিয়ান, আফগান, ইরানি, মোগল নানা ধারার মানুষের অভিবাসন ঘটে এদেশে। এ অভিবাসন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বাভাবিক। এমন স্বাভাবিকতাকে রুখে দেয়ার কথা ভাবেনি কেউ। বরঞ্চ এতে জনগোষ্ঠীর ভেতর সংকরীকরণ ঘটেছে সাড়ম্বরে। সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণে সমাজ সংস্কৃতিই বরং পরিপুষ্ট হয়েছে। উপনিবেশিক যুগেও কি অভিবাসন প্রক্রিয়া থেমে গিয়েছিল? ইউরোপীয় বণিকদের আগমন ও অভিবাসনকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। শুরুর দিকে আর্মেনীয় বণিকদের বাণিজ্যিক বসতি গড়ে উঠেছিল ঢাকায়। আর্মানিটোলা নামটি এখনও সে স্মৃতি বহন করে।
এসব কারণে বৈশ্বিক বাস্তবতাতেই যুগ যুগ ধরেই অভিবাসন একটি চলমান বাস্তবতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওবামার বৈধতা দেয়ার প্রস্তাব হবে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার আইনি নিষ্পত্তি। বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রায় দশ লাখ অবৈধ বাংলাদেশী ওবামার সিদ্ধান্তের ফলে বৈধ হওয়ার সুযোগ পাবে। তবে এ সত্যটিও মানতে হবে, এসব বাংলাদেশী অভিবাসীকে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদা নিয়েই থাকতে হবে। কারণ নতুন আইন অনুযায়ী এসব বৈধতা পাওয়া অভিবাসী ভোটাধিকার বা সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ও বীমা সুবিধা পাবেন না। তবে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ও ব্যাংক হিসাব খোলাসহ ন্যূনতম সুবিধাগুলো তাদের জন্য সম্প্রসারিত হবে। এছাড়া উচ্চ ডিগ্রিধারী ও দক্ষ প্রযুক্তিকর্মীদের জন্য বৈধতার এ সুযোগ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। রিপাবলিকানরা যে দৃষ্টিতেই বিরোধিতা করুক না কেন, এ অভিবাসীরা কখনও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে না। বরঞ্চ এসব মানুষের মেধা আর শ্রমকে কাজে লাগাতে পারবে ওবামার দেশ। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্র বিকাশে অভিবাসীরা সব দেশে সব সময়েই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
তবে মানতে হবে রিপাবলিকানদের প্রতিক্রিয়া অনেকটাই রাজনৈতিক বিরুদ্ধাচরণ। কারণ ইতিহাসের আদিকাল থেকেই অভিবাসন প্রক্রিয়া একটি চলমান বাস্তবতা। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক বাস্তবতায় অভিবাসন প্রক্রিয়া পরিত্যাজ্য হওয়ার সুযোগ কম।
উনিশ শতকের শুরুতে আমেরিকায় পশ্চিমে সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া চলেছিল জোরেশোরে। পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ একর জমির ওপর দখলদারিত্ব বজায় রাখার জন্য, বিশেষ করে ইউরোপের নানা অঞ্চলের মানুষ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। নতুন নতুন খামারের পত্তন হয়। এভাবে আজকের আমেরিকানদের উৎস খুঁজলে অধিকাংশকে এ অভিবাসীদের বংশধর হিসেবেই শনাক্ত করা যাবে।
অভিবাসী কোথায় নেই? অস্ট্রেলিয়ায় খুঁজলে অল্পসংখ্যক আদিবাসী ছাড়া বেশিরভাগই অভিবাসী। সৃষ্টির শুরুতে যখন মানুষের বন্য দশা ছিল তখন স্বাভাবিকভাবেই সে ছিল যাযাবর। ক্ষুণ্নিবৃত্তির জন্য বন থেকে বনে ঘুরে বেড়াতে হতো। তারপর বর্বর দশায় উদ্ভাবন ঘটায়
কৃষির। কৃষির প্রয়োজনে স্থায়ী আবাস গড়তে হয় নদীর তীরে উর্বর মাটির আশ্রয়ে। এখানেও অভিবাসন ঘটে। রুক্ষ অঞ্চলের মানুষ জীবন বাঁচাতে আর জীবন সাজাতে নদীর তীরে এসে নতুন বসতি গড়ে।
