টাকা পাচার বাড়ছেই
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের ঘটনা বেড়েই চলেছে। প্রতিবছর গড়ে ১৭
কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে
যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা পদ্ধতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন
কর্মকর্তার তৈরি একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে তিনি বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে পাচার করা টাকা সম্পর্কে
বিভিন্ন ধরনের তথ্য পেয়েছেন। ওইসব তথ্যে পাচার করা টাকার অংক আরও বেশি বা
কম দেখানো হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, চোরাচালন, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য দেখান এবং রফতানির ক্ষেত্রে কম দেখানো এবং হুন্ডি প্রধানত এই তিনটি পথে দেশ থেকে প্রতিবছর ওই টাকা পাচার হচ্ছে। টাকা পাচারের কারণ হিসেবে দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মুদ্রার অতিমূল্যায়িত বিনিময় হার, আর্থিক খাতের অদক্ষতা, কর নীতিতে বৈষম্য, মুদ্রার চলাচলে কঠোরতা আরোপ, ভারতীয় অর্থনীতির প্রভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার নিয়ে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান গবেষণা করেছে। তাদের প্রত্যেক গবেষণায়ই দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা বেরিয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে এক বছরের ব্যবধানে দেশে টাকা পাচার ২০০ শতাংশ বেড়েছে বলে বলা হয়েছে। ২০১১ সালে দেশ থেকে পাচার হয়েছিল ৫৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৪ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৮ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় ১৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিলের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত চার দশকে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আবদুল আউয়াল সরকার বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের বিষয়ে একটি গবেষণা তৈরি করেছিলেন। ‘বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য নীতি পরামর্শ’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনটিতে তিনি দেশ থেকে টাকা পাচারের কারণ, কিভাবে পাচার হয়, পাচার রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি পদক্ষেপ নিতে পারে এসব বিষয়ে সুপারিশ উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বিশ্বব্যাংকের পদ্ধতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের বেশ কিছু তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ১৯৯৪ সালে ১০৬ কোটি ডলার, ১৯৯৬ সালে ১৮২ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ১৯৯৮ সালে ১২২ কোটি ডলার, ২০০০ সালে ১১৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০০১ সালে ১৬৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার, ২০০২ সালে ১৪৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৮৯ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং ২০০৭ সালে ১৩২ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাচার করার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অর্থপাচার রোধে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি এখন অনেক বেড়েছে। ফলে ব্যাংকের মাধ্যমে মুদ্রা পাচার নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এছাড়া কাস্টমসের কার্যক্রম অটোমেশন করা হয়েছে। তাই মিস ইনভয়েসিং করা আগের চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে গেছে। ফলে বিদেশে অর্থ পাচার আগের চেয়ে কমেছে।
তবে তিনি সোমবার রাতে প্রকাশিত জিএফআইর প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, দালিলিকভাবে টাকা পাচারের তথ্য-প্রমাণ করা খুব কঠিন। আগে যেভাবে পাচার হতো। এখন তা অনেক কমে গেছে।
মুদ্রা পাচারের কারণ : গবেষণায় মুদ্রা পাচারের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, মুদ্রার অতিমূল্যায়িত বিনিময় হার, আর্থিক খাতের অদক্ষতা, কর নীতিতে বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মুদ্রার চলাচলে কঠোরতা আরোপ, ভারতীয় অর্থনীতির প্রভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, যেখানে মুদ্রার নিশ্চয়তা ও বাড়তি মুনাফার সুযোগ মেলে সেখানে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনুন্নত দেশগুলো তাদের দেশ থেকে মুদ্রা যাতে অবাধে চলে যেতে না পারে সে কারণে নানা ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ করে মুদ্রার লেনদেনের ওপর। ফলে যাদের টাকা আছে তারা যে কোনো উপায়ে তা পাচার করার পথ খুঁজে এই প্রক্রিয়ায় টাকা দেশের বাইরে চলে যায়।
