জীবনানন্দের কাব্যদর্শন by রাজীব সরকার
জীবদ্দশায়
সমালোচকদের আঘাতে বারবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। সেদিন কি তিনি
জানতেন মৃত্যুর পর আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান কাণ্ডারি হয়ে উঠবেন নিজেই?
‘অবগুণ্ঠিত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, ‘নির্জনতার কবি’ জীবনানন্দকে দেখে অনুমান
করা কঠিন আধুনিক বাংলা কবিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচনের পাশাপাশি গভীর নিষ্ঠার
সঙ্গে তিনি ভেবেছেন কবিতা সম্পর্কে, কবিতার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। কবিসুলভ
ভাবালুতা দিয়ে নয়, পরতে পরতে যুক্তির পসরা সাজিয়ে তিনি দাঁড় করিয়েছেন নিজের
কবিতা দর্শন। এভাবেই নির্মিত হয়ে যায় সমালোচক জীবনানন্দের জীবনবীক্ষা।
সমালোচকদের প্রতি জীবনানন্দের ক্ষোভ কখনোই প্রশমিত হয়নি, ক্ষোভের মাত্রার তারতম্য ঘটেছে মাত্র। ‘সমারূঢ়’ কবিতায় সমালোচকের উদ্দেশে বলেছেন- বরং নিজেই তুমি লেখ নাকো একটি কবিতা। যিনি কবি নন, তিনি কাব্য সমালোচনার জন্য কতটুকু যোগ্য সে সন্দেহ জীবনানন্দ সবসময় পোষণ করেছেন। ‘কবিতার আলোচনা’ প্রবন্ধে বলেছেন-
‘...কবিতার স্পষ্ট, কুশল, যথাসম্ভব নির্ভয়ে চিন্তনীয় আলোচনা সেই যুগের কবিদেরই করা উচিত। যাদের মন কবিতা সৃষ্টির জন্যে তৈরি নয়, কাব্য আলোচনায় তারা পরিচ্ছন্নতা, পাণ্ডিত্য, ভালো অন্তঃপ্রবেশ দেখাতে পারলেও কবিতা সম্বন্ধে তাদের বোধ, আমার ভয় হচ্ছে, শেষ গভীরতা লাভ করতে গিয়ে প্রায়ই ব্যর্থ হয়, বিশৃংখল হয়ে পড়ে।’
সমসাময়িক কাব্য সমালোচকদের তিনি এই বলে অভিযুক্ত করেছেন যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা অসৎ সমালোচনা করেছেন। বড় কবিরা অসৎ সমালোচনা অগ্রাহ্য করে প্রায়ই বিপদ উত্তীর্ণ হতে পারেন। কিন্তু অন্য কবিদের সে পথ জানা নেই। কবিতার সমালোচনা শুধু ভুল ও খারাপ হলে বড় কবিদের কবিতাও নষ্ট হয়ে যেতে পারে কিংবা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে যেন কবিতার সুধী ও বিবেকি পাঠককেও ফাঁপড়ে পড়তে হয়। ফলে কবি নিরাপত্তাহীনতার শিকার হন। এর অবসান ঘটাতে হবে কবিকেই। জীবনানন্দ অনুভব করেছেন শুধু ভালো কবিতা লেখাই যথেষ্ট নয় কবির পক্ষে। গভীরতাস্পর্শী ও যুক্তি আলোকিত মননের অধিকারী হওয়াও জরুরি। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন বড় কবিরাই ধারাবাহিকভাবে সেখানে সমালোচনা করেছেন। ড্রাইডেন, জনসন, কোলরিজ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটস, শেলী, আর্নল্ড, ইয়েটস, পাউন্ড, এলিয়ট- প্রত্যেকে কবিতা লেখার পাশাপাশি সমালোচনা লিখেছেন। তাই স্বয়ং জীবনানন্দও কাব্য সমালোচনা করেছেন। কবিদের কাব্য সমালোচনা যে প্রকৃত অর্থেই কবিতাবান্ধব ও শ্রেষ্ঠতর তার প্রমাণ জীবনানন্দের কালের বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত থেকে শুরু করে একালের আবদুল মান্নান সৈয়দ পর্যন্ত প্রসারিত। জীবনানন্দের বিশ্বাস সবাই সমালোচক নয়, কেউ কেউ সমালোচক।
‘কলাকৈবল্যবাদ’ দর্শনকে বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় করার নেপথ্যে তিরিশের পাঁচ আধুনিক কবির ভূমিকা সর্বজনবিদিত। তাদের মধ্যে জীবনানন্দ সবশেষে বেশি বিশিষ্ট। ‘কেন লিখি’ প্রবন্ধে জীবনানন্দের কাব্যদর্শনের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়-
‘কারো নির্দেশ পালন করবার রীতি নেই কবিমানসের ভিতর, কিম্বা তার সৃষ্ট কবিতায়। অথচ সৎ কবিতা খোলাখুলিভাবে নয়, কিন্তু নিজের স্বচ্ছন্দ সমগ্রতার উৎকর্ষে শোষিত মানবজীবনের কবিতা, সেই জীবনের বিপ্লবের ও তৎপরবর্তী শ্রেষ্ঠতর সময়ের কবিতা। মহৎ কবির ভাবনা সূক্ষ্ম, হৃদয় আন্তরিক (আশা করা যেতে পারে), অভিজ্ঞতা সজাগ, ও চেতনা অবচেতনা ঐকান্তিকভাবে সক্রিয় থাকার দরুণ ব্যবহারিক পৃথিবীতে এরকম মানুষের কাছ থেকে জীবনের উন্নতশীল ভাঙাগড়ার কাজে শুভ ও সার্থক আত্মনিয়োগ দাবি করা যেতে পারে। কিন্তু প্রায়ই দেয়া যায় কবিতা ও শিল্পসৃষ্টির ভিতরেই তিনি ঢের বেশি স্বাভাবিক ও বরণীয়- এমন কি অধিকতর মহৎ; বাস্তব কার্যক্ষেত্রে তেমন নন।’
এ উদ্ধৃতি থেকে জীবনানন্দকে জীবনবিমুখ মনে করার কোনো কারণ নেই। তিনি মানেন যে কবিতা জীবনের নানা রকম সমস্যার উদ্ঘাটন। তবে সেই উদ্ঘাটন দার্শনিকের মতো নয়, কবির সৃষ্টিশীল উদ্ঘাটন যা আবির্ভূত হবে সৌন্দর্যের অবয়বে, কল্পনাকে তৃপ্ত করবে। কবিতার পাঠক জীবনানন্দের কালেও বেশি ছিল না, এখনো নেই। এজন্য আক্ষেপ করার কিছু নেই। ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’-এমন অমোঘ উচ্চারণ যিনি করেছিলেন তার মুখ
-২-
থেকেই ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধে আমরা শুনতে পাই যে কবিতা সবার জন্য নয়। যে পর্যন্ত জনচিত্ত নতুন দিগবলয় অধিকার না করবে সে পর্যন্ত কয়েকটি তৃতীয় শ্রেণীর ‘কবি’র মূল উদ্বোধন থাকবে বাজারে ও বন্দরে মানব-সমাজ ও সভ্যতার সমগ্রতার ভেতর কোনো প্রথম শ্রেণীর কাব্যের প্রবেশের পথ থাকবে না। দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান থেকে কবিতা এখানেই পৃথক। কবিতার কাছে কাব্যরস ছাড়া অতিরিক্ত কিছুই আমরা দাবি করতে পারি না। যদি এমন হয় যে কবিতা যা দিতে পারে, দর্শনও তা দিতে পারে, ধর্মও তা দিতে পারে, সমাজ সংস্কারক মনীষী এমনকি কর্মীরাও তা দিতে পারে তবে কবিতার স্বকীয় সিদ্ধির আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। একই প্রবন্ধে জীবনানন্দের ভাষ্য-
‘অন্য সমস্ত প্রতিভার মতো কবি প্রতিভার কাছেও শ্রেষ্ঠ জিনিস পেতে হলে যেখানে তার প্রতিভার স্বকীয় বিকাশ হবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা সেই শিল্পের রাজ্যে তাকে খুঁজতে হবে; সেখানে দর্শন নেই, রাজনীতি নেই, সমাজনীতি নেই, ধর্মও নেই- কিংবা এই সবই রয়েছে কিন্তু তবুও এ সমস্ত জিনিস যেন এ সমস্ত জিনিস নয় আর; এ সমস্ত জিনিসের সম্পূর্ণ সারবত্তা ও ব্যবহারিক প্রচার অন্যান্য মনীষী ও কর্মীদের হাতে যেন কবির হাতে নয়।’
‘আধুনিক বাংলা কবিতা’র অন্যতম সম্পাদক আবু সয়ীদ আইয়ুব ভূমিকায় বলেছিলেন, ‘কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ পরবর্তী, এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত, অন্তত মুক্তিপ্রয়াসী, কাব্যকেই আমরা আধুনিক কাব্য বলে গণ্য করেছি।’ রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে মুক্তিপ্রয়াসী আধুনিক কবিদের প্রায় প্রত্যেকেই ক্ষয়িষ্ণুতা ও অবক্ষয়কে কাব্যের মূল সুর বলে চিহ্নিত করেছেন। চেতনে-অবচেতনে রবীন্দ্রবলয়কে অতিক্রম করাই সেদিন আধুনিকতার প্রধান শর্ত বলে বিবেচিত হয়েছিল। জীবনানন্দ তার সহচর আধুনিক কবিদের থেকে ভিন্ন দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথকে অবলোকন করেছেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে দু-একজন কবির কয়েকটি কবিতা ছাড়া আধুনিক বাংলা কবিতায় ভঙ্গুরতার ছাপ এমন স্পষ্ট যে মুহূর্তের জন্য রবীন্দ্রনাথের যে কোনো কবিতা বা গানের সংস্পর্শে এলে মনে হয় তার সঙ্গে আধুনিকদের আদর্শিক বৈসাদৃশ্য কত কাক্সিক্ষত ও চমৎকার। একজন প্রকৃত আধুনিক কবি বলেই জীবনানন্দ কখনও বিস্মৃত হননি যে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই ঘটেছে। রবীন্দ্রভাবমুক্ত ও স্বতন্ত্র কবিকণ্ঠের অধিকারী জীবনানন্দ অসংকোচে স্বীকার করেছেন-
‘রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সাহায্য ও ইঙ্গিত পেয়ে আজ যে আধুনিক কাব্যের ঈষৎ সূত্রপাত হয়েছে তার পরিণাম-বাংলা সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথের ভিত্তি ভেঙে ফেলে কোনো সম্পূর্ণ অভিনব জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে, সাহিত্যের ইতিহাস এ রকম অজ্ঞাতকুলশীল জিনিস নয়। ইংরেজ কবিরা যেমন যুগে যুগে ফিরে ফিরে সেক্সপীয়র-এর কেন্দ্রিকতার থেকে সঞ্চারিত হয়ে বৃত্ত রচনা করে ব্যাপ্ত হয়ে চলেছে, আমাদের কবিরাও রবীন্দ্রনাথকে পরিক্রমা করে তাই করবে- এই ধারণা প্রত্যেক যুগসন্ধির মুখে নিতান্তই বিচারসাপেক্ষ বলে বোধ হলেও অনেককাল পর্যন্ত অমূলক বা অসঙ্গত বলে প্রমাণিত হবে না- এ আমার মনে হয়।’
সমকালীন আধুনিক কবিদের মাত্রাতিরিক্ত পাশ্চাত্য মোহ জীবনানন্দকে পীড়িত করেছে। পাশ্চাত্যের কবি এলিয়ট, মালার্মের বিপুল প্রভাব দেখা যায় সমসাময়িক আধুনিক কবিদের মানসিক গড়নে। বোদলেয়ারও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন কোনো কোনো কবির। এ স্রোতে গা ভাসাননি জীবনানন্দ। পাশ্চাত্য কাব্যচিন্তার সঙ্গে সমকালীন বাংলা কবিতার সৃষ্টি প্রক্রিয়া ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে নিজের কাব্যাদর্শ নির্মাণ করেছেন তিনি। ‘শব্দই কবিতা’ মালার্মের এ বহুলপ্রচারিত উক্তি নিয়ে যখন তরুণ কবিদের বৃহদাংশ চায়ের কাপে ঝড় তুলেছে, তখন জীবনানন্দ বলেছেন, ‘উপমাই কবিত্ব।’ শুধু বলেননি, তার কবিতায় এর সার্থক প্রয়োগও ঘটিয়েছেন।
সবাই কেন কবি নয় এর জবাব জীবনানন্দের চেয়ে হৃদয়গ্রাহী করে কেউ দিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। কবিদের হৃদয়বৃত্তি সম্পর্কে তিনি বলেছেন-
‘তাদের হৃদয়ে কল্পনা এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য-বিকীরণ তাদের সাহায্য করছে। সাহায্য করছে; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।’
‘নানারকম চরাচর’ জীবনানন্দের প্রতিভাকে বৈচিত্র্যময় পরিসর দিয়েছে। তিনি সচেতন কবিতা রচনার পশ্চাতে ক্রিয়াশীল অন্তঃপ্রেরণা সম্পর্কেও। অন্তঃপ্রেরণা তার কাছে কল্পনাশক্তি ও অনুশীলনের সমন্বয়। এ সমন্বয়ের চূড়া স্পর্শ করতে পেরেছিলেন বলেই জীবনানন্দ তার কালকে অতিক্রম করতে পেরেছেন। হয়ে উঠেছেন উত্তররৈবিক
-৩-
যুগের প্রধান কবি। যদিও জীবদ্দশায় জীবনানন্দের তেমন খ্যাতি ও প্রতিপত্তি জোটেনি, তবুও তিনি হাল ছেড়ে দেননি। কাব্যলক্ষ্মীকে বিসর্জন দিয়ে স্বধর্মচ্যুত হননি। অন্য কোনো সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেননি। তিনি জানেন-
‘প্রত্যেক মনীষীরই একটি বিশেষ প্রতিভা থাকে নিজের রাজ্যেই সে সিদ্ধ। কবির সিদ্ধি ও তার নিজের জগতে; কাব্যসৃষ্টির ভিতরে। ...প্রতিভা যাকে কবি বানিয়েছে কিংবা সঙ্গীত বা চিত্রশিল্পী বানিয়েছে- বুদ্ধির সমীচীনতা নয়, শিল্পের দেশেই সে সিদ্ধ শুধু অন্য কোথাও নয়। একজন প্রতিভাযুক্ত মানুষের কাছ থেকে আমরা যদি তার শ্রেষ্ঠ দান চাই, কোনো দ্বিতীয় স্তরের দান নয়, তাহলে তা পেতে পারি সেই রাজ্যের পরিধির ভিতরেই শুধু যেখানে তার প্রতিভার প্রণালী ও বিকাশ তর্কাতীত।’
জীবনানন্দ নিজের প্রতিভা ও প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রটিকে নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি শুধুই কবি এবং কবি ছাড়া আর কিছুই নন। নিজের কাব্যভাবনা ও কাব্যচর্চা উভয় ক্ষেত্রে এ সত্যের দ্বিধাহীন উদ্বোধন ঘটেছে।
সমালোচকদের প্রতি জীবনানন্দের ক্ষোভ কখনোই প্রশমিত হয়নি, ক্ষোভের মাত্রার তারতম্য ঘটেছে মাত্র। ‘সমারূঢ়’ কবিতায় সমালোচকের উদ্দেশে বলেছেন- বরং নিজেই তুমি লেখ নাকো একটি কবিতা। যিনি কবি নন, তিনি কাব্য সমালোচনার জন্য কতটুকু যোগ্য সে সন্দেহ জীবনানন্দ সবসময় পোষণ করেছেন। ‘কবিতার আলোচনা’ প্রবন্ধে বলেছেন-
‘...কবিতার স্পষ্ট, কুশল, যথাসম্ভব নির্ভয়ে চিন্তনীয় আলোচনা সেই যুগের কবিদেরই করা উচিত। যাদের মন কবিতা সৃষ্টির জন্যে তৈরি নয়, কাব্য আলোচনায় তারা পরিচ্ছন্নতা, পাণ্ডিত্য, ভালো অন্তঃপ্রবেশ দেখাতে পারলেও কবিতা সম্বন্ধে তাদের বোধ, আমার ভয় হচ্ছে, শেষ গভীরতা লাভ করতে গিয়ে প্রায়ই ব্যর্থ হয়, বিশৃংখল হয়ে পড়ে।’
সমসাময়িক কাব্য সমালোচকদের তিনি এই বলে অভিযুক্ত করেছেন যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা অসৎ সমালোচনা করেছেন। বড় কবিরা অসৎ সমালোচনা অগ্রাহ্য করে প্রায়ই বিপদ উত্তীর্ণ হতে পারেন। কিন্তু অন্য কবিদের সে পথ জানা নেই। কবিতার সমালোচনা শুধু ভুল ও খারাপ হলে বড় কবিদের কবিতাও নষ্ট হয়ে যেতে পারে কিংবা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে যেন কবিতার সুধী ও বিবেকি পাঠককেও ফাঁপড়ে পড়তে হয়। ফলে কবি নিরাপত্তাহীনতার শিকার হন। এর অবসান ঘটাতে হবে কবিকেই। জীবনানন্দ অনুভব করেছেন শুধু ভালো কবিতা লেখাই যথেষ্ট নয় কবির পক্ষে। গভীরতাস্পর্শী ও যুক্তি আলোকিত মননের অধিকারী হওয়াও জরুরি। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন বড় কবিরাই ধারাবাহিকভাবে সেখানে সমালোচনা করেছেন। ড্রাইডেন, জনসন, কোলরিজ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটস, শেলী, আর্নল্ড, ইয়েটস, পাউন্ড, এলিয়ট- প্রত্যেকে কবিতা লেখার পাশাপাশি সমালোচনা লিখেছেন। তাই স্বয়ং জীবনানন্দও কাব্য সমালোচনা করেছেন। কবিদের কাব্য সমালোচনা যে প্রকৃত অর্থেই কবিতাবান্ধব ও শ্রেষ্ঠতর তার প্রমাণ জীবনানন্দের কালের বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত থেকে শুরু করে একালের আবদুল মান্নান সৈয়দ পর্যন্ত প্রসারিত। জীবনানন্দের বিশ্বাস সবাই সমালোচক নয়, কেউ কেউ সমালোচক।
‘কলাকৈবল্যবাদ’ দর্শনকে বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় করার নেপথ্যে তিরিশের পাঁচ আধুনিক কবির ভূমিকা সর্বজনবিদিত। তাদের মধ্যে জীবনানন্দ সবশেষে বেশি বিশিষ্ট। ‘কেন লিখি’ প্রবন্ধে জীবনানন্দের কাব্যদর্শনের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়-
‘কারো নির্দেশ পালন করবার রীতি নেই কবিমানসের ভিতর, কিম্বা তার সৃষ্ট কবিতায়। অথচ সৎ কবিতা খোলাখুলিভাবে নয়, কিন্তু নিজের স্বচ্ছন্দ সমগ্রতার উৎকর্ষে শোষিত মানবজীবনের কবিতা, সেই জীবনের বিপ্লবের ও তৎপরবর্তী শ্রেষ্ঠতর সময়ের কবিতা। মহৎ কবির ভাবনা সূক্ষ্ম, হৃদয় আন্তরিক (আশা করা যেতে পারে), অভিজ্ঞতা সজাগ, ও চেতনা অবচেতনা ঐকান্তিকভাবে সক্রিয় থাকার দরুণ ব্যবহারিক পৃথিবীতে এরকম মানুষের কাছ থেকে জীবনের উন্নতশীল ভাঙাগড়ার কাজে শুভ ও সার্থক আত্মনিয়োগ দাবি করা যেতে পারে। কিন্তু প্রায়ই দেয়া যায় কবিতা ও শিল্পসৃষ্টির ভিতরেই তিনি ঢের বেশি স্বাভাবিক ও বরণীয়- এমন কি অধিকতর মহৎ; বাস্তব কার্যক্ষেত্রে তেমন নন।’
এ উদ্ধৃতি থেকে জীবনানন্দকে জীবনবিমুখ মনে করার কোনো কারণ নেই। তিনি মানেন যে কবিতা জীবনের নানা রকম সমস্যার উদ্ঘাটন। তবে সেই উদ্ঘাটন দার্শনিকের মতো নয়, কবির সৃষ্টিশীল উদ্ঘাটন যা আবির্ভূত হবে সৌন্দর্যের অবয়বে, কল্পনাকে তৃপ্ত করবে। কবিতার পাঠক জীবনানন্দের কালেও বেশি ছিল না, এখনো নেই। এজন্য আক্ষেপ করার কিছু নেই। ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’-এমন অমোঘ উচ্চারণ যিনি করেছিলেন তার মুখ
-২-
থেকেই ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধে আমরা শুনতে পাই যে কবিতা সবার জন্য নয়। যে পর্যন্ত জনচিত্ত নতুন দিগবলয় অধিকার না করবে সে পর্যন্ত কয়েকটি তৃতীয় শ্রেণীর ‘কবি’র মূল উদ্বোধন থাকবে বাজারে ও বন্দরে মানব-সমাজ ও সভ্যতার সমগ্রতার ভেতর কোনো প্রথম শ্রেণীর কাব্যের প্রবেশের পথ থাকবে না। দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান থেকে কবিতা এখানেই পৃথক। কবিতার কাছে কাব্যরস ছাড়া অতিরিক্ত কিছুই আমরা দাবি করতে পারি না। যদি এমন হয় যে কবিতা যা দিতে পারে, দর্শনও তা দিতে পারে, ধর্মও তা দিতে পারে, সমাজ সংস্কারক মনীষী এমনকি কর্মীরাও তা দিতে পারে তবে কবিতার স্বকীয় সিদ্ধির আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। একই প্রবন্ধে জীবনানন্দের ভাষ্য-
‘অন্য সমস্ত প্রতিভার মতো কবি প্রতিভার কাছেও শ্রেষ্ঠ জিনিস পেতে হলে যেখানে তার প্রতিভার স্বকীয় বিকাশ হবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা সেই শিল্পের রাজ্যে তাকে খুঁজতে হবে; সেখানে দর্শন নেই, রাজনীতি নেই, সমাজনীতি নেই, ধর্মও নেই- কিংবা এই সবই রয়েছে কিন্তু তবুও এ সমস্ত জিনিস যেন এ সমস্ত জিনিস নয় আর; এ সমস্ত জিনিসের সম্পূর্ণ সারবত্তা ও ব্যবহারিক প্রচার অন্যান্য মনীষী ও কর্মীদের হাতে যেন কবির হাতে নয়।’
‘আধুনিক বাংলা কবিতা’র অন্যতম সম্পাদক আবু সয়ীদ আইয়ুব ভূমিকায় বলেছিলেন, ‘কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ পরবর্তী, এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত, অন্তত মুক্তিপ্রয়াসী, কাব্যকেই আমরা আধুনিক কাব্য বলে গণ্য করেছি।’ রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে মুক্তিপ্রয়াসী আধুনিক কবিদের প্রায় প্রত্যেকেই ক্ষয়িষ্ণুতা ও অবক্ষয়কে কাব্যের মূল সুর বলে চিহ্নিত করেছেন। চেতনে-অবচেতনে রবীন্দ্রবলয়কে অতিক্রম করাই সেদিন আধুনিকতার প্রধান শর্ত বলে বিবেচিত হয়েছিল। জীবনানন্দ তার সহচর আধুনিক কবিদের থেকে ভিন্ন দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথকে অবলোকন করেছেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে দু-একজন কবির কয়েকটি কবিতা ছাড়া আধুনিক বাংলা কবিতায় ভঙ্গুরতার ছাপ এমন স্পষ্ট যে মুহূর্তের জন্য রবীন্দ্রনাথের যে কোনো কবিতা বা গানের সংস্পর্শে এলে মনে হয় তার সঙ্গে আধুনিকদের আদর্শিক বৈসাদৃশ্য কত কাক্সিক্ষত ও চমৎকার। একজন প্রকৃত আধুনিক কবি বলেই জীবনানন্দ কখনও বিস্মৃত হননি যে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই ঘটেছে। রবীন্দ্রভাবমুক্ত ও স্বতন্ত্র কবিকণ্ঠের অধিকারী জীবনানন্দ অসংকোচে স্বীকার করেছেন-
‘রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সাহায্য ও ইঙ্গিত পেয়ে আজ যে আধুনিক কাব্যের ঈষৎ সূত্রপাত হয়েছে তার পরিণাম-বাংলা সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথের ভিত্তি ভেঙে ফেলে কোনো সম্পূর্ণ অভিনব জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে, সাহিত্যের ইতিহাস এ রকম অজ্ঞাতকুলশীল জিনিস নয়। ইংরেজ কবিরা যেমন যুগে যুগে ফিরে ফিরে সেক্সপীয়র-এর কেন্দ্রিকতার থেকে সঞ্চারিত হয়ে বৃত্ত রচনা করে ব্যাপ্ত হয়ে চলেছে, আমাদের কবিরাও রবীন্দ্রনাথকে পরিক্রমা করে তাই করবে- এই ধারণা প্রত্যেক যুগসন্ধির মুখে নিতান্তই বিচারসাপেক্ষ বলে বোধ হলেও অনেককাল পর্যন্ত অমূলক বা অসঙ্গত বলে প্রমাণিত হবে না- এ আমার মনে হয়।’
সমকালীন আধুনিক কবিদের মাত্রাতিরিক্ত পাশ্চাত্য মোহ জীবনানন্দকে পীড়িত করেছে। পাশ্চাত্যের কবি এলিয়ট, মালার্মের বিপুল প্রভাব দেখা যায় সমসাময়িক আধুনিক কবিদের মানসিক গড়নে। বোদলেয়ারও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন কোনো কোনো কবির। এ স্রোতে গা ভাসাননি জীবনানন্দ। পাশ্চাত্য কাব্যচিন্তার সঙ্গে সমকালীন বাংলা কবিতার সৃষ্টি প্রক্রিয়া ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে নিজের কাব্যাদর্শ নির্মাণ করেছেন তিনি। ‘শব্দই কবিতা’ মালার্মের এ বহুলপ্রচারিত উক্তি নিয়ে যখন তরুণ কবিদের বৃহদাংশ চায়ের কাপে ঝড় তুলেছে, তখন জীবনানন্দ বলেছেন, ‘উপমাই কবিত্ব।’ শুধু বলেননি, তার কবিতায় এর সার্থক প্রয়োগও ঘটিয়েছেন।
সবাই কেন কবি নয় এর জবাব জীবনানন্দের চেয়ে হৃদয়গ্রাহী করে কেউ দিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। কবিদের হৃদয়বৃত্তি সম্পর্কে তিনি বলেছেন-
‘তাদের হৃদয়ে কল্পনা এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য-বিকীরণ তাদের সাহায্য করছে। সাহায্য করছে; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।’
‘নানারকম চরাচর’ জীবনানন্দের প্রতিভাকে বৈচিত্র্যময় পরিসর দিয়েছে। তিনি সচেতন কবিতা রচনার পশ্চাতে ক্রিয়াশীল অন্তঃপ্রেরণা সম্পর্কেও। অন্তঃপ্রেরণা তার কাছে কল্পনাশক্তি ও অনুশীলনের সমন্বয়। এ সমন্বয়ের চূড়া স্পর্শ করতে পেরেছিলেন বলেই জীবনানন্দ তার কালকে অতিক্রম করতে পেরেছেন। হয়ে উঠেছেন উত্তররৈবিক
-৩-
যুগের প্রধান কবি। যদিও জীবদ্দশায় জীবনানন্দের তেমন খ্যাতি ও প্রতিপত্তি জোটেনি, তবুও তিনি হাল ছেড়ে দেননি। কাব্যলক্ষ্মীকে বিসর্জন দিয়ে স্বধর্মচ্যুত হননি। অন্য কোনো সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেননি। তিনি জানেন-
‘প্রত্যেক মনীষীরই একটি বিশেষ প্রতিভা থাকে নিজের রাজ্যেই সে সিদ্ধ। কবির সিদ্ধি ও তার নিজের জগতে; কাব্যসৃষ্টির ভিতরে। ...প্রতিভা যাকে কবি বানিয়েছে কিংবা সঙ্গীত বা চিত্রশিল্পী বানিয়েছে- বুদ্ধির সমীচীনতা নয়, শিল্পের দেশেই সে সিদ্ধ শুধু অন্য কোথাও নয়। একজন প্রতিভাযুক্ত মানুষের কাছ থেকে আমরা যদি তার শ্রেষ্ঠ দান চাই, কোনো দ্বিতীয় স্তরের দান নয়, তাহলে তা পেতে পারি সেই রাজ্যের পরিধির ভিতরেই শুধু যেখানে তার প্রতিভার প্রণালী ও বিকাশ তর্কাতীত।’
জীবনানন্দ নিজের প্রতিভা ও প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রটিকে নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি শুধুই কবি এবং কবি ছাড়া আর কিছুই নন। নিজের কাব্যভাবনা ও কাব্যচর্চা উভয় ক্ষেত্রে এ সত্যের দ্বিধাহীন উদ্বোধন ঘটেছে।
No comments