জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট গঠনের কাফ্ফারা দিতে হচ্ছে গোটা জাতিকে by ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ১৯৭১
সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের
স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা স্বীকার করতে না
চাইলেও তার সেই ঘোষণা সেদিন দল-মত নির্বিশেষে গোটা জাতিকে অন্ধকারে আলোর
আভাস দিয়ে দখলদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়ার
দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করেছে এবং সাহস জুগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস
রণাঙ্গনেও তিনি ছিলেন সর্বাধিক আলোচিত ও জনপ্রিয় সেনাপতি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দল হিসেবে বিএনপির গড়ে ওঠা এবং কালক্রমে জাতীয় রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান দল হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে জিয়াউর রহমানের এই ভাবমূর্তি ছিল সবচেয়ে বড় নিয়ামক। আজকের দিনেও জিয়াউর রহমানকে বাদ দিলে বিএনপির পালের বাতাস শূন্যে মিলিয়ে যায়।
সন্দেহ নেই, বিএনপির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল একটি জগাখিচুড়ি দক্ষিণপন্থী দল হিসেবে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে একাত্তরের রাজাকার-আলবদর ও অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী সুকৌশলে জাসদের পেছনে শক্তি জুগিয়ে আত্মরক্ষার পথ খুঁজেছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতিতে তারা একইভাবে বিএনপির ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়ে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সর্বাত্মক প্রয়াস চালায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান অল্পদিনেই উপলব্ধি করতে থাকেন, মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা থেকে সরে গেলে এদেশের অবস্থা হবে হালবিহীন লক্ষ্যচ্যুত তরণীর মতো। তাই তিনি দক্ষিণমুখী ঝোঁক পরিহার করে নিজেকে মধ্যপন্থী মূলধারার রাজনীতিতে স্থাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সে অনুযায়ী তার দলের নেতৃত্ব ঢেলে সাজাতে উদ্যোগী হন। বস্তুত এ কারণেই ১৯৮০ সাল নাগাদ দলটির ভাবমূর্তি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সক্রিয় কর্মীরা বিপুল সংখ্যায় এই দলে যোগ দিতে শুরু করেন। আওয়ামী লীগ, জাতীয় লীগ, ন্যাপ, জাসদ, জনতা পার্টিসহ বিভিন্ন স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির কর্মী-সংগঠকরা এ দলে যোগ দিয়ে দলটিকে নতুন রূপদান করেন। দলের ভেতরে স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক চেতনার ধারকরা পিছু হটতে থাকে। বিএনপি হয়ে ওঠে যথার্থই এদেশের মূলধারার রাজনৈতিক দল। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে জিয়ার মৃত্যুর পর তার জানাজায় এবং পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে।
জিয়ার আকস্মিক ও মর্মান্তিক মৃত্যুতে এই ধারা ব্যাহত হলেও পরবর্তী সময়ে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বেগম জিয়াকে সামনে নিয়ে দলটির সংগ্রামী ভূমিকা, বিশেষ করে ৮০-র দশকজুড়ে ৫-দফা আন্দোলনে আপসহীন অবস্থান দলটিকে পুনরায় জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় অবস্থানে স্থাপন করে। সে কারণেই ৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভরাডুবি বরণ করতে হয়।
মনে রাখা দরকার, এদেশের অধিকাংশ মানুষ না ডানপন্থী, না বামপন্থী। এই মধ্যপন্থার কারণেই ষাটের দশকে সেদিনের আওয়ামী লীগ জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্র দখল করতে পেরেছিল এবং সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ জনসমর্থনে আর সব দলকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। শেখ মুজিব তার সমকালীন অনেক বাঘা বাঘা নেতাকে পেছনে ফেলে বাংলার মানুষের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বলার অপেক্ষা থাকে না, স্বাধীনতা যুদ্ধকালে, সম্ভবত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রভাবে, শখের সমাজতন্ত্রী সাজতে গিয়ে আওয়ামী লীগ বামপন্থীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে। অতঃপর মধ্যপন্থা থেকে সরে গিয়ে কেন্দ্রচ্যুত হয়েছে। আর তখনই জাতীয় জীবনের মূলধারায় দলটির নজীরবিহীন জনপ্রিয়তায় ধস নামে। যার মর্মান্তিক পরিণতি ১৯৭৫-এর ঘটনাবলী।
আগেই বলেছি, বিএনপির ভেতরে গোড়াতেই একটি শক্তিমান ডানপন্থী চক্র গড়ে উঠেছিল। মূলত শাহ আজিজকে ঘিরে এ চক্রটি শক্তি সঞ্চয় করে। এই চক্র জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখত। ৮৩ সালে ৫-দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৫ দল এবং বিএনপি নেৃত্বত্বাধীন ৭ দলের সমন্বয়ে ২২-দলীয় ঐক্য গড়ে তোলার সময় এই চক্র ৭-দলীয় জোটে জামায়াতকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। এ নিয়ে দলে তীব্র বাকবিতণ্ডা চলতে থাকে। দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির তরুণ সদস্যদের তীব্র বিরোধিতার মুখে শেষ পর্যন্ত জামায়াতকে বাইরে রাখা হয়। (সেদিন যদি ৭-দলে জামায়াতকে যুক্ত করা হতো তাহলে ২২-দলীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রক্রিয়া অবধারিতরূপেই মাঠে মারা যেত)। ৯১-এর নির্বাচনের সময়ও জামায়াতের সঙ্গে জোট গড়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সেই নির্বাচনে এককভাবে লড়েই বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সরকার গঠন করে। জামায়াতও আলাদাভাবে প্রায় সব আসনে প্রার্থী দিয়ে কয়েকটি আসন পায় এবং উপযাচক হয়ে বিএনপির প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে। ৯৬তে জামায়াত আওয়ামী লীগের সঙ্গে কৌশলগত ঐক্য করে মাঠে-ময়দানে বিএনপি প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নেয়। ২০০১ সালে জামায়াত আবার ভোল পাল্টায়। এবারে বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে জোট বাঁধায় তাদের দীর্ঘদিনের প্রয়াস সফল হয়। বিএনপির কাঁধে চড়ে দলটি প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায়ও ভাগ বসাতে পেরেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, জামায়াত দল হিসেবে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল। অধিক সুসংগঠিত দল প্রায়শ ফ্যাসিস্ট প্রবণতায় আক্রান্ত হয়। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আমি ফেনীতে একটি আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলাম। এটি ছিল দেশের সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসকবলিত নির্বাচনী এলাকা। সেই নির্বাচন কীভাবে হয়েছিল তা নিয়ে আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন। তবে তাতে জামায়াতের কী ভূমিকা ছিল এবং জামায়াতের কর্মীরা কীভাবে আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে একত্র হয়ে বিএনপির সভায় বোমা ছুঁড়েছে, সে দৃশ্য এখনও চোখের সামনে ভাসে। ২০০১ সালের নির্বাচনেও ওই আসন থেকে আমার নির্বাচন করার কথা ছিল। দলীয় পর্যায়ে তা আগেই চূড়ান্তভাবে স্থির করা ছিল। ৯৬-এর অভিজ্ঞতার পর ৫ বছর ধরে আমি ওই নির্বাচনী এলাকা সংগঠিত করেছি। কিন্তু ৫ বছরে পুরো এলাকার পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গিয়েছিল। এবার আর ৯৬-এর মতো সন্ত্রাস করে ভোট কেন্দ্র দখল করার, কিংবা প্রশাসনের সহায়তায় কারচুপি করে বানোয়াট ঘোষণা দেয়ার সুযোগ ছিল না। নির্বাচন ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
এ সময়েই বিএনপির ভেতরের জামায়াতপন্থীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির আনুষ্ঠানিক জোট গড়ার জন্য। বরাবরের মতো এই উদ্যোগকে আমি সহজভাবে নিতে পারিনি। আমি এ ব্যাপারে আমার অভিমত ব্যক্ত করে একটি নিবন্ধ লিখি। নিবন্ধটি দৈনিক মানবজমিন কয়েক কিস্তিতে প্রকাশ করে।
নিবন্ধটির সারমর্ম ছিল- বিএনপি ও জামায়াতের জোট গঠন উভয় দলের জন্যই আত্মঘাতী হবে। কারণ এ দুই দলের মতাদর্শ ও রাজনৈতিক অবস্থান সম্পূর্ণ আলাদা। বিএনপি গর্বের সঙ্গে বলে থাকে যে, এই দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী ছিল সেই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের শত্রু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান দোসর। এই দুই দল রাজনীতির মাঠে কৌশলগত সুসম্পর্ক রাখতে পারে; কিন্তু জোটবদ্ধ হতে পারে না। তাহলে উভয় দলই গুরুতর আদর্শিক সংকটে পড়বে। সেক্ষেত্রে একই মঞ্চে গোলাম আযমের পাশে দাঁড়িয়ে বিএনপি কীভাবে একাত্তরে জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বলবে? জামায়াতে ইসলামীই বা কীভাবে তার ইসলামী শাসন কায়েমের কথা বলবে? তাদের অবস্থা হবে পিঠে পিঠে লেগে থাকা যমজের মতো (SIAMESE TWIN)। ... ইত্যাদি।
আমার দৃঢ় অভিমত, ২০০১ সালে বিএনপির বিজয় ছিল অবধারিত। তখন ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার অনেক নিচে নেমে গিয়েছিল। তাছাড়া এদেশে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের পর পর দুবার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার দৃষ্টান্ত নেই। আমার দৃঢ় অভিমত ছিল, বিএনপির উচিত তার স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির ভাবমূর্তি ধরে রাখা। জামায়াতের সঙ্গে জোট সেই ভাবমূর্তি ধ্বংস করে দেবে।
আমার বক্তব্য কে কীভাবে নিয়েছেন, জানি না। তবে তার মোদ্দা ফল দাঁড়িয়েছিল, নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে জানলাম, ঢাকায় মওদুদ গং, বিএনপির ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াত, আমার বিরুদ্ধে একটা বড় রকমের ঘোঁট পাকিয়ে তুলেছে। দলের হাইকমান্ড তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আমার মনোনয়ন বাতিল করে অন্য একজনকে মনোনয়ন দিয়েছেন স্বয়ং খালেদা জিয়া!
এখন কাফ্ফারা দেয়ার পালা পাঠক, বিগত কয়েক বছরের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে তাকিয়ে বিএনপি-জামায়াত সিয়ামিজ টুইন-এর পিঠে পিঠে লেগে থাকার করুণ দৃশ্যটি কি আমরা দেখতে পাচ্ছি? পিঠে পিঠে লেগে থাকা এই দুটিকে পৃথক করার জন্য এখন অপারেশন ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই অপারেশনের পর কোনটি বেঁচে থাকবে?
সেদিন লিখেছিলাম, বিএনপি কোন পথে? জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধার পরিণামে আজ বিএনপির সংগঠন কোথায় এবং কোন পথে এসে দাঁড়িয়েছে? মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল হিসেবে যে দলটি আশির দশকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এদেশের মূলধারার জনমতের প্রতিনিধিত্ব করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পেরেছিল, ২০০১ সালে জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠনের পর সেই দলটি আজ আদর্শিকভাবে ডানপন্থী ধর্মান্ধতার বলয়ে বৃত্তবন্দি হয়ে মূলধারা থেকে ছিটকে পড়েছে। এই নতুন ভাবমূর্তি অর্জনের পর দলটির শীর্ষ থেকে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা যত তারস্বরেই বলা হোক না কেন, কারও হৃদয়তন্ত্রীতে আর কোনো অনুরণন তোলে না।
অপরদিকে বিএনপির ছাতার নিচে জায়গা করে নিয়ে ক্ষমতার ছিটেফোঁটা অংশ হাতিয়ে নিতে গিয়ে জামায়াতই বা আজ কোথায়? পাঠক, ভেবে দেখুন। বিএনপির সঙ্গে এভাবে জোটবদ্ধ না হলে জামায়াত নেতাদের কি এভাবে নিগ্রহের শিকার হতে হতো? (এই আওয়ামী লীগই না ৯৬ সালে জামায়াতের মিত্র ছিল!)।
২০০১ সালে কোম্পানীগঞ্জে মওদুদ আহমদ খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে তার নির্বাচনী জনসভায় মাঠের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিশাল ব্যানারে লিখে রেখেছিলেন- মওদুদ আহমদকে রাষ্ট্রপতি চাই। ক্ষমতার রাজনীতির নোংরা খেলোয়াড়দের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র কখনোই কল্যাণ বয়ে আনে না।
আফসোস, ক্ষমতার উদগ্র বাসনা এবং অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের মাশুল হিসেবে কেবল উভয় দলকেই নয়, আজ গোটা জাতিকেই তার কাফ্ফারা দিতে হচ্ছে।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী :রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
বলার অপেক্ষা রাখে না, দল হিসেবে বিএনপির গড়ে ওঠা এবং কালক্রমে জাতীয় রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান দল হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে জিয়াউর রহমানের এই ভাবমূর্তি ছিল সবচেয়ে বড় নিয়ামক। আজকের দিনেও জিয়াউর রহমানকে বাদ দিলে বিএনপির পালের বাতাস শূন্যে মিলিয়ে যায়।
সন্দেহ নেই, বিএনপির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল একটি জগাখিচুড়ি দক্ষিণপন্থী দল হিসেবে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে একাত্তরের রাজাকার-আলবদর ও অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী সুকৌশলে জাসদের পেছনে শক্তি জুগিয়ে আত্মরক্ষার পথ খুঁজেছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতিতে তারা একইভাবে বিএনপির ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়ে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সর্বাত্মক প্রয়াস চালায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান অল্পদিনেই উপলব্ধি করতে থাকেন, মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা থেকে সরে গেলে এদেশের অবস্থা হবে হালবিহীন লক্ষ্যচ্যুত তরণীর মতো। তাই তিনি দক্ষিণমুখী ঝোঁক পরিহার করে নিজেকে মধ্যপন্থী মূলধারার রাজনীতিতে স্থাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সে অনুযায়ী তার দলের নেতৃত্ব ঢেলে সাজাতে উদ্যোগী হন। বস্তুত এ কারণেই ১৯৮০ সাল নাগাদ দলটির ভাবমূর্তি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সক্রিয় কর্মীরা বিপুল সংখ্যায় এই দলে যোগ দিতে শুরু করেন। আওয়ামী লীগ, জাতীয় লীগ, ন্যাপ, জাসদ, জনতা পার্টিসহ বিভিন্ন স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির কর্মী-সংগঠকরা এ দলে যোগ দিয়ে দলটিকে নতুন রূপদান করেন। দলের ভেতরে স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক চেতনার ধারকরা পিছু হটতে থাকে। বিএনপি হয়ে ওঠে যথার্থই এদেশের মূলধারার রাজনৈতিক দল। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে জিয়ার মৃত্যুর পর তার জানাজায় এবং পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে।
জিয়ার আকস্মিক ও মর্মান্তিক মৃত্যুতে এই ধারা ব্যাহত হলেও পরবর্তী সময়ে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বেগম জিয়াকে সামনে নিয়ে দলটির সংগ্রামী ভূমিকা, বিশেষ করে ৮০-র দশকজুড়ে ৫-দফা আন্দোলনে আপসহীন অবস্থান দলটিকে পুনরায় জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় অবস্থানে স্থাপন করে। সে কারণেই ৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভরাডুবি বরণ করতে হয়।
মনে রাখা দরকার, এদেশের অধিকাংশ মানুষ না ডানপন্থী, না বামপন্থী। এই মধ্যপন্থার কারণেই ষাটের দশকে সেদিনের আওয়ামী লীগ জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্র দখল করতে পেরেছিল এবং সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ জনসমর্থনে আর সব দলকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। শেখ মুজিব তার সমকালীন অনেক বাঘা বাঘা নেতাকে পেছনে ফেলে বাংলার মানুষের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বলার অপেক্ষা থাকে না, স্বাধীনতা যুদ্ধকালে, সম্ভবত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রভাবে, শখের সমাজতন্ত্রী সাজতে গিয়ে আওয়ামী লীগ বামপন্থীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে। অতঃপর মধ্যপন্থা থেকে সরে গিয়ে কেন্দ্রচ্যুত হয়েছে। আর তখনই জাতীয় জীবনের মূলধারায় দলটির নজীরবিহীন জনপ্রিয়তায় ধস নামে। যার মর্মান্তিক পরিণতি ১৯৭৫-এর ঘটনাবলী।
আগেই বলেছি, বিএনপির ভেতরে গোড়াতেই একটি শক্তিমান ডানপন্থী চক্র গড়ে উঠেছিল। মূলত শাহ আজিজকে ঘিরে এ চক্রটি শক্তি সঞ্চয় করে। এই চক্র জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখত। ৮৩ সালে ৫-দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৫ দল এবং বিএনপি নেৃত্বত্বাধীন ৭ দলের সমন্বয়ে ২২-দলীয় ঐক্য গড়ে তোলার সময় এই চক্র ৭-দলীয় জোটে জামায়াতকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। এ নিয়ে দলে তীব্র বাকবিতণ্ডা চলতে থাকে। দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির তরুণ সদস্যদের তীব্র বিরোধিতার মুখে শেষ পর্যন্ত জামায়াতকে বাইরে রাখা হয়। (সেদিন যদি ৭-দলে জামায়াতকে যুক্ত করা হতো তাহলে ২২-দলীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রক্রিয়া অবধারিতরূপেই মাঠে মারা যেত)। ৯১-এর নির্বাচনের সময়ও জামায়াতের সঙ্গে জোট গড়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সেই নির্বাচনে এককভাবে লড়েই বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সরকার গঠন করে। জামায়াতও আলাদাভাবে প্রায় সব আসনে প্রার্থী দিয়ে কয়েকটি আসন পায় এবং উপযাচক হয়ে বিএনপির প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে। ৯৬তে জামায়াত আওয়ামী লীগের সঙ্গে কৌশলগত ঐক্য করে মাঠে-ময়দানে বিএনপি প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নেয়। ২০০১ সালে জামায়াত আবার ভোল পাল্টায়। এবারে বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে জোট বাঁধায় তাদের দীর্ঘদিনের প্রয়াস সফল হয়। বিএনপির কাঁধে চড়ে দলটি প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায়ও ভাগ বসাতে পেরেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, জামায়াত দল হিসেবে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল। অধিক সুসংগঠিত দল প্রায়শ ফ্যাসিস্ট প্রবণতায় আক্রান্ত হয়। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আমি ফেনীতে একটি আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলাম। এটি ছিল দেশের সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসকবলিত নির্বাচনী এলাকা। সেই নির্বাচন কীভাবে হয়েছিল তা নিয়ে আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন। তবে তাতে জামায়াতের কী ভূমিকা ছিল এবং জামায়াতের কর্মীরা কীভাবে আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে একত্র হয়ে বিএনপির সভায় বোমা ছুঁড়েছে, সে দৃশ্য এখনও চোখের সামনে ভাসে। ২০০১ সালের নির্বাচনেও ওই আসন থেকে আমার নির্বাচন করার কথা ছিল। দলীয় পর্যায়ে তা আগেই চূড়ান্তভাবে স্থির করা ছিল। ৯৬-এর অভিজ্ঞতার পর ৫ বছর ধরে আমি ওই নির্বাচনী এলাকা সংগঠিত করেছি। কিন্তু ৫ বছরে পুরো এলাকার পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গিয়েছিল। এবার আর ৯৬-এর মতো সন্ত্রাস করে ভোট কেন্দ্র দখল করার, কিংবা প্রশাসনের সহায়তায় কারচুপি করে বানোয়াট ঘোষণা দেয়ার সুযোগ ছিল না। নির্বাচন ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
এ সময়েই বিএনপির ভেতরের জামায়াতপন্থীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির আনুষ্ঠানিক জোট গড়ার জন্য। বরাবরের মতো এই উদ্যোগকে আমি সহজভাবে নিতে পারিনি। আমি এ ব্যাপারে আমার অভিমত ব্যক্ত করে একটি নিবন্ধ লিখি। নিবন্ধটি দৈনিক মানবজমিন কয়েক কিস্তিতে প্রকাশ করে।
নিবন্ধটির সারমর্ম ছিল- বিএনপি ও জামায়াতের জোট গঠন উভয় দলের জন্যই আত্মঘাতী হবে। কারণ এ দুই দলের মতাদর্শ ও রাজনৈতিক অবস্থান সম্পূর্ণ আলাদা। বিএনপি গর্বের সঙ্গে বলে থাকে যে, এই দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী ছিল সেই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের শত্রু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান দোসর। এই দুই দল রাজনীতির মাঠে কৌশলগত সুসম্পর্ক রাখতে পারে; কিন্তু জোটবদ্ধ হতে পারে না। তাহলে উভয় দলই গুরুতর আদর্শিক সংকটে পড়বে। সেক্ষেত্রে একই মঞ্চে গোলাম আযমের পাশে দাঁড়িয়ে বিএনপি কীভাবে একাত্তরে জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বলবে? জামায়াতে ইসলামীই বা কীভাবে তার ইসলামী শাসন কায়েমের কথা বলবে? তাদের অবস্থা হবে পিঠে পিঠে লেগে থাকা যমজের মতো (SIAMESE TWIN)। ... ইত্যাদি।
আমার দৃঢ় অভিমত, ২০০১ সালে বিএনপির বিজয় ছিল অবধারিত। তখন ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার অনেক নিচে নেমে গিয়েছিল। তাছাড়া এদেশে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের পর পর দুবার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার দৃষ্টান্ত নেই। আমার দৃঢ় অভিমত ছিল, বিএনপির উচিত তার স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির ভাবমূর্তি ধরে রাখা। জামায়াতের সঙ্গে জোট সেই ভাবমূর্তি ধ্বংস করে দেবে।
আমার বক্তব্য কে কীভাবে নিয়েছেন, জানি না। তবে তার মোদ্দা ফল দাঁড়িয়েছিল, নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে জানলাম, ঢাকায় মওদুদ গং, বিএনপির ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াত, আমার বিরুদ্ধে একটা বড় রকমের ঘোঁট পাকিয়ে তুলেছে। দলের হাইকমান্ড তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আমার মনোনয়ন বাতিল করে অন্য একজনকে মনোনয়ন দিয়েছেন স্বয়ং খালেদা জিয়া!
এখন কাফ্ফারা দেয়ার পালা পাঠক, বিগত কয়েক বছরের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে তাকিয়ে বিএনপি-জামায়াত সিয়ামিজ টুইন-এর পিঠে পিঠে লেগে থাকার করুণ দৃশ্যটি কি আমরা দেখতে পাচ্ছি? পিঠে পিঠে লেগে থাকা এই দুটিকে পৃথক করার জন্য এখন অপারেশন ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই অপারেশনের পর কোনটি বেঁচে থাকবে?
সেদিন লিখেছিলাম, বিএনপি কোন পথে? জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধার পরিণামে আজ বিএনপির সংগঠন কোথায় এবং কোন পথে এসে দাঁড়িয়েছে? মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল হিসেবে যে দলটি আশির দশকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এদেশের মূলধারার জনমতের প্রতিনিধিত্ব করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পেরেছিল, ২০০১ সালে জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠনের পর সেই দলটি আজ আদর্শিকভাবে ডানপন্থী ধর্মান্ধতার বলয়ে বৃত্তবন্দি হয়ে মূলধারা থেকে ছিটকে পড়েছে। এই নতুন ভাবমূর্তি অর্জনের পর দলটির শীর্ষ থেকে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা যত তারস্বরেই বলা হোক না কেন, কারও হৃদয়তন্ত্রীতে আর কোনো অনুরণন তোলে না।
অপরদিকে বিএনপির ছাতার নিচে জায়গা করে নিয়ে ক্ষমতার ছিটেফোঁটা অংশ হাতিয়ে নিতে গিয়ে জামায়াতই বা আজ কোথায়? পাঠক, ভেবে দেখুন। বিএনপির সঙ্গে এভাবে জোটবদ্ধ না হলে জামায়াত নেতাদের কি এভাবে নিগ্রহের শিকার হতে হতো? (এই আওয়ামী লীগই না ৯৬ সালে জামায়াতের মিত্র ছিল!)।
২০০১ সালে কোম্পানীগঞ্জে মওদুদ আহমদ খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে তার নির্বাচনী জনসভায় মাঠের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিশাল ব্যানারে লিখে রেখেছিলেন- মওদুদ আহমদকে রাষ্ট্রপতি চাই। ক্ষমতার রাজনীতির নোংরা খেলোয়াড়দের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র কখনোই কল্যাণ বয়ে আনে না।
আফসোস, ক্ষমতার উদগ্র বাসনা এবং অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের মাশুল হিসেবে কেবল উভয় দলকেই নয়, আজ গোটা জাতিকেই তার কাফ্ফারা দিতে হচ্ছে।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী :রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
No comments