টাকা পাচার রোধে করণীয় : টাকা পাচার রোধে কর নীতি সমন্বয় করা, বিনিময় হার নমনীয় করা, সরকার পরিচালনায় সুশাসন নিশ্চিত করা, ব্যাংকিং খাতে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন তদারকি বাড়ানো, প্রদর্শিত ও অপ্রদর্শিত আয়ের ব্যাপারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, শেয়ারবাজার ও মুদ্রাবাজারের লেনদেন পদ্ধতিতে আধুনিকায়ন করা, অবৈধ বৈদেশিক মুদ্রা বাজার বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
অর্থ পাচার রোধে প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্ভিলেন্স এবং তদারকি দায়িত্ব স্বাধীন অন্য একটি সংস্থার কাছে ছেড়ে দিতে পারে। প্রয়োজনীয় নীতি এবং তদারকির মাধ্যমে ব্যাংকিং সিস্টেমকে আরও যুগোপযোগী করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ অবৈধ কার্ব মার্কেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের কথা শোনা যায়। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে টাকা পাচার হয়। সাধারণত আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়। তবে বিষয়টি তদন্ত করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, একদিকে সরকার বিদেশ ঋণ ও অনুদান নিচ্ছে, অন্যদিকে দেশের নিজস্ব আয় বাইরে চলে যাচ্ছে। এটি স্ববিরোধী। দেশ থেকে টাকা পাচার ঠেকানো গেলে বৈদেশিক নির্ভরশীলতার প্রয়োজন হবে না।
আমদানির নামে মুদ্রা পাচার : গত অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এই ৬ মাসে ব্যাংকগুলোতে হঠাৎ করে বেড়ে যায় শিল্পঋণ বিতরণের পরিমাণ। এ ঋণের বড় অংশই ব্যয় হয়েছে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ওই ৬ মাসে শিল্পঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৮০ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে একই সময়ে এই ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৭১ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। ওই সময়ে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১২ দশমিক ২৬ শতাংশ। যদিও ওই সময়ে মেয়াদি ঋণ বিতরণ ১ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে, চলতি মূলধন ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। প্রচলিত নিয়মে মেয়াদি ঋণ বাড়লে চলতি মূলধন ঋণ বিতরণও বাড়ে। কিন্তু মেয়াদি ঋণ বিতরণ কমলেও সাধারণত চলতি মূলধন ঋণ বাড়ার যুক্তি নেই।
গত বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছে। ওই সময়ে ঋণের একটি বড় অংশ দেশ থেকে পাচার হয়ে যায়। এর আগেও বিভিন্ন সরকারের শেষ সময়ে দেশ থেকে টাকা পাচার হওয়ার নজির পাওয়া গেছে। যে কারণে ওই সময়ে একদিকে যেমন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ কমেছে, তেমনি দেশে কার্ব মার্কেটে ডলারের দামও বেড়ে যায়। মূলত এসব কারণেই ওই সময়ে শিল্প ঋণের একটি অংশ দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। এছাড়া আরও একটি বড় প্রমাণ মিলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তদন্তে।
ঋণের বিপরীতে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে। কিন্তু শিল্পের পণ্য আসেনি। এ সবের বদলে কন্টেইনারে এসেছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের ব্লক। এছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে খালি কনটেইনার আসার ঘটনাও ধরা পড়েছে। এর মধ্যে এবি অ্যান্ড ডি কর্পোরেশন, আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়াম, এসআর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ, এসএল স্টিল এবং এলএসআই, ইয়াছির এন্টারপ্রাইজ ও সেবা এন্টারগ্রাইজের নামে এসব জালিয়াতি হয়েছে। চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার, মার্কেন্টাইল, সোনালী ও কমার্স ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় এসব এলসি খোলা হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা মনে করছেন, এর মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার করা হয়েছে। ঘোষণা অনুযায়ী সাম্প্রতিক সময়ে দেশে পণ্য না আসার প্রবণতাও বেড়েছে।
রফতানির নামে মুদ্রা পাচার : সাম্প্রতিক সময়ে ভুয়া রফতানি এলসি এবং ক্রয়চুক্তির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনা ধরা পড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখা থেকে এ ধরনের পাচারের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জের টানবাজার শাখায় রফতানিতে ভুয়া ঋণপত্র খুলে এবং রফতানি মূল্য দেশে না এনে বিদেশে রেখে দেয়ার মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়েছে। ভুয়া রফতানি এলসি এবং ক্রয়চুক্তির ফটোকপির বিপরীতে রফতানি কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। মেসার্স আলমাস নিট ওয়্যার কোনোরূপ ব্যবসায়িক সম্পর্ক ব্যতীত ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলে। রফতানি এলসি ব্যাংকিং চ্যানেলে না এসে রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান নিজেই ব্যাংকের শাখায় দাখিল করে। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক সঠিকতা যাচাই-বাছাই ছাড়া এক লাখ সাত ডলারের ঋণপত্র স্থাপন করে। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার ক্রেতা ‘টিএসকো পিটিওয়াই’ ক্রেডিট প্রতিবেদন ব্যতীত ঋণপত্র খোলা হয়েছে। পরে এলসির তথ্য বিদেশী ক্রেতার ব্যাংকে ‘ন্যাশনাল অস্ট্রেলিয়া ব্যাংক’ পাঠিয়ে দেখা যায়, ওই নামে তাদের কোনো গ্রাহক নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল মনে করে, রফতানিকারক এবং শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অনৈতিকভাবে ভুয়া রফতানির বিপরীতে অর্থ পাচার করেছেন। মেসার্স আল-ফালাহ নিট গার্মেন্টস এবং নরওয়ের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘পিপপারমিন্ট নরজ’ মধ্যকার ক্রয় চুক্তির ফটোকপির বিপরীতে ৩২ হাজার ২০০ ডলারের মূল্যের পোশাক রফতানি করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন আইনের নির্দেশনায় ক্রয় চুক্তির সঠিকতা যাচাই এবং বিদেশী ক্রেতার ক্রেডিট প্রতিবেদন ছাড়াই রফতানি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। ব্যাংকের রফতানি মূল্য আদায়ে নরডিয়া ব্যাংক নরজ এএসএ তথ্য প্রেরণ করলে সংশ্লিষ্ট ক্রেতার হদিস মেলেনি।
এছাড়া বেসিক ব্যাংক থেকে রফতানি করেও দেশে রফতানির মূল্য আনা হয়নি। এর মাধ্যমে প্রায় ১৭৭ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এর বাইরে আরও টাকা পাচারের ঘটনা কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্ঘাটন করেছে।
মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে পাচার ৪ হাজার কোটি টাকা : মালয়েশিয়া সরকার বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে ২০০২ সালে চালু করে ‘মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচি। এতে যারা বিনিয়োগ করবেন তাদের সে দেশে নানা ধরনের সুযোগ দেয়া হবে। আগে ওই কর্মসূচিতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশের নাম ছিল না। বর্তমানে এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চীন এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তিন হাজারের বেশি বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় আবাস গড়েছেন। এতে তারা বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। যা বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। এই তালিকায় আছেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা। ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো ৩২ জন বাংলাদেশী সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করেন। ২০০৪ সালে এতে বিনিয়োগ করেন ২০৪ জন, ২০০৫ সালে ৮৫২ জন, ২০০৬ সালে ৩৪১ জন, ২০০৭ সালে ১৪৯ জন, ২০০৮ সালে ৬৮জন, ২০০৯ সালে ৮৬ জন এবং ২০১০ সালে ৭৪ জন, ২০১১ সালে ২৭৬ জন, ২০১২ সালে ৩৮৮ জন, ২০১৩ সালে ২৮৫ জন এবং ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত ১৭৫ জন বাংলাদেশী সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করেছেন।
মালয়েশিয়ার সরকারের নিয়ম অনুযায়ী সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে কেউ সে দেশে আবাস গড়ে তুলতে চাইলে তাকে নগদ এক কোটি ২৫ লাখ টাকা বা ৫ লাখ রিঙ্গিত (মালয়েশিয়ান মুদ্রার নাম) মালয়েশিয়ায় নিয়ে যেতে হবে।
সিঙ্গাপুরে টাকা পাচার হচ্ছে : বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে টাকা পাচার করা হচ্ছে। পাচার করা টাকায় সিঙ্গাপুরে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বাংলাদেশের কয়েকজন রাজনীতিবিদের নামে সিঙ্গপুরের মিষ্টির দোকান, রেস্টুরেন্ট ও তেলের পাম্প রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
যুক্তরাজ্যেও টাকা পাচার : বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে টাকা পাচার করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশের কয়েকজন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর নামে টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে।
যুক্তরাজ্যের শক্তিশালী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা শাখার তদন্তে সে দেশে বাংলাদেশের কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীর নামে টাকা রাখার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু পরে এ বিষয়ে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে আর কোনো কাজ করেনি। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো এখন পড়ে আছে।
এছাড়া একজন ব্যবসায়ীর নামে সে দেশের একটি ব্যাংকে ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। সে কার্ডের মাধ্যমে ওই ব্যবসায়ী ৩৫০ কোটি টাকা খরচ করেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, চোরাচালন, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য দেখান এবং রফতানির ক্ষেত্রে কম দেখানো এবং হুন্ডি প্রধানত এই তিনটি পথে দেশ থেকে প্রতিবছর ওই টাকা পাচার হচ্ছে। টাকা পাচারের কারণ হিসেবে দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মুদ্রার অতিমূল্যায়িত বিনিময় হার, আর্থিক খাতের অদক্ষতা, কর নীতিতে বৈষম্য, মুদ্রার চলাচলে কঠোরতা আরোপ, ভারতীয় অর্থনীতির প্রভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার নিয়ে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান গবেষণা করেছে। তাদের প্রত্যেক গবেষণায়ই দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা বেরিয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে এক বছরের ব্যবধানে দেশে টাকা পাচার ২০০ শতাংশ বেড়েছে বলে বলা হয়েছে। ২০১১ সালে দেশ থেকে পাচার হয়েছিল ৫৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৪ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৮ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় ১৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিলের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত চার দশকে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আবদুল আউয়াল সরকার বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের বিষয়ে একটি গবেষণা তৈরি করেছিলেন। ‘বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য নীতি পরামর্শ’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনটিতে তিনি দেশ থেকে টাকা পাচারের কারণ, কিভাবে পাচার হয়, পাচার রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি পদক্ষেপ নিতে পারে এসব বিষয়ে সুপারিশ উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বিশ্বব্যাংকের পদ্ধতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের বেশ কিছু তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ১৯৯৪ সালে ১০৬ কোটি ডলার, ১৯৯৬ সালে ১৮২ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ১৯৯৮ সালে ১২২ কোটি ডলার, ২০০০ সালে ১১৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০০১ সালে ১৬৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার, ২০০২ সালে ১৪৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৮৯ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং ২০০৭ সালে ১৩২ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাচার করার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অর্থপাচার রোধে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি এখন অনেক বেড়েছে। ফলে ব্যাংকের মাধ্যমে মুদ্রা পাচার নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এছাড়া কাস্টমসের কার্যক্রম অটোমেশন করা হয়েছে। তাই মিস ইনভয়েসিং করা আগের চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে গেছে। ফলে বিদেশে অর্থ পাচার আগের চেয়ে কমেছে।
তবে তিনি সোমবার রাতে প্রকাশিত জিএফআইর প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, দালিলিকভাবে টাকা পাচারের তথ্য-প্রমাণ করা খুব কঠিন। আগে যেভাবে পাচার হতো। এখন তা অনেক কমে গেছে।
মুদ্রা পাচারের কারণ : গবেষণায় মুদ্রা পাচারের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, মুদ্রার অতিমূল্যায়িত বিনিময় হার, আর্থিক খাতের অদক্ষতা, কর নীতিতে বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মুদ্রার চলাচলে কঠোরতা আরোপ, ভারতীয় অর্থনীতির প্রভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, যেখানে মুদ্রার নিশ্চয়তা ও বাড়তি মুনাফার সুযোগ মেলে সেখানে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনুন্নত দেশগুলো তাদের দেশ থেকে মুদ্রা যাতে অবাধে চলে যেতে না পারে সে কারণে নানা ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ করে মুদ্রার লেনদেনের ওপর। ফলে যাদের টাকা আছে তারা যে কোনো উপায়ে তা পাচার করার পথ খুঁজে এই প্রক্রিয়ায় টাকা দেশের বাইরে চলে যায়।
টাকা পাচার রোধে করণীয় : টাকা পাচার রোধে কর নীতি সমন্বয় করা, বিনিময় হার নমনীয় করা, সরকার পরিচালনায় সুশাসন নিশ্চিত করা, ব্যাংকিং খাতে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন তদারকি বাড়ানো, প্রদর্শিত ও অপ্রদর্শিত আয়ের ব্যাপারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, শেয়ারবাজার ও মুদ্রাবাজারের লেনদেন পদ্ধতিতে আধুনিকায়ন করা, অবৈধ বৈদেশিক মুদ্রা বাজার বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
অর্থ পাচার রোধে প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্ভিলেন্স এবং তদারকি দায়িত্ব স্বাধীন অন্য একটি সংস্থার কাছে ছেড়ে দিতে পারে। প্রয়োজনীয় নীতি এবং তদারকির মাধ্যমে ব্যাংকিং সিস্টেমকে আরও যুগোপযোগী করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ অবৈধ কার্ব মার্কেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের কথা শোনা যায়। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে টাকা পাচার হয়। সাধারণত আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়। তবে বিষয়টি তদন্ত করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, একদিকে সরকার বিদেশ ঋণ ও অনুদান নিচ্ছে, অন্যদিকে দেশের নিজস্ব আয় বাইরে চলে যাচ্ছে। এটি স্ববিরোধী। দেশ থেকে টাকা পাচার ঠেকানো গেলে বৈদেশিক নির্ভরশীলতার প্রয়োজন হবে না।
আমদানির নামে মুদ্রা পাচার : গত অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এই ৬ মাসে ব্যাংকগুলোতে হঠাৎ করে বেড়ে যায় শিল্পঋণ বিতরণের পরিমাণ। এ ঋণের বড় অংশই ব্যয় হয়েছে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ওই ৬ মাসে শিল্পঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৮০ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে একই সময়ে এই ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৭১ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। ওই সময়ে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১২ দশমিক ২৬ শতাংশ। যদিও ওই সময়ে মেয়াদি ঋণ বিতরণ ১ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে, চলতি মূলধন ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। প্রচলিত নিয়মে মেয়াদি ঋণ বাড়লে চলতি মূলধন ঋণ বিতরণও বাড়ে। কিন্তু মেয়াদি ঋণ বিতরণ কমলেও সাধারণত চলতি মূলধন ঋণ বাড়ার যুক্তি নেই।
গত বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছে। ওই সময়ে ঋণের একটি বড় অংশ দেশ থেকে পাচার হয়ে যায়। এর আগেও বিভিন্ন সরকারের শেষ সময়ে দেশ থেকে টাকা পাচার হওয়ার নজির পাওয়া গেছে। যে কারণে ওই সময়ে একদিকে যেমন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ কমেছে, তেমনি দেশে কার্ব মার্কেটে ডলারের দামও বেড়ে যায়। মূলত এসব কারণেই ওই সময়ে শিল্প ঋণের একটি অংশ দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। এছাড়া আরও একটি বড় প্রমাণ মিলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তদন্তে।
ঋণের বিপরীতে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে। কিন্তু শিল্পের পণ্য আসেনি। এ সবের বদলে কন্টেইনারে এসেছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের ব্লক। এছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে খালি কনটেইনার আসার ঘটনাও ধরা পড়েছে। এর মধ্যে এবি অ্যান্ড ডি কর্পোরেশন, আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়াম, এসআর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ, এসএল স্টিল এবং এলএসআই, ইয়াছির এন্টারপ্রাইজ ও সেবা এন্টারগ্রাইজের নামে এসব জালিয়াতি হয়েছে। চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার, মার্কেন্টাইল, সোনালী ও কমার্স ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় এসব এলসি খোলা হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা মনে করছেন, এর মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার করা হয়েছে। ঘোষণা অনুযায়ী সাম্প্রতিক সময়ে দেশে পণ্য না আসার প্রবণতাও বেড়েছে।
রফতানির নামে মুদ্রা পাচার : সাম্প্রতিক সময়ে ভুয়া রফতানি এলসি এবং ক্রয়চুক্তির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনা ধরা পড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখা থেকে এ ধরনের পাচারের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জের টানবাজার শাখায় রফতানিতে ভুয়া ঋণপত্র খুলে এবং রফতানি মূল্য দেশে না এনে বিদেশে রেখে দেয়ার মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়েছে। ভুয়া রফতানি এলসি এবং ক্রয়চুক্তির ফটোকপির বিপরীতে রফতানি কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। মেসার্স আলমাস নিট ওয়্যার কোনোরূপ ব্যবসায়িক সম্পর্ক ব্যতীত ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলে। রফতানি এলসি ব্যাংকিং চ্যানেলে না এসে রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান নিজেই ব্যাংকের শাখায় দাখিল করে। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক সঠিকতা যাচাই-বাছাই ছাড়া এক লাখ সাত ডলারের ঋণপত্র স্থাপন করে। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার ক্রেতা ‘টিএসকো পিটিওয়াই’ ক্রেডিট প্রতিবেদন ব্যতীত ঋণপত্র খোলা হয়েছে। পরে এলসির তথ্য বিদেশী ক্রেতার ব্যাংকে ‘ন্যাশনাল অস্ট্রেলিয়া ব্যাংক’ পাঠিয়ে দেখা যায়, ওই নামে তাদের কোনো গ্রাহক নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল মনে করে, রফতানিকারক এবং শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অনৈতিকভাবে ভুয়া রফতানির বিপরীতে অর্থ পাচার করেছেন। মেসার্স আল-ফালাহ নিট গার্মেন্টস এবং নরওয়ের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘পিপপারমিন্ট নরজ’ মধ্যকার ক্রয় চুক্তির ফটোকপির বিপরীতে ৩২ হাজার ২০০ ডলারের মূল্যের পোশাক রফতানি করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন আইনের নির্দেশনায় ক্রয় চুক্তির সঠিকতা যাচাই এবং বিদেশী ক্রেতার ক্রেডিট প্রতিবেদন ছাড়াই রফতানি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। ব্যাংকের রফতানি মূল্য আদায়ে নরডিয়া ব্যাংক নরজ এএসএ তথ্য প্রেরণ করলে সংশ্লিষ্ট ক্রেতার হদিস মেলেনি।
এছাড়া বেসিক ব্যাংক থেকে রফতানি করেও দেশে রফতানির মূল্য আনা হয়নি। এর মাধ্যমে প্রায় ১৭৭ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এর বাইরে আরও টাকা পাচারের ঘটনা কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্ঘাটন করেছে।
মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে পাচার ৪ হাজার কোটি টাকা : মালয়েশিয়া সরকার বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে ২০০২ সালে চালু করে ‘মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচি। এতে যারা বিনিয়োগ করবেন তাদের সে দেশে নানা ধরনের সুযোগ দেয়া হবে। আগে ওই কর্মসূচিতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশের নাম ছিল না। বর্তমানে এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চীন এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তিন হাজারের বেশি বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় আবাস গড়েছেন। এতে তারা বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। যা বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। এই তালিকায় আছেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা। ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো ৩২ জন বাংলাদেশী সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করেন। ২০০৪ সালে এতে বিনিয়োগ করেন ২০৪ জন, ২০০৫ সালে ৮৫২ জন, ২০০৬ সালে ৩৪১ জন, ২০০৭ সালে ১৪৯ জন, ২০০৮ সালে ৬৮জন, ২০০৯ সালে ৮৬ জন এবং ২০১০ সালে ৭৪ জন, ২০১১ সালে ২৭৬ জন, ২০১২ সালে ৩৮৮ জন, ২০১৩ সালে ২৮৫ জন এবং ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত ১৭৫ জন বাংলাদেশী সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করেছেন।
মালয়েশিয়ার সরকারের নিয়ম অনুযায়ী সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে কেউ সে দেশে আবাস গড়ে তুলতে চাইলে তাকে নগদ এক কোটি ২৫ লাখ টাকা বা ৫ লাখ রিঙ্গিত (মালয়েশিয়ান মুদ্রার নাম) মালয়েশিয়ায় নিয়ে যেতে হবে।
সিঙ্গাপুরে টাকা পাচার হচ্ছে : বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে টাকা পাচার করা হচ্ছে। পাচার করা টাকায় সিঙ্গাপুরে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বাংলাদেশের কয়েকজন রাজনীতিবিদের নামে সিঙ্গপুরের মিষ্টির দোকান, রেস্টুরেন্ট ও তেলের পাম্প রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
যুক্তরাজ্যেও টাকা পাচার : বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে টাকা পাচার করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশের কয়েকজন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর নামে টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে।
যুক্তরাজ্যের শক্তিশালী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা শাখার তদন্তে সে দেশে বাংলাদেশের কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীর নামে টাকা রাখার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু পরে এ বিষয়ে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে আর কোনো কাজ করেনি। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো এখন পড়ে আছে।
এছাড়া একজন ব্যবসায়ীর নামে সে দেশের একটি ব্যাংকে ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। সে কার্ডের মাধ্যমে ওই ব্যবসায়ী ৩৫০ কোটি টাকা খরচ করেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
No comments