দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা কেন যৌক্তিক by মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করতে দেয়ার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হলেও সময়পোযোগী নয়। কারণ ওই সিদ্ধান্তের ফলে একটি প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো ধরনের পর্যবেক্ষণ ছাড়াই পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের নামে একটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করার অধিকার কর্তৃপক্ষের নেই।
আসন শূন্য থাকা এবং ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি বন্ধের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ বন্ধ করা হলেও এর ফলে সেই উদ্দেশ্য কতটুকু পূরণ হবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। ওই ঘটনার জন্য শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই দায়ী না হওয়ায় দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা বন্ধের নামে তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। বস্তুত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতির গলদের কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। ফলে আমরা দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ না করে পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার করতে পারি। কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতার দায়ভার শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া নিঃসন্দেহে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার ঢাকতে একটি ব্যাচকে বঞ্চিত করার অধিকার কর্তৃপক্ষের আছে কি?
শিক্ষার্থীরা ভালো বিষয়ে পড়ার আশায় দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বলে অনেক আসন শূন্য হয়ে যায়। বর্তমান সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ভবিষ্যতে আসন শূন্য থাকার সম্ভাবনা কমে আসবে, এ দাবি অনেকাংশে সত্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪৮ ভাগই প্রায় এক বছর ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করে দ্বিতীয়বার কাক্সিক্ষত বিষয়ে সুযোগ পায়। ইংরেজি ও অর্থনীতি ছাড়া কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের প্রায় সব বিষয়ে এবং চাকরির বাজারে কম চাহিদার বিজ্ঞান অনুষদের অনেক বিষয়ে বহু আসন শূন্য হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে অন্য বিষয়ে চলে যাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১-১২, ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে যথাক্রমে ৪২৯, ৪১৬ ও ৪২১ আসন শূন্য হয়েছে। ঢাবির একটি আসন অনেক মূলবান হওয়ায় ভালো বিষয়ে পড়ার অজুহাতে এত আসন শূন্য থাকা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তবে এর দায়ভার কোনোক্রমেই ২০১৪ সালের এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের নয়।
প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ ছাড়া দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার কারণে প্রতিবছর আসন শূন্য থাকার প্রবণতা বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দেখেছি, আমার বিভাগে প্রতিবছর ১১০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলেও বছর শেষে গড়ে ২০ জন অন্যত্র চলে যাচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাচের ক্ষেত্রে ওই হার অনেক বেশি। তাই বর্তমান সিদ্ধান্ত আসনশূন্য রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখলেও এর বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে তা কার্যকর করা হলে একটি প্রজম্ম (২০১৪ সালে এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা) ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হঠাৎ সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন ও নতুন পাঠ্যবই প্রণয়ন করে এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের কলংকের কালিমা এঁকে দিয়ে ইতিমধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ওদের বহুবার মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করেছে।
এবার ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে নতুন নিয়মে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের অপমৃত্যু হলে এ শিক্ষার্থীদের অনেকে হতাশ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিলে তার দায় কে নেবে? এমনিতে অন্য বছরের তুলনায় এবার ভর্তি পরীক্ষা কয়েক মাস আগে হওয়ায় এইচএসসি পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়নি। ফলে ২০১৩ সালের এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতা করে তারা উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এ বছর ভর্তি পরীক্ষায় মোট উত্তীর্ণ ৪৫ হাজার ৫৩ জনের মধ্যে ২১ হাজার ৪৯৩ জনই বিগত বছরের পরীক্ষার্র্থী, যা এর বড় প্রমাণ। ফলে হঠাৎ করে ভর্তি পরীক্ষা থেকে নতুন নিয়ম চালু করা হলে ২০১৪ সালে এইচএসসি উত্তীর্ণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া থেকে বঞ্চিত হবে।
‘দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেয়া যাবে না’ এমন সিদ্ধান্ত ভর্তি পরীক্ষার আগে জানালেও তারা বিকল্প চিন্তা করতে পারত। অনেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টাও করেনি। ইতিমধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাবির মতো ‘একবার পরীক্ষা নীতি’ গ্রহণ করায় এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজে পড়া ছাড়া উপায় থাকছে না।
এই সিদ্ধান্ত কোচিং বাণিজ্য বন্ধ না করলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পোয়াবারো হবে। অন্যত্র ভর্তি হওয়ার সব সুযোগ শেষ হওয়ায় শিক্ষার্থীরা এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হবে। কিন্তু যাদের আর্থিক অবস্থা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উপযুক্ত নয়, তারা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়বে। এ ক্ষেত্রে গ্রামের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ শহুরে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও দ্বিতীয়বার গ্রামের শিক্ষার্থীরা বেশি ভালো করে। গ্রামের মধ্যবিত্ত-নিুমধ্যবিত্ত, খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিক-মজুরের সন্তানদের কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষের কাছে সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করছি।
কর্তৃপক্ষের উচিত হবে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত ধাপে ধাপে কার্যকর করা। বিভাগীয় চেয়ারম্যানের অনুমতি সাপেক্ষে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যে নিয়ম চালু আছে, তা বন্ধ করা হলে ঢাবিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা আর আগামী শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না, যা আসন শূন্য হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করবে। আর ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্ত এখনই ঘোষণা করা হলে ২০১৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা বিকল্প চিন্তা করার এবং উপযুক্ত প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য যথেষ্ট সময় পাবে।
বাইরের কেন্দ্রগুলোয় ভর্তি পরীক্ষায় যে অনিয়ম হয়, তা রোধ করা কঠিন নয়। ঢাকা বা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভর্তি পরীক্ষার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রতি কক্ষে ২-৫ জন শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। তাই ভেতরে একজন বা প্রয়োজনে দু’জন শিক্ষককে দায়িত্বে রেখে বাকি শিক্ষকদের বাইরের কেন্দ্রগুলোয় পাঠানো যায় এবং কয়েকটি কক্ষ মিলে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে নজরদারিতে নিয়োজিত করা হলে বাইরের কেন্দ্রগুলোর শিক্ষকদের দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগে জালিয়াতি করার সুযোগ বন্ধ হবে। ভর্তি পরীক্ষার আগে বাইরের কেন্দ্রগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রকৃতপক্ষে কতজন শিক্ষক ওই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনে সক্ষম তা যাচাইপূর্বক প্রতি কক্ষে কমপক্ষে দু’জন শিক্ষক দায়িত্ব পালন করবে এমন অনুপাত হিসাব করে এবং প্রকৃত আসন সংখ্যা যাচাই করে সেই অনুপাতে পরীক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা হলে দুর্নীতি প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। ভর্তি পরীক্ষার এক ঘণ্টা মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখা হলে মোবাইল ও ব্লুটুথের মাধ্যমে উত্তর পাঠানো বন্ধ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
ভর্তি পরীক্ষা জালিয়াতিমুক্ত করার অজুহাতে অথবা আসন শূন্য থাকার দোহাই দিয়ে একটি প্রজন্মকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়। তাই ঢাবিতে ভর্তি না হওয়া ২০১৪ সালের এইচএসসি উত্তীর্ণদের দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সুযোগ দিয়ে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে ‘একবার পরীক্ষানীতি’ চালু করার জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আসন শূন্য থাকা এবং ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি বন্ধের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ বন্ধ করা হলেও এর ফলে সেই উদ্দেশ্য কতটুকু পূরণ হবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। ওই ঘটনার জন্য শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই দায়ী না হওয়ায় দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা বন্ধের নামে তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। বস্তুত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতির গলদের কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। ফলে আমরা দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ না করে পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার করতে পারি। কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতার দায়ভার শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া নিঃসন্দেহে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার ঢাকতে একটি ব্যাচকে বঞ্চিত করার অধিকার কর্তৃপক্ষের আছে কি?
শিক্ষার্থীরা ভালো বিষয়ে পড়ার আশায় দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বলে অনেক আসন শূন্য হয়ে যায়। বর্তমান সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ভবিষ্যতে আসন শূন্য থাকার সম্ভাবনা কমে আসবে, এ দাবি অনেকাংশে সত্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪৮ ভাগই প্রায় এক বছর ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করে দ্বিতীয়বার কাক্সিক্ষত বিষয়ে সুযোগ পায়। ইংরেজি ও অর্থনীতি ছাড়া কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের প্রায় সব বিষয়ে এবং চাকরির বাজারে কম চাহিদার বিজ্ঞান অনুষদের অনেক বিষয়ে বহু আসন শূন্য হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে অন্য বিষয়ে চলে যাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১-১২, ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে যথাক্রমে ৪২৯, ৪১৬ ও ৪২১ আসন শূন্য হয়েছে। ঢাবির একটি আসন অনেক মূলবান হওয়ায় ভালো বিষয়ে পড়ার অজুহাতে এত আসন শূন্য থাকা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তবে এর দায়ভার কোনোক্রমেই ২০১৪ সালের এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের নয়।
প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ ছাড়া দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার কারণে প্রতিবছর আসন শূন্য থাকার প্রবণতা বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দেখেছি, আমার বিভাগে প্রতিবছর ১১০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলেও বছর শেষে গড়ে ২০ জন অন্যত্র চলে যাচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাচের ক্ষেত্রে ওই হার অনেক বেশি। তাই বর্তমান সিদ্ধান্ত আসনশূন্য রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখলেও এর বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে তা কার্যকর করা হলে একটি প্রজম্ম (২০১৪ সালে এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা) ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হঠাৎ সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন ও নতুন পাঠ্যবই প্রণয়ন করে এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের কলংকের কালিমা এঁকে দিয়ে ইতিমধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ওদের বহুবার মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করেছে।
এবার ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে নতুন নিয়মে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের অপমৃত্যু হলে এ শিক্ষার্থীদের অনেকে হতাশ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিলে তার দায় কে নেবে? এমনিতে অন্য বছরের তুলনায় এবার ভর্তি পরীক্ষা কয়েক মাস আগে হওয়ায় এইচএসসি পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়নি। ফলে ২০১৩ সালের এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতা করে তারা উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এ বছর ভর্তি পরীক্ষায় মোট উত্তীর্ণ ৪৫ হাজার ৫৩ জনের মধ্যে ২১ হাজার ৪৯৩ জনই বিগত বছরের পরীক্ষার্র্থী, যা এর বড় প্রমাণ। ফলে হঠাৎ করে ভর্তি পরীক্ষা থেকে নতুন নিয়ম চালু করা হলে ২০১৪ সালে এইচএসসি উত্তীর্ণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া থেকে বঞ্চিত হবে।
‘দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেয়া যাবে না’ এমন সিদ্ধান্ত ভর্তি পরীক্ষার আগে জানালেও তারা বিকল্প চিন্তা করতে পারত। অনেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টাও করেনি। ইতিমধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাবির মতো ‘একবার পরীক্ষা নীতি’ গ্রহণ করায় এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজে পড়া ছাড়া উপায় থাকছে না।
এই সিদ্ধান্ত কোচিং বাণিজ্য বন্ধ না করলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পোয়াবারো হবে। অন্যত্র ভর্তি হওয়ার সব সুযোগ শেষ হওয়ায় শিক্ষার্থীরা এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হবে। কিন্তু যাদের আর্থিক অবস্থা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উপযুক্ত নয়, তারা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়বে। এ ক্ষেত্রে গ্রামের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ শহুরে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও দ্বিতীয়বার গ্রামের শিক্ষার্থীরা বেশি ভালো করে। গ্রামের মধ্যবিত্ত-নিুমধ্যবিত্ত, খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিক-মজুরের সন্তানদের কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষের কাছে সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করছি।
কর্তৃপক্ষের উচিত হবে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত ধাপে ধাপে কার্যকর করা। বিভাগীয় চেয়ারম্যানের অনুমতি সাপেক্ষে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যে নিয়ম চালু আছে, তা বন্ধ করা হলে ঢাবিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা আর আগামী শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না, যা আসন শূন্য হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করবে। আর ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্ত এখনই ঘোষণা করা হলে ২০১৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা বিকল্প চিন্তা করার এবং উপযুক্ত প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য যথেষ্ট সময় পাবে।
বাইরের কেন্দ্রগুলোয় ভর্তি পরীক্ষায় যে অনিয়ম হয়, তা রোধ করা কঠিন নয়। ঢাকা বা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভর্তি পরীক্ষার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রতি কক্ষে ২-৫ জন শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। তাই ভেতরে একজন বা প্রয়োজনে দু’জন শিক্ষককে দায়িত্বে রেখে বাকি শিক্ষকদের বাইরের কেন্দ্রগুলোয় পাঠানো যায় এবং কয়েকটি কক্ষ মিলে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে নজরদারিতে নিয়োজিত করা হলে বাইরের কেন্দ্রগুলোর শিক্ষকদের দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগে জালিয়াতি করার সুযোগ বন্ধ হবে। ভর্তি পরীক্ষার আগে বাইরের কেন্দ্রগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রকৃতপক্ষে কতজন শিক্ষক ওই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনে সক্ষম তা যাচাইপূর্বক প্রতি কক্ষে কমপক্ষে দু’জন শিক্ষক দায়িত্ব পালন করবে এমন অনুপাত হিসাব করে এবং প্রকৃত আসন সংখ্যা যাচাই করে সেই অনুপাতে পরীক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা হলে দুর্নীতি প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। ভর্তি পরীক্ষার এক ঘণ্টা মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখা হলে মোবাইল ও ব্লুটুথের মাধ্যমে উত্তর পাঠানো বন্ধ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
ভর্তি পরীক্ষা জালিয়াতিমুক্ত করার অজুহাতে অথবা আসন শূন্য থাকার দোহাই দিয়ে একটি প্রজন্মকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়। তাই ঢাবিতে ভর্তি না হওয়া ২০১৪ সালের এইচএসসি উত্তীর্ণদের দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সুযোগ দিয়ে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে ‘একবার পরীক্ষানীতি’ চালু করার জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments