বিকাশে ঘুষ লেনদেন!
ভাই জীবনে এই দুঃসহ স্মৃতি কোনোদিন ভুলতে পারব না। বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি দোহারের জয়পাড়ায় এসে সব সোনালী স্বপ্ন ধুলায় মিশে গেছে। বুয়েটে পড়াশোনা করেছি। চৌদ্দ বছর ঢাকায় থাকি। গ্রামের বাড়ি আসা হয় না বললেই চলে। অথচ কী ভয়াবহ সুনামি না বয়ে গেছে আমার জীবনের ওপর দিয়ে। বোনের বিয়ের রাতে আমাকে ধরে নিয়ে যায় দোহার থানা পুলিশ। আমি হতবাক! কী আমার অপরাধ? জীবনে আমার বিরুদ্ধে কোথাও কোনো জিডি পর্যন্ত হয়নি। অথচ থানায় ধরে নিয়ে আমার কাছে সরাসরি ৩ লাখ টাকা চেয়ে বসেন ওসি মাহমুদুল হক ও এসআই আবদুল কাদের। শেষ পর্যন্ত আমাকে ২ লাখ টাকা ঘুষ ও এক মাসের জেলের ঘানি টেনে বের হতে হয়েছে। মাঝখানে আমি বহুজাতিক একটি কোম্পানির চাকরিতে যোগ দেয়ার সুযোগ হারিয়েছি।
চোখে জল আর মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে যুগান্তর প্রতিবেদকে এসব কথা বলেন, বুয়েটের মেধাবী ছাত্র রুবেল (ছদ্মনাম)। ভুক্তভোগী ব্যক্তির বিশেষ অনুরোধে তার নামটি প্রকাশ করা হল না। তবে তার বাড়ি দোহার উপজেলা উত্তর জয়পাড়া গ্রামে। তিনি জানিয়েছেন, পুলিশকে ঘুষ দেয়া দুই লাখ টাকার মধ্যে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দিয়েছেন নগদ এবং বাকি ২৫ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন ঢাকা থেকে বিকাশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এসআই কাদের নামে। এ সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণ তিনি যুগান্তরকে সরবরাহ করেন। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু বুয়েট থেকে সদ্য পাস করা এই মেধাবী রুবেল নয়, দোহার থানার ওসির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশে বহু মানুষ প্রায় প্রতিদিন এভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তার রোষানলে পড়ে জেল খাটছেন নিরপরাধ এইচএসসি পরীক্ষার্থী কলেজছাত্র নাজমুস সাকিব, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সায়েম, কোচিং সেন্টারের মালিক ফরিদ ও তার বন্ধু রবিউল। আর জেল থেকে সদ্য বেরিয়ে এসেছেন দোহার নবাবগঞ্জ কলেজের প্রবীণ শিক্ষক হাবীব উল্লাহ। ওসির এহেন নিপীড়নে দোহারের সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। যাদের অনেকে পুলিশি হয়রানি হওয়ার ভয়ে এ রকম জঘন্য অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। এদিকে এতসব প্রমাণিত অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহার করার পরও একজন ওসির এভাবে স্বপদে বহাল থাকা নিয়ে দোহারের সচেতন মহলসহ পর্যবেক্ষক মহলের অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেন। বেশ কয়েকজন যুগান্তরকে বলেন, গত কয়েকদিনে দৈনিক যুগান্তরে ওসি মাহমুদুল হকের বিরুদ্ধে তথ্যনির্ভর যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে প্রত্যাহার করা উচিত ছিল। কিন্তু তাকে এখনও বহাল রাখায় এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে, পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ ওপর মহলের সঙ্গে ওসি মাহমুদুল হকের গভীর সখ্যতা রয়েছে। আর এ রকম আশংকা যদি সত্য হয়, তাহলে এই পুলিশ কখনও জনগণের বন্ধু হওয়ার দাবি করতে পারে না। একই সঙ্গে বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের প্রতিও মানুষের আস্থা তলানিতে পৌঁছে যাবে। সরকারি দল আওয়ামী লীগকে যার খেসারত দিতে হবে আগামী নির্বাচনে।
কেস স্টাডি এক : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে পাস করা তরুণ প্রকৌশলী রুবেল। ১৪ বছর ধরে তিনি গ্রামের বাড়িতে থাকেন না। ২৬ সেপ্টেম্বর তার ডাক্তার ছোট বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। দোহার থানার পাশেই তাদের বাড়ি। বিয়ের আসর থেকে রাত ৯টায় ওই প্রকৌশলীকে ধরে নিয়ে আসেন দোহার থানার এসআই আবদুল কাদের ও এসআই মো. সেকান্দার হোসেন। থানায় নিয়ে তাকে নির্যাতন করার হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ৩ লাখ টাকা দাবি করা হয়। বহুজাতিক কোম্পানিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পদে চাকরি হওয়া ওই প্রকৌশলীর ১৫ অক্টোবর কর্মস্থলে যোগ দেয়ার কথা ছিল। জীবনের প্রথম চাকরি হারানোর আশংকায় ও নির্যাতনের ভয়ে ওই রাতে তিনি অনেক কষ্টে এক লাখ টাকা জোগাড় করে এসআই কাদেরের হাতে তুলে দেন। কিন্তু তারপরও রুবেলকে পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে এক দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ডে রেখে নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে আদায় করা হয় আরও এক লাখ টাকা। এরপর চালান করা হয় কোর্টে। এক মাসের বেশি জেল খেটে ২ নভেম্বর জামিনে ছাড়া পান।
ভুক্তভোগী প্রকৌশলী রুবেল যুগান্তরকে জানান, এলাকায় কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা নেই। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ঢাকাতেই লেখাপড়া করেছেন। মাঝে মধ্যে ঈদে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দু-এক দিনের বেশি থাকেননি। স্থানীয় এক দালাল তার ছবি থানায় দিয়ে বলে মালদার পার্টি। ধরলে মোটা অংকের ক্যাশ পাওয়া যাবে। পরে এসআই কাদের ও সিকান্দার বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে তাকে তুলে আনে। ঘুষ দেয়ার প্রমাণ হিসেবে তরুণ ওই প্রকৌশলী জানান, তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী নগদ টাকা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। ফলে ঢাকা থেকে এসআই আবদুল কাদেরের মোবাইল নম্বরে বিকাশ করে সাড়ে ২৫ হাজার টাকা দেন। এর প্রমাণ হিসেবে ২৮ সেপ্টেম্বর তারিখে এসআই আবদুল কাদেরের মোবাইল নম্বর ০১৭১৭০৭৭১০০ এ নম্বরে বিকাশ করে ০১৮৫০৭৭৫০০ নম্বর থেকে ১০ হাজার টাকা ও একই তারিখে ০১৭৫৫৬৫১২৭০ নম্বর থেকে ১৫৫০০ টাকা দেয়া হয়। যার প্রমাণ যুগান্তরের হাতে এসেছে।
তরুণ এ প্রকৌশলী বলেন, শুধু ঘুষ আদায়ের জন্য ডাক্তার বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ধরে এনে তার ওপর এ নিপীড়ন চালানো হয়। তাকে জেলে যেতে হয়েছে। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩৪১, ৪২৭, ৪৩৫, ১৪৭, ১৪৯, ৩৫৩, ৩৩২, ১৬৮ ধারার মতো সংবেদনশীল ও জামিন অযোগ্য ধারায় মামলায় আসামি পর্যন্ত করা হয়েছে। অথচ যে মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে সেখানে উপস্থিত থাকা তো দূরের কথা ওই দিন দোহার থানা এলাকাতেই ছিলেন না। এ ছাড়া থানা ও জেলখানায় তিনি শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাকে সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়েছে। মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি বিদেশও যেতে পারবেন না। প্রতি মাসে হাজিরা দেয়ার বিড়ম্বনা তো আছেই। তার মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজনরা এখনও পুলিশের হয়রানির ভয়ে আতংকে দিন কাটাচ্ছেন।
কেস স্টাডি ২ : দোহার নবাবগঞ্জ কলেজের সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক হাবীব উল্লাহকে নবাবগঞ্জের হাগড়াইল এলাকা থেকে আটক করে নবাবগঞ্জ থানা পুলিশ। দোহার থানার ওসি ফোর্স পাঠিয়ে বলেন, হাবীব উল্লাহ দোহার পৌরসভার চরলটা এলাকায় একটি মামলার আসামি। প্রবীণ এ শিক্ষাবিদকে দোহার থানায় আটকে রেখে ৩০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের একটি পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর জেলজাহতে পাঠানো হয়। ওসির জিঘাংসার শিকার হয়ে জেলে যেতে হয়েছে প্রবীণ এ শিক্ষাবিদকে। এ ঘটনায় দোহার ও নবাবগঞ্জের বাসিন্দাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দেয়।
কেস স্টাডি ৩ : নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র আবু সায়েম। দোহারের বারাঘাটা এলাকার বাড়ি থেকে গত সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যরাতে আবু সায়েমকে আটক করে পুলিশ। ওই ঘটনার মাত্র চার দিন আগে তার বাবা জুলহাশের মৃত্যু হয়েছিল। সায়েম ও পরিবারের সদস্যরা যখন শোকে মুহ্যমান, ঠিক ওইসময় দোহার থানা পুলিশ তাকে মধ্যরাতে ঘুম থেকে তুলে আটক করে। নির্যাতন করে তার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। পরে সায়েমকে ভাংচুরের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। ওসির রোষানলে পড়ে জেল খাটতে হয়েছে নিরাপরাধ এ সায়েমকে।
কেস স্টাডি ৪ : নাজমুস সাকিব মালিকান্দা মেঘুলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তার পরিবারের অভিযোগ, দোহারের শাইনপুকুর মাদ্রাসার শিক্ষক খলিলুর রহমানের সঙ্গে রিকশায় যাওয়ার সময় রাস্তায় তাদের আটক করে দোহার থানা পুলিশ। থানায় নিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে দুই দফায় রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয় কলেজছাত্র নাজমুস সাকিবকে। তার ভগ্নিপতি থানায় দেখতে গেলে তাকেও আটক করে পুলিশ। দোহার থানার এসআই আবদুল কাদের সাকিবের স্কুলশিক্ষক বাবার কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা দাবি করে। দুই দফায় তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়। তার দরিদ্র বাবা ১০ হাজার টাকা দেয়ার পরও সাকিবকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। সাকিব ও মাদ্রাসাশিক্ষক খলিল এখনও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। সাকিবের আত্মীয়রা জানান, মিথ্যা মামলা দেয়ায় সাকিবের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। জামিন না পাওয়ায় তার এইচএসসি পরীক্ষা দেয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
কেস স্টাডি ৫ : দোহারের প্রোটন কোচিং সেন্টারের মালিক ফরিদ ও তার বন্ধু ছাত্রলীগ কর্মী রবিউলকে আটক করে ৪ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি মাহমুদুল হক। কিছু টাকা আদায় করে রবিউলকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে তাদের আবারও ধরে নিয়ে পেন্ডিং মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়। তারা এখনও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।
এই ঘটনাগুলো দোহার থানা পুলিশের সাম্প্রতিক নির্যাতনের কয়েকটি নমুনা মাত্র। এ ধরনের আরও অসংখ্য অত্যাচার-নির্যাতন ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, এত অত্যাচার নির্যাতনের পরও বহাল তবিয়তে আছেন মাহমুদুল হক। প্রশ্ন উঠেছে তার খুটির জোর কোথায়?
চোখে জল আর মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে যুগান্তর প্রতিবেদকে এসব কথা বলেন, বুয়েটের মেধাবী ছাত্র রুবেল (ছদ্মনাম)। ভুক্তভোগী ব্যক্তির বিশেষ অনুরোধে তার নামটি প্রকাশ করা হল না। তবে তার বাড়ি দোহার উপজেলা উত্তর জয়পাড়া গ্রামে। তিনি জানিয়েছেন, পুলিশকে ঘুষ দেয়া দুই লাখ টাকার মধ্যে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দিয়েছেন নগদ এবং বাকি ২৫ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন ঢাকা থেকে বিকাশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এসআই কাদের নামে। এ সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণ তিনি যুগান্তরকে সরবরাহ করেন। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু বুয়েট থেকে সদ্য পাস করা এই মেধাবী রুবেল নয়, দোহার থানার ওসির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশে বহু মানুষ প্রায় প্রতিদিন এভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তার রোষানলে পড়ে জেল খাটছেন নিরপরাধ এইচএসসি পরীক্ষার্থী কলেজছাত্র নাজমুস সাকিব, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সায়েম, কোচিং সেন্টারের মালিক ফরিদ ও তার বন্ধু রবিউল। আর জেল থেকে সদ্য বেরিয়ে এসেছেন দোহার নবাবগঞ্জ কলেজের প্রবীণ শিক্ষক হাবীব উল্লাহ। ওসির এহেন নিপীড়নে দোহারের সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। যাদের অনেকে পুলিশি হয়রানি হওয়ার ভয়ে এ রকম জঘন্য অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। এদিকে এতসব প্রমাণিত অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহার করার পরও একজন ওসির এভাবে স্বপদে বহাল থাকা নিয়ে দোহারের সচেতন মহলসহ পর্যবেক্ষক মহলের অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেন। বেশ কয়েকজন যুগান্তরকে বলেন, গত কয়েকদিনে দৈনিক যুগান্তরে ওসি মাহমুদুল হকের বিরুদ্ধে তথ্যনির্ভর যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে প্রত্যাহার করা উচিত ছিল। কিন্তু তাকে এখনও বহাল রাখায় এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে, পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ ওপর মহলের সঙ্গে ওসি মাহমুদুল হকের গভীর সখ্যতা রয়েছে। আর এ রকম আশংকা যদি সত্য হয়, তাহলে এই পুলিশ কখনও জনগণের বন্ধু হওয়ার দাবি করতে পারে না। একই সঙ্গে বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের প্রতিও মানুষের আস্থা তলানিতে পৌঁছে যাবে। সরকারি দল আওয়ামী লীগকে যার খেসারত দিতে হবে আগামী নির্বাচনে।
কেস স্টাডি এক : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে পাস করা তরুণ প্রকৌশলী রুবেল। ১৪ বছর ধরে তিনি গ্রামের বাড়িতে থাকেন না। ২৬ সেপ্টেম্বর তার ডাক্তার ছোট বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। দোহার থানার পাশেই তাদের বাড়ি। বিয়ের আসর থেকে রাত ৯টায় ওই প্রকৌশলীকে ধরে নিয়ে আসেন দোহার থানার এসআই আবদুল কাদের ও এসআই মো. সেকান্দার হোসেন। থানায় নিয়ে তাকে নির্যাতন করার হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ৩ লাখ টাকা দাবি করা হয়। বহুজাতিক কোম্পানিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পদে চাকরি হওয়া ওই প্রকৌশলীর ১৫ অক্টোবর কর্মস্থলে যোগ দেয়ার কথা ছিল। জীবনের প্রথম চাকরি হারানোর আশংকায় ও নির্যাতনের ভয়ে ওই রাতে তিনি অনেক কষ্টে এক লাখ টাকা জোগাড় করে এসআই কাদেরের হাতে তুলে দেন। কিন্তু তারপরও রুবেলকে পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে এক দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ডে রেখে নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে আদায় করা হয় আরও এক লাখ টাকা। এরপর চালান করা হয় কোর্টে। এক মাসের বেশি জেল খেটে ২ নভেম্বর জামিনে ছাড়া পান।
ভুক্তভোগী প্রকৌশলী রুবেল যুগান্তরকে জানান, এলাকায় কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা নেই। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ঢাকাতেই লেখাপড়া করেছেন। মাঝে মধ্যে ঈদে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দু-এক দিনের বেশি থাকেননি। স্থানীয় এক দালাল তার ছবি থানায় দিয়ে বলে মালদার পার্টি। ধরলে মোটা অংকের ক্যাশ পাওয়া যাবে। পরে এসআই কাদের ও সিকান্দার বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে তাকে তুলে আনে। ঘুষ দেয়ার প্রমাণ হিসেবে তরুণ ওই প্রকৌশলী জানান, তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী নগদ টাকা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। ফলে ঢাকা থেকে এসআই আবদুল কাদেরের মোবাইল নম্বরে বিকাশ করে সাড়ে ২৫ হাজার টাকা দেন। এর প্রমাণ হিসেবে ২৮ সেপ্টেম্বর তারিখে এসআই আবদুল কাদেরের মোবাইল নম্বর ০১৭১৭০৭৭১০০ এ নম্বরে বিকাশ করে ০১৮৫০৭৭৫০০ নম্বর থেকে ১০ হাজার টাকা ও একই তারিখে ০১৭৫৫৬৫১২৭০ নম্বর থেকে ১৫৫০০ টাকা দেয়া হয়। যার প্রমাণ যুগান্তরের হাতে এসেছে।
তরুণ এ প্রকৌশলী বলেন, শুধু ঘুষ আদায়ের জন্য ডাক্তার বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ধরে এনে তার ওপর এ নিপীড়ন চালানো হয়। তাকে জেলে যেতে হয়েছে। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩৪১, ৪২৭, ৪৩৫, ১৪৭, ১৪৯, ৩৫৩, ৩৩২, ১৬৮ ধারার মতো সংবেদনশীল ও জামিন অযোগ্য ধারায় মামলায় আসামি পর্যন্ত করা হয়েছে। অথচ যে মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে সেখানে উপস্থিত থাকা তো দূরের কথা ওই দিন দোহার থানা এলাকাতেই ছিলেন না। এ ছাড়া থানা ও জেলখানায় তিনি শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাকে সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়েছে। মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি বিদেশও যেতে পারবেন না। প্রতি মাসে হাজিরা দেয়ার বিড়ম্বনা তো আছেই। তার মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজনরা এখনও পুলিশের হয়রানির ভয়ে আতংকে দিন কাটাচ্ছেন।
কেস স্টাডি ২ : দোহার নবাবগঞ্জ কলেজের সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক হাবীব উল্লাহকে নবাবগঞ্জের হাগড়াইল এলাকা থেকে আটক করে নবাবগঞ্জ থানা পুলিশ। দোহার থানার ওসি ফোর্স পাঠিয়ে বলেন, হাবীব উল্লাহ দোহার পৌরসভার চরলটা এলাকায় একটি মামলার আসামি। প্রবীণ এ শিক্ষাবিদকে দোহার থানায় আটকে রেখে ৩০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের একটি পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর জেলজাহতে পাঠানো হয়। ওসির জিঘাংসার শিকার হয়ে জেলে যেতে হয়েছে প্রবীণ এ শিক্ষাবিদকে। এ ঘটনায় দোহার ও নবাবগঞ্জের বাসিন্দাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দেয়।
কেস স্টাডি ৩ : নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র আবু সায়েম। দোহারের বারাঘাটা এলাকার বাড়ি থেকে গত সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যরাতে আবু সায়েমকে আটক করে পুলিশ। ওই ঘটনার মাত্র চার দিন আগে তার বাবা জুলহাশের মৃত্যু হয়েছিল। সায়েম ও পরিবারের সদস্যরা যখন শোকে মুহ্যমান, ঠিক ওইসময় দোহার থানা পুলিশ তাকে মধ্যরাতে ঘুম থেকে তুলে আটক করে। নির্যাতন করে তার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। পরে সায়েমকে ভাংচুরের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। ওসির রোষানলে পড়ে জেল খাটতে হয়েছে নিরাপরাধ এ সায়েমকে।
কেস স্টাডি ৪ : নাজমুস সাকিব মালিকান্দা মেঘুলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তার পরিবারের অভিযোগ, দোহারের শাইনপুকুর মাদ্রাসার শিক্ষক খলিলুর রহমানের সঙ্গে রিকশায় যাওয়ার সময় রাস্তায় তাদের আটক করে দোহার থানা পুলিশ। থানায় নিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে দুই দফায় রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয় কলেজছাত্র নাজমুস সাকিবকে। তার ভগ্নিপতি থানায় দেখতে গেলে তাকেও আটক করে পুলিশ। দোহার থানার এসআই আবদুল কাদের সাকিবের স্কুলশিক্ষক বাবার কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা দাবি করে। দুই দফায় তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়। তার দরিদ্র বাবা ১০ হাজার টাকা দেয়ার পরও সাকিবকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। সাকিব ও মাদ্রাসাশিক্ষক খলিল এখনও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। সাকিবের আত্মীয়রা জানান, মিথ্যা মামলা দেয়ায় সাকিবের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। জামিন না পাওয়ায় তার এইচএসসি পরীক্ষা দেয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
কেস স্টাডি ৫ : দোহারের প্রোটন কোচিং সেন্টারের মালিক ফরিদ ও তার বন্ধু ছাত্রলীগ কর্মী রবিউলকে আটক করে ৪ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি মাহমুদুল হক। কিছু টাকা আদায় করে রবিউলকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে তাদের আবারও ধরে নিয়ে পেন্ডিং মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়। তারা এখনও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।
এই ঘটনাগুলো দোহার থানা পুলিশের সাম্প্রতিক নির্যাতনের কয়েকটি নমুনা মাত্র। এ ধরনের আরও অসংখ্য অত্যাচার-নির্যাতন ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, এত অত্যাচার নির্যাতনের পরও বহাল তবিয়তে আছেন মাহমুদুল হক। প্রশ্ন উঠেছে তার খুটির জোর কোথায়?
No comments