ইতিহাসের সূত্র ধরে আদি থেকে বর্তমানে দাঁড়ালে ভারতবর্ষে এবং বাংলায় অভিবাসন কি কম হয়েছে? এখন তো জাতিসংঘের এক অদ্ভুত ব্যাখ্যায় স্থূল সুবিধা পাওয়ার আকাক্সক্ষায় আমাদের দেশের নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সবাই আদিবাসী হতে চায়। এটি কী আত্মপ্রবঞ্চনা নয়! এদেশে আমরা অধিকাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিবাসী। সেই আদি অস্ট্রিক বা অস্ট্রলয়েডগোষ্ঠী অর্থাৎ কোল, মুণ্ডা, সাঁওতাল ছাড়া আদি সূত্রে এ মাটির সন্তান আর কেউ নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সম্প্রদায় সুলতানি যুগের শেষে পনের-ষোল শতকে এবং এরপর মোগল যুগে অভিবাসিত হয়ে বসতি গড়েছিল আমাদের এ ভূখণ্ডে। গারো-হাজং সম্প্রদায় নাগাল্যান্ড, মেঘালয় থেকে অভিবাসিত হয়ে বসতি গড়েছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে। উনিশ শতকে মনিপুরীরা সিলেট অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। এসব হচ্ছে বাস্তবতা। এসবের জন্য কোনো সম্প্র্রদায়ের নিন্দিত বা নন্দিত হওয়ার কারণ নেই। নিন্দিত হতে হয় তখনই যখন অভিবাসী হয়ে আসা কোনো সম্প্র্রদায় নিজেকে সেই মাটির আদিসন্তান বলে পরিচয় দেয়। সুবিধাবাদী সংজ্ঞায় নিজেদের আদিবাসী অর্থাৎ aborigines বলতে চায়। এভাবেই কোনো সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছায় নিজ উৎসকে অস্বীকার করার নজির খুব বেশি নেই।
স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে। এরপর আবার অহেতুক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ চাপানো হল। ইতিহাস মূর্খতা নিয়ে যে ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হল তার মূলে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের তাৎপর্যতে বুঝতে না পারা বা না চাওয়া। ধারণা দেয়া হল বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। তাই এ মাটিতে বসত করা- যারা বাংলা ভাষাভাষী নন (অর্থাৎ ভিনভাষী অভিবাসী) তারা এভাবে বাঙালিত্ব চাপিয়ে দেয়াটাকে অন্যায় বিবেচনা করল এবং ক্ষুব্ধ হল। কিন্তু ইতিহাস কি তা বলে? যখন বাংলা ভাষা এর নির্দিষ্ট অবয়ব নিয়ে দাঁড়ায়নি তখনও বাংলা ভূখণ্ডের অধিবাসী বলে এ অঞ্চলের মানুষ বাঙালি নামে পরিচিত ছিলেন। চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায় এসেছিলেন। সিলেট হয়ে সোনারগাঁ ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। ইবনে বতুতা বাংলার মানুষকে বাঙালি বলেছেন। এর এক দশক পর দিল্লির মুসলমান শাসকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাকে স্বাধীন করেন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ। পুরো বাংলার স্বাধীন সুলতান হওয়ার পর দিল্লির ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারণী ইলিয়াস শাহের নাম উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, সুলতান ইলিয়াস শাহ সুলতান-ই-বাঙালিয়ান অর্থাৎ ইলিয়াস শাহ বাঙালির সুলতান। এতে স্পষ্ট হয় তখন বাংলা ভূখণ্ডের মানুষ বাঙালি নামে পরিচিত ছিল। সারকথা হল স্থানীয় ও অভিবাসী সব মানুষকে স্বাভাবিক নিয়মেই আত্তীকরণ করে ফেলেছিল বাংলার মটি। এভাবে সবাই হয়েছিল গর্বিত বাঙালি।
২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য হয়ে যখন আর্যরা ভারতে প্রবেশ করে, তখন কতদিন তাদের আক্রমণকারী অভিবাসী হিসেবে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পেরেছে ভারতবাসী? একসময় তাদের আত্তীকরণ হয়ে যায়। ভারতীয় অভিধায়ই অভিহিত হয় তারা। এ সূত্রে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও হয় রূপান্তর। আর্য ধর্মগ্রন্থ বেদ ভারতীয় সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে। এ সূত্রেই সনাতন ধর্ম তথা হিন্দু ধর্ম তার নিজস্ব কাঠামোটি পেয়ে যায়। সাত শতক থেকে আরব বাণিজ্য তরী ভারতের পশ্চিম উপকূলে নোঙর করে। শতাধিক বছর ধরে বাণিজ্য সম্প্র্রসারণ করে পশ্চিম উপকূল থেকে দক্ষিণ উপকূল পর্যন্ত। এক পর্যায়ে ভারত মহাসাগর হয়ে ঢুকে পড়ে বঙ্গোপসাগরে। অতিক্রম করে চলে আসে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। এভাবে যে আরব অভিবাসন প্রক্রিয়া চলছিল তাকে কি রুখে দেয়া সম্ভব হয়েছিল, না সে চেষ্টা কেউ করেছে? সুলতানি শাসন পর্বে তুর্কি পাঠান বংশোদ্ভূত মানুষের অভিবাসন হয় ভারতে। মোগল রক্তধারা আসে গজনী, সমরখন্দ, বুখারা ও কাবুল হয়ে। তারাও মিশে গিয়েছিল ভারতীয় জীবনধারায়। মোগল যুগে ইরান থেকে বড় ধরনের অভিবাসন ঘটে ভারতে ও বাংলায়। এসব অভিবাসন ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি সংমিশ্রণ এবং সেই সূত্রে সমন্বয়ের ইতিবাচক প্রবাহের সৃষ্টি করে।
আমাদের বাংলা ভূখণ্ডে অভিবাসন চলেছে দীর্ঘকাল ধরে। আদিবাসী মুণ্ডা সাঁওতালদের সঙ্গে একসময় মিশ্রণ ঘটে আর্য রক্তধারা। উত্তর ভারতের মৌর্য ও গুপ্ত বংশীয় রাজাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ফলে সামরিক এবং বাণিজ্যিক কারণে উত্তর ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীর অভিবাসন ঘটে বাংলায়। অন্তত নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম সমুদ্র উপকূলে সীমিতভাবে হলেও বাণিজ্যিক এবং বৈবাহিক সূত্রে আরব অভিবাসন ঘটে। আট শতক থেকে পাল রাজাদের শাসন যুগে সেনাবাহিনীতে চাকরির সূত্রে ভারতের নানা অঞ্চলের মানুষের অভিবাসন ঘটে বাংলায়। এ পথ ধরেই এগারো শতকে পাল শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক থেকে আসা সেন বংশের ব্রাহ্মণ রাজারা বাংলার রাজক্ষমতা দখল করে। তের শতকের সূচনায় রাজক্ষমতায় মুসলমানদের অনুপ্রবেশের আগ পর্যন্ত বাংলায় দক্ষিণ ভারতীয় অভিবাসন অব্যাহত থাকে।
বাংলায় মুসলমান শাসন অব্যাহত ছিল আঠার শতকের মাঝপর্ব পর্যন্ত। এ দীর্ঘ কালপরিসরে তুর্কি, আরব, আবিসিনিয়ান, আফগান, ইরানি, মোগল নানা ধারার মানুষের অভিবাসন ঘটে এদেশে। এ অভিবাসন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বাভাবিক। এমন স্বাভাবিকতাকে রুখে দেয়ার কথা ভাবেনি কেউ। বরঞ্চ এতে জনগোষ্ঠীর ভেতর সংকরীকরণ ঘটেছে সাড়ম্বরে। সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণে সমাজ সংস্কৃতিই বরং পরিপুষ্ট হয়েছে। উপনিবেশিক যুগেও কি অভিবাসন প্রক্রিয়া থেমে গিয়েছিল? ইউরোপীয় বণিকদের আগমন ও অভিবাসনকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। শুরুর দিকে আর্মেনীয় বণিকদের বাণিজ্যিক বসতি গড়ে উঠেছিল ঢাকায়। আর্মানিটোলা নামটি এখনও সে স্মৃতি বহন করে।
এসব কারণে বৈশ্বিক বাস্তবতাতেই যুগ যুগ ধরেই অভিবাসন একটি চলমান বাস্তবতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওবামার বৈধতা দেয়ার প্রস্তাব হবে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার আইনি নিষ্পত্তি। বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রায় দশ লাখ অবৈধ বাংলাদেশী ওবামার সিদ্ধান্তের ফলে বৈধ হওয়ার সুযোগ পাবে। তবে এ সত্যটিও মানতে হবে, এসব বাংলাদেশী অভিবাসীকে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদা নিয়েই থাকতে হবে। কারণ নতুন আইন অনুযায়ী এসব বৈধতা পাওয়া অভিবাসী ভোটাধিকার বা সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ও বীমা সুবিধা পাবেন না। তবে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ও ব্যাংক হিসাব খোলাসহ ন্যূনতম সুবিধাগুলো তাদের জন্য সম্প্রসারিত হবে। এছাড়া উচ্চ ডিগ্রিধারী ও দক্ষ প্রযুক্তিকর্মীদের জন্য বৈধতার এ সুযোগ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। রিপাবলিকানরা যে দৃষ্টিতেই বিরোধিতা করুক না কেন, এ অভিবাসীরা কখনও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে না। বরঞ্চ এসব মানুষের মেধা আর শ্রমকে কাজে লাগাতে পারবে ওবামার দেশ। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্র বিকাশে অভিবাসীরা সব দেশে সব সময়েই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments