সার্ক : অসীম যাত্রায় সসীম পদক্ষেপ by ড. দেলোয়ার হোসেন
দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার কাজটি বাংলাদেশের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালে সার্ক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সেই থেকে ১৮টি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংস্থাটি ২৯ বছর অতিক্রম করল। এই দীর্ঘ সময়ে সার্কের পথচলা কখনোই মসৃণ ছিল না। শুরু থেকেই ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব এবং এ অঞ্চলের বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিবেশ আঞ্চলিক সহযোগিতা শক্তিশালী করার জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করেছে। এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশে সার্ক বহুবার বড় ধরনের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুললেও নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সংস্থাটির ১৮তম শীর্ষ বৈঠকে এক ধরনের হতাশাই তৈরি হয়েছিল, যদিও শেষ মুহূর্তে জ্বালানিবিষয়ক একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সার্কের প্রতি দক্ষিণ এশীয় জনগণের আস্থার জায়গাটি কিছুটা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সার্ক সম্পর্কে যে কোনো বিশ্লেষণে তিনটি বিষয়কে একসঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এর একটি হল দক্ষিণ এশিয়া, অন্যটি আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং তৃতীয়টি আঞ্চলিক সংগঠন। দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতায় আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সার্ক আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, যদিও সার্কের কার্যকারিতা সম্পর্কে সাধারণভাবে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এর অন্যতম হল, সার্ক হচ্ছে একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যেখানে সদস্যরাষ্ট্রের সরকারগুলো অন্যতম চালিকাশক্তি। অর্থাৎ সার্ক নিজস্ব শক্তিতে চলার যোগ্যতা রাখে না। সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ঐকান্তিকতা ও আগ্রহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করে রাখে। সার্কের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৃহৎ দুই পক্ষ- ভারত ও পাকিস্তান এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে না। দ্বিতীয়ত, সার্ক হচ্ছে সহযোগিতার একটি সম্পূরক প্রক্রিয়া। অর্থাৎ একটি অঞ্চলে দ্বিপাক্ষিক ও অন্যান্য পর্যায়ে যে ধরনের সহযোগিতা ও সংহতি বিদ্যমান থাকে, সেখানে আঞ্চলিক পর্যায়ে সার্ক বহুপাক্ষিক বৃহত্তর ফোরাম হিসেবে কাজ করে থাকে। ফলে সার্কের অর্জন নিয়ে আমাদের একটি বাস্তবভিত্তিক মূল্যায়ন প্রয়োজন।
এবার আসা যাক ১৮তম শীর্ষ সম্মেলনে কী অর্জিত হয়েছে সে প্রসঙ্গে। প্রথমত, এ বৈঠকটি সার্কের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১১ সালে মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে ১৭তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের মধ্যে পরবর্তী সার্ক শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে এক ধরনের হতাশা ছিল, যা এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে দূর হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এবারের সম্মেলনে তিনটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের চেষ্টা করা হয়েছিল। এর মধ্যে দুটি অর্থাৎ মোটরযান ও রেল যোগাযোগ সংক্রান্ত চুক্তি শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষর না হলেও জ্বালানি সহযোগিতাবিষয়ক যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা এ অঞ্চলের জন্য সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া মোটরযান ও রেল যোগাযোগ সংক্রান্ত চুক্তির বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে অগ্রগতির জন্য তিন মাস পর সার্ক পরিবহনমন্ত্রীদের বৈঠকের কথা বলা হয়েছে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে আমি মনে করি।
তৃতীয়ত কাঠমান্ডু ঘোষণার দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। সার্ক প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম শীর্ষ বৈঠকে সর্বাত্মক ও ব্যাপকভাবে অর্থপূর্ণ বিষয়ে একটি ঘোষণা অনুমোদন করা হয়েছে। এই ৩৬ দফার ঘোষণাটিতে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ২০০ কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। বিশেষ করে এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন- দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ইকোনমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা, কানেকটিভিটি, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ মোকাবেলা, শিক্ষার জন্য আঞ্চলিক সমন্বিত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, দারিদ্র্য বিমোচন, পর্যবেক্ষক সদস্যদের কার্যকর অংশগ্রহণের জন্য একটি কাঠামো গড়ে তোলা, ব্ল– ইকোনমির ধারণা, মানুষের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা ইত্যাদি বিষয় ঘোষণায় স্থান পেয়েছে। এ বিষয়গুলো ভবিষ্যতে সার্ককে নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে নেবে।
