নিয়ন্ত্রণের বাইরে by ব্র্যাড অ্যাডামস
সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে লেখা এক চিঠিতে সানজিদা ইসলাম বলেছে, তার বড় ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপির এ সদস্যকে শেষ জীবিত দেখা গিয়েছিল ৪ঠা ডিসেম্বর। সেদিন তাকে ঢাকায় এক কাজিনের বাসা থেকে গড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এক প্রত্যক্ষদর্শী পরিবারকে জানান, সাজেদুল ইসলামকে র্যাবের সদস্যরা নিয়ে যায়। তথাকথিত এ সন্ত্রাসবিরোধী প্যারামিলিটারি ইউনিটকে নিয়ে চরম আতঙ্ক রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, অপহরণকারীরা যে গাড়ি ব্যবহার করেছিল তা র্যাবের। সাজেদুলের কাজিনসহ আরও ৫ জনকে একই সময় উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের কাউকেই এর পর আর দেখা যায়নি। র্যাব, পুলিশ উভয়ই বলেছে তারা ওই ৬ জনের অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানে না। সানজিদা ইসলাম লিখেছেন, “আমার ভাইয়ের দুই কন্যা সন্তান রয়েছে আর তারা সবসময় তাদের বাবার কথা জানতে চায়। পুরো পরিবার দিন দিন আরও বেদনাহত হয়ে পড়ছে। ওদেরকে উদ্ধার করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছি আমরা, কিন্তু আট মাস পরও একজনেরও খোঁজ মেলেনি।” ২০০৪ সালে র্যাব গঠিত হওয়ার পর থেকে ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ র্যাবের দ্বারা নির্যাতনের যে সমস্ত ঘটনার প্রমাণ সংগ্রহ করেছে তার সঙ্গে মিল রয়েছে এ ঘটনার। বিএনপি সরকারের সময়ে ইসলামপন্থি জঙ্গিদের মোকাবিলায় গঠন করা হয় এ ব্যাটালিয়ন। এতে সেনা ও পুলিশ উভয় বাহিনীর সদস্য রয়েছে যারা ইউনিটের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টের ভিত্তিতে পালাবদল করে দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, গত এক দশকে আনুমানিক ৮০০ জন মানুষের প্রাণহানির দায় র্যাবের। এদের গৎবাঁধা গল্প হলো- ভিকটিম হয় গ্রেপ্তার থেকে পালিয়ে বাঁচতে গিয়ে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে অথবা গ্রেপ্তারের পর অপরাধের ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়ার পর তার সহযোগীরা র্যাবের ওপর হামলা চালালে সে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। ঘটনার এমন বিবরণ এত বেশি অভিন্ন যে ‘ক্রসফায়ার’ জনপ্রিয় অভিধানে ক্রিয়াপদ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। যারাই ক্ষমতায় থাকুন না কেন তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে শিখেছে র্যাব। গত বছর জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ে চাপ দিতে বিএনপি সদস্যরা সহিংস রাজপথ প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তা মেনে নেয়নি। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি ঘটে। বিরোধী সমর্থকেরা রেললাইন উপড়ে ফেলে, বাসে আগুন দেয়, সরকার সমর্থকদের হত্যা করে আর জনবহুল রাস্তায় গ্রেনেড ছুড়তে পথশিশুদের বাধ্য করে। ডিসেম্বরে পেট্রল বোমার আঘাতে ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার নিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষকরা ঢাকার প্রধান হাসপাতালের বার্নস ইউনিটে গিয়ে দেখতে পায়, এত ভিড় ছিল যে হাসপাতালের করিডোরে পর্যন্ত রোগীদের চিকিৎসা চলছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের তরফ থেকে এসব সহিংসতার জবাব ছিল নৃশংস। ২০১৪ সালের এপ্রিলে ‘ডেমোক্রেসি ইন ক্রসফায়ার’ শীর্ষক আমাদের এক রিপোর্টে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ পেয়েছে যে, নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচনের পর অনেক বিরোধী দল কর্মীদের বেআইনি হত্যাকাণ্ড ও গুমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল র্যাব সদস্য এবং অন্যান্য সরকারি বাহিনী। আমরা যে সব ঘটনা নিয়ে তদন্ত করেছি সেগুলোর ছয়টিতে কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ওই ভিকটিমদের প্রাথমিকভাবে গ্রেপ্তার করেছিল আর হেফাজতে থাকাকালে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সানজিদার ভাইয়ের মতো আরও ১০টি ঘটনা তদন্ত করেছে যেখানে একজনকে অবৈধভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে তারা নিজেদের পুলিশ বা র্যাবের সদস্য বলে পরিচয় দিয়েছে। ওই ঘটনাগুলোর সাতটিতে ভিকটিমের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। বেশির ভাগই রাস্তার পাশে। আর বাকিরা স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এপ্রিল মাসে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে সাতটি লাশ উদ্ধার করা হয়। তাদের পেট কেটে ফেলার চিহ্ন ছিল। ইট বেঁধে দিয়ে শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হত্যাকারীদের হিসাবে ভুল হয়েছিল, তাই মৃতদেহগুলো ভেসে ওঠে। ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ করছিল এমন তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আটজন র্যাব সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাব এত ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে, বিরোধী দল থাকাকালে আওয়ামী লীগ তাদের কঠোর সমালোচনা করলেও, এখন ক্ষমতাসীন হওয়া সত্ত্বেও র্যাব সংস্কার বা তাদের সদস্যদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষমতায় থাকাকালে বড় ধরনের ভুলের স্বীকারোক্তি দিয়ে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়া এখন বলছেন র্যাবকে বিলুপ্ত করা উচিত। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম দ্বিপাক্ষিক দাতা রাষ্ট্র এবং বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে ইউকে’র উচিত যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারতসহ অন্যান্য ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের সঙ্গে একযোগে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা নির্যাতনের চর্চা বন্ধে আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপ দেয়া। দাতা রাষ্ট্রগুলোর উচিত সাজেদুল ইসলামের মতো এমন গুমের ঘটনায় স্বতন্ত্র তদন্তের দাবি জানানো। তারপরও এটা ভবিষ্যতের নৃশংসতা প্রতিহত করবে না। নিয়মতান্ত্রিক পরিবর্তন আনার সময় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও প্রতীয়মান হয়েছে র্যাব সংস্কারযোগ্য নয়।
ব্র্যাড অ্যাডামস হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক
লন্ডনের নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার অনুবাদ
No comments