রক্তস্নাত ফিলিস্তিন ও মুসলিম বিশ্ব by ড. মো: ময়নুল হক
ইতিহাসের পাতা উল্টালে যে চিত্র ভেসে ওঠে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলÑ তার পেছনের পাতায় ফিরে যাওয়াটা নিতান্তই সময়ের দাবি। ইসলামের চিরায়ত শত্রু হিসেবে পরিচিত ইহুদিরা ১৭৯২ সালে বিশ্বসম্মেলন করে প্রটোকল গ্রহণ করে যাতে তারা পৃথিবীতে তাদের জাতিসত্তার নামে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা তাদেরই সৃষ্ট। রাসূল সা:-এর যুগে তাদের দাদন ব্যবসায় যা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ গ্রহণ করার মাধ্যমে সমাজকে শোষণ করার হাতিয়ার ছিল, যুগপরিক্রমায় তা সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার প্রচলন করে যা পুঁজিবাদ নামে ইউরোপ-আমেরিকায় রাষ্ট্রীয়ভাবে বাস্তবায়ন ঘটে ফরাসি বিপ্লব ও আমেরিকার স্বাধীনতা লাভের পর। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়ার মাধ্যমে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। ১৯০৪ সালে ইহুদিরা দ্বিতীয় বিশ্বসম্মেলন করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাদের এই পরিকল্পনা ছিল যুদ্ধ বাধিয়ে বিশ্বমানচিত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে কোনো এক বৃহৎ শক্তির সহায়তা নিয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং তারা তাদের স্বপ্নের রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় খেলাফত ধ্বংস করে দেয় পাশ্চাত্ত্য জগৎ তথা খ্রিষ্টানরা, আরব ও তুরানি জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে। ব্রিটিশদের দখলে চলে যায় মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল অংশ, যার মধ্যে ফিলিস্তিন ছিল অন্যতম। ইংরেজরা ইহুদিদের সামনে তিনটি অপসন দিয়েছিলÑ ১. মুজাম্বিক, ২. সাইপ্রাস ও ৩. ফিলিস্তিন। কিন্তু ইহুদিরা শেষেরটিকে বেছে নেয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মূসা আ:-এর জন্মভূমি হিসেবে। ২ নভেম্বর ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য কায়েম করা হয় অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল। কিন্তু জবরদখল করা ভূখণ্ডে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও তার স্থায়িত্ব নিয়ে নিজেরাই ছিল সন্দিহান, ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধানোটা তাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। জার্মানির হিটলার কর্তৃক পোলা আক্রমণের মাধ্যমে শুরু হওয়া যুদ্ধে পাঁচ-ছয় লাখ ইহুদি মারা যায় হিটলারের হাতে। কিন্তু যুদ্ধে হিটলারের পরাজয়ের পর রাশিয়া ও আমেরিকার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে তারা ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করে নেয় ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘ থেকে। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ইহুদিদের এবং জবর দখল করে বসতি স্থাপন করে গিলে ফেলা হয় তিন চতুর্থাংশ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড। ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘকর্তৃক স্বীকৃতি ইসরাইলের পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করে। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে পাশ্চাত্ত্যের সহযোগিতার কারণে ইসরাইলের সীমানা সম্প্রসারিত হয়। অদ্যাবধি ইউরোপ-আমেরিকাসহ গোটা পাশ্চাত্ত্য বিশ্ব নির্লজ্জ বেহায়ার মতো এই অবৈধ রাষ্ট্রের সম্প্রসারণবাদী নীতিকে অর্থ ও সামরিক সাহায্যের মাধ্যমে সহযাগিতা দিয়ে আসছে। ফিলিস্তিনের জনগণ বাপ-দাদার সম্পত্তি ও স্থাপনা হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে জীবনযাপন করছে বিভিন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। আর যারা ইটপাটকেল নিয়ে জায়নবাদী ইহুদিদের মোকাবেলা করার চেষ্টা চালাচ্ছে পাশ্চাত্ত্য তাদেরই বলছে সন্ত্রাসী। একজন অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে মানুষ খুন করছে, বুলডোজার দিয়ে বসতভিটা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, বিমান হামলা করে বাড়িঘর ও জানমালের ক্ষতি করছে সে সন্ত্রাসী নয়, সে হলো নিজের নিরাপত্তা বিধান করছে। আর এ হামলার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে যারা তারা স্বীকৃতি পাচ্ছে জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে। কী বিচিত্র সেলুকাস এ পৃথিবীর মানবাধিকার!
শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পরিবর্তনে ব্যস্ত এখন আমেরিকা। আর সেই সুযোগে ইহুদি অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল তার সীমানাপ্রাচীর বাড়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত। তাদের স্বপ্ন খায়বার ও মদিনাসহ জাজিরাতুল আরবে বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন। গাজায় অব্যাহত সামরিক হামলা তারই প্রমাণ। জোর গুজব রয়েছে খোদ সৌদি রাজতন্ত্র নিজের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মিসরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ইসরাইল নামে বিষবৃক্ষের সাথে গোপন আঁতাত করে সফলকাম হয়েছে। খাল কেটে কুমির এনে এখন আমেরিকার সেবাদাস বনে যাওয়া ছাড়া সৌদি আরবের যে আর কিছুই করার নেই। ফিলিস্তিনের মুসলমানের রক্তের বদলা কে নেবে? দেখেশুনে কবি নজরুলের কবিতার চরণ মনে পড়ছে: ‘যত লাথি গুঁতো খাই বলি দাদারে আমার বড়ই সুখ, মেরে নাও দুটো দিন আসিতেছে ইমাম মেহেদি... ইমাম মেহেদি আসুক আর না আসুক আমরা হয়েছি মেহেদি লাল, শত্রুরা মেরে মোদেরকে করেছে হাঁড়ির হাল।’
ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই ইহুদি জাতি ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছে। অর্থনৈতিকভাবে বলিষ্ঠতা অর্জনের পর তারা এখন বিশ্বের নেতৃত্ব পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। বিশেষভাবে পাশ্চাত্ত্য রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতায় কে থাকবে আর কে থাকবে না সেটা নির্ধারণ করছে ইহুদিরা। এখানেও তারা সেসব লোককে ক্ষমতায় নিয়ে আসছে যারা চরম ইসলামবিদ্বেষী। অর্থলগ্নি ছাড়াও প্রচারণায় সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে তাদের প্রার্থীর বিজয়কে সুনিশ্চিত করছে। শোনা যায়, সম্প্রতি ভারতের ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়েছেন মোদি ইহুদিদের সার্বিক সহযোগিতায়। বিশ্বের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব কিভাবে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগানো যায় সে জন্য তারা যুগে যুগে বিভিন্ন মতবাদের জন্ম দেয়া ও তার বিস্তার ঘটানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। অন্যের ঘাড়ে অস্ত্র রেখে তাদের মূল উদ্দিষ্ট মুসলিম জাতিসত্তার বিনাশ।
১৯৮৫ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে একক সুপার পাওয়ার আমেরিকার। পৃথিবীতে সামরিক ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করে। আমেরিকা নতুন শত্রু আবিষ্কার করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল কিনটন ঘোষণা করেনÑ ‘পৃথিবীতে লালবিপ্লব সফল হতে দেইনি, সবুজবিপ্লবও সফল হতে দেবো না।’ অর্থাৎ ইসলামি বিপ্লব সফল হতে দেবো না। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান ১৯৯৩ সালে বই লেখেন দ্য কাশ অব সিভিলাইজেশন এ রিমেকিং ওয়ার্ল্ড অর্ডার, যাতে আমেরিকার ভবিষ্যৎশত্রু সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করা হয় এই বলেÑ ‘কোনো একসময় ইসলাম ও চৈনিক সভতা একত্র হয়ে পাশ্চাত্যকে থ্রেট করবে।’ সুপার পাওয়ার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়ে বুশ ঘোষণা করেনÑ ‘আমেরিকা যদি মনে করে কোনো দেশ তার দেশ বা জনগণের ক্ষতি করবে বা করতে পারে তাহলে প্রি-মেজারমেন্ট অনুযায়ী ওই দেশে হামলা চালানোর অধিকার রয়েছে আমেরিকার।’ সে থেকে অদ্যাবধি ইসলাম ও মুসলমানকে টার্গেট করে বিশ্বব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে আমেরিকার নেতৃত্বে পাশ্চাত্য বিশ্ব। একই পথে প্রচারণা চালাচ্ছে ইসলাম ধর্ম সন্ত্রাসবাদী ধর্ম এবং মুসলমানেরাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী। পাশ্চাত্যের ইসলামভীতি থেকে উৎসারিত এই প্রচারণায় এখন কায়েমি স্বার্থবাদী মুসলিম শাসক শ্রেণীও আদাজল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। পাশ্চাত্যের শেখানো বুলি এখন তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রধান অবলম্বন। ইসলামভীতি পাশ্চাত্যকেই শুধু নয়, গোটা মুসলিম দুনিয়ার শাসক শ্রেণীকেও ক্ষমতা হারানোর ভীতিতে ফেলেছে। আলজেরিয়ার সালভেশন ফ্রন্ট এবং মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড গণতান্ত্রিকভাবে বিজয় অর্জন করলেও তাদের ক্ষমতায় যেতে দেয়া হয়নি বা ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। আরব বসন্ত বলে পাশ্চাত্ত্যের গণতান্ত্রিক বিশ্ব মুখে খই ফোটালেও যখন ইসলামি শক্তির উত্থান দেখতে পেল, তখন তারা তাদের পুরনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য কখনোই ইসলামের বিজয় সহ্য করতে পারেনি। তাদের কাছে গণতন্ত্র হলো ইসলামশূন্য গণতন্ত্র। বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধর্মকে খাটো ও হেয় করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আমেরিকার নেতৃত্বে পাশ্চাত্য শক্তি ইসলামভীতি ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা দুনিয়ায়; তার পরও ইসলামের প্রসার দিন দিন বেড়েই চলেছে। কারণ এটা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা : ‘তারা ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, আর আল্লাহ তাঁর নূরকে পরিপূর্ণতা দেবেন, কাফেররা যতই অপছন্দ করুক না কেন’ (আল কুরআন)।
মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব অপপ্রচার চলছে তার জবাব দিতে হবে উত্তম পন্থায়। মধ্যপন্থা অবলম্বন করে ইসলামবিরোধী শক্তির সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে যেকোনো চরমপন্থা বোকামি ও মূর্খতার শামিল। কাফের শক্তির পদলেহন না করে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে নিজেদের সম্পদ ও জনগণের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। এর জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে এবং দুশমনের মোকাবেলায় সামরিক শক্তিতে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রয়াস চালাতে হবে। মুসলিম সমাজ একটি দেহের মতো, দেহের কোনো অঙ্গে আঘাত পেলে সারা শরীরে সে ব্যথা অনুভূত হয়। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে অন্যায়ভাবে একজন মুসলমানের রক্ত ঝরলে অন্য প্রান্তের কোনো মুসলমান বিনিদ্র রজনী যাপন করার কথা, ব্যথাতুর হওয়ার কথা; কিন্তু যখন এ চেতনাই অনুপস্থিত তখন আসলে আমাদের ঈমান আছে কি না সেটাই বড় প্রশ্ন।
লেখক : অধ্যাপক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পরিবর্তনে ব্যস্ত এখন আমেরিকা। আর সেই সুযোগে ইহুদি অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল তার সীমানাপ্রাচীর বাড়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত। তাদের স্বপ্ন খায়বার ও মদিনাসহ জাজিরাতুল আরবে বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন। গাজায় অব্যাহত সামরিক হামলা তারই প্রমাণ। জোর গুজব রয়েছে খোদ সৌদি রাজতন্ত্র নিজের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মিসরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ইসরাইল নামে বিষবৃক্ষের সাথে গোপন আঁতাত করে সফলকাম হয়েছে। খাল কেটে কুমির এনে এখন আমেরিকার সেবাদাস বনে যাওয়া ছাড়া সৌদি আরবের যে আর কিছুই করার নেই। ফিলিস্তিনের মুসলমানের রক্তের বদলা কে নেবে? দেখেশুনে কবি নজরুলের কবিতার চরণ মনে পড়ছে: ‘যত লাথি গুঁতো খাই বলি দাদারে আমার বড়ই সুখ, মেরে নাও দুটো দিন আসিতেছে ইমাম মেহেদি... ইমাম মেহেদি আসুক আর না আসুক আমরা হয়েছি মেহেদি লাল, শত্রুরা মেরে মোদেরকে করেছে হাঁড়ির হাল।’
ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই ইহুদি জাতি ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছে। অর্থনৈতিকভাবে বলিষ্ঠতা অর্জনের পর তারা এখন বিশ্বের নেতৃত্ব পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। বিশেষভাবে পাশ্চাত্ত্য রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতায় কে থাকবে আর কে থাকবে না সেটা নির্ধারণ করছে ইহুদিরা। এখানেও তারা সেসব লোককে ক্ষমতায় নিয়ে আসছে যারা চরম ইসলামবিদ্বেষী। অর্থলগ্নি ছাড়াও প্রচারণায় সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে তাদের প্রার্থীর বিজয়কে সুনিশ্চিত করছে। শোনা যায়, সম্প্রতি ভারতের ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়েছেন মোদি ইহুদিদের সার্বিক সহযোগিতায়। বিশ্বের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব কিভাবে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগানো যায় সে জন্য তারা যুগে যুগে বিভিন্ন মতবাদের জন্ম দেয়া ও তার বিস্তার ঘটানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। অন্যের ঘাড়ে অস্ত্র রেখে তাদের মূল উদ্দিষ্ট মুসলিম জাতিসত্তার বিনাশ।
১৯৮৫ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে একক সুপার পাওয়ার আমেরিকার। পৃথিবীতে সামরিক ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করে। আমেরিকা নতুন শত্রু আবিষ্কার করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল কিনটন ঘোষণা করেনÑ ‘পৃথিবীতে লালবিপ্লব সফল হতে দেইনি, সবুজবিপ্লবও সফল হতে দেবো না।’ অর্থাৎ ইসলামি বিপ্লব সফল হতে দেবো না। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান ১৯৯৩ সালে বই লেখেন দ্য কাশ অব সিভিলাইজেশন এ রিমেকিং ওয়ার্ল্ড অর্ডার, যাতে আমেরিকার ভবিষ্যৎশত্রু সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করা হয় এই বলেÑ ‘কোনো একসময় ইসলাম ও চৈনিক সভতা একত্র হয়ে পাশ্চাত্যকে থ্রেট করবে।’ সুপার পাওয়ার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়ে বুশ ঘোষণা করেনÑ ‘আমেরিকা যদি মনে করে কোনো দেশ তার দেশ বা জনগণের ক্ষতি করবে বা করতে পারে তাহলে প্রি-মেজারমেন্ট অনুযায়ী ওই দেশে হামলা চালানোর অধিকার রয়েছে আমেরিকার।’ সে থেকে অদ্যাবধি ইসলাম ও মুসলমানকে টার্গেট করে বিশ্বব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে আমেরিকার নেতৃত্বে পাশ্চাত্য বিশ্ব। একই পথে প্রচারণা চালাচ্ছে ইসলাম ধর্ম সন্ত্রাসবাদী ধর্ম এবং মুসলমানেরাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী। পাশ্চাত্যের ইসলামভীতি থেকে উৎসারিত এই প্রচারণায় এখন কায়েমি স্বার্থবাদী মুসলিম শাসক শ্রেণীও আদাজল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। পাশ্চাত্যের শেখানো বুলি এখন তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রধান অবলম্বন। ইসলামভীতি পাশ্চাত্যকেই শুধু নয়, গোটা মুসলিম দুনিয়ার শাসক শ্রেণীকেও ক্ষমতা হারানোর ভীতিতে ফেলেছে। আলজেরিয়ার সালভেশন ফ্রন্ট এবং মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড গণতান্ত্রিকভাবে বিজয় অর্জন করলেও তাদের ক্ষমতায় যেতে দেয়া হয়নি বা ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। আরব বসন্ত বলে পাশ্চাত্ত্যের গণতান্ত্রিক বিশ্ব মুখে খই ফোটালেও যখন ইসলামি শক্তির উত্থান দেখতে পেল, তখন তারা তাদের পুরনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য কখনোই ইসলামের বিজয় সহ্য করতে পারেনি। তাদের কাছে গণতন্ত্র হলো ইসলামশূন্য গণতন্ত্র। বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধর্মকে খাটো ও হেয় করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আমেরিকার নেতৃত্বে পাশ্চাত্য শক্তি ইসলামভীতি ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা দুনিয়ায়; তার পরও ইসলামের প্রসার দিন দিন বেড়েই চলেছে। কারণ এটা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা : ‘তারা ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, আর আল্লাহ তাঁর নূরকে পরিপূর্ণতা দেবেন, কাফেররা যতই অপছন্দ করুক না কেন’ (আল কুরআন)।
মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব অপপ্রচার চলছে তার জবাব দিতে হবে উত্তম পন্থায়। মধ্যপন্থা অবলম্বন করে ইসলামবিরোধী শক্তির সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে যেকোনো চরমপন্থা বোকামি ও মূর্খতার শামিল। কাফের শক্তির পদলেহন না করে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে নিজেদের সম্পদ ও জনগণের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। এর জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে এবং দুশমনের মোকাবেলায় সামরিক শক্তিতে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রয়াস চালাতে হবে। মুসলিম সমাজ একটি দেহের মতো, দেহের কোনো অঙ্গে আঘাত পেলে সারা শরীরে সে ব্যথা অনুভূত হয়। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে অন্যায়ভাবে একজন মুসলমানের রক্ত ঝরলে অন্য প্রান্তের কোনো মুসলমান বিনিদ্র রজনী যাপন করার কথা, ব্যথাতুর হওয়ার কথা; কিন্তু যখন এ চেতনাই অনুপস্থিত তখন আসলে আমাদের ঈমান আছে কি না সেটাই বড় প্রশ্ন।
লেখক : অধ্যাপক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
No comments