বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও দেশীয় জঙ্গিবাদের স্বরূপ by তারেক শামসুর রেহমান
সম্প্রতি জঙ্গিবাদ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ ছাপা হয়েছে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়। এগুলো দেশের জন্য কোনো ভালো সংবাদ নয়। ভারতের বর্ধমানের খগড়াগড়ে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বলা হয়, বাংলাদেশের ইসলামপন্থী জঙ্গিরা এর সঙ্গে জড়িত। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদিনকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হল। তারপর ভারতীয় গোয়েন্দারা বাংলাদেশে এলেন। তারা বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের সঙ্গে মতবিনিময় করলেন। মতবিনিময়কালে বাংলাদেশ ভারতীয় পক্ষকে ১০ জঙ্গি ও ৪৯ জন সন্ত্রাসীর একটি তালিকা দিয়েছে, যারা পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যে অবৈধভাবে বসবাস করছে। তৃতীয় খবরটি এলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ সূচক ২০১৪ প্রকাশিত হয়েছে। এটি প্রকাশ করেছে ইন্সটিটিউট ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস নামে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ সূচক ২০১৪-এ ১৬২টি দেশের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩ নম্বরে।
এ তিনটি ঘটনাকে যদি একসঙ্গে মেলান যায়, তাহলে কতগুলো প্রশ্ন ওঠে। এক. বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আছে, এর অস্তিত্ব আছে এবং জঙ্গিরা বাংলাদেশের বাইরে ভারতেও তৎপর। এ ঘটনা বাংলাদেশের ইমেজের জন্য খারাপ। এতে করে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নজরদারিতে চলে যাবে এবং আগামীতে বাংলাদেশের ওপর বৈশ্বিক চাপ আরও বাড়বে। দুই. তিনটি জঙ্গি সংগঠনের কথা মোটামুটিভাবে আমরা জানি এবং এদের তৎপরতা সীমিত আকারে হলেও আছে। জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম এবং আনসারুল্লাহ বাংলাটিম। এদের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা গেছে, এটা বলা যাবে না। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এদের তৎপরতার খবর মাঝে-মধ্যে সংবাদপত্রে ছাপা হয় এখনও। এখানে বাংলাদেশের পুলিশ তথা গোয়েন্দাদের ভূমিকার প্রশ্নটি চলে আসে। তারা তাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে, এই প্রশ্নটিও আছে। সরকার পুলিশ প্রশাসনের জন্য অনেক কিছু করেছে। পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে সিনিয়র পদ অনেক বাড়ানো হয়েছে। এতে করে কি তাদের কর্মদক্ষতা বাড়ানো গেছে? জঙ্গি দমনে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল দরকার। এখানে বেশ ঘাটতি আছে। এ বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
একসময় র্যাব যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইকে গ্রেফতারের কৃতিত্ব র্যাবের। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে র্যাবের কর্মকাণ্ড (সন্ত্রাস দমনে) তেমন চোখে পড়ে না। র্যাবকে অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। উপরন্তু র্যাবের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আসরেও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ফলে র্যাবকে দিয়ে জঙ্গি দমনের বিষয়টি এখন আর তেমনভাবে আলোচিত হয় না।
দুই. বাংলাদেশের জঙ্গিরা এখন পশ্চিমবঙ্গে তৎপর! এ খবরটি ভারতীয় গোয়েন্দাদের। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, তা বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের খুঁজে বের করতে হবে। বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের বর্ধমানে যাওয়া উচিত। বাংলাদেশ যদি ভারতীয় গোয়েন্দাদের বক্তব্যকে স্বীকার করে নেয়, তাহলে বাংলাদেশের ওপর ভারতীয় চাপ আরও বাড়বে। একসময় ভারতীয় গোয়েন্দারা বাংলাদেশে এসে কাজ শুরু করবে! এতে করে বাংলাদেশের জঙ্গি দমনের ব্যর্থতা (?) প্রশ্নের মুখে থাকবে। বাংলাদেশের উচিত বিষয়টির নিরপেক্ষ তদন্ত করা। তবে ভারতে বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা আছে, বসবাস করে, এটা মোটামুটিভাবে স্পষ্ট। নিশ্চয়ই এসব সন্ত্রাসীর সঙ্গে ভরতীয় সন্ত্রাসীদের একটা যোগসূত্র আছে। এই যোগসূত্রটি ভেঙে দিতে হবে। বাংলাদেশের জঙ্গিরা ভারতে আশ্রয় নিতে পারে। সীমান্ত অতিক্রম করা কঠিন কিছু নয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা সৎ নন। তাদের ম্যানেজ করা কঠিন কিছু নয়। উপরন্তু চোরাকারবারিরাও রয়েছে। এদের ম্যানেজ করে বাংলাদেশের জঙ্গিরা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিতে পারে। এটা স্বাভাবিক। এখন বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের উচিত হবে তৎপরতা বাড়ানো।
তিন. জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ ও ভারতের খোলামন নিয়ে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এই সহযোগিতায় যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে না। এক পর্যায়ে ভারত বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াবে এবং সুবিধা আদায় করে নিতে চাইবে। যা কি-না যে কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য ভালো খবর নয়।
চার. বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা দমনের স্বার্থে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে ন্যূনতম প্রশ্নে ঐকমত্য হওয়া প্রয়োজন। না হলে জঙ্গিরা এর সুযোগ নেবে। এ মুহূর্তে যে সংসদ কার্যক্রম রয়েছে, তার ভূমিকা নিয়ে জনমনে ও বুদ্ধিজীবী সার্কেলে নানা প্রশ্ন আছে। সংসদ কার্যকর নয়- এটা জাতীয় পার্টিও স্বীকার করে। বিএনপি বড় দল। সংসদে না থাকলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে এ দলটির ভূমিকা বড় ও ব্যাপক। সন্ত্রাস দমনে বিএনপিরও একটি ভূমিকা আছে। এ ভূমিকাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে নিয়ে সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে একটা সহাবস্থান গড়ে তোলা। আমি বিশ্বাস করি, সন্ত্রাসবাদ দমনে ও জঙ্গি উৎখাতে বিএনপি আন্তরিক। এখন বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যদি জঙ্গি দমনে এক হয়, তাহলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই দুটি দলের মাঝে বিভক্তি ও বিদ্বেষ এত বেশি যে, এর সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গিরা। তারা সংগঠিত হচ্ছে। সুতরাং বড় দল দুটির মাঝে সমঝোতা দরকার।
পাঁচ. জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের উত্থান জঙ্গিবাদে নতুন একটি মাত্রা দিয়েছে। এদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিদের যোগাযোগ থাকা বিচিত্র কিছু নয়। তবে আল কায়দার উপমহাদেশীয় শাখা ইতিমধ্যে সংগঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার নিয়ে এ শাখা গঠিত। এদের সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের কোনো খবর আমাদের জানা নেই। তবে আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, এরা সংগঠিত হচ্ছে। ভারতে ইসলামী জঙ্গিরা রয়েছে। এদের তৎপরতার খবরও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এদের সঙ্গে আল কায়দা কিংবা আইএসের সম্পর্ক কী, তা এখন খতিয়ে দেখার বিষয়। বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এ কাজটি করা অত্যন্ত জরুরি। তবে বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা জানেন আল কায়দা ও আইএসের মধ্যে নীতিগতভাবে ও জঙ্গি তৎপরতার দিক দিয়ে পার্থক্য রয়েছে। আইএস যেখানে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করছে এবং ইতিমধ্যে ইরাক-সিরিয়ার একটি বিশাল এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে (সুন্নিস্তান), সেখানে আল কায়দা এখনও গেরিলা কায়দায় তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। আইএসের মতো তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনীও নেই। এ দুই সশস্ত্র গ্র“পের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। উপরন্তু আল কায়দার সঙ্গে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর সম্পর্ক বা তাদের শাখা থাকলেও আইএসের শাখা নেই। এমনকি পাকিস্তান, আফগানিস্তান কিংবা লিবিয়ার মতো দেশে যেখানে জঙ্গি তৎপরতা রয়েছে, সেখানে আইএসের কোনো শাখা নেই। সুতরাং বাংলাদেশ বা ভারতে আইএস এ মুহূর্তে কোনো শাখা নাও খুলতে পারে। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের উত্থানে উৎসাহিত হবে, এটা স্বাভাকি। সব জঙ্গির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা তাই জরুরি।
আল কায়দা তার জঙ্গি তৎপরতা পরিচালিত করে সীমিত জায়গায় সংগঠিত হয়ে, যাকে বিশ্লেষকরা স্পাইডার ওয়েভ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মাকড়সা যেভাবে ছোট জায়গায় জাল বোনে এবং ওই জাল ভেঙে গেলে আবার অন্যত্র গিয়ে জাল বোনে, আল কায়দার স্ট্র্যাটেজি অনেকটা তেমনি। তারা এক জায়গায় একত্রিত হয়। সেখানকার স্থাপনার ওপর আক্রমণ করে এবং তা ধ্বংস করে দেয়। পরে আবার অন্যত্র গিয়ে আক্রমণ করে। বাংলাদেশের জঙ্গিদের মধ্যে তেমন স্ট্র্যাটেজি চোখে পড়ে না। এদের বড় কোনো কর্মকাণ্ড সম্প্রতি আমাদের চোখে পড়েনি। এরা যে খুব শক্তিশালী তাও আমার কখনও মনে হয়নি। মাঝে মাঝে দু-একজন ধরা পড়ে। তবে এদের কোনো কর্মকাণ্ড নেই। আমাদের আইন-শৃংখলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে এরা সংগঠিত হতে পারছে না। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, জঙ্গিবাদ একটা বৈশ্বিক সমস্যা। মুসলিমপ্রধান অঞ্চলেই এদের তৎপরতা। এ জঙ্গি তৎপরতা এখন সুদূর আফ্রিকার যেখানে মুসলমান জাতি রয়েছে, সেখানেও সম্প্রসারিত হয়েছে। নাইজেরিয়া, সাদ, সুদানের মতো দেশেও জঙ্গি তৎপরতা বাড়ছে। এর অর্থ হচ্ছে, জঙ্গি তৎপরতা মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে এখন আফ্রিকায় সম্প্রসারিত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডেও জঙ্গিরা তৎপর। ইন্দোনেশিয়ায়
এদের অবস্থান অত্যন্ত শক্তশালী। ফলে দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশকে এরা টার্গেট করবে, এটাই স্বাভাবিক। সতর্ক হওয়ার প্রয়োজনটা তাই এ কারণেই।
জঙ্গিবাদ মানবতার শত্রু। আল কায়দা কিংবা আইএস যেভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়, বাংলাদেশের মানুষ কখনোই সেটা সমর্থন করবে না। জঙ্গিবাদী ইসলাম আসলেই কোনো ইসলাম নয়। গলা কেটে, বোমা বানিয়ে মানুষ হত্যা করার নাম ইসলাম হতে পারে না। ইসলাম মানবতার ধর্ম। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। কিন্তু যারা ধর্মের নামে রাজনীতি করে, বোমা বানায়, এদের কোনো গণভিত্তি নেই। মানুষ এদের সমর্থনও করবে না। তবে মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তকারীরা রয়েছে। বাংলাদেশেও আছে। তাই এ মাটিতে জঙ্গি গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। ইসলামের নামে এরা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় আমরা তাই শংকিত। বর্ধমানের জঙ্গি তৎপরতার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা দরকার। এজন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দাদের ওপর নির্ভর না করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথা পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা প্রয়োজন। এটা ভারতীয় জঙ্গিদের কাজও হতে পারে। মমতা ব্যানার্জি সরকারের ভূমিকা কী এটাও আমাদের জানা দরকার। এখানে কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কাজ করছে কি-না, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ আমরা জানি, মোদি সরকারের এখন প্রধান টার্গেট হচ্ছে মমতা ব্যানার্জিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে উৎখাত করা। তাই বলে আমরা যেন কোনো ধরনের আত্মতুষ্টিতে না ভুগি। আমাদের দেশে জঙ্গিরা আছে। এরা হয়তো তেমনভাবে সংগঠিত নয়। তবে আছে এবং সুযোগ পেলেই এরা তৎপর হয়ে ওঠে। ত্রিশালের জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা এর বড় প্রমাণ। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তি ও বিদ্বেষ বাড়ছে। সংসদ কার্যকর নয়। রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে। আর এর সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গিরা।
সরকার জঙ্গি দমনের কথা বলছে বটে; কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে যে প্রচারণা দরকার, সেটি হচ্ছে না। গোয়েন্দা তৎপরতা আরও বাড়ানো দরকার। সেটিও হচ্ছে না। গোয়েন্দাদের অন্যত্র ব্যস্ত রাখা হচ্ছে। তবে একটি আশার কথা অবশ্যই আছে- এ জঙ্গি তৎপরতা বড় কোনো হুমকি সৃষ্টি করতে পারেনি। তাই বলে আমরা চুপচাপ বসে থাকলে এদের তৎপরতা বাড়বে বৈ কমবে না। বাংলাদেশে সীমিত আকারে হলেও জঙ্গি তৎপরতা আছে। এ তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। জঙ্গিবাদ যে মানবতার শত্রু এ প্রচারণার ওপরই এখন গুরুত্ব দেয়া উচিত বেশি।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এ তিনটি ঘটনাকে যদি একসঙ্গে মেলান যায়, তাহলে কতগুলো প্রশ্ন ওঠে। এক. বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আছে, এর অস্তিত্ব আছে এবং জঙ্গিরা বাংলাদেশের বাইরে ভারতেও তৎপর। এ ঘটনা বাংলাদেশের ইমেজের জন্য খারাপ। এতে করে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নজরদারিতে চলে যাবে এবং আগামীতে বাংলাদেশের ওপর বৈশ্বিক চাপ আরও বাড়বে। দুই. তিনটি জঙ্গি সংগঠনের কথা মোটামুটিভাবে আমরা জানি এবং এদের তৎপরতা সীমিত আকারে হলেও আছে। জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম এবং আনসারুল্লাহ বাংলাটিম। এদের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা গেছে, এটা বলা যাবে না। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এদের তৎপরতার খবর মাঝে-মধ্যে সংবাদপত্রে ছাপা হয় এখনও। এখানে বাংলাদেশের পুলিশ তথা গোয়েন্দাদের ভূমিকার প্রশ্নটি চলে আসে। তারা তাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে, এই প্রশ্নটিও আছে। সরকার পুলিশ প্রশাসনের জন্য অনেক কিছু করেছে। পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে সিনিয়র পদ অনেক বাড়ানো হয়েছে। এতে করে কি তাদের কর্মদক্ষতা বাড়ানো গেছে? জঙ্গি দমনে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল দরকার। এখানে বেশ ঘাটতি আছে। এ বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
একসময় র্যাব যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইকে গ্রেফতারের কৃতিত্ব র্যাবের। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে র্যাবের কর্মকাণ্ড (সন্ত্রাস দমনে) তেমন চোখে পড়ে না। র্যাবকে অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। উপরন্তু র্যাবের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আসরেও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ফলে র্যাবকে দিয়ে জঙ্গি দমনের বিষয়টি এখন আর তেমনভাবে আলোচিত হয় না।
দুই. বাংলাদেশের জঙ্গিরা এখন পশ্চিমবঙ্গে তৎপর! এ খবরটি ভারতীয় গোয়েন্দাদের। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, তা বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের খুঁজে বের করতে হবে। বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের বর্ধমানে যাওয়া উচিত। বাংলাদেশ যদি ভারতীয় গোয়েন্দাদের বক্তব্যকে স্বীকার করে নেয়, তাহলে বাংলাদেশের ওপর ভারতীয় চাপ আরও বাড়বে। একসময় ভারতীয় গোয়েন্দারা বাংলাদেশে এসে কাজ শুরু করবে! এতে করে বাংলাদেশের জঙ্গি দমনের ব্যর্থতা (?) প্রশ্নের মুখে থাকবে। বাংলাদেশের উচিত বিষয়টির নিরপেক্ষ তদন্ত করা। তবে ভারতে বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা আছে, বসবাস করে, এটা মোটামুটিভাবে স্পষ্ট। নিশ্চয়ই এসব সন্ত্রাসীর সঙ্গে ভরতীয় সন্ত্রাসীদের একটা যোগসূত্র আছে। এই যোগসূত্রটি ভেঙে দিতে হবে। বাংলাদেশের জঙ্গিরা ভারতে আশ্রয় নিতে পারে। সীমান্ত অতিক্রম করা কঠিন কিছু নয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা সৎ নন। তাদের ম্যানেজ করা কঠিন কিছু নয়। উপরন্তু চোরাকারবারিরাও রয়েছে। এদের ম্যানেজ করে বাংলাদেশের জঙ্গিরা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিতে পারে। এটা স্বাভাবিক। এখন বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের উচিত হবে তৎপরতা বাড়ানো।
তিন. জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ ও ভারতের খোলামন নিয়ে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এই সহযোগিতায় যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে না। এক পর্যায়ে ভারত বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াবে এবং সুবিধা আদায় করে নিতে চাইবে। যা কি-না যে কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য ভালো খবর নয়।
চার. বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা দমনের স্বার্থে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে ন্যূনতম প্রশ্নে ঐকমত্য হওয়া প্রয়োজন। না হলে জঙ্গিরা এর সুযোগ নেবে। এ মুহূর্তে যে সংসদ কার্যক্রম রয়েছে, তার ভূমিকা নিয়ে জনমনে ও বুদ্ধিজীবী সার্কেলে নানা প্রশ্ন আছে। সংসদ কার্যকর নয়- এটা জাতীয় পার্টিও স্বীকার করে। বিএনপি বড় দল। সংসদে না থাকলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে এ দলটির ভূমিকা বড় ও ব্যাপক। সন্ত্রাস দমনে বিএনপিরও একটি ভূমিকা আছে। এ ভূমিকাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে নিয়ে সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে একটা সহাবস্থান গড়ে তোলা। আমি বিশ্বাস করি, সন্ত্রাসবাদ দমনে ও জঙ্গি উৎখাতে বিএনপি আন্তরিক। এখন বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যদি জঙ্গি দমনে এক হয়, তাহলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই দুটি দলের মাঝে বিভক্তি ও বিদ্বেষ এত বেশি যে, এর সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গিরা। তারা সংগঠিত হচ্ছে। সুতরাং বড় দল দুটির মাঝে সমঝোতা দরকার।
পাঁচ. জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের উত্থান জঙ্গিবাদে নতুন একটি মাত্রা দিয়েছে। এদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিদের যোগাযোগ থাকা বিচিত্র কিছু নয়। তবে আল কায়দার উপমহাদেশীয় শাখা ইতিমধ্যে সংগঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার নিয়ে এ শাখা গঠিত। এদের সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের কোনো খবর আমাদের জানা নেই। তবে আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, এরা সংগঠিত হচ্ছে। ভারতে ইসলামী জঙ্গিরা রয়েছে। এদের তৎপরতার খবরও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এদের সঙ্গে আল কায়দা কিংবা আইএসের সম্পর্ক কী, তা এখন খতিয়ে দেখার বিষয়। বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এ কাজটি করা অত্যন্ত জরুরি। তবে বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা জানেন আল কায়দা ও আইএসের মধ্যে নীতিগতভাবে ও জঙ্গি তৎপরতার দিক দিয়ে পার্থক্য রয়েছে। আইএস যেখানে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করছে এবং ইতিমধ্যে ইরাক-সিরিয়ার একটি বিশাল এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে (সুন্নিস্তান), সেখানে আল কায়দা এখনও গেরিলা কায়দায় তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। আইএসের মতো তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনীও নেই। এ দুই সশস্ত্র গ্র“পের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। উপরন্তু আল কায়দার সঙ্গে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর সম্পর্ক বা তাদের শাখা থাকলেও আইএসের শাখা নেই। এমনকি পাকিস্তান, আফগানিস্তান কিংবা লিবিয়ার মতো দেশে যেখানে জঙ্গি তৎপরতা রয়েছে, সেখানে আইএসের কোনো শাখা নেই। সুতরাং বাংলাদেশ বা ভারতে আইএস এ মুহূর্তে কোনো শাখা নাও খুলতে পারে। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের উত্থানে উৎসাহিত হবে, এটা স্বাভাকি। সব জঙ্গির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা তাই জরুরি।
আল কায়দা তার জঙ্গি তৎপরতা পরিচালিত করে সীমিত জায়গায় সংগঠিত হয়ে, যাকে বিশ্লেষকরা স্পাইডার ওয়েভ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মাকড়সা যেভাবে ছোট জায়গায় জাল বোনে এবং ওই জাল ভেঙে গেলে আবার অন্যত্র গিয়ে জাল বোনে, আল কায়দার স্ট্র্যাটেজি অনেকটা তেমনি। তারা এক জায়গায় একত্রিত হয়। সেখানকার স্থাপনার ওপর আক্রমণ করে এবং তা ধ্বংস করে দেয়। পরে আবার অন্যত্র গিয়ে আক্রমণ করে। বাংলাদেশের জঙ্গিদের মধ্যে তেমন স্ট্র্যাটেজি চোখে পড়ে না। এদের বড় কোনো কর্মকাণ্ড সম্প্রতি আমাদের চোখে পড়েনি। এরা যে খুব শক্তিশালী তাও আমার কখনও মনে হয়নি। মাঝে মাঝে দু-একজন ধরা পড়ে। তবে এদের কোনো কর্মকাণ্ড নেই। আমাদের আইন-শৃংখলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে এরা সংগঠিত হতে পারছে না। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, জঙ্গিবাদ একটা বৈশ্বিক সমস্যা। মুসলিমপ্রধান অঞ্চলেই এদের তৎপরতা। এ জঙ্গি তৎপরতা এখন সুদূর আফ্রিকার যেখানে মুসলমান জাতি রয়েছে, সেখানেও সম্প্রসারিত হয়েছে। নাইজেরিয়া, সাদ, সুদানের মতো দেশেও জঙ্গি তৎপরতা বাড়ছে। এর অর্থ হচ্ছে, জঙ্গি তৎপরতা মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে এখন আফ্রিকায় সম্প্রসারিত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডেও জঙ্গিরা তৎপর। ইন্দোনেশিয়ায়
এদের অবস্থান অত্যন্ত শক্তশালী। ফলে দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশকে এরা টার্গেট করবে, এটাই স্বাভাবিক। সতর্ক হওয়ার প্রয়োজনটা তাই এ কারণেই।
জঙ্গিবাদ মানবতার শত্রু। আল কায়দা কিংবা আইএস যেভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়, বাংলাদেশের মানুষ কখনোই সেটা সমর্থন করবে না। জঙ্গিবাদী ইসলাম আসলেই কোনো ইসলাম নয়। গলা কেটে, বোমা বানিয়ে মানুষ হত্যা করার নাম ইসলাম হতে পারে না। ইসলাম মানবতার ধর্ম। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। কিন্তু যারা ধর্মের নামে রাজনীতি করে, বোমা বানায়, এদের কোনো গণভিত্তি নেই। মানুষ এদের সমর্থনও করবে না। তবে মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তকারীরা রয়েছে। বাংলাদেশেও আছে। তাই এ মাটিতে জঙ্গি গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। ইসলামের নামে এরা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় আমরা তাই শংকিত। বর্ধমানের জঙ্গি তৎপরতার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা দরকার। এজন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দাদের ওপর নির্ভর না করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথা পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা প্রয়োজন। এটা ভারতীয় জঙ্গিদের কাজও হতে পারে। মমতা ব্যানার্জি সরকারের ভূমিকা কী এটাও আমাদের জানা দরকার। এখানে কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কাজ করছে কি-না, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ আমরা জানি, মোদি সরকারের এখন প্রধান টার্গেট হচ্ছে মমতা ব্যানার্জিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে উৎখাত করা। তাই বলে আমরা যেন কোনো ধরনের আত্মতুষ্টিতে না ভুগি। আমাদের দেশে জঙ্গিরা আছে। এরা হয়তো তেমনভাবে সংগঠিত নয়। তবে আছে এবং সুযোগ পেলেই এরা তৎপর হয়ে ওঠে। ত্রিশালের জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা এর বড় প্রমাণ। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তি ও বিদ্বেষ বাড়ছে। সংসদ কার্যকর নয়। রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে। আর এর সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গিরা।
সরকার জঙ্গি দমনের কথা বলছে বটে; কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে যে প্রচারণা দরকার, সেটি হচ্ছে না। গোয়েন্দা তৎপরতা আরও বাড়ানো দরকার। সেটিও হচ্ছে না। গোয়েন্দাদের অন্যত্র ব্যস্ত রাখা হচ্ছে। তবে একটি আশার কথা অবশ্যই আছে- এ জঙ্গি তৎপরতা বড় কোনো হুমকি সৃষ্টি করতে পারেনি। তাই বলে আমরা চুপচাপ বসে থাকলে এদের তৎপরতা বাড়বে বৈ কমবে না। বাংলাদেশে সীমিত আকারে হলেও জঙ্গি তৎপরতা আছে। এ তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। জঙ্গিবাদ যে মানবতার শত্রু এ প্রচারণার ওপরই এখন গুরুত্ব দেয়া উচিত বেশি।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments