প্রতারণা এবং বর্বরতা by নাজিব মুবিন
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী কলোনিতে বসবাসরত সুলতানা রাজিয়া পপি (২০)-র ওপর চালানো হয় নির্যাতন। এ নির্যাতন চলে প্রায় ১ মাস ধরে। কখনও মুখে কাপড় বেঁধে আঙুলে ফুটানো হয় সুচ, ব্লেড দিয়ে কাটা হয় হাত, আবার কখনও গরম লোহার ছ্যাঁকা দেয়া হয় শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গে। এভাবেই প্রতিনিয়ত নির্যাতন করা হয় তাকে। মাত্র এক মাস পূর্বে প্রেমের ফাঁদে পড়ে মা-বাবাকে ছেড়ে প্রেমিক নূর মোহাম্মদ টিপুর (২২) সঙ্গে সংসার বাঁধে পপি। পপিকে ঘরে আটকে রেখে শাশুড়ি, দেবর, ননদ মাসব্যাপী চালায় নির্মম নির্যাতন। জীবন বাঁচাতে চিঠি লিখে জানালা দিয়ে ফেলে পপি। চিঠিতে লেখা ঠিকানায় যোগাযোগ করে গত ২৪শে নভেম্বর রাতে পপিকে ওই বদ্ধঘর থেকে উদ্ধার করে প্রতিবেশী ও তার স্বজনরা। এদিকে ঘটনা ধামাচাপা দিতে ওই দিন রাত ৮টার দিকে পপির শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় পুলিশের এস.আই আকবর আলীকে ডেকে আনা হয়। পুলিশ টাকা খেয়ে ঘটনা ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা করছে এমন অভিযোগ করে পুলিশকে আটকে রাখে এলাকার লোকজন। এ সময় ওই এলাকার লোকজন পপির ওপর অত্যাচারের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে। ভুক্তভোগী পপি জানান, দুই বছর আগে টিপুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। কথামতো পপি বাড়ি থেকে পালিয়ে এলে তাকে ঢাকায় নিয়ে কোর্ট ম্যারেজ করার প্রলোভন দেখিয়ে নবদম্পতির পরিচয় দিয়ে ঢাকার আবদুল্লাহপুরে একটি বাসা ভাড়া নেয় টিপু। এ সময় পপি টিপুকে বিয়ের কথা বললে সে বারবার এড়িয়ে যায়। ওই বাড়িতে তারা এক সপ্তাহ অবস্থান করে। পরে ওই এলাকার লোকজন তাদের বিয়ের কাগজপত্র দেখতে চাইলে টিপু পপিকে নিয়ে আবার ময়মনসিংহে চলে আসে। পরে টিপু তাকে ময়মনসিংহ শহরের চরপাড়া এলাকায় রেখে পালিয়ে যায়। এ সময় দিশেহারা পপি টিপুকে খুঁজতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী কলোনিতে চলে আসে। পরে পপির মুখে বিস্তারিত ঘটনা শুনে এলাকার লোকজন পারিবারিকভাবে টিপুর সঙ্গে তার বিয়ে দেয়। বিয়ের দিন রাতেই পপির ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেয় তার শাশুড়ি নূরজাহান বেগম। এর দু’দিন পর থেকে পপির ওপর শুরু হয় নির্যাতন। পপিকে থাকতে দেয়া হয় রান্নাঘরে। ঘরে আবদ্ধ রেখে প্রতিদিন নতুন নতুন কায়দায় নির্যাতন করে পপির শাশুড়ি, ননদ ও দেবর। এ সময় তারা পপিকে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়নি। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত ২৪শে নভেম্বর চার পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে ঘরের জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেয় পপি। চিঠিতে তাকে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তার ভাইয়ের নাম্বারে খবর দিতে বলা হয়। চিঠি পেয়ে তার প্রতিবেশীরা পপির বাড়িতে খবর দেয়। পরে পপির চাচা ও খালা এলে এলাকার লোকজন তাকে ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার করে বাইরে নিয়ে আসে। এ সময় ঘটনা ধামাচাপা দিতে পপির শ্বশুরবাড়িরজন লোক ডেকে আনেন ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার এস.আই আকবর আলীকে। এস.আই আকবর আলী ঘটনা ভিন্নখাতে নিয়ে যেতে পপি ও তার চাচার কাছ থেকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে জোরপূর্বক এই মর্মে অঙ্গীকার নেয় যে, পপি স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে স্বামীর বাসা ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে যাচ্ছে। পপির চাচা বকুল মৃধা এই মর্মে অঙ্গীকার দেয় যে, পপির শরীরে কোন জখমের দাগ নেই। তাকে সুস্থ শরীরে নিজের জিম্মায় সে নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে পুলিশ জোর করে এরকম অঙ্গীকারনামা নিয়েছে জানতে পেরে এলাকার লোকজন এস.আই আকবর ও ৪ কনস্টেবলকে আটকে রাখে। এ সময় আকবর আলী ওই অঙ্গীকারনামাটি ছিঁড়ে ফেলতে চাইলে এলাকার লোকজন তা ছিনিয়ে নেয়। তবে টাকা খেয়ে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা এবং জোরপূর্বক অঙ্গীকারনামা লেখানোর অভিযোগ অস্বীকার করেন এস.আই আকবর। নির্যাতনের বিষয়ে অভিযুক্ত পপির স্বামী নূর মোহাম্মদ টিপু বলেন, পপি খুব রাগি। তার সঙ্গে একটু মনোমালিন্য হওয়ায় সে নিজেই নিজের হাত কেটে এমন অভিযোগ করছে। নির্যাতনের কথা অস্বীকার করে পপির শাশুড়ি নূরজাহান বেগম বলেন, পপি একটা নষ্ট মেয়ে। এলাকার লোকজন ষড়যন্ত্র করে তার পরিবারকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। নির্যাতিত পপি ময়মনসিংহ সদরের শিকারীকান্দা ইউনিয়নের ভাটিয়ারেরা গ্রামের মৃত আবদুল মান্নানের মেয়ে। পপি ময়মনসিংহ মহিলা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী। অন্যদিকে পপির স্বামী টিপু বাকৃবি নিরাপত্তা কর্মী আবুবকর সিদ্দিকের ছেলে। সে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
No comments