চতুর্থত, সার্কের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার বাইরে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সাইডলাইনে যেসব দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে, তার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সার্কের সব সদস্যদেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। একইভাবে নেপাল, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। নেপাল ভারতের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। অর্থাৎ সার্ক ফোরামকে কাজে লাগিয়ে সদস্যরাষ্ট্রগুলো তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সাধনে সক্ষম হয়েছে।
পঞ্চমত, বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকটি অর্জন উল্লেখযোগ্য। এর একটি হচ্ছে, আঞ্চলিক জ্বালানি চুক্তির ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের জ্বালানি সহযোগিতার বিষয়টিকে বহুপাক্ষিক পর্যায়ে বিবেচনার একটি বাস্তব সুযোগ তৈরি হয়েছে। শুধু ভারত নয়, নেপাল ও ভুটানও এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কাজেই বাংলাদেশের জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে এ সহযোগিতা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
এর বাইরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ফলপ্রসূ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো দুই নেতার সাক্ষাৎ পারস্পরিক সমঝোতার বিষয়টিকে বহুলাংশে এগিয়ে নিয়েছে, বিশেষ করে স্থলসীমান্ত চুক্তি এবং তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির জোর প্রচেষ্টার ঘোষণা বাংলাদেশকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে আশ্বস্ত করতে পারে। বাংলাদেশকে এ সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে।
এবারের সম্মেলনের আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়। সেটি হল সার্কের ঘোষণায় বাংলদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তথা বাংলাদেশের ভাবনার প্রতিফলন। কাঠমান্ডু ঘোষণায় ব্লু ইকোনমির বিষয়টি স্থান পাওয়া এর অন্যতম। ফলে দেখা যাচ্ছে, ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তথাপি সার্কের ইতিহাস ও মানুষের প্রত্যাশা বিবেচনা করলে সংস্থাটির আরও কার্যকর ও সফল ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার প্রয়োজন ছিল। প্রসঙ্গত, আমরা যদি বহিঃবিশ্বের দিকে তাকাই, দেখতে পাব সার্ক প্রতিষ্ঠার আগে অথবা পরে প্রতিষ্ঠিত এমন অনেক আঞ্চলিক সংস্থা আছে যেগুলো অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এ পরিস্থিতিতে সার্কের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট। সংস্থাটির সামনে কতগুলো চ্যালেঞ্জ আমরা লক্ষ্য করি। এর অন্যতম হল, সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে ভারত ও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে একক ও যৌথভাবে সার্কের লক্ষ্য অর্জনে যথেষ্ট সাড়া না দেয়া। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, এ দুটি দেশ দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করছে। ফলে সার্ক বঞ্চিত হচ্ছে তাদের কার্যকর মনোযোগ থেকে। এ বাস্তবতা আশির দশকের শুরুতে থাকলেও এখনও বিভিন্ন পর্যায়ে অব্যাহত আছে।
সার্ক বেশকিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ যেমন- মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠার চুক্তি, আঞ্চলিক ফুডব্যাংক প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় কনভেশন স্বাক্ষর ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নেয়া সত্ত্বেও শুধু বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে এ অর্জনগুলো জনগণের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে না। অর্থাৎ বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জটি বড় আকারেই রয়েছে।
সার্ক সচিবালয়ের দিকেও দৃষ্টি দিতে চাই। ১৯৮৫ সালে কাঠমান্ডুতে প্রতিষ্ঠিত সচিবালয়কে তেমন একটা কার্যকর ও শক্তিশালী করে উন্নীত করা হয়নি। অনেকে দুঃখ করে এ সচিবালয়কে পোস্ট অফিস হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। এ সচিবালয়ের মহাসচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও রিসোর্সের ব্যাপক অসামঞ্জস্য দেখা যায়। এ ধরনের একটি আঞ্চলিক সংস্থার মহাসচিবের যে ধরনের মর্যাদা থাকা উচিত, সার্কে তেমনটি দেখা যায় না। এ বিষয়টি সার্কের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে একটি বড় বাধা হয়ে আছে।
সবশেষে সার্ক সনদের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। সার্ক প্রতিষ্ঠার সময়ে যেসব ধারা সংযোজন করে সনদটি স্বাক্ষর করা হয়েছিল, আজও সেসবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিশেষ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বসম্মতির বাধ্যবাধকতা এবং দ্বিপাক্ষিক ও বিরোধপূর্ণ বিষয়ে আলোচনায় নিষেধাজ্ঞা সার্ককে শক্তিশালী করা এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করছে।
আরেকটি চ্যালেঞ্জ উল্লেখযোগ্য। সার্ক নেতারা জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগের বিষয়টিকে আনুষ্ঠানিকভাবে গুরুত্ব দিলেও এক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যেমন, এ অঞ্চলের ভিসা প্রক্রিয়া এখনও অনেক জটিল ও দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজালে আবদ্ধ। ভিসার জন্য ভোগান্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রত্যাখ্যান একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সার্ক প্রক্রিয়ায় নন-স্টেট অ্যাক্টরদের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ তৈরি করা হয়নি। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, দুর্যোগ মোকাবেলা, মানব পাচার- এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সুশীল সমাজের অর্থবহ ভূমিকা থাকতে পারত। কিন্তু বাস্তবে সেটি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
সুতরাং সার্বিক বিবেচনায় সার্ক এ অঞ্চলের আঞ্চলিক সহযোগিতার একমাত্র উপায় হিসেবে বিবেচিত হলেও এটি দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের আকাক্সক্ষাকে পুরোপুরি বাস্তব কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিফলিত করতে পারছে না। এটি যেমন দিবালোকের মতো সত্য, তেমনি বহুপাক্ষিক সহযোগিতা ফোরাম হিসেবে সার্কের কোনো বিকল্প নেই। বিমসটেক, বিসিআইএম এবং অন্যান্য উপ-আঞ্চলিক ও আন্তঃআঞ্চলিক সহযোগিতার প্রক্রিয়া সার্কের বিকল্প হতে পারে না। সার্ককে শক্তিশালী করার জন্য সব মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। সার্ক কার্যক্রমের কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সরকারিকরণ প্রক্রিয়া থেকে সরে এসে বিভিন্ন বেসরকারি ও নাগরিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা বাড়াতে হবে। সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আস্থার পরিবেশ আরও বাড়াতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার জন্য ফ্রান্স ও জার্মানি তাদের চিরশত্র“তা ভুলে গিয়ে যেভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের অনুরূপ ভূমিকা অপরিহার্য। এটি যত দ্রুত হবে, ততই মঙ্গলজনক হবে দক্ষিণ এশিয়ার ২০০ কোটি দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য।
ড. দেলোয়ার হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সার্ক সম্পর্কে যে কোনো বিশ্লেষণে তিনটি বিষয়কে একসঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এর একটি হল দক্ষিণ এশিয়া, অন্যটি আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং তৃতীয়টি আঞ্চলিক সংগঠন। দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতায় আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সার্ক আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, যদিও সার্কের কার্যকারিতা সম্পর্কে সাধারণভাবে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এর অন্যতম হল, সার্ক হচ্ছে একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যেখানে সদস্যরাষ্ট্রের সরকারগুলো অন্যতম চালিকাশক্তি। অর্থাৎ সার্ক নিজস্ব শক্তিতে চলার যোগ্যতা রাখে না। সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ঐকান্তিকতা ও আগ্রহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করে রাখে। সার্কের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৃহৎ দুই পক্ষ- ভারত ও পাকিস্তান এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে না। দ্বিতীয়ত, সার্ক হচ্ছে সহযোগিতার একটি সম্পূরক প্রক্রিয়া। অর্থাৎ একটি অঞ্চলে দ্বিপাক্ষিক ও অন্যান্য পর্যায়ে যে ধরনের সহযোগিতা ও সংহতি বিদ্যমান থাকে, সেখানে আঞ্চলিক পর্যায়ে সার্ক বহুপাক্ষিক বৃহত্তর ফোরাম হিসেবে কাজ করে থাকে। ফলে সার্কের অর্জন নিয়ে আমাদের একটি বাস্তবভিত্তিক মূল্যায়ন প্রয়োজন।
এবার আসা যাক ১৮তম শীর্ষ সম্মেলনে কী অর্জিত হয়েছে সে প্রসঙ্গে। প্রথমত, এ বৈঠকটি সার্কের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১১ সালে মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে ১৭তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের মধ্যে পরবর্তী সার্ক শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে এক ধরনের হতাশা ছিল, যা এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে দূর হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এবারের সম্মেলনে তিনটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের চেষ্টা করা হয়েছিল। এর মধ্যে দুটি অর্থাৎ মোটরযান ও রেল যোগাযোগ সংক্রান্ত চুক্তি শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষর না হলেও জ্বালানি সহযোগিতাবিষয়ক যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা এ অঞ্চলের জন্য সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া মোটরযান ও রেল যোগাযোগ সংক্রান্ত চুক্তির বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে অগ্রগতির জন্য তিন মাস পর সার্ক পরিবহনমন্ত্রীদের বৈঠকের কথা বলা হয়েছে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে আমি মনে করি।
তৃতীয়ত কাঠমান্ডু ঘোষণার দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। সার্ক প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম শীর্ষ বৈঠকে সর্বাত্মক ও ব্যাপকভাবে অর্থপূর্ণ বিষয়ে একটি ঘোষণা অনুমোদন করা হয়েছে। এই ৩৬ দফার ঘোষণাটিতে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ২০০ কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। বিশেষ করে এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন- দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ইকোনমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা, কানেকটিভিটি, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ মোকাবেলা, শিক্ষার জন্য আঞ্চলিক সমন্বিত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, দারিদ্র্য বিমোচন, পর্যবেক্ষক সদস্যদের কার্যকর অংশগ্রহণের জন্য একটি কাঠামো গড়ে তোলা, ব্ল– ইকোনমির ধারণা, মানুষের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা ইত্যাদি বিষয় ঘোষণায় স্থান পেয়েছে। এ বিষয়গুলো ভবিষ্যতে সার্ককে নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে নেবে।
চতুর্থত, সার্কের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার বাইরে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সাইডলাইনে যেসব দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে, তার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সার্কের সব সদস্যদেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। একইভাবে নেপাল, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। নেপাল ভারতের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। অর্থাৎ সার্ক ফোরামকে কাজে লাগিয়ে সদস্যরাষ্ট্রগুলো তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সাধনে সক্ষম হয়েছে।
পঞ্চমত, বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকটি অর্জন উল্লেখযোগ্য। এর একটি হচ্ছে, আঞ্চলিক জ্বালানি চুক্তির ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের জ্বালানি সহযোগিতার বিষয়টিকে বহুপাক্ষিক পর্যায়ে বিবেচনার একটি বাস্তব সুযোগ তৈরি হয়েছে। শুধু ভারত নয়, নেপাল ও ভুটানও এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কাজেই বাংলাদেশের জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে এ সহযোগিতা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
এর বাইরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ফলপ্রসূ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো দুই নেতার সাক্ষাৎ পারস্পরিক সমঝোতার বিষয়টিকে বহুলাংশে এগিয়ে নিয়েছে, বিশেষ করে স্থলসীমান্ত চুক্তি এবং তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির জোর প্রচেষ্টার ঘোষণা বাংলাদেশকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে আশ্বস্ত করতে পারে। বাংলাদেশকে এ সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে।
এবারের সম্মেলনের আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়। সেটি হল সার্কের ঘোষণায় বাংলদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তথা বাংলাদেশের ভাবনার প্রতিফলন। কাঠমান্ডু ঘোষণায় ব্লু ইকোনমির বিষয়টি স্থান পাওয়া এর অন্যতম। ফলে দেখা যাচ্ছে, ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তথাপি সার্কের ইতিহাস ও মানুষের প্রত্যাশা বিবেচনা করলে সংস্থাটির আরও কার্যকর ও সফল ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার প্রয়োজন ছিল। প্রসঙ্গত, আমরা যদি বহিঃবিশ্বের দিকে তাকাই, দেখতে পাব সার্ক প্রতিষ্ঠার আগে অথবা পরে প্রতিষ্ঠিত এমন অনেক আঞ্চলিক সংস্থা আছে যেগুলো অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এ পরিস্থিতিতে সার্কের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট। সংস্থাটির সামনে কতগুলো চ্যালেঞ্জ আমরা লক্ষ্য করি। এর অন্যতম হল, সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে ভারত ও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে একক ও যৌথভাবে সার্কের লক্ষ্য অর্জনে যথেষ্ট সাড়া না দেয়া। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, এ দুটি দেশ দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করছে। ফলে সার্ক বঞ্চিত হচ্ছে তাদের কার্যকর মনোযোগ থেকে। এ বাস্তবতা আশির দশকের শুরুতে থাকলেও এখনও বিভিন্ন পর্যায়ে অব্যাহত আছে।
সার্ক বেশকিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ যেমন- মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠার চুক্তি, আঞ্চলিক ফুডব্যাংক প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় কনভেশন স্বাক্ষর ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নেয়া সত্ত্বেও শুধু বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে এ অর্জনগুলো জনগণের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে না। অর্থাৎ বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জটি বড় আকারেই রয়েছে।
সার্ক সচিবালয়ের দিকেও দৃষ্টি দিতে চাই। ১৯৮৫ সালে কাঠমান্ডুতে প্রতিষ্ঠিত সচিবালয়কে তেমন একটা কার্যকর ও শক্তিশালী করে উন্নীত করা হয়নি। অনেকে দুঃখ করে এ সচিবালয়কে পোস্ট অফিস হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। এ সচিবালয়ের মহাসচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও রিসোর্সের ব্যাপক অসামঞ্জস্য দেখা যায়। এ ধরনের একটি আঞ্চলিক সংস্থার মহাসচিবের যে ধরনের মর্যাদা থাকা উচিত, সার্কে তেমনটি দেখা যায় না। এ বিষয়টি সার্কের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে একটি বড় বাধা হয়ে আছে।
সবশেষে সার্ক সনদের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। সার্ক প্রতিষ্ঠার সময়ে যেসব ধারা সংযোজন করে সনদটি স্বাক্ষর করা হয়েছিল, আজও সেসবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিশেষ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বসম্মতির বাধ্যবাধকতা এবং দ্বিপাক্ষিক ও বিরোধপূর্ণ বিষয়ে আলোচনায় নিষেধাজ্ঞা সার্ককে শক্তিশালী করা এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করছে।
আরেকটি চ্যালেঞ্জ উল্লেখযোগ্য। সার্ক নেতারা জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগের বিষয়টিকে আনুষ্ঠানিকভাবে গুরুত্ব দিলেও এক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যেমন, এ অঞ্চলের ভিসা প্রক্রিয়া এখনও অনেক জটিল ও দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজালে আবদ্ধ। ভিসার জন্য ভোগান্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রত্যাখ্যান একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সার্ক প্রক্রিয়ায় নন-স্টেট অ্যাক্টরদের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ তৈরি করা হয়নি। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, দুর্যোগ মোকাবেলা, মানব পাচার- এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সুশীল সমাজের অর্থবহ ভূমিকা থাকতে পারত। কিন্তু বাস্তবে সেটি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
সুতরাং সার্বিক বিবেচনায় সার্ক এ অঞ্চলের আঞ্চলিক সহযোগিতার একমাত্র উপায় হিসেবে বিবেচিত হলেও এটি দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের আকাক্সক্ষাকে পুরোপুরি বাস্তব কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিফলিত করতে পারছে না। এটি যেমন দিবালোকের মতো সত্য, তেমনি বহুপাক্ষিক সহযোগিতা ফোরাম হিসেবে সার্কের কোনো বিকল্প নেই। বিমসটেক, বিসিআইএম এবং অন্যান্য উপ-আঞ্চলিক ও আন্তঃআঞ্চলিক সহযোগিতার প্রক্রিয়া সার্কের বিকল্প হতে পারে না। সার্ককে শক্তিশালী করার জন্য সব মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। সার্ক কার্যক্রমের কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সরকারিকরণ প্রক্রিয়া থেকে সরে এসে বিভিন্ন বেসরকারি ও নাগরিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা বাড়াতে হবে। সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আস্থার পরিবেশ আরও বাড়াতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার জন্য ফ্রান্স ও জার্মানি তাদের চিরশত্র“তা ভুলে গিয়ে যেভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের অনুরূপ ভূমিকা অপরিহার্য। এটি যত দ্রুত হবে, ততই মঙ্গলজনক হবে দক্ষিণ এশিয়ার ২০০ কোটি দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য।
ড. দেলোয়ার